বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং যে দিন প্রয়াত হলেন, সেই দিনটা ছিল ১৪ মার্চ, আইনস্টাইনের জন্মদিন। কিন্তু প্রত্যেক বছর ওই দিনটায় ইন্টারনেটে গুগল-এর পাতাটা খুললে আইনস্টাইন বা হকিং-এর ছবি ছাড়াও যা দেখা যায়, তা হল বৃত্তাকার একটা প্যানকেক-এর ছবি আর কতকগুলো সংখ্যা। যারা স্কুলের একটু উঁচু ক্লাসে উঠেছে, তারা চিনতে পারে— ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা সংখ্যাগুলো সাজিয়ে নিলে হয় ৩.১৪। গণিতে এই ৩.১৪ হল একটি বিশেষ (রাশির) মান, যা একটি গ্রিক অক্ষর দিয়ে বোঝানো হয়, সেটা হল ‘পাই’ ()। অর্থাৎ, পাই শুধু একটা অক্ষর নয়, একটা বিশেষ সংখ্যাকে বোঝায়। ১৪ মার্চ তারিখটাকে যদি ৩/১৪— এ ভাবে লেখা যায়, তা হলে তা ওই পাই সংখ্যাটির মানের মতো দেখায়, তাই ১৪ মার্চ হল ‘পাই-ডে’। সুতরাং, বিশ্ব জুড়ে এই দিনটায় নানা রকম ভাবে পাই-এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটাই ঝালিয়ে নেওয়া হয়। তবে যাঁরা অঙ্ক নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন, এই উৎসাহ তাঁদের মধ্যেই বেশি।
এর থেকে বোঝা গেল যে, পাই আমাদের কাছে এতই গুরুত্বপূর্ণ একটা সংখ্যা যে, আইনস্টাইনের মতো আইকনকেও পাই-এর জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। কথাটা সত্যি। সরলরেখার সরল হিসেব থেকে যে-ই আমরা বাঁকা পথে, মানে বক্ররেখার পথে যাই, ত্রিভুজ-চতুর্ভুজ থেকে যে-ই বৃত্তের পরিধি বা ক্ষেত্রফল বার করতে যাই, তখনই এই বিশেষ রাশির সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। বৃত্তের পরিধির মাপ হল, পাই ও ব্যাসের গুণফল। আর ক্ষেত্রফল হল, পাই ও ব্যাসার্ধের বর্গের গুণফল। অর্থাৎ, যে কোনও বৃত্তের ক্ষেত্রেই পরিধির সঙ্গে ব্যাসের মাপের যে অনুপাত, সেটাই হল পাই। আবার ইংরেজিতে পাই মানে পিঠে, যার আকার গোল। তাই পাই-ডে’র ছবিতে ৩.১৪-র সঙ্গে বৃত্তাকার পিঠে ঘুরেফিরে আসে।
এই পর্যন্ত আমাদের মোটামুটি জানা। কিন্তু, পাই বিষয়ে আরও অনেক কিছুই আমাদের জানার আছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর গণিতবিদ উইলিয়াম জোন্স প্রথম বৃত্তের জ্যামিতিতে পাই-কে ঢুকিয়ে নেন। গ্রিক শব্দ ‘পেরিফেরিয়া’, যার অর্থ হল পরিধি, তার প্রথম অক্ষর পি। গ্রিকে লিখলে ‘পাই’; এখান থেকেই গণিতে পাই-এর ঢুকে পড়া। তবে আমরা যে ভাবে ৩.১৪ লিখি, পাই-এর মান মোটেই অত সরল ব্যাপার নয়। বরং, পাই-এর মান ঠিক ভাবে বার করা নিয়েই রয়েছে অনেক কাহিনি।
আর্কিমিডিস নামটি বললেই আমাদের মনে আসে আপেক্ষিক গুরুত্ব বার করার কথা, আর সেই ‘ইউরেকা! ইউরেকা!’ বলতে বলতে রাস্তা ধরে দৌড়। কিন্তু পাই-এর মান কত হতে পারে, তা নিয়ে প্রথম যুক্তিগ্রাহ্য কাজও করেছিলেন এই গ্রিক বিজ্ঞানী। ওঁর দেখানো পদ্ধতিতে কাজ করেই পাই-এর মান ক্রমাগত নিখুঁত ভাবে বার করা সম্ভব হচ্ছে।
আমরা আগেই দেখেছি, যে কোনও বৃত্তের ক্ষেত্রে পরিধি হল পাই ও ব্যাসের গুণফল। তা হলে যে বৃত্তের ব্যাস হল ১ একক, তার ক্ষেত্রে পরিধির মাপই হল পাই-এর মাপ। কিন্তু বৃত্তের পরিধি তো সরলরেখা নয়, তাই এর মাপ কী করে পাওয়া যাবে? আর্কিমিডিস দেখালেন, যদি বৃত্তের পরিধিকে ছুঁয়ে বৃত্তের ভিতরে একটা আর বাইরে একটা বর্গ আঁকা যায়, তা হলে বৃত্তের পরিধিটা হবে ভিতরের বর্গের পরিসীমার চেয়ে বেশি, আর বাইরের বর্গের পরিসীমার চেয়ে কম।
পরিমিতির প্রাথমিক জ্ঞান থেকে এটা সহজেই বার করে ফেলা যায় যে, ব্যাসকে (১ একক) কর্ণ ধরে বৃত্তের ভিতরে যে বর্গ আঁকা হয়, তার এক-একটা বাহু ১/২, আর পরিসীমা ৪/২, মানে ২.৮৩। আর বাইরের বর্গের এক-একটা বাহু হল বৃত্তের ব্যাস, মানে ১ একক; পরিসীমা হল ৪। তার মানে পাই-এর মান, এই ২.৮৩-এর চেয়ে বেশি, কিন্তু ৪-এর চেয়ে কম। আজ ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে এই আবিষ্কারকে নিয়ে আমাদের বিশেষ মাথাব্যথা নেই, কারণ আমরা জানি পাই-এর মান আসলে ৩.১৪। কিন্তু সেই খ্রিস্টপূর্ব ২২০-২২৫ অব্দে (আর্কিমিডিসের আয়ুষ্কাল ২৮৭-২১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), যখন গণিতের আধুনিক কলাকৌশল কিছুই জানা ছিল না, তখন স্রেফ ধারণার জোরে হাতে লম্বা লম্বা অঙ্ক কষে যিনি এই উদ্ভাবন করেছিলেন, তাঁর কৃতিত্বের মূল্যায়ন বোধ হয় আজকের দিনে সম্ভবই নয়।
যা-ই হোক, আর্কিমিডিসের এই নিয়মের মজা হল যে, এটা কেবল প্রাথমিক একটা হিসেব; রাস্তাটা শুধু দেখিয়ে দেওয়া, যে রাস্তা ধরে অনেক দূর যাওয়া যাবে। মানে হল, এই পদ্ধতিটাকে ক্রমাগত সংশোধন করে পাই-এর মান নির্ণয়ের সীমাটা ক্রমাগত কমিয়া আনা যাবে। কী ভাবে? বৃত্তের ভিতরে আর বাইরে যে দুটো ক্ষেত্রের পরিসীমার সঙ্গে তুলনা করে পরিধির (অর্থাৎ, পাই-এর) মান বার করা হচ্ছে, তাদের বাহুর সংখ্যা যত বাড়বে, অর্থাৎ যদি চতুর্ভুজের জায়গায় ষড়ভুজ বা অষ্টভুজ বা আরও বেশি সংখ্যক বাহুবিশিষ্ট ক্ষেত্র নেওয়া হয়, বৃত্তের বহিঃস্থ আর অন্তঃস্থ ক্ষেত্রের পরিসীমার মান ততই কাছাকাছি আসবে। আর পাই-এর মানও তত নির্দিষ্ট ভাবে মাপা যাবে। কারণ, যে কোনও বক্ররেখাকে (যেমন, বৃত্তের পরিধি) আসলে অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সরলরেখা দিয়ে তৈরি বলে মনে করা হয়; তাই বৃত্তের বহিঃস্থ ও অন্তঃস্থ বহুভুজের বাহুর সংখ্যা যত বেশি হবে, ততই তারা বৃত্তের পরিধির কাছাকাছি যাবে, ও এক সময় দুটো বহুভুজ ও বৃত্ত সমাপতিত হয়ে যাবে। তখন পাইয়ের একটিই মান পাওয়া যাবে। ষড়ভুজ নিলে পাই-এর মানের সীমা ৩.০০ আর ৩.৪৬৪-র মধ্যে নেমে আসে। আর্কিমিডিস নিজেই ৯৬ বাহুবিশিষ্ট বহুভুজের সঙ্গে তুলনা করে পাই-এর মানের সীমা কমিয়ে ৩.১৪১ আর ৩.১৪৩-র মধ্যে এনে ফেলেছিলেন। পরবর্তী কালে বহুভুজের বাহুর সংখ্যা বাড়িয়ে পাইয়ের মানের সীমা আরও কমিয়ে আনা গিয়েছে। ৫০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চিনা গণিতজ্ঞ সু ছংচি ১২,২৮৮ বাহুবিশিষ্ট বহুভুজ ধরে গণনা করে পাই-এর মান ৩.১৪৫৯২৬ আর ৩.১৪৫৯২৭-এর মধ্যে নামিয়ে এনেছেন। এখানে একটা কথা মনে করিয়ে দিই। ‘পাই-এর মান’ কথাটা প্রকৃত অর্থে ঠিক নয়, পাই নিজেই একটা সংখ্যা, যে সংখ্যাটা নিয়েই এই আলোচনা; কিন্তু বোঝানোর সুবিধার জন্য বিষয়টাকে ‘পাই-এর মান’ এই ভাবে লেখা হয়েছে।
এত ক্ষণে এটা পরিষ্কার, পাই মোটেই ৩.১৪-এর মতো একটা সহজ সংখ্যা নয়। হ্যাঁ, এটাই পাই-এর মজা বা সমস্যা, যে ভাবে দেখা যায়। এর মান নির্দিষ্ট তো নয়ই, আবার সংখ্যাটার শেষও পাওয়া যায়নি আজ অবধি। আমরা পাই-কে ২২/৭ বা ৩.১৪ হিসেবে লিখলেও আসলে সেই সংখ্যাটা শেষ পর্যন্ত লিখি না, দশমিকের পর দুই বা তিন ঘর অবধি লিখে ছেড়ে দিই। কিন্তু জটিলতম গণনায় এবং শেষমেশ কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে ৩.১৪১৫৯২৬৫৩৫৮৯৭৯৩২৩৮৪ এই ভাবে দশমিকের পর কয়েক কোটিতম স্থান অবধি গুণেও এর শেষ পাওয়া যায়নি, এমনকি সংখ্যাগুলোর মধ্যে কোনও বিন্যাসও (যেটা পৌনঃপুনিকের ক্ষেত্রে পাওয়া যায়) দেখা যায়নি। তাই সে দিক থেকেও পাই গণিতজ্ঞদের কৌতূহল জাগিয়ে রেখেছে। তবে পাই-এর মান এত দূর অবধি গুনে যাওয়ার যে খুব বাস্তব দরকার আছে, এমনও নয়, এটা একেবারেই বিশুদ্ধ গাণিতিক কৌতূহল।
আর ঠিক এই কারণেই ফার্মা-র শেষ প্রতিপাদ্য-র মতো পাই-ও নানা ভাবে গল্পে, ছড়ায়, রসিকতায় ঘুরেফিরে এসেছে। সবচেয়ে চালু রসিকতা হল, কেউ ‘পাই-আর-স্কোয়্যার’ (বৃত্তের ক্ষেত্রফল যে হেতু পাই ও ব্যাসার্ধের বর্গের গুণফল) বললেই তাকে বলা হয় ‘পাই (পিঠে) ইজ় নট স্কোয়্যার, ইট ইজ় রাউন্ড!’ এক বার রাজনীতিতেও জুড়ে গিয়েছিল পাই। ১৮৯৭ সালে ইন্ডিয়ানায় ‘পাই-বিল’ এর প্রস্তাবনা হয়েছিল, যাতে পাই-এর মান ৩.২ ধরা হবে, এমন দাবি করা হয়েছিল। যদিও শেষ অবধি সে দাবি খারিজ হয় এক গণিতবিদের মধ্যস্থতায়। এই ঘটনা মনে রেখে অধ্যাপক হার্ভে এল কার্টার এক লিমেরিক লিখেছিলেন, যার কাছাকাছি বাংলা করলে এই রকম দাঁড়ায়, “এইটা আমার সবচেয়ে বড় সাধ/ পাই-এর মানে চাই না কোনও খাদ/ মানটা হবে ঠিক তিন/ এই কথাটা লিখে নিন/ দশমিক এক-চার-পাঁচ-নয়... বাদ!
এক জনপ্রিয় ধারাবাহিকে দেখানো হয়েছিল, কোনও এক আলোচনাসভায় বিজ্ঞানীরা যখন সবাই খুব উত্তেজিত হয়ে কথাবার্তা বলছেন, কিছুতেই তাঁদের চুপ করানো যাচ্ছে না, তখন তাঁদের থামাতে সঞ্চালক এই কথাটা বলছেন যে, “শুনুন পাই-এর মান ঠিক তিন!” অমনি সবাই চুপ করে গেলেন। যে পাই নিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে তিনের পরে হাজার হাজার সংখ্যা বসিয়ে যাওয়া হল, তার মান শুধু তিন— এর চেয়ে বড় চমক আর বিজ্ঞানীদের কাছে কী-ই বা হতে পারে! এটাই পাই-এর ম্যাজিক। তাই ১৪ মার্চ দু’জন গাণিতিক তারকার সঙ্গে জড়িয়ে গেলেও ‘পাই-ডে’র আবেদন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
সিস্টার নিবেদিতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy