বব বলরাম ও তাঁর ভাবনার ফসল মার্স হেলিকপ্টার। ছবি সৌজন্যে: নাসা।
বছরকুড়ি আগে যাঁর কথা কেউ ধর্তব্যের মধ্যেই আনতে চাননি, সেই বলরামই কি না এ বার বড় ভরসা হল নাসার! বলরামের নামই জপতে হল মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থাকে! একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে মঙ্গলে পাড়ি জমাতে গিয়ে।
কুড়ি বছর আগে বলরামের দেখা স্বপ্নের ‘ডানা’য় ভরসা রেখেই লাল গ্রহের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে নাসার সর্বাধুনিক মঙ্গলযান। ‘মার্স ২০২০ রোভার’। যার পোশাকি নাম- ‘পারসিভের্যান্স’। সঙ্গে গেল প্রথম বলরামেরই ভাবনায় আসা ‘মার্স হেলিকপ্টার’। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইনজেনুইটি’। এই প্রথম কোনও হেলিকপ্টার ওড়ানো হবে পৃথিবীর বাইরে। অন্য কোনও গ্রহে।
বছরকুড়ি আগে ভারতীয় প্রযুক্তিবিদ জে বব বলরাম যখন অন্য কোনও গ্রহে হেলিকপ্টার ওড়ানোর কথা ভেবেছিলেন, সে দিন তাঁর কথায় কেউ কর্ণপাত করারও প্রয়োজন মনে করেননি। ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা জানালেন ভ্রাতৃপ্রতিম বলরামের বন্ধুসম নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরির (জেপিএল) ‘নিসার মিশন’-এর ইন্টারফেস ম্যানেজার বঙ্গসন্তান আলোক চট্টোপাধ্যায়।
ভাবনাটা প্রথম আসে বলরামের মাথায়
পাসা়ডেনা থেকে আলোক বললেন, ‘‘মাদ্রাজের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি)’ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বেরিয়ে রেনস্লার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে মাস্টার্স এবং পিএইচডি-র পর বলরাম জেপিএল-এ চাকরি করতে ঢোকেন ১৯৮৫-তে। ওই সময়ের মধ্যেই মঙ্গলে কয়েকটি ল্যান্ডার ও রোভার পাঠানো হয়ে গিয়েছে নাসার। লাল গ্রহের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে প্রাণের সন্ধানে। ওই সময় বলরামেরই প্রথম মাথায় আসে ল্যান্ডারে চাপিয়ে মঙ্গলে হেলিকপ্টার পাঠালেই তো কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। সেটা নয়ের দশকের গোড়ার দিকের কথা। বলরামের মনে হয়, রোভার যতটা এলাকা ঘুরেটুরে দেখতে পারবে, তার চেয়ে অনেক বেশি এলাকার উপর অনেক কম সময়ে নজরদারির কাজটা সেরে ফেলতে পারবে হেলিকপ্টার।’’
মার্স ২০২০ রোভার ও (ডান দিকে) মার্স হেলিকপ্টার। ছবি সৌজন্যে: নাসা।
বলরামের পাশে দাঁড়ালেন চার্লস
বলরামের সেই অভিনব ভাবনা গোড়ার দিকে কিন্তু তেমন আমল পায়নি জেপিএল-এ। পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য যে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন।
আলোক জানালেন, বলরাম যে এমন একটা কিছু ভেবেছেন, কোনও ভাবে তা পৌঁছে যায় জেপিএল-এর তদানীন্তন অধিকর্তা চার্লস এলাচির কানে। লেবানিজ চার্লস ছিলেন অসম্ভব দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। কিন্তু প্রথম দিকে তিনিও বলরামের এই ভাবনার কথাটা সাহস করে জানাতে পারেননি ওয়াশিংটনে নাসার সদর দফতরে। ভাবনাটা কতটা কার্যকরী হতে পারে, নিজে তা পরখ করে দেখার তোড়জোড় শুরু করলেন। কিন্তু তার জন্য তো ডলার লাগবে। পরীক্ষানিরীক্ষা, গবেষণায়। সেই ডলার জোগাড় করা তো সহজ কথা নয়। তার জন্য নাসার সদর দফতরের অনুমোদন প্রয়োজন। যা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পেতে হয়। জেপিএল-এর অধিকর্তা হিসাবে অবশ্য চার্লসের নিজস্ব কিছুটা ক্ষমতা ছিল কোনও গবেষণা বা পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য চটজলদি তহবিল-বরাদ্দের। সেই অর্থেই শুরু হল পরীক্ষানিরীক্ষা, গবেষণা। মঙ্গলে হেলিকপ্টার পাঠানোর ভাবনা নিয়ে। ২০১৪ থেকে। নিজে নিশ্চিত হওয়ার পর মঙ্গলে হেলিকপ্টার পাঠানোর জন্য শেষমেশ ২০১৮-য় নাসার সদর দফতরের অনুমোদন চাইলেন চার্লস। মিলেও গেল বলরামের ভাবনার অভিনবত্বের জন্য। মঙ্গলে এ বার নাসার রোভারের সঙ্গে পাঠানো হেলিকপ্টার প্রকল্পের চিফ ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ভারতের বলরামকেই।
আরও পড়ুন- পানীয় জলে বিষ মেশায় এই দুই ব্যাকটেরিয়া, হদিশ মিলল এই প্রথম
আরও পড়ুন- বিষে বিষে বিষক্ষয়! ভয়ঙ্কর মানসিক রোগ সারানোর পথ দেখালেন তিন বাঙালি
আলোক বললেন, ‘‘৬২ বছরের বলরামকে গোটা জেপিএল আজ ‘বব’ নামে একডাকে চেনে। বলরাম এখানে ‘বব বলরাম’ হয়ে গিয়েছেন। জেপিএল-এ এখন মুখে মুখে ঘুরছে বব বলরামের নাম। ভারতীয় হিসাবে গর্ব বোধ করছি।’’
‘পারসিভের্যান্স’-এর হেলিকপ্টার ও বাকি ৭ ‘ব্রহ্মাস্ত্র’!
মঙ্গলে এ বার নাসার পাঠানো রোভারে গবেষণার জন্য যে ৮টি খুব গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র রয়েছে, তার প্রথম চারটির মধ্যেই রয়েছে বলরামের ভাবনার ফসল ৪ পাউন্ড (১.৮ কিলোগ্রাম) ওজনের হেলিকপ্টার। যা সবার শেষে, গত বছর মার্স ২০২০ রোভারের ‘পে-লোডে’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এই হেলিকপ্টার ‘ইনজেনুইটি’ ছাড়া রোভারের বাকি ৭টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে- ‘মাস্টক্যাম-জেড (মাস্ট মাউন্টেড ক্যামেরা-জুম)’, ‘মেডা (মার্স এনভায়রনমেন্টাল ডায়নামিক্স অ্যানালাইজার)’, ‘মক্সি (মার্স অক্সিজেন ইন-সিটু রিসোর্স ইউটিলাইজেশন এক্সপেরিমেন্ট)’, ‘পিক্সেল (প্ল্যানেটারি ইনস্ট্রুমেন্ট ফর এক্স-রে লিথোকেমিস্ট্রি)’, ‘রিমফ্যাক্স (দ্য রাডার ইমেজার ফর মার্স সাব-সারফেস এক্সপেরিমেন্ট)’, ‘শেরলক (স্ক্যানিং হ্যাবিটেব্ল এনভায়রনমেন্টস উইথ রমন অ্যান্ড লুমিনিসেন্স ফর অরগ্যানিক্স অ্যান্ড কেমিক্যাল্স)’ এবং ‘সুপারক্যাম (সুপার ক্যামেরা)’।
খড়্গপুরের আইআইটি থেকে অ্যারোনটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ইসরোতে ১০ বছর চাকরির পর লেক গার্ডেন্সের আলোক আমেরিকায় পাড়ি জমান ১৯৮৫-তে। যোগ দেন জেপিএল-এ। ওই সময়ে জেপিএল-এ ঢোকেন আর এক ভারতীয় বলরামও। নাসার একেবারে সামনের সারির তিন-চারটি মিশনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে কাজ করেছেন আলোক। তাদের মধ্যে অন্যতম ‘গ্যালিলিও’, ‘ক্যাসিনি’ ও ‘গ্রেল’। ২০০৪/’০৫-এ ‘মিশন আর্কিটেক্ট’-এর দায়িত্বও পালন করেন আলোক, মঙ্গলে পাঠানো নাসার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ রোভার ‘কিউরিওসিটি’-র।
নাসার ‘নিসার মিশন’-এর ইন্টারফেস ম্যানেজার বঙ্গসন্তান আলোক চট্টোপাধ্যায়।
নাসার মঙ্গলে নামার আগ্রহ বাড়ল কী ভাবে?
মার্স ২০২০ রোভারকে শুধুই মঙ্গলে পাঠানো নাসার আরও একটি রোভার ভাবা হলে ভুল হবে। ১৯৭৫ সাল থেকে লাল গ্রহে নামার প্রস্তুতি শুরু হয় নাসার। পাঠানো শুরু হয় ল্যান্ডার। ১৯৭৫-এই নাসা মঙ্গলে পাঠায় দু’টি ল্যান্ডার। ‘ভাইকিং-১’ এবং ‘ভাইকিং-২’।
তার ২১ বছর পর থেকে নামার (‘ল্যান্ডিং’) পাশাপাশি মঙ্গলের জমি ঢুঁড়ে বেড়ানোর (‘মুভিং’) জন্য রোভার পাঠাতে শুরু করে নাসা। ’৯৬-এ পাঠানো হয় ‘মার্স পাথফাইন্ডার রোভার’। সেই রোভারটি ছিল একেবারেই ছোট একটি খেলনার মতো। রোভার নামানোর জন্য ওই মিশনেও ছিল ল্যান্ডার। তার পর ১৯৯৯-এ মঙ্গলের মেরুতে একটি ল্যান্ডার নামানোর চেষ্টা করেছিল নাসা। কিন্তু সেই ‘মার্স পোলার ল্যান্ডার’ নিখোঁজ হয়ে যায়।
এর ৪ বছর পর ২০০৩-এ মঙ্গলে নাসা পাঠায় ‘স্পিরিট’ রোভার। ছিল একটি ল্যান্ডারও। ওই বছরেই পাঠানো হয় আরও একটি রোভার। ‘অপরচুনিটি’। ছিল ল্যান্ডারও। ২০০৭-এ মঙ্গলে ‘ফিনিক্স’ ল্যান্ডার পাঠায় নাসা। সে বার রোভার পাঠানো হয়নি। ৪ বছর পর আবার একটি রোভার পাঠায় নাসা। ‘কিউরিওসিটি’। ২০১১-য়। ছিল ল্যান্ডারও। এর পর ২০১৮-য় পাঠানো হয় আরও একটি ল্যান্ডার। ‘ইনসাইট’। সে বারও রোভার পাঠায়নি নাসা। তার দু’বছর পর এ বার নাসা ফের ল্যান্ডার ও রোভার পাঠাল লাল গ্রহে। মার্স ২০২০ রোভার। পারসিভের্যান্স।
ফলে, এ বারের অভিযান সফল হবে, এটা ধরে নিলে গত ৪৫ বছরে নাসা মঙ্গলে সফল ভাবে নামাবে মোট ৯টি ল্যান্ডার। আর ৫টি রোভার।
সাড়ে ৫ দশকে কেন মঙ্গলে নামার উৎসাহ বাড়ল নাসার?
আলোক জানাচ্ছেন, উদ্দেশ্য ছিল মূলত দু’টি। যা এখনও আছে।
প্রথমত, লাল গ্রহে প্রাণের সন্ধান। যার পোশাকি নাম- ‘অ্যাস্ট্রোবায়োলজি মিশন’।
দ্বিতীয়ত, মঙ্গল অভিযানের মাধ্যমে নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন, যা আমাদের রোজকার জীবনেও কাজে লাগতে পারে।
প্রথম কয়েকটি মিশনের মূল লক্ষ্য ছিল, লাল গ্রহে জলের সন্ধান করা। ‘ফলো দ্য ওয়াটার’।
তার পর থেকেই শুরু হয় মঙ্গল ভবিষ্যতে ফের বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে কি না, তা খতিয়ে দেখা। থিম ছিল ‘এক্সপ্লোর হ্যাবিটাবিলিটি’। প্রাণের টিঁকে থাকার জন্য জল ছাড়া আর যে সব রাসায়নিক মৌল খুব জরুরি, লাল গ্রহে সেগুলি আছে কি না অথবা সেগুলি কী পরিমাণে রয়েছে, তার সন্ধান।
আরও পড়ুন- সূর্যের করোনায় এই প্রথম হদিশ ‘ক্যাম্পফায়ার’-এর
আরও পড়ুন- নিজের ছোড়া ‘বাণ’ থেকে আমাদের বাঁচায় সূর্যই! দেখালেন মেদিনীপুরের সঞ্চিতা
২০১১-য় সেই থিমও বদলে দেয় কিউরিওসিটি রোভার। নতুন থিম হয়- ‘সিক সাইন্স অব লাইফ’। প্রাণের চিহ্ন খোঁজা।
আলোকের কথায়, ‘‘এ বার নাসার মঙ্গল অভিযান আদতে খুব বড় একটি পরিকল্পনার অংশ। সেটা হল, মঙ্গল কতটা বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে (‘হ্যাবিটাবিলিটি অব মার্স’) তা জানা ও বোঝা। বোঝার চেষ্টা, মানুষ সেখানে যেতে পারবে কি না। কারণ, চাঁদের থেকে অনেক দূরে রয়েছে লাল গ্রহ। চাঁদ তিন দিনে যাওয়া যায়। মঙ্গলে যেতে ৬/৭ মাস লাগে। পথটাও খুব সহজ নয়। এটাও বোঝার চেষ্টা, মঙ্গলে গিয়ে কয়েক দিন থাকতে হলে মানুষের যা যা দরকার, তা আছে কি না। না থাকলে, লাল গ্রহের মুলুকে তা কী ভাবে তৈরি করে নেওয়া সম্ভব, সেটা দেখা। মানুষকে ফের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে গেলে লাল গ্রহ থেকেই রকেট উৎক্ষেপণ করতে হবে। সেটার সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখা। সেই রকেটের জ্বালানি কী ভাবে মঙ্গলেই তৈরি করা যায়, তার পরীক্ষানিরীক্ষা করা।’’
আরও একটি বিষয় রয়েছে। যে কোনও গ্রহ, উপগ্রহে যাওয়ার ক্ষেত্রে মূলত তিনটি খুব জটিল সমস্যা থাকে।
এক, নিরাপদে সেই গ্রহ বা উপগ্রহের কক্ষপথে ঢুকে পড়া (‘এন্ট্রি’)। না হলে ব্রহ্মাণ্ডের অতলে হারিয়ে যেতে হবে বরাবরের মতো।
দুই, ধীরে ধীরে গতিবেগ কমিয়ে এনে সেই গ্রহ বা উপগ্রহের পিঠে (‘সারফেস’) নামা (‘ডিসেন্ট’)।
তিন, একেবারে পালকের ছোঁয়ার মতো (‘ফেদার টাচ্’) সেই গ্রহে বা উপগ্রহের পিঠে নেমে প়ড়া (‘ল্যান্ডিং’)।
এই তিনটি প্রক্রিয়াই এত জটিল যে, তা ‘সেভেন মিনিট্স অব টেরর’ নামে পরিচিত। হিসাবের বা কম্যান্ডের একটু ভুলচুক হয়ে গেলেই ঘটে যাবে চরম বিপত্তি। যেটা ঘটেছিল ইসরোর পাঠানো ল্যান্ডার ‘বিক্রম’-এর ক্ষেত্রে। অতীতে নাসা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (এসা) ও অন্যান্য মহাকাশ গবেষণা সংস্থার বহু অভিযানে একই ভুলে চরম বিপত্তি ঘটেছিল।
‘‘তাই ল্যান্ডার ও রোভার পাঠানোর প্রয়াসের মধ্যে রয়েছে সেই সব ভুল শুধরে নেওয়ার চেষ্টাও’’, বলছেন আলোক।
এখন কেন মঙ্গলে মন নাসার?
আলোকের বক্তব্য, মানুষের মনে একটা ভুল ধারণার জন্ম হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, নাসা বোধহয় চাঁদ থেকে সরে গিয়ে মঙ্গলে মন সঁপে দিতে চাইছে। কিন্তু সেটা ঠিক নয়। এটা কোনও চাঁদ বনাম মঙ্গলে পৌঁছনোর প্রতিযোগিতা নয়। নাসার মহাকাশ অভিযানে দু’টিরই সমান গুরুত্ব রয়েছে। চাঁদ আর মঙ্গল অভিযান আদতে নাসার একটি বৃহত্তর পরিকল্পনারই অংশ। দু’টি অভিযানেরই একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। আদত কথাটা হল, অন্য গ্রহে মানুষ পাঠাতে চায় নাসা। সেটা যাতে নিরাপদে করা সম্ভব হয়, তার জন্য যাবতীয় পরীক্ষানিরীক্ষা ঘরের কাছে থাকা চাঁদেই সেরে ফেলা হবে। শুধু মঙ্গল কেন, সৌরমণ্ডলের অন্য গ্রহেও মানুষের পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে নাসা, এসা-সহ বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা সংস্থার। প্রাণের চিহ্ন খুঁজতে বৃহস্পতির জলে ভরা চাঁদ ইউরোপাতেও অভিযান চালানো হবে।
আরও পড়ুন- রক্তের ‘এ’ গ্রুপে কোভিড বেশি ভয়াবহ? ‘ও’ গ্রুপে কম? প্রশ্ন তুলল গবেষণা
আরও পড়ুন- অতিবর্ষণে ভাগীরথী, শতদ্রুতে আগামী দিনে ভয়াল প্লাবনের আশঙ্কা, বলছে গবেষণা
একের পর এক সফল অ্যাপোলো মিশনের ৫০ বছর পর বরং আরও বড় পরিকল্পনা নিয়ে আবার চাঁদে ফিরছে নাসা। ২০২৪-এই হবে নাসার ‘আর্টেমিস মিশন’। চাঁদে প্রথম মানুষের পদচিহ্ন এঁকে দিতে পেরেছিল নাসাই। এ বার লক্ষ্য, আরও অনেক দূরে লাল গ্রহে সভ্যতার পদচিহ্ন রেখে আসার। আগামী দশকের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে মঙ্গলে মহিলা নভশ্চর পাঠানোর পরিকল্পনা শুধুই খাতায়-কলমে আটকে নেই। সেই কাজ অনেক দূর এগিয়েও গিয়েছে।
আলোক জানাচ্ছেন, মঙ্গলে আমাদের আস্তানাগুলি কেমন হবে, কেমন হবে লাইফ-সাপোর্ট সিস্টেম, সেগুলিকে দীর্ঘমেয়াদি করা সম্ভব হবে কি না, এ বার আর্টেমিস মিশনে সেই সবই পরীক্ষা করে দেখা হবে চাঁদে। পার্থিব সভ্যতার জ্বালানি সমস্যা কী ভাবে মেটানো যায়, তার জন্যেও নতুন নতুন প্রযুক্তির পরীক্ষানিরীক্ষা চলবে চাঁদে। চাঁদে টানা কয়েক মাস থাকলে আমাদের শরীরের উপর কী কী প্রভাব পড়ে, মঙ্গলে গিয়ে আস্তানা গাড়ার আগে সেই সবও জেনে-বুঝে নেওয়ার চেষ্টা হবে চাঁদে। তাই চাঁদে আর্টেমিস মিশনের সাফল্যের উপরেই নির্ভর করছে আগামী দিনে আমরা লাল গ্রহে আস্তানা গাড়তে পারব কি না।
তাঁর কথায়, ‘‘মঙ্গলের চেয়ে চাঁদে গিয়ে মানুষের বেশি ক্ষণ থাকা মুশকিল। কারণ, আমাদের উপগ্রহে কোনও বায়ুমণ্ডল নেই বললেই চলে। তার ফলে, মুহূর্মুহূ সৌর বিকিরণ ও মহাজাগতিক রশ্মির বিষাক্ত ছোবল থেকে চাঁদে আমাদের বাঁচানোর ব্যবস্থা করার কাজটা অনেক বেশি দুরূহ। তা ছাড়া, মঙ্গলে এখনও যতটা জল তরল বা বরফ অবস্থায় রয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে, ততটা চাঁদে আদৌ আছে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কিন্তু খুব পাতলা হলেও বায়ুমণ্ডল রয়েছে লাল গ্রহে। মঙ্গলের পিঠের নীচে এখনও প্রচুর জল রয়েছে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের। ফলে, লাল গ্রহে গিয়ে মানুষের পক্ষে কিছু দিন থাকাটা চাঁদের চেয়ে সহজতর হবে বলেই বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। তাই মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর লক্ষ্যে কঠিনতর কাজগুলির পরীক্ষানিরীক্ষা ও গবেষণাটা নাসা সেরে নিতে চাইছে চাঁদে। আর্টেমিস মিশনের লক্ষ্য হবে সেটাই।’’
বাতাসে অক্সিজেন নেই, জলও অধরা!
তবে লাল গ্রহে সমস্যাও রয়েছে যথেষ্টই। সেখানকার বায়ুমণ্ডলের ৯৬ শতাংশই কার্বন ডাই-অক্সাইড। আমাদের শ্বাসের জন্য যার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, সেই অক্সিজেন নেই বললেই চলে লাল গ্রহের বায়ুমণ্ডলে। ফলে, নাসা চাইছে সেই কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকেই শ্বাসের অক্সিজেন জোগাড় করে নিতে। যা পৃথিবী থেকে মঙ্গলে যাওয়া-আসার জন্য রকেটের জ্বালানি হিসাবেও কাজ করবে, জানাচ্ছেন আলোক।
তাঁর বক্তব্য, মানুষ যাতে মঙ্গলে গিয়ে কিছু দিন থাকতে পারে, তার জন্য আর যেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হল জল। সেই জল লাল গ্রহের কোথায় কতটা এখনও আছে, সেটাও বুঝে নেওয়া দরকার। তাই এ বার মার্স ২০২০ রোভারে যে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রগুলি পাঠানো হয়েছে, তাদের মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে অক্সিজেন বানানোর পদ্ধতির পরীক্ষানিরীক্ষা যেমন হবে, তেমনই খুঁজে দেখা হবে লাল গ্রহের জলের ভাণ্ডার।
কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র এ বার পাঠানো হয়েছে মঙ্গলে?
হেলিকপ্টার-সহ মোট আটটি সর্বাধুনিক যন্ত্রাদি পাঠানো হয়েছে এ বার মঙ্গলে।
আলোকের মতে, এদের মধ্যে চারটির গুরুত্ব অপরিসীম। একটি যন্ত্রের নাম- ‘মক্সি’। বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে কতটা কার্যকরী ভাবে লাল গ্রহে অক্সিজেন তৈরি করা যায়, তার পরীক্ষানিরীক্ষা করবে যন্ত্রটি। মঙ্গলের মাটির নীচে থাকা জলের ভাণ্ডার থেকেও অক্সিজেন তৈরির কথা ভাবা হয়েছিল এক সময়। কিন্তু তা অনেক বেশি ব্যয়সাপেক্ষ। এ ছাড়াও পাঠানো হয়েছে একটি অত্যন্ত উন্নত মানের রাডার। ‘রিমফ্যাক্স’। যার থেকে পাঠানো তরঙ্গ লাল গ্রহের পিঠের নীচে ১০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত ফুঁড়ে গিয়ে খোঁজখবর নেবে কোথায় কতটা জল এখনও তরল বা বরফ অবস্থায় রয়েছে সেখানে। কী ভাবে সৌর বিকিরণ ও মহাজাগতিক রশ্মির ছোবল থেকে মানুষকে লাল গ্রহে বাঁচানো যায় তার প্রাথমিক পরীক্ষাটা অবশ্য সেরে নেওয়া হবে চাঁদে। পাঠানো হয়েছে আরও দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র। একটি, এই প্রথম। হেলিকপ্টার। যা মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে উড়ে সেখানে আদিম জীবনের খোঁজখবর নেবে। লাল গ্রহের গঠন বোঝার চেষ্টা করবে। আর রয়েছে একটি অত্যন্ত উন্নত মানের ‘স্যাম্পল কালেকশন সিস্টেম’। যা মঙ্গলের মাটি খুঁড়ে নুড়ি, পাথর কুড়োবে। তার পর সেগুলিকে একটি টিউবে ভরে টিউবগুলি সিল করে দেবে। গবেষণার জন্য পরে পৃথিবীতে পাঠানোর লক্ষ্যে।
২০২৬-এ নাসা, এসার যৌথ মঙ্গল অভিযান
আলোক জানাচ্ছেন, মার্স ২০২০ রোভার আপাতত দু’বছর কাজ করবে বলে ভাবা হয়েছে। এই দু’বছরে মঙ্গল ফুঁড়ে (‘ড্রিলিং’) বের করে আনা নুড়ি, পাথর (‘স্যাম্পল’) মোট ২০টি স্যাম্পল টিউবে ভরে সেগুলি সিল করে রাখবে এই রোভার। গবেষণার জন্য যেগুলি পৃথিবীতে আনতে ২০২৬ সালে দু’টি যৌথ অভিযানে মঙ্গলে যাবে নাসা এবং এসা। ‘মার্স অ্যাসেন্ট ভেহিক্ল (এমএভি)’ রকেটে চাপিয়ে। মঙ্গল থেকে কুড়োনো সেই সব স্যাম্পলের টিউব গবেষণার জন্য ২০৩১-এ পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনারও পরিকল্পনা রয়েছে। পৃথিবী থেকে রকেট উৎক্ষেপণ, মঙ্গলে অবতরণ, মঙ্গল থেকে পৃথিবীর উদ্দেশে ফের রকেট উৎক্ষেপণ এবং মঙ্গলের কক্ষপথ পরিক্রমণ করে সেই রকেটের পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনের পরীক্ষানিরীক্ষাও হবে ৬ বছর পরে নাসা, এসার সেই যৌথ অভিযানে।
তবে একেবারেই অভিনব বলে বলরামের ভাবনার ফসল হেলিকপ্টার ইনজেনুইটিই এ বার ‘স্টার অ্যাট্রাকশান’ নাসার মার্স ২০২০ রোভার মিশনের। যার সাফল্য সৌরমণ্ডলের অন্যান্য গ্রহেও আগামী দিনে হেলিকপ্টার ওড়ানোর পরিকল্পনার পালে বাতাস জোগাবে।
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
ছবি ও গ্রাফিক-তথ্য সৌজন্যে: নাসা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy