Advertisement
E-Paper

ক্রিসপার-এর সন্ধান যেন রূপকথা

জিন কাটা-ছেঁড়া করার পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা চলছে কয়েক দশক ধরেই। জিন কাটা-ছেঁড়া করার পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা চলছে কয়েক দশক ধরেই।

বদলানো যায় ডিএনএ-র নকশার মধ্যে জড়িয়ে থাকা জীবন-সঙ্কেত।

বদলানো যায় ডিএনএ-র নকশার মধ্যে জড়িয়ে থাকা জীবন-সঙ্কেত।

মুনিয়া গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২০ ০১:৫৫
Share
Save

চলতি বছরে রসায়নে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা বৈজ্ঞানিক মহলে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। জার্মানির ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব ইনফেকশন বায়োলজি-তে গবেষণারত ইমানুয়েল শারপেঁতিয়ে এবং আমেরিকার ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলে-র অধ্যাপিকা জেনিফার দৌদনা আবিষ্কার করলেন এমন এক পদ্ধতি, যা দিয়ে প্রাণী, উদ্ভিদ বা অণুজীবের কোষের মধ্যে উপস্থিত ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা ডিএনএ-কে নির্ধারিত জায়গায় নিখুঁত ভাবে কাটা-ছেঁড়া করা যায়। বদলানো যায় ডিএনএ-র নকশার মধ্যে জড়িয়ে থাকা জীবন-সঙ্কেত। এই কাটা-ছেঁড়া, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যাকে বলে ‘জিনোম এডিটিং’, তার পিছনে রয়েছে ক্রিসপার-ক্যাস৯ নামের এক ‘জেনেটিক’ কাঁচি, যা একই সঙ্গে ধারালো ও নিখুঁত। এই আবিষ্কারের সাহায্যে শুধু যে জীবন রহস্য বোঝার কাজ আরও সহজ হবে, তা-ই নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে নতুন ধরনের চিকিৎসার আশ্বাস।

আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে আরও কিছু কারণে। শুধুমাত্র দুই মহিলা বিজ্ঞানীর একসঙ্গে নোবেল প্রাপ্তি এই প্রথম। আর রসায়নে একক ভাবে কোনও মহিলা বিজ্ঞানীর নোবেল প্রাপ্তি ১৯৬৪ সালে ডরোথি হজকিনের পরে আর ঘটেনি। ২০১৮ সালেও রসায়নে নোবেল প্রাপকের তালিকায় ছিল মহিলা বিজ্ঞানী ফ্রান্সেস আর্নল্ডের নাম। কিন্তু তাঁকে নোবেল ভাগ করে নিতে হয়েছিল জর্জ স্মিথ ও গ্রেগরি উইন্টারের সঙ্গে। তা ছাড়া ২০১২ সালে সায়েন্স ম্যাগাজ়িনে এই গবেষণার ফল প্রকাশের মাত্র আট বছর পরেই এসেছে এই সম্মান।

ক্রিসপারের পুরো নাম হল ‘ক্লাস্টার্ড রেগুলারলি ইন্টারস্পেসড শর্ট প্যালিনড্রোমিক রিপিটস’। খুব সহজ ভাষায়, এ হল জিনোমের মধ্যে ক্রমানুযায়ী সাজানো বিশেষ ধরনের ডিএনএ সিকোয়েন্স। বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছিলেন যে, এই বিশেষ ধরনের সিকোয়েন্স নানা ধরনের ব্যাকটিরিয়ায় দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি দইতে পাওয়া যায় যে ব্যাকটিরিয়া, স্ট্রেপটোকক্কাস থার্মোফিলাস, তাতেও রয়েছে এই ধরনের সিকোয়েন্স। এই সিকোয়েন্স-হল ব্যাকটিরিয়ার নিজস্ব প্রতিরোধী ব্যবস্থার অংশ।

যুগলবন্দি: ২০২০ সালে রসায়নে নোবেল ভাগ করে নিয়েছেন ইমানুয়েল শারপেঁতিয়ে (বাঁ দিকে) ও জেনিফার দৌদনা

কী ভাবে কাজ করে এই ব্যবস্থা? প্রথম বার ভাইরাস আক্রমণ করলে বেঁচে যাওয়া ব্যাকটিরিয়া পরবর্তী আক্রমণকে সামাল দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। যুদ্ধ জয়ের জন্য যে গুপ্তচর বাহিনী ও সেনা দলের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন, এ কথা সবাই জানে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যাকটিরিয়ার গুপ্তচর ব্যবস্থা ও সেনা দলের সমন্বয়ই হল ক্রিসপার ব্যবস্থা।

কোনও ভাইরাস ব্যাকটিরিয়াকে আক্রমণ করলে নিজের ডিএনএ ব্যাকটিরিয়ার দেহে ঢুকিয়ে দেয়। প্রথম বার ব্যাকটিরিয়া এই কাজে বাধা দেয় না, বরং সাদরে বরণ করে নিজের ডিএনএ-র মধ্যে জায়গা করে দেয়— ঠিক সেই বিশেষ ধরনের সিকোয়েন্সের মধ্যিখানে, যাকে বলে ক্রিসপার সিকোয়েন্স। ধ্বংস করার আগে আরও কাছ থেকে শত্রুকে চিনে নেওয়ার ধাপ এটি।

এর পর ভাইরাল ডিএনএ-সমেত ব্যাকটিরিয়ার ক্রিসপার সিকোয়েন্সটি একটি লম্বা ক্রিসপার আরএনএ তৈরি করে। সংলগ্ন ক্যাস জিন থেকে তৈরি হয় ক্যাস৯ প্রোটিন। এই প্রোটিন কি তা হলে সেই কাঁচি, যা ভাইরাসের ডিএনএ-কে কেটে ফেলে?

আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুশিবির ধ্বংস করতে একটি পদ্ধতির ব্যবহার ব্যাপক হারে হয়। ধরে নেওয়া যাক, একটি শত্রুশিবির একেবারে বাজারের মধ্যিখানে। সেটিকে দূর থেকে ধ্বংস করলে সাধারণ মানুষ হতাহত হওয়ার আশঙ্কা খুবই বেশি। তা হলে উপায়? আধুনিক যুদ্ধে এক দল গুপ্তচর গিয়ে প্রথমে শত্রুশিবিরের খোঁজখবর নেয়, এবং নিখুঁত অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ পাঠিয়ে দেয় বিমানবাহিনীর কাছে। এই তথ্যে ভর করে শত্রুশিবিরে নিখুঁত হামলা চালায় বিমানবাহিনী। ক্রিসপারের কর্মপদ্ধতিও একই রকমের। ক্রিসপার আরএনএ থেকে ক্যাস৯ তৈরি হওয়ার পরে আরও এক বিশেষ আরএনএ, নাম ট্রেসার আরএনএ, গিয়ে জুড়ে যায় ক্রিসপার আরএনএ-র সঙ্গে। এদের সঙ্গে যোগ দেয় ক্যাস৯। এর কাজ ভাইরাসের ডিএনএ-র বিশেষ জায়গা চিনে কেটে ফেলা এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

ট্রেসার আরএনএ ও ক্যাস৯, দু’জনে রাইবোনিউক্লিয়েজ়-৩ প্রোটিনের সাহায্যে ক্রিসপারের আরএনএ-র একটা ছোট্ট অংশ কেটে নিয়ে নিজেদের দলে টেনে নেয়, যা আসলে তৈরি হয়েছিল প্রথম ধাপে ভাইরাসের ডিএনএ থেকে। কেটে নেওয়া ভাইরাসের এই ছোট্ট আরএনএ-ই হল শত্রুশিবিরের অবস্থানের তথ্য। এ ভাবেই তৈরি হয় জেনেটিক কাঁচি— যার মধ্যে ট্রেসার আরএনএ হল সেই গুপ্তচর, যে বার করে এনেছে শত্রুশিবিরের তথ্য, এবং ক্যাস৯ হল এ ক্ষেত্রে বিমানবাহিনী, যে শত্রু ধ্বংস করবে। আর এদের দু’জনের কাছে তো নতুন ভাইরাসকে চিনে নেওয়ার তথ্য রয়েইছে।

দ্বিতীয় বার ভাইরাস আক্রমণ করলেও ট্রেসার আরএনএ-র কাছে আগে থেকেই সে ব্যাপারে তথ্য থাকে। এর ওপর ভর করেই শত্রুর অবস্থান চিনিয়ে দেওয়ার কাজটি সম্পন্ন হয়। এ ক্ষেত্রে শত্রুশিবিরের অবস্থান হল ভাইরাসের ডিএনএ-র কোনখানে আঘাত হানতে হবে, সেই সিকোয়েন্স। ট্রেসার আরএনএ নতুন আক্রমণকারী ভাইরাসের ডিএনএ-কে চিনিয়ে দিলেই ক্যাস৯ সেটিকে কেটে ফেলে। এই পদ্ধতিরই অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন ইমানুয়েল ও জেনিফার।

২০১১ সাল। পুয়ের্তো রিকোতে এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দেন ইমানুয়েল ও জেনিফার। তার আগে ইউরোপে বসে স্ট্রেপটোকক্কাস পায়োজেনস নামের এক ব্যাকটিরিয়া নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিলেন ইমানুয়েল। ট্রেসার আরএনএ কী ভাবে একজোট হয়ে ক্যাস৯-এর সঙ্গে কাজ করে, তা ইমানুয়েলেরই আবিষ্কার। অন্য দিকে, সুদূর ক্যালিফর্নিয়ায় জেনিফার নানা ধরনের ক্যাস জিন ও প্রোটিন নিয়ে গবেষণারত ছিলেন। সম্মেলনে ওঁরা নিজেদের কাজ নিয়ে আলোচনা করেন এবং সেখান থেকেই যৌথ ভাবে এই গবেষণার শুরু।

দুই বিজ্ঞানী ব্যাকটিরিয়ার এই জৈব প্রক্রিয়াকে নিয়ে এলেন গবেষণাগারের টেস্ট-টিউবে। ব্যাকটিরিয়ার নানা ধরনের আরএনএ- গুলির কাজ বুঝে নিয়ে নতুন নকশায় তৈরি করলেন গাইড আরএনএ— যে গুপ্তচর একাই জানে ডিএনএ-র একদম সঠিক ঠিকানা। এই আবিষ্কার যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা অল্প দিনের মধ্যেই বোঝা গেল। অন্য বিজ্ঞানীরা এর প্রয়োগ করলেন জীবিত কোষের ভিতরে। জেনেটিক কাঁচি দিয়ে প্রয়োজনমতো ডিএনএ কেটে ফেলা ও ইচ্ছেমতো অন্য ডিএনএ জুড়ে দেওয়ার গবেষণা শুরু হল বিশ্বজুড়ে।

ক্রিসপারকে নানা ধরনের কঠিন রোগের চিকিৎসার চাবিকাঠি বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। প্রযুক্তিও নানা নতুন উন্নতির পথে এগিয়ে চলেছে। বংশগত অন্ধত্ব এবং সিকল সেল অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি প্রয়োগ করা শুরু হয়েছে। চিকিৎসা ছাড়াও ক্রিসপারের প্রয়োগ করা হচ্ছে ফসলকে স্বাস্থ্যকর এবং খরা-সহনশীল করে তোলার কাজে।

ভারতেও ক্রিসপার নিয়ে গবেষণা পুরোদমে চলছে। নয়াদিল্লির ইনস্টিটিউট অব জেনোমিক্স অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলজি-তে দেবজ্যোতি চক্রবর্তী ও সৌভিক মাইতি গবেষণা করছেন এক নতুন ক্যাস৯ প্রোটিন নিয়ে, যেটি পাওয়া যায় ফ্রানসিসেল্লা নোভিসিডা নামক একটি ব্যাকটিরিয়া থেকে। এই নতুন ক্যাস৯-কে ওঁরা ব্যবহার করছেন রোগীর নাকের রস থেকে কোভিড-আরএনএ খুঁজে পাওয়ার কাজে। এমনকি এই প্রযুক্তির নামের সংক্ষিপ্ত রূপটিতেও রয়েছে বাঙালির প্রিয় গোয়েন্দা ফেলুদার নাম। ফেলুদা-র পুরো নাম এফএনক্যাস৯ এডিটর লিঙ্কড ইউনিফর্ম ডিটেকশন অ্যাসে।

যে কোনও নতুন আবিষ্কার যেমন আশার আলো দেখায়, তেমনই সঙ্গে নিয়ে আসে নানা নৈতিক প্রশ্ন। এর প্রয়োগের সীমারেখা কোথায় টানা হবে, তা নিয়ে চলছে বিজ্ঞান মহলে নানা বিতর্ক। তবে বিতর্ক যা-ই থাক, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, দুই মহিলার এই নোবেল জয় বিশ্বজুড়ে মেয়েদের বিজ্ঞানে উৎসাহিত করবে।

লেখক নয়াদিল্লির ইনস্টিটিউট অব জেনোমিক্স অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলজি-তে গবেষণারত

Nobel Prize Chemistry

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

ক্যানসেল করতে পারবেন আপনার সুবিধামতো

Best Value
প্রতি বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
প্রতি মাসে

৪২৯

১৬৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।