‘হোয়াটসআপ’ যাচ্ছে এ বার ধূমকেতুদের পাড়ায়! আমাদের সৌরমণ্ডলের ধূমকেতুতে কোন রঙের জল কতটা পরিমাণে রয়েছে, তার খোঁজখবর নিতে। সেই জলের অণুর চেহারা জানতে, বুঝতে। যা থেকে বোঝা যাবে, পৃথিবীতে জল বলতে আমরা যা বুঝি, তা আদতে এল কোথা থেকে?
হ্যাঁ, জলেরও ‘রং’ রয়েছে! রয়েছে ‘হরেক রঙে’র জল! সৌরমণ্ডলের বিভিন্ন গ্রহে, উপগ্রহে, ধূমকেতু, গ্রহাণুতে জলের অভাব নেই। সেই জলের রহস্য ভেদ করতেই হোয়াটসআপ বানিয়েছেন কোন্নগরের গৌতম চট্টোপাধ্যায়। একটা যন্ত্র।
নাসা সেই যন্ত্রটাকে একটা জুতোর বাক্সের মাপের উপগ্রহে (যাকে বলে, কিউব স্যাট) ভরে পাঠাবে গ্রহাণু বা অ্যাস্টারয়েডের মুলুকে। চেনা-জানা ধূমকেতুদের কাছে। খুঁজবে সৌরমণ্ডলে জলের ইতিহাস। প্রশ্ন তুলবে, ‘হোয়াটস আপ উইথ ওয়াটার?’ কী রয়েছে জলের অন্দরে?
দিশা গৌতমের হোয়াটসঅ্যাপেই
সেই জন্যই গৌতমের বানানো যন্ত্রটির নাম- ‘ওয়াটার হান্টিং অ্যাডভান্সড টেরাহার্ৎজ স্পেকট্রোমিটার অন অ্যান আলট্রা-স্মল প্ল্যাটফর্ম’। সংক্ষেপে, হোয়াটসঅ্যাপ (WHATSUP)।
আমাদের সৌরমণ্ডলের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে জলের খোঁজ-তল্লাশে আর সেই জল কী ভাবে এল পৃথিবীতে, তা জানতে এর আগে এমন ভাবে ঝাঁপ দেয়নি নাসা। প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অভাবে।
সেই অভাব দূর করতেই হোয়াটসঅ্যাপ বানিয়েছেন পাসাডেনায় নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরির (জেপিএল) সিনিয়র সায়েন্টিস্ট গৌতম চট্টোপাধ্যায়। গৌতমের যন্ত্রের প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য মাসতিনকে আগে ৩০ লক্ষ ডলার বরাদ্দ করেছে নাসা।
এই অনুসন্ধান নাসার কাছে কেন এতটা জরুরি হয়ে পড়েছে?
‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে গৌতম বলেছেন, ‘‘সৌরমণ্ডল সৃষ্টির সময় জল ছিল না। এমনকী, পৃথিবীর জন্মের পরেও বেশ কয়েক কোটি বছর কোনও জল ছিল না আমাদের গ্রহে। সেখানেই কৌতূহলের সূত্রপাত, পৃথিবীতে জলটা তা হলে কী ভাবে এসেছিল? কারা এনেছিল? কী ভাবে এতটা জলে টুইটুম্বুর হয়ে গেল পৃথিবী? বিজ্ঞানীদের একটি অংশের বিশ্বাস, ধূমকেতুরাই সেই জল এনেছিল আমাদের গ্রহে। কিন্তু সে ব্যাপারে এখনও সুর্নির্দিষ্ট কোনও তথ্যপ্রমাণ মেলেনি। তাই সুনিশ্চিতও হওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপ এ বার সেই প্রশ্নের উত্তরটা খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।’’
কী ভাবে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে হোয়াটসঅ্যাপ?
গৌতম জানাচ্ছেন, আমাদের পৃথিবী আর এই সৌরমণ্ডলের বিভিন্ন ধূমকেতুতে রয়েছে হরেক ‘রঙে’র জল। মানে, বিভিন্ন রকমের জল। স্পেকট্রোস্কোপির যন্ত্রে সেই বিভিন্ন রকমের জলের তরঙ্গদৈর্ঘ্য (ওয়েভলেংথ) ও কম্পাঙ্ক (ফ্রিকোয়েন্সি) একে অন্যের চেয়ে হয় আলাদা। আমরা যে জল খাই, ব্যবহার করি, সেটা হল- ‘H216O’। মানে, এই জলের একটি অণুতে রয়েছে দু’টি হাইড্রোজেন আর একটি অক্সিজেন পরমাণু। যে অক্সিজেন পরমাণুর ভর ১৬। মানে, তার নিউক্লিয়াসে রয়েছে ১৬টি প্রোটন আর ১৬টি নিউট্রন। এই ধরনের অণুর জলের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্ক হয় এক রকমের। আবার রয়েছে অন্য রকমের জলও। যেমন, ‘H217O’, ‘H218O’, ‘HDO’। জলের যে অণুর চেহারাটা ‘H217O’, তাতে থাকা অক্সিজেন পরমাণুর ভর ১৭। তার নিউক্লিয়াসে ১৭টি নিউট্রন রয়েছে বলে। মানে, অক্সিজেনের অন্য একটি আইসোটোপ সেই জল তৈরি করেছে। এই ধরনের অণুর জলের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্ক হয় অন্য রকমের।
একই ভাবে জলের যে অণুর চেহারা ‘H218O’, তাতে থাকা অক্সিজেন পরমাণুর ভর ১৮। তার নিউক্লিয়াসে ১৮টি নিউট্রন রয়েছে বলে। এই ধরনের অণুর জলের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্ক আগের দু’ধরনের সঙ্গে মেলে না।
আবার যে জলের অণুর চেহারাটা ‘HDO’, তাতে থাকে একটি হাইড্রোজেন, একটি ডয়টেরিয়াম (হাইড্রোজেনের আইসোটোপ) এবং একটি অক্সিজেন পরমাণু। এই ধরনের অণুর জলের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্কও হয় একেবারেই আলাদা।
আরও পড়ুন- সূর্যের রহস্যভেদ, আন্দিজের পাহাড়চূড়ায় উড়ল বাঙালির বিজয়পতাকা!
‘‘এর অর্থ, ‘H216O’, ‘H217O’, ‘H218O’, ‘HDO’, এই সব ধরনের জলেরই রং হয় আলাদা আলাদা। এই বিভিন্ন রঙের জলের পরিমাপের অনুপাত মেপে দেখা সম্ভব হবে আমার বানানো হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে’’, বললেন গৌতম।
পৃথিবীর বাইরে প্রাণের সন্ধানেও পথ দেখাবে এই খোঁজতল্লাশ
এই ব্রহ্মাণ্ডে আমরা কি একেবারেই একা? জীবনের অস্তিত্ব নেই আর কোথাও? কোনওখানে? গত ৬ দশক ধরে লাগাতার তারই অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে নাসা। যদিও এখনও পর্যন্ত পৃথিবী ছাড়া ব্রহ্মাণ্ডের আর কোথাও প্রাণের হদিশ মেলেনি।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ মনে করেন, এই ব্রহ্মাণ্ডের অন্যান্য মুলুকেও রয়েছে প্রাণের অস্তিত্ব। এখনও পর্যন্ত যতটুকু জানা গিয়েছে, তাতে ব্রহ্মাণ্ডে রয়েছে ১০ হাজার কোটিরও বেশি গ্যালাক্সি। আর ব্রহ্মাণ্ডে আমাদের ঠিকানা মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতে রয়েছে ১০ হাজার কোটিরও বেশি নক্ষত্র বা তারা। যার কোনওটা আমাদের সূর্যের মতো। চেহারা বা চরিত্রে। কোনওটা-বা সূর্যের চেয়ে অনেক গুণ বড়। আমাদের গ্যালাক্সিতেই সৌরমণ্ডলের বাইরে খোঁজতল্লাশ চালিয়ে এখনও পর্যন্ত হদিশ মিলেছে প্রায় ৪ হাজারেরও বেশি ভিন গ্রহ।
কোথায় প্রাণ খুঁজি আমরা?
সেই সব ভিন গ্রহের মধ্যে প্রাণের খোঁজে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সেইগুলিকেই বেশি গুরুত্ব দেন, যে ভিন গ্রহগুলি রয়েছে তার নক্ষত্র বা তারা থেকে এমন একটি সুর্নির্দিষ্ট দূরত্বে, যাকে বলা হয়, ‘গোল্ডিলক্স জোন’। বা ‘হ্যাবিটেব্ল জোন’। গোল্ডিলক্স জোন সেটাই, কোনও নক্ষত্র থেকে যে দূরত্বে থাকলে কোনও ভিন গ্রহের পিঠ বা তার ঠিক নীচে তাপমাত্রা এমন থাকে যাতে জল থাকতে পারে তরল অবস্থায়।
জল থাকলেও না-থাকতে পারে প্রাণ!
তবে শুধুই জল তরল অবস্থায় থাকলে যে সেই ভিন গ্রহের বাসযোগ্য হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেড়ে যায় বিজ্ঞানীদের চোখে, তা কিন্তু নয়। কারণ, প্রাণের সৃষ্টি আর তার টিঁকে থাকার জন্য প্রয়োজন বায়ুমণ্ডলেরও।
তবে সেই বায়ুমণ্ডল থাকলেই যে প্রাণের অস্তিত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে, তা-ও নয়। তার জন্য সেই বায়ুমণ্ডলে থাকতে হবে অক্সিজেনও। কারণ, আমরা প্রাণ বলতে যা বুঝি, তার সৃষ্টির জন্য সবার আগে প্রয়োজন কার্বন রয়েছে এমন একটি অণুর। তাই পার্থিব জীবনকে আমরা বলি, কার্বন-বেসড লাইফ।
থাকতে পারে অন্য ধরনের প্রাণও
তবে অন্য ধরনের জীবনও থাকতে পারে ভিন গ্রহগুলিতে। এমনকি, সেই অন্য ধরনের প্রাণ থাকতে পারে মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনির মতো আমাদের সৌরমণ্ডলের অন্যান্য গ্রহেও। তাই মাঝেমধ্যেই প্রশ্ন ওঠে, কেন সৌরমণ্ডলে বা ভিন গ্রহের ভিন মুলুকে অন্য ধরনের প্রাণের অনুসন্ধান করা হচ্ছে না?
তার উত্তরটা হল, সেই অন্য ধরনের প্রাণ আদতে কী, তা দেখতে কেমন, সে ব্যাপারে আমাদের কোনও ধারণাই নেই। ফলে, সেই অন্য ধরনের প্রাণের খোঁজতল্লাশটা চালানো সম্ভব হয় না। জানা জিনিসেরই খোঁজতল্লাশ করা যায়। একেবারেই অজানা জিনিসের অনুসন্ধান তো আর করা যায় না। সেই যে রবীন্দ্রনাথের কথা, ‘‘জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান।’’
পৃথিবীতে জল এল কোথা থেকে?
এটা নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা, নানা রকমের দাবি, পাল্টা দাবি, বিতর্ক চলছে বহু দিন ধরেই। উত্তর খুঁজতে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ইএসএ বা ‘এসা’) সঙ্গে হাত মিলিয়ে ধূমকেতু ‘চুরিয়ামোভ-গেরাশিমেঙ্কো’তে ‘রোসেটা’ মিশন পাঠিয়েছিল নাসা। কিন্তু তাতে তেমন কাজ হয়নি।
গৌতম বলছেন, পৃথিবীতে জল এসেছিল কী ভাবে, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। নানা তত্ত্ব রয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেউই ১০০ শতাংশ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারেন না, পৃথিবীতে জল কারা এনেছে? কারা জল এনেছে এই সৌরমণ্ডলের বিভিন্ন প্রান্তে। নানা মুলুকে। গ্রহে, গ্রহান্তরে। গ্রহাণুদের রাজ্যে (অ্যাস্টারয়েড বেল্ট)। একটি ব্যাপারে এখন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশই একমত হয়েছেন যে, আমাদের এই নীলাভ গ্রহটি যে সব পদার্থ দিয়ে তৈরি হয়েছে, সেই সব কিছুই পৃথিবীর নিজস্ব নয়। সেগুলি এসেছিল এই সৌরমণ্ডলের অনেক দূর থেকে। আর সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বের (এক অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট বা, ‘এইউ’) মধ্যে যা কিছু (গ্রহের চেয়েও ছোট আকারের মহাজাগতিক বস্তু) তৈরি হয়েছিল এই সৌরমণ্ডলের জন্মের পর, সেগুলির সবক’টিতেই জল ছিল যৎকিঞ্চিৎ। আর একটি ব্যাপারে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মোটামুটি সম্মতিতে পৌঁছেছেন যে, এই সৌরমণ্ডলে সূর্য থেকে যে পাথুরে মহাজাগতিক বস্তুগুলি ছিল দূরে, তাদের মধ্যে জলের পরিমাণ অনেক গুণ বেশি। সেই জল যদিও তরল অবস্থার নয়। তা ওয়াটার আইস। তার পরিমাণ অনেক বেশি জলে ভরা গ্রহাণুগুলিতে। অনেক বেশি ধূমকেতুগুলিতে।
আরও পড়ুন- মুঠো মুঠো সোনা, প্ল্যাটিনাম ছড়িয়ে পড়ছে মহাকাশে! ঘটকালি করছে ব্ল্যাক হোল
গৌতমের বক্তব্য, সেই জলও তো আর এক ধরনের হয় না। তার নানা ধরনের রং থাকে। তাই জলও হয় হরেক রঙের। রংবেরঙের। জলের রং নির্ভর করে, তার অণু যারা গড়ে তুলছে, সেই হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন পরমাণু কী পরিমাণে, কী অনুপাতে রয়েছে, তার উপর। নির্ভর করে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের কোন কোন আইসোটোপ দিয়ে সেই জল বানানো হচ্ছে, তার উপর। এই সব ধরনের জল আমাদের গ্রহে যে পরিমাণে রয়েছে, দেখা গিয়েছে, তা প্রায় একই পরিমাণে রয়েছে ধূমকেতুগুলিতেও। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তা মাত্র কয়েকটি ধূমকেতুতে দেখা সম্ভব হয়েছে। এ বার গৌতমের প্রযুক্তিতে তা অনেক বেশি সংখ্যক ধূমকেতুতে খুঁজে দেখা হবে।
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: গৌতম চট্টোপাধ্যায়, জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরি, নাসা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy