সৌর-মুলুকে ‘পার্কার সোলার প্রোব’। ছবি সৌজন্যে: নাসা।
সূর্যের অতটা কাছে গিয়ে অবাক করা কাণ্ডকারখানা দেখল নাসার মহাকাশযান ‘পার্কার সোলার প্রোব’। দেখল সূর্যের নানা রকমের ক্ষ্যাপামি! এমন সব ঘটনা দেখল, যা কস্মিন কালেও কেউ ভাবতে পারেননি।
পার্কার সোলার প্রোব যে সব ঘটনা চাক্ষুষ করেছে, তা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার’-এর চারটি গবেষণাপত্রে। ২০১৮-র ১২ অগস্ট সৌর অভিযানে রওনা হয় নাসার মহাকাশযান পার্কার সোলার প্রোব। আর এক বছরের মধ্যেই ভারতের প্রথম সৌর অভিযান। ‘আদিত্য-এল-ওয়ান’ যাবে সূর্যের মুলুকে। নাসার মহাকাশযান যে সব অবাক করা কাণ্ডকারখানার হদিশ পেল প্রথম, সেগুলি সৌর-মুলুকে ইসরোর মহাকাশযানের খুব কাজে লাগবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
কী সেই অবাক কাণ্ডকারখানা?
দেখা গেল, সূর্য থেকে বেরিয়ে এই সৌরমণ্ডলে পৃথিবী-সহ অন্য গ্রহগুলির দিকে ছুটে আসতে আসতে হঠাৎই ‘মতিভ্রম’ হয় সৌরবায়ু বা সোলার উইন্ডের। সেগুলি আবার উল্টোমুখে সূর্যের দিকেই ছুটে যায়। তার পর খামখেয়ালে ইলেকট্রন, প্রোটনের মতো খুব ছোট ছোট কণাদের নিয়ে সে আবার ছুটে আসতে শুরু করে অন্য গ্রহগুলির দিকে। সেকেন্ডে ৯০০ কিলোমিটার বা তারও বেশি গতিবেগে। যখন তার তাপমাত্রা থাকে ১০ লক্ষ ডিগ্রি কেলভিন।
এও দেখল, সৌরবায়ুর এই খামখেয়ালিপনা সূর্যের সর্বত্র এক রকম ভাবে হয় না। কোথাও তা বেশি দেখা যায়। কোথাও বা কম।
যা যা দেখল নাসার মহাকাশযান, একঝলকে দেখুন নাসার ভিডিয়োয়
সূর্যের মনের অন্দরে কী গোপন কথা লুকিয়ে রয়েছে, সেই রহস্য জানার চেষ্টা তো বিজ্ঞানীরা চালিয়ে যাচ্ছেন কয়েক শতাব্দী ধরেই। কিন্তু সৌরবায়ুর এই খামখেয়ালিপনার কথা এর আগে জানা তো দূরের কথা, বিজ্ঞানীরা কখনও ভাবতেই পারেননি।
সূর্যকে কেন্দ্র করে অসম্ভব জোরে ঘুরছে সৌরবায়ু
সূর্যের অত কাছে গিয়ে নাসার মহাকাশযান এও দেখল, নিজের কক্ষপথে যখন সূর্য ঘুরছে, তখন তার থেকে বেরিয়ে আসার সময় সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে সৌরবায়ুও। ওই ভাবে ঘুরতে ঘুরতেই সূর্য থেকে ছিটকে বেরিয়ে সৌরবায়ু ছুটে আসতে শুরু করে সৌরমণ্ডলের বিভিন্ন প্রান্তে। বিভিন্ন গ্রহ, উপগ্রহে।
সৌরবায়ুর খামখেয়ালিপনা
কোনও ধুলোকণা নেই সূর্যের কাছের একটি জায়গায়!
পার্কার সোলার প্রোবই প্রথম দেখল, সূর্যের কাছাকাছি এমন একটা এলাকা রয়েছে, যেখানে কোনও ধুলোবালি নেই। যাকে বলা যায় একেবারেই ‘ডাস্ট-ফ্রি জোন’। এত দিন বিজ্ঞানীরা জানতেন, ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে মহাজাগতিক ধূলিকণা (কসমিক ডাস্ট)। এই প্রথম দেখা গেল, সূর্যের কাছাকাছি এমন জায়গাও রয়েছে, যেখানে টিঁকে থাকার সাহস পায় না মহাজাগতিক ধূলিকণারাও। সূর্যের তাপ তাদের জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেয়। তার ফলে, সূর্যের কাছাকাছি সেই এলাকা একেবারেই হয়ে পড়ে ধুলোকণাহীন।
সূর্যের এই এলাকায় নেই এমনকী, মহাজাগতিক ধূলিকণাও
ক্ষ্যাপাটে সৌরবায়ু আচমকা উল্টোমুখী হয়ে ছোটে সূর্যের দিকে!
মোহনপুরের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার-কলকাতা)’-এর অধ্যাপক বিশিষ্ট সৌরপদার্থবিজ্ঞানী দিব্যেন্দু নন্দী বলছেন, ‘‘সবচেয়ে অবাক করা ঘটনা সৌরবায়ুর আচমকা উল্টোমুখী হয়ে পড়ার ঘটনা। যাকে ‘সুইচব্যাক’ বলা হচ্ছে। এর আগে পৃথিবীর কাছাকাছি এলাকা থেকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমাদের যেটুকু জানা ছিল, তা হল; সৌরবায়ু সূর্য থেকে বেরিয়ে শুধুই সৌরমণ্ডলের বিভিন্ন প্রান্তের দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তার একটাই গতিমুখ। কিন্তু এ বার দেখা গেল, আমাদের ধারণায় খামতি ছিল। সৌরবায়ু উল্টোমুখীও হয়। তা এক সময় সূর্যের দিকে ছুটে যায়। তার পর আবার বেরিয়ে এসে ছুটতে শুরু করে সৌরমণ্ডলের বিভিন্ন প্রান্তে।’’
নাসার মহাকাশযানের ‘দর্শনে’ যা যা ধরা পড়েছে, তার মধ্যে আরও একটা জিনিস অবাক করে দিয়েছে সৌরপদার্থবিজ্ঞানীদের।
কোথাও ফিনকি দিয়ে বেরচ্ছে সৌরবায়ু!
নৈনিতালের ‘আর্যভট্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অফ অবজারভেশনাল সায়েন্সেস (অ্যারিস)’-এর অধিকর্তা বিশিষ্ট সৌরপদার্থবিজ্ঞানী দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘দেখা গিয়েছে, সূর্যের কোথাও সৌরবায়ু বইছে অনেক ধীর গতিতে। আবার কোথাও তা অনেক বেশি জোরালো। যেন ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে কোনও কোনও জায়গা থেকে। এটা কেন হচ্ছে, কেনই বা সৌরমণ্ডলের দিকে ছুটে আসতে আসতে হঠাৎই গতিমুখ বদলিয়ে সৌরবায়ু কখনও কখনও ছুটে যায় সূর্যের দিকে, তার কারণ এখনও আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। তবে এই ঘটনা সূর্যের পিঠের চেয়ে বায়ুমণ্ডলের (করোনা) তাপমাত্রা একলাফে কয়েক লক্ষ গুণ বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারে।’’
সূর্যের করোনাকে কী ভাবে দেখেছে নাসার মহাকাশযান? দেখুন ভিডিয়ো
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ঘটনা সৌরবায়ুর গতিবেগ বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা নিতে পারে। দিব্যেন্দুর কথায়, ‘‘অনেকটা সেই নদীর মতো উৎস থেকে দূরে যাওয়ার পরেও হঠাৎ যার গতিবেগ অনেকটা বেড়ে যায়।’’
সূর্যের ঘূর্ণন-গতি কমছে অনেক বেশি হারে
সূর্য থেকে বেরিয়ে আসার সময় সূর্যের সঙ্গে সৌরবায়ু যে গতিতে ঘুরতে পারে বলে এত দিন ধারণা ছিল সৌরপদার্থবিজ্ঞানীদের, সেটাও আমূল বদলে দিয়েছে নাসার মহাকাশযানের ‘দর্শন’। পার্কার সোলার প্রোব দেখেছে, বেরিয়ে আসার প্রাক মুহূর্তে সূর্যের সঙ্গে অনেক বেশি জোরে ঘোরে সৌরবায়ু। তার পর উল্লম্ব ভাবে বেরিয়ে পড়ে সৌরমণ্ডলের উদ্দেশে।
দিব্যেন্দু জানাচ্ছেন, এর ফলে বোঝা যাচ্ছে, প্রায় ৫০০/সাড়ে ৫০০ কোটি বছর ধরে নিজের কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে সূর্যের ঘূর্ণন-গতি (স্পিন) যে হারে কমে আসছে বলে ভাবা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত হারে তা কমে আসছে। এর ফলে, এটাও বোঝা সহজতর হবে, পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির অনুকুল পরিবেশ তৈরি করার জন্য সেই সুদূর অতীতে সূর্য কতটা শক্তিশালী ছিল।
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy