পথিকৃৎ: নির্মলকুমার সেন (১৮৯৭-১৯৮৩)
পরাধীন ভারতে হুগলিতে নিযুক্ত কালেক্টর উইলিয়াম হার্শ্চেল জানতেন যে, এক জন মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্ট তাঁর জীবদ্দশায় কখনও পরিবর্তিত হয় না। উইলিয়াম ওপরতলায় আবেদন করলেন, সরকারি কাজেকর্মে যাতে ফিঙ্গারপ্রিন্টের প্রয়োগ করা হয়। জালিয়াতি রুখতে এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরলেন তিনি। হেসে উড়িয়ে দিলেন ওপরতলার কর্তারা। কিন্তু এডওয়ার্ড রিচার্ড বেঙ্গল পুলিশের ইন্সপেক্টর হয়ে এসে এই বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে থাম্ব-ইমপ্রেশনের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। সেটা ১৮৯৭ সাল, অর্থাৎ যে বছর নির্মলকুমার সেন জন্মগ্রহণ করলেন। ইনিই পরবর্তী কালে হয়ে উঠবেন ভারতের ফরেন্সিক সায়েন্সের পথিকৃৎ। ১৮৯৭ সালের জুলাই মাসে বিশ্বের প্রথম ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতায়। আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে রাখা হল সন্দেহভাজন বা চিহ্নিত অপরাধীদের। বিপ্লবীদের চিঠি বা অন্যান্য নথির সূত্র উদ্ধার কিংবা গোপন, সাঙ্কেতিক বিষয় জানার জন্যও পদ তৈরি হল। এর আগে ১৮৯২ সালে কলকাতায় ফরাসি গবেষক বার্টিলনের আবিষ্কৃত অ্যানথ্রোপমেট্রিক সিস্টেম প্রচলনের উদ্যোগ দেখা যায়। বার্টিলন-সিস্টেম অপরাধীদের শরীর সম্পর্কিত তথ্য ধরে রাখার একটি বিজ্ঞানভিত্তিক কৌশল। এর দ্বারা অপরাধীদের পরবর্তী ক্ষেত্রে চিহ্নিত করা সহজ হয় বা শনাক্ত করতে সুবিধে হয়।
১৯১৫ সালে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের অধীনে তৈরি হল ফুট-প্রিন্ট বিশ্লেষণের প্রচেষ্টা, খোলা হল একটি শাখা। অপরাধীদের চিহ্নিতকরণের জন্য এই পদ্ধতিও ব্যবহার করা হবে ঠিক হল।
ফরেন্সিক বিজ্ঞান সেই শাখা, যেখানে অপরাধ-সম্বন্ধীয় অনুসন্ধান, প্রমাণ, সাক্ষ্য, ব্যাখ্যা, জিজ্ঞাসা ও আইনানুগ বিষয় যুক্ত থাকে। সারা পৃথিবীতে প্রাচীনকাল থেকে অনুসন্ধানমূলক এমন একটি ভাবনা চর্চিত ছিল বিভিন্ন দেশে। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে সেনা বিভাগের মেডিক্যাল শাখায় যুক্ত কর্মীদের কেউ কেউ অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন চর্চা শুরু হয় এবং সুসংবদ্ধ আকার প্রাপ্ত হয় উনিশ শতকেই। বিংশ শতকে যার প্রয়োগ আরও বিজ্ঞানভিত্তিক হয়ে ওঠে। অস্বাভাবিক মৃত্যু, খুন-জখম, আত্মহত্যা, নথি-জাল, ড্রাগ-সেবন, বিষক্রিয়া ইত্যাদির প্রমাণের জন্যে দেহ-রস, মূত্র, রক্ত, মাথার চুলের নমুনা, ফিঙ্গারপ্রিন্ট ইত্যাদি সংগ্রহ করা হয়। সুচিন্তিত বিশ্লেষণ ও প্রমাণের দ্বারা অপরাধীকে চিহ্নিত করা বা বিষয়টির কারণ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রটিই হল ফরেন্সিক শাখার অন্যতম লক্ষ্য।
১৮৯৭ সালের ১ জানুয়ারি যশোরে জন্ম নির্মলকুমার সেনের। পাবনা থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে রসায়নে অনার্স নিয়ে পড়তে এলেন ঢাকা কলেজে। ১৯২২ সালে জৈব-রসায়নে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করলেন। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ। নির্মলকুমারের আকর্ষণ ছিল জ্ঞানচন্দ্রের অভাবনীয় প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের প্রতি। পাটের বীজের রাসায়নিক গঠন নিয়ে ডিএসসি করবেন মনস্থির করলেন জ্ঞানচন্দ্রের তত্ত্বাবধানে। ১৯৩৩ সালে পাটের বীজ নিয়ে নির্মলকুমারের গবেষণাটি শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হওয়ায় এলিয়ট প্রাইজ পেলেন। ইতিমধ্যেই তিনি শিক্ষকতার কাজে যুক্ত হয়েছেন। ১৯৪২ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। কয়েক বছরের মধ্যেই স্বাধীন হল ভারত।
ভারত স্বাধীন হলে রাজ্যের পক্ষ থেকে নির্মলকুমারকে পাঠানো হল লন্ডনে। ১৯৪৯ সালে লন্ডনে থাকাকালীন তিনি মেট্রোপলিটান পুলিশ ল্যাবরেটরি, ল’ ক্রাইম প্রিভেনশন এগজ়িবিশন দেখার সুযোগ পেলেন। সেই সঙ্গে বিখ্যাত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের তদন্ত পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত হন তিনি।
১৯৫০ সালে দেশে ফিরে কলকাতা পুলিশের ফরেন্সিক শাখার আংশিক সময়ের লেকচারার হয়ে ধারাবাহিক ভাবে বক্তব্য রাখতে শুরু করলেন নির্মলকুমার। নিজের দেখে আসা অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে শুরু করলেন সহকর্মীদের কাছে। ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকারের প্রস্তাবে একটি স্বতন্ত্র ফরেন্সিক ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করতে শুরু করেন তিনি। চারটি বিভাগ নির্দিষ্ট করা হয়। কেমিক্যাল, বায়োলজিক্যাল, ফিজিক্যাল বিভাগের সঙ্গে ব্যালিস্টিক সেকশনও থাকবে ঠিক হয়। যদিও ১৯৩০ সালে খুব সংক্ষিপ্ত আকারে কলকাতা পুলিশের অধীনে খোলা হয়েছিল গুলি, বন্দুক, আগ্নেয়াস্ত্র পরীক্ষার জন্য একটি ল্যাবরেটরি। কিন্তু সেই ল্যাবরেটরির পরীক্ষা পদ্ধতি ছিল পুরনো। নির্মলকুমার সেই বিভাগটিকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করেন। অবশেষে ১৯৫২ সালের জুলাই থেকে শুরু হল ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাজ। নির্মলকুমার সেন হলেন প্রথম ডিরেক্টর। অসম, ওড়িশা-সহ ভারতের সামরিক বিভাগের প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ হবে এখানে, ঠিক হল। এই সূত্রে পুলিশদের ট্রেনিং-এর জন্য তিনি ধারাবাহিক ভাবে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন অপরাধ-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। একই সঙ্গে তাঁর ভাবনাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রবন্ধ লিখতে শুরু করলেন ‘ক্যালকাটা পুলিশ’ জার্নালে। জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায় লিখলেন একাধিক প্রবন্ধ। অনুসন্ধান শুরু করলেন কী ভাবে অপরাধের পদ্ধতি পাল্টে যাচ্ছে সময়ের সঙ্গে এবং অতি সহজে কী ভাবে শনাক্ত করা যায় অপরাধীকে। এ সব নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখলেন যে, পরীক্ষার জন্য কিছু কিট প্রয়োজন। নির্মলকুমার তদন্ত বা অনুসন্ধানের উপযুক্ত গাইডলাইন ও আবশ্যক কিট তৈরি করলেন পুলিশ অফিসারদের জন্য। চলতে থাকল বিভিন্ন ঘটনার অনুসন্ধানমূলক বিশ্লেষণ এবং তদন্ত করে সহজ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পথ। তাঁর পরামর্শে সেই সময়ে উল্লেখযোগ্য দুটি ঘটনার বিশ্লেষণের একটি ছিল বেলারানী মার্ডার কেস এবং অন্যটি দীনদয়াল উপাধ্যায়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুর অনুসন্ধান।
তাঁর অভাবনীয় ভাবনার অন্যতম একটি হল ‘রোল অব ইঙ্ক ইন দ্য এগজামিনেশন অব কোয়েশ্চেন ডকুমেন্টস’। সেই সময় জাল নথি বানানো বা লিখিত নথির কারচুপি ধরার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ দেন তিনি। নথি নকলের জন্য কালির তফাত হতেই হবে। সেটাই মূলত চিহ্নিত করা হয় কালির বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহৃত কালির এজিং বা বয়স নির্ণয় করে। এই পদ্ধতি বিশেষ সহায়ক হয়ে ওঠে সেই সময়ে জাল নথি, উইল, সুইসাইড নোট ইত্যাদির বিশ্লেষণে। অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে সামান্য পরিমাণে হলেও কেরোসিন বা পেট্রলের ভূমিকা শনাক্ত করার ক্ষেত্রে তাঁর ফরেন্সিক বিশ্লেষণ উল্লেখযোগ্য।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের ফরেন্সিক বিভাগের উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখে নির্মলকুমারের পরামর্শে প্রতিষ্ঠিত হয় বিভিন্ন প্রদেশে ফরেন্সিক ল্যাবরেটরি। এমন এক জন মানুষের অনুসন্ধানী ভাবনা কাজে লাগিয়ে ফরেন্সিক বিভাগ সাবালক হয়ে উঠেছিল ভারতে। নির্মলকুমার মুক্ত মনের মানুষ, যে কোনও ধরনের নতুন পদ্ধতিকে তিনি গ্রহণ করে প্রয়োগেও প্রস্তুত ছিলেন। ১৯৮৩ সালের ১৬ অক্টোবর প্রয়াত হন নির্মলকুমার সেন। অজস্র অনুগামীদের মধ্যে এখনও তিনি উজ্জ্বল হয়ে আছেন ভারতে ফরেন্সিক সায়েন্সের পথিকৃ্ৎ হয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy