মেহমুদা সুলতানা। হাতে সেন্সর। নাসার গডার্ড স্পেস সেন্টারে। গ্রিনবেল্টে।
আরশোলাকেও হার মানিয়েছেন বাঙালি কন্যা মেহমুদা সুলতানা! তাঁর প্রযুক্তি, তাঁর বানানো সেন্সর যন্ত্রের মাধ্যমে। শুঁড় দিয়ে আশপাশের সব কিছুকে এক লহমায় বুঝে ফেলার যে আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে আরশোলার, সুলতানার সেন্সর তার ‘জাদু’ সম্ভবত বুঝে ফেলেছে!
তাই যাকে প্রায় দেখাই যায় না, এমন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোনও বস্তুর ক্ষমতা কতটা হতে পারে, এ বার তা বাংলার সুলতানার কাছ থেকে শিখছে নাসা। তাঁর বানানো সেন্সরের মাধ্যমে। যাঁর জন্ম আর শৈশব-কৈশোরের একটা অংশের স্মৃতি ধরা রয়েছে পাবনার এক অজ পাড়াগাঁয়ে।
ব্রহ্মাণ্ডে ভিন মুলুকের ভিন গ্রহে প্রাণ খুঁজতে সুলতানাই আপাতত বড় ভরসা নাসার। ছোট হতে হতে কত ছোট হওয়া যায়, অত ছোট হয়েও কী ভাবে তাকে বড় কাজে লাগানো যায়, সুলতানাই তা শিখিয়েছেন নাসাকে। তাঁর প্রযুক্তির মাধ্যমে। যা আগামী দিনে চাঁদ ও মঙ্গলে মহাকাশচারীদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠতে চলেছে। প্রাণ বা তার উপাদানের খোঁজ-তল্লাশে।
সুলতানার উদ্ভাবিত প্রযুক্তির নাম- ‘থ্রিডি-প্রিন্টেড সেন্সর টেকনোলজি’। অত্যন্ত কম চাপ ও তাপমাত্রায় কোনও গ্যাস বা বাষ্প খুব সামান্য পরিমাণে থাকলেও, তার মধ্যে প্রাণের উপাদান লুকিয়ে আছে কি না, আছে কি না জলের কণা, অ্যামোনিয়া, মিথেন বা হাইড্রোজেনের অণু, সুলতানার প্রযুক্তির দৌলতে এ বার তারও ‘গন্ধ’ পাওয়া যাবে। আর ‘নাকে’ আসা সেই ‘গন্ধ’ সুলতানার বানানো সেন্সর বেতার (ওয়্যারলেস) অ্যান্টেনার মাধ্যমে পৃথিবী বা গ্রাউন্ড স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলা উপগ্রহকে জানিয়ে দিতে পারবে। কয়েক লহমার মধ্যে। যা এর আগে কখনও সম্ভব হয়নি।
আরশোলার মতো সেন্সর বানানোর প্রয়োজনটা নাসার অনেক দিনের। ভিন গ্রহে প্রাণের খোঁজে সেই হাতিয়ারটা এত দিন ছিল না নাসার হাতে। যা তুলে দিলেন সুলতানা। ২০১৭-য় তিনি পান নাসার ‘বর্ষসেরা বিজ্ঞানী’র পুরস্কার।
আরও পড়ুন- বিশাল গর্তের হদিশ মঙ্গলে! নীচে দেখা মিলবে জলস্রোতের?
আরও পড়ুন- গত ২০ বছরে আরও সবুজ হয়েছে বিশ্ব, নেতৃত্বে ভারত-চিন, বলছে নাসা
আমাদের হাতের সবচেয়ে ছোট আঙুলের মতো সেন্সর
সেন্সরটি আকারে আমাদের হাতের সবচেয়ে ছোট আঙুলটির (কনিষ্ঠা) মতো। ৩ ইঞ্চি লম্বা, ২ ইঞ্চি চওড়া। মানে, চওড়ায় পায়ের বুড়ো আঙুলের চেয়ে একটু বেশি। এত ছোট সেন্সর এর আগে আর পাঠানো যায়নি মহাকাশে।
মঙ্গলে রোভার ‘মিস কিউরিওসিটি’র সেন্সর। দেখুন, কী ভাবে রশ্মি (লাল আলো) ফেলে তা খুঁজছে প্রাণের উপাদান
মেরিল্যান্ডের গ্রিনবেল্টে নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের প্রযুক্তিবিদ মেহমুদা সুলতানা ওয়াশিংটন থেকে টেলিফোনে ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে বলেছেন, ‘‘আমাদের এই নতুন সেন্সরটি এ বার মঙ্গল, চাঁদে পাঠানো কোনও ল্যান্ডার, রোভারের শরীরেও গুঁজে দেওয়া দেওয়া যাবে। ফলে, তাদের পক্ষে ওই সেন্সর দিয়ে ভিন গ্রহের ভিন মুলুকে খুব সামান্য পরিমাণ গ্যাসেও জলের কণা বা প্রাণের উপাদান রয়েছে কি না, তার ‘গন্ধ’ পাওয়া যাবে, চোখের পাতা পড়তে না পড়তেই।’’
পাবনার গ্রামে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পরেই মা, বাবার সঙ্গে তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন আমেরিকায়। সেখানেই গ্র্যাজুয়েশন। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন। ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। ২০১০ সালে সুলতানা যোগ দেন নাসায়।
প্রাণের ‘গন্ধ’ চট করে চলে আসবে সেন্সরের নাকে!
ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘স্মেল’, এই ‘গন্ধ’ অবশ্য তা নয়। গ্যাস বা বাষ্পে খুব সামান্য পরিমাণে জলের কণা, খনিজ পদার্থ বা প্রাণসৃষ্টির কোনও উপাদান অথবা জৈব অণু থাকলে সেই গ্যাস বা বাষ্পের রং বা আচার-আচরণ কিছুটা বদলে যায়। সুলতানার প্রযুক্তির কৃতিত্ব, তাঁর বানানো সেন্সরটি চট করে সেই রদবদলটা ধরে ফেলতে পারে। আর সঙ্গে সঙ্গে তাকে সিগন্যালে বদলে ফেলে তা গ্রাউন্ড স্টেশন বা পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলা উপগ্রহকে জানিয়ে দিতে পারে।
কী বলছেন মেহমুদা সুলতানা তাঁর সেন্সর সম্পর্কে? দেখুন ভিডিয়ো
থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তি বলতে কী বোঝায়?
সুলতানার কথায়, ‘‘এটা আসলে একটা প্রিন্টার। কাগজ বা নোট যে ভাবে ছাপানো হয় প্রিন্টারে, ঠিক সেই পদ্ধতিতেই চলে আমাদের সেন্সর। তবে কাগজ বা নোট ছাপানোর জন্য যেমন প্রিন্টারে কালি লাগাতে হয়, আমাদের প্রিন্টারে তা লাগাতে হয় না। আমাদের থ্রিডি-প্রিন্টেড সেন্সরে কালির বদলে লাগানো হয় বিভিন্ন ধরনের ন্যানো মেটিরিয়াল। বা অত্যন্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পদার্থ। সেগুলি থাকে খুব গুঁড়ো গুঁড়ো অবস্থায়। যে কোনও পদার্থকে গুঁড়ো করলে, তা যতই ছোট হোক না কেন, তাকে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু ন্যানো মেটিরিয়ালগুলিকে অণুবীক্ষণের নীচে না রাখলে কখনওই দেখা সম্ভব নয়।’’
আগামী বছর নাসার পাঠানো রোভারের যে সব জায়গায় থাকবে এই সেন্সর
পাউরুটির উপর যেমন মাখন লাগানো হয়, আর তাকে আরও মাখো-মাখো করতে যেমন একটি স্তরের উপর মাখন লাগানো হয় আরও কয়েকটি স্তরে, সুলতানার বানানো সেন্সরে তেমন ভাবেই বিশেষ একটি পদার্থের উপর (যাকে ‘সাবস্ট্রেট’ বলা হয়, যেমন- পাউরুটি) স্তরে স্তরে লাগানো থাকে ন্যানো মেটিরিয়ালগুলি।
সুলতানার বানানো সেন্সরের অভিনবত্ব কোথায়?
সেই ন্যানো মেটিরিয়ালগুলির এক-একটি স্তরের কাজ এক-এক রকম। কখনও প্রত্যেকটি স্তরে থাকে একই ধরনের ন্যানো মেটিরিয়াল। কখনও বা একটি স্তরে যে ন্যানো মেটিরিয়াল আছে, অন্য স্তরে তা থাকে না। সেখানে থাকে অন্য একটি ন্যানো মেটিরিয়াল।
তার ফলে, সুলতানার বানানো সেন্সরের কোনও একটি স্তর যদি কোনও একটি জৈব অণু বা প্রাণের উপাদানের ‘গন্ধ’ পায়, তা হলে অন্য স্তরটির নাকে পৌঁছবে অন্য কোনও জৈব অণু বা প্রাণের অন্য কোনও উপাদানের গন্ধ। ফলে, একটি সেন্সর একই সঙ্গে ভিন গ্রহের ভিন মুলুকে খুব সামান্য পরিমাণ গ্যাস বা বাষ্পে প্রাণসৃষ্টির বিভিন্ন ধরনের উপাদানের খোঁজ-তল্লাশ করতে পারবে। এর আগে যা সম্ভব হয়নি। এত ছোট চেহারার সেন্সরে সেটা করা সম্ভব বলে কেউ সেই ভাবে ভেবেও উঠতে পারেননি।
মেরিল্যান্ডে নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারে তাঁর গবেষণাগারে বঙ্গতনয়া মেহমুদা সুলতানা
ওয়াশিংটনে নাসার সদর দফতরে মঙ্গলের ‘পাথফাইন্ডার মিশন’-এর গবেষকদলের অন্যতম বিজ্ঞানী অমিতাভ ঘোষ বলছেন, ‘‘সুলতানার এই প্রযুক্তিকে আমি বৈপ্লবিক বলব। কারণ, এখনও পর্যন্ত একই সেন্সরে এত গুলি স্তরের ন্যানো মেটিরিয়াল ব্যবহার করে তার কর্মক্ষমতা অনেক গুণ বাড়িয়ে তোলা সম্ভব হয়নি। আর তা যে এত ছোট আকারের সেন্সরে করা সম্ভব, এটাও আগে কারও পক্ষে করে দেখানো সম্ভব হয়নি।’’
ন্যানো মেটিরিয়ালের আচার, আচরণ কেমন হয়?
ন্যানো মেটিরিয়াল নানা ধরনের হয়। কখনও তা হয় কার্বন ন্যানোটিউব বা গ্র্যাফিন। আবার তা কখনও হয় মলিবডেনাম ডাই-সালফাইড বা অন্য কোনও যৌগের। খুব সামান্য চাপ আর হাড়জমানো ঠান্ডাতেও যা বিগড়ে যায় না। দীর্ঘ দিন সেই পরিবেশে কাজও করে যেতে পারে। এমনকী, মহাকাশের বিভিন্ন ধরনের বিকিরণ (রেডিয়েশন)-কে অগ্রাহ্য করেও। সেই বিকিরণের মাত্রা যতই বেশি হোক, তার প্রচণ্ড ঝড়-ঝাপটাতেও কাজ করতে কোনও অসুবিধা হয় না সুলতানার বানানো সেন্সরটির।
আরও পড়ুন- ৮০ বছরে গলে যাবে হিমালয়ের অর্ধেক বরফ! শুকিয়ে যাবে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র!
আরও পড়ুন- বিগ ব্যাংয়ের পর ৬০০ লক্ষ কোটি সূর্যের ঝলসানি দেখল নাসা
সুলতানার কথায়, ‘‘লজ্জাবতী গাছ দেখেছেন? আমাদের হাত, পায়ের আলতো ছোঁয়ায় যার পাতা মুড়ে যায়। তারা এতটাই ‘স্পর্শকাতর’ (সেনসিটিভ)। আমাদের সেন্সর তার চেয়েও অনেক গুণ বেশি সেনসিটিভ। ফলে, ভিন গ্রহের ভিন মুলুকে গ্যাস বা বাষ্পের ধরনধারণ খুব সামান্য পরিমাণে বদলে গেলেও, সেন্সর তা চট করে ধরে ফেলতে পারে।’’
খুব হাল্কা, চালাতে বিদ্যুৎশক্তিও লাগে সামান্যই
মহাকাশে আমরা সেই সব জিনিসই পাঠাই, যাদের ওজন খুব কম হয়। যেটুকু ওজন না থাকলেই নয়। কারণ, ওজন বেড়ে গেলেই তাকে পিঠে চাপিয়ে মহাকাশে ঝড়ের গতিতে ছুটতে অসুবিধা হয় মহাকাশযানের। তাই সুলতানার বানানো সেন্সরটি ওজনেও খুব হাল্কা।
আরশোলার মতো সেন্সর বলতে কী বোঝায়? দেখুন ভিডিয়ো
চাঁদ বা মঙ্গলে এই ধরনের সেন্সরের বেশির ভাগই চলে বিদ্যুৎশক্তিতে। কারণ, অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলে সেগুলিকে চার পাশ খোলা জায়গায় রাখা সম্ভব নয় চাঁদ বা মঙ্গলে। বিভিন্ন রকমের তেজস্ক্রিয় বিকিরণে সেগুলি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। খোলা জায়গায় থাকলে সেগুলিকে সৌরশক্তিতে চালানো যেত। যেমন কোনও রোভার বা ল্যান্ডারে থাকা সোলার প্যানেলগুলি চলে সৌরশক্তিতে। কিন্তু সেন্সরকে চাঁদ বা মঙ্গলে তার নিরাপত্তার প্রয়োজনে অনেকটাই ঢাকা-চাপা দিয়ে রাখতে হয়। তাই সেগুলি চালানোর জন্য লাগে বিদ্যুৎশক্তি। যার জোগান দেয় সেন্সরের মধ্যে থাকা ব্যাটারি। কিন্তু মহাকাশে তো আর বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করা সম্ভব নয়। প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎশক্তি ওই ব্যাটারিতে ভরেই মহাকাশে নিয়ে যেতে হয়। পরে, কাজের জন্য গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে কম্যান্ড রোভারে পৌঁছলে সেই ব্যাটারিগুলি সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তার দৌলতে সেন্সরও তার কাজ করতে শুরু করে দেয়।
ব্যাটারির আয়ু ও দক্ষতা বাড়ায় সুলতানার সেন্সর
কিন্তু বেশি বিদ্যুৎশক্তির ভারী ব্যাটারি ভরে মহাকাশযানের পিঠে চাপানো যায় না। তাতেও ওজন বেড়ে যায় মহাকাশযানের। দ্রুত গতিতে ছুটতে তার অসুবিধা হয়। তার গতিবেগ কমিয়ে দিতে হয়। তা ছাড়া মঙ্গলের মতো গ্রহে যেতে সময় লাগে অন্তত ৭ থেকে ৮ মাস। তার পরেও কয়েক বছর ধরে ভিন গ্রহে সেন্সরের প্রাণসন্ধানের কাজ চালিয়ে যেতে হলে, তার ব্যাটারিতে ভরে দিতে হয় পর্যাপ্ত বিদ্যুৎশক্তি। ফলে, সেন্সরটিকে যত কম বিদ্যুৎশক্তি খরচ করে চালানো যায়, ততই মঙ্গল। তাতে ব্যাটারির ওজন কমে, মহাকাশযানের পিঠের বোঝাটার ওজন বাড়ে না। আবার বেশি বিদ্যুৎশক্তির খরচ হচ্ছে না বলে ব্যাটারির আয়ু বাড়ে। তাদের কর্মক্ষমতাও বেড়ে যায় কয়েক গুণ।
আমার সেন্সরগুলি একই চিপে বানানো: সুলতানা
সুলতানার কাজের আরও অভিনবত্ব, তাঁর বানানো সেন্সরগুলি একই চিপের উপর বানানো। প্রিন্টারে খুব দ্রুত কাগজ বা নোট ছাপানোর মতো ওই চিপের উপর থাকা ন্যানো মেটিরিয়ালে বানানো একটি স্তর থেকে অন্য স্তরে তা খুব দ্রুত ছেপে যায়। তার ফলে, চাঁদ বা মঙ্গলে প্রাণ বা প্রাণের উপাদানের গন্ধ সে পেল কি না, পেলে কোন কোন জৈব অণুর হদিশ পেল, খুব দ্রুত ওই সেন্সরের মাধ্যমে গ্রাউন্ড স্টেশন বা তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলা উপগ্রহগুলিতে তার সিগন্যাল পৌঁছে যেতে পারবে।
সুলতানা বললেন, ‘‘এখন আরও নতুন নতুন ন্যানো মেটিরিয়াল নিয়ে আর সেন্সরের উপর তাদের স্তরের সংখ্যা বাড়িয়ে, কমিয়ে ওই সেন্সরের সেনসিটিভিটি আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে তোলাটাই আমার এক ও একমাত্র লক্ষ্য।’’
সাবাশ, সুলতানা!
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy