কলকাতা থেকে দিল্লি যাবেন? বিমান দু’-আড়াই ঘণ্টা লেগে যাবে। তবে অদূর ভবিষ্যতে এই ১৫০০ কিলোমিটার পথ পেরোতে ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের মতো লাগবে। না, কোন কল্পবিজ্ঞান নয়। ঘোরতর বাস্তব। এটা সম্ভব হাইপারলুপ প্রযুক্তিতে। কী এই হাইপারলুপ? সেটা জানার আগে, জানা দরকার কে এই হাইপারলুপের কথা প্রথমে বলেছিলেন?
২০১২। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে সানফ্রান্সিসকো বে এরিয়া পর্যন্ত দ্রতগামী বুলেট ট্রেন তৈরির কথা ভাবা হচ্ছে। এমন ভাবনায় বেজায় বিরক্ত এলন মাস্ক। কারণ, পরিবহণের এক ভিন্নতর ভাবনা তাঁর মাথায় খেলা করছে। প্রযুক্তির দুনিয়ায় যাঁকে সবাই চেনেন। ‘টেসলা’ নামের বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থা থেকে মহাকাশ যাত্রার জন্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট তৈরির ‘স্পেস এক্স’ সংস্থার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তিনি। তাঁর সেই ভাবনাটিই হল ‘হাইপারলুপ’। এর পাঁচটি বৈশিষ্ট্য থাকবে বলে ঘোষণা করেন মাস্ক। প্রথমত, এই পরিবহণ পরিবেশের অবস্থার উপরে নির্ভর করবে না। মানে, বৃষ্টি, ঝড় বা অন্য কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ একে প্রভাবিত করবে না। দ্বিতীয়ত, এই পরিবহণে দু’টি যানের মধ্যে ধাক্কা লাগার আশঙ্কা থাকবে না। তৃতীয়ত, যাত্রিবাহী বিমানের থেকে দু’গুণ গতিতে ছুটতে পারবে এই যান। চতুর্থত, এই গতিবেগ সত্ত্বেও শক্তির ব্যবহার কম হবে। এবং শেষ শর্তটি হল, অন্তত ২৪ ঘণ্টা যানটিকে চালানোর শক্তি যানেই মজুত থাকবে। কিন্তু কেন একে লুপ বলব? কারণ, এই যানটি ছুটবে টিউবের মধ্যে দিয়ে। মাস্ক-এর দাবি, টিউবের মধ্যে দিয়ে যানটি ঘণ্টায় ১,২০০ কিলোমিটার বেগেও যেতে পারে।
কী ভাবে কাজ করবে এই হাইপারলুপ? যানের যাতায়াতের পথে প্রধানত দু’টি বাধা কাজ করে। একটি হল ঘর্ষণের। অন্যটি বায়ুর বাধা। এই দু’টি বাধা সরিয়ে নিলে যানের গতিবেগ অনেক বেড়ে যাওয়া সম্ভব। এমনকি তত্ত্ব বলে, এমন অবস্থায় শব্দের থেকে কয়েক গুণ বেশি জোরেও ছুটতে পারবে যানটি। ঘর্ষণের বাধা দূর করতে যানটিকে শূন্যে ভাসমান অবস্থায় রাখতে হবে। আর বায়ুর বাধা দূর করতে যানটিকে এমন পথে নিয়ে যেতে হবে, যা বায়ুশূন্য বা প্রায় বায়ুশূন্য অবস্থায় রয়েছে। হাইপারলুপ-এর যানটির পোশাকি নাম পড। এই পডটিকে প্রায় বায়ুশূন্য স্টিলের টিউবের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পডটি একটি লাইনের উপরে থাকে। অনেকটা রেললাইনের মতো। কিন্তু পডটি যখন চলতে শুরু করে তখন লাইনের একটু উপরে উঠে আসে। ফলে ঘর্ষণজনিত বাধা থাকে না। পডটিকে এই উপরে তোলার কাজটি কয়েকটি প্রযুক্তির মাধ্যমে করা সম্ভব। কেউ চুম্বকের সাহায্য নিতে পারেন। যাতে চৌম্বক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পডটিকে লাইনের উপরে তুলে ধরা হবে। যেমন করে বুলেট ট্রেন চলে। আবার বাতাসের চাপকে কাজে লাগিয়েও পডটিকে লাইনের কিছুটা উপরে তুলে রাখা যায়। যেমন ভাবে কাজ করে হোভারক্র্যাফ্ট। দুই ক্ষেত্রেই পডটিকে টানতে, মানে মোটর চালাতে, বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। পডের মধ্যে থাকা ব্যাটারিতে সেই বিদ্যুৎ মজুত থাকে।
এই ভাবনাটি কিন্তু বেশ পুরনো। ১৭৯৯-এ লন্ডনের জর্জ মেডহার্স্ট এমন বায়ুশূন্য টিউবের মধ্যে ট্রেন নিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন। ১৯১০-এ বায়ুশূন্য পথ দিয়ে ট্রেন চলাচলের কথা ভেবেছিলেন রবার্ট গোডার্ট। প্রথম রকেট তৈরির কৃতিত্ব যাঁকে দেওয়া হয়। একে তখন বলা হত ভ্যাকুয়াম ট্রেন। রাশিয়ার বরিস ওয়েইনবার্গ ১৯০৯ সালে ভ্যাকুয়াম ট্রেনের একটি মডেলও বানান। তবে যাত্রীপরিবহণ না করলেও বায়ুশূন্য টিউবের মধ্যে দিয়ে জিনিসপত্র পাঠানোর ব্যবস্থা আগেও চালু ছিল। গ্রন্থাগারের মধ্যে বই এ-দিক ও–দিক নিয়ে যেতে এমন টিউব ব্যবহার হত। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত প্যারিসে বার্তা বিনিময়ের জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হত। নিউ ইয়র্কে ম্যানহাটন ও ব্রুকলিনের মধ্যে বার্তা বিনিময় করতে এমন ব্যবস্থা ছিল।
হাইপারলুপ তৈরিতে সবাইকে জড়িয়ে নিতে এলন মাস্ক একে ‘ওপেন সোর্স’ করে দিয়েছেন। ২০১৭ থেকে শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। এর জন্য ‘স্পেস এক্স’ ক্যালিফোর্নিয়ায় নিজের সদর দফতরে ১.৬ কিলোমিটার দীর্ঘ বায়ুশূন্য টানেল বানিয়েছে। যেখানে পডগুলিকে পরীক্ষা করা হবে। সম্প্রতি এই প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছিল আইআইটি মাদ্রাজের ‘সেন্টার ফর ইনোভেশন’-এর সদস্যেরা। ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিভিন্ন বিভাগের পড়ুয়ারাদের নিয়ে এই দলটি তৈরি হয়েছে।। তাঁদের তৈরি পডটির নাম ছিল ‘আবিষ্কার’। প্রথম চারটি দলের মধ্যে স্থান না পেলেও, তাঁদের কাজ দেখে বেশ খুশিই হয়েছেন এলন মাস্ক। কয়েকটি সংস্থা হাইপারলুপের কাজ বেশ খানিকটা এগিয়েও নিয়ে গিয়েছে। যেমন, ভার্জিন-এর ‘হাইপারলুপ ওয়ান’। লাস ভেগাসের বাইরে মরুভূমিতে পডের পূর্ণাবয়ব মডেল তৈরি করে পরীক্ষানিরীক্ষা করছে তারা। এদের সঙ্গে মহারাষ্ট্র সরকারের মউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। মুম্বই ও পুণের মধ্যে হাইপারলুপ তৈরির কথা ভাবা হচ্ছে। এতে দুই শহরের মধ্যে যাতায়াত করতে মাত্র ২০ মিনিট লাগবে। ‘হাইপারলুপ ট্রান্সপোর্টশন টেকনোলজি’ নামের লস অ্যাঞ্জেলসের একটি সংস্থা, টরোন্টোর ‘ট্রান্সপড’-এর মতো কিছু সংস্থাও হাইপারলুপ নিয়ে কাজ করছে। ভবিষ্যতে এদের কারও হাইপারলুপে আপনিও সওয়ার হতে পারেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy