Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
সংক্রমণের বিচিত্র পথ
Exotic Animal

বন্যপ্রাণী খাবারের প্লেটে, তা থেকেই কি মারণ রোগবালাই?

অন্য প্রাণীর দেহ থেকে লাফ দিয়ে ভাইরাস ও অন্যান্য সংক্রামক জীবাণুর মানুষের দেহে ঢুকে পড়াকে বলা হয় ‘জুনোটিক ট্রান্সফার’।

সুমন প্রতিহার
শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২০ ০৩:০২
Share: Save:

সালটা ১৯৯৬। কঙ্গোর ইভিন্দো নদীর দক্ষিণ পাড়ে ১৫০ জনের বসবাস। জঙ্গল ঘিরে বাস করা এই জনগোষ্ঠী শিকার করে প্রায়শই। এক সকালে এক দল শিকারি কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে তারা একটা শিম্পাঞ্জিকে মেরে ফেলে। তার পর একত্রে রান্নাবান্না। কিন্তু ওই দলের কেউই আর রক্ষা পেল না। ৩৭ জনের মধ্যে ২১ জনই মারা গেল। অনেকেরই খাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সাংঘাতিক জ্বর এল। সে দিনের ঘাতকের নাম ইবোলা ভাইরাস। আমাদের পূর্বপুরুষ গোরিলা, শিম্পাঞ্জি, বাঁদর-সহ হাজারো স্তন্যপায়ী মারণ ভাইরাসের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে কাজ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষ বেশ নতুন সদস্য। শিম্পাঞ্জি, বাঁদর, গোরিলা ও অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীরা পৃথিবীতে এসেছে মানুষের অনেক আগে। সেই হিসেবে দেখতে গেলে এরা সবাই আমাদের পূর্বপুরুষ। এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে রোগের ইতিহাস ও গতিপ্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করা অধ্যাপক থমাস গিলেস্পি বলছেন, মানুষ ও বন্যপ্রাণীর মধ্যে প্রাকৃতিক সুরক্ষার লক্ষণরেখা ছিল। সেই বর্ম ভেঙে এখন প্রাণঘাতী পরজীবী ও ভাইরাসের কাছে ক্রমশ বেআব্রু হচ্ছে মানুষ। অন্য প্রাণীর দেহ থেকে লাফ দিয়ে ভাইরাস ও অন্যান্য সংক্রামক জীবাণুর মানুষের দেহে ঢুকে পড়াকে বলা হয় ‘জুনোটিক ট্রান্সফার’। গত কয়েক বছরে যত ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে, তা এই কারণেই।

ব্যাঙ্কক শহরের চাতুচাক পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জীবিত বন্যপ্রাণের বাজার। আফ্রিকার বেড়াল, সাহারার খ্যাঁকশেয়াল, আমেরিকার বাঁদর মার্মোসেট, সাপ-সহ হরেক প্রাণীর মাংস পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ১৯৬০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ৩৩৫টি রোগে বিধ্বস্ত হয়েছে সভ্যতা, যার মধ্যে ৬০ শতাংশই বন্যপ্রাণীদের থেকে এসেছে।

আপাতনিরীহ একটা প্রাণী পিপীলিকাভুক বা প্যাঙ্গোলিন। এদের গোটা শরীরে আর লেজে আঁশের বর্ম আছে, যা সাপ ও মাছের থেকে আলাদা। সেই বর্ম কেরাটিন দিয়ে তৈরি। কেরাটিন হল সেই প্রোটিন, যা দিয়ে নখ ও চুল তৈরি হয়। পৃথিবীতে মাত্র আটটি প্রজাতির পিপীলিকাভুক দেখা যায়— চারটি আফ্রিকায়, চারটি এশিয়ায়। চিনের চিরাচরিত দেশজ ওষুধ বা ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের ঠেলায় আজ তারা সপরিবারে নির্মূল হতে বসেছে। আট কোটি বছরের পুরনো এই প্রাণের বেঁচে থাকাটা এখন মানুষের উপরেই নির্ভরশীল। এদের শরীরের কেরাটিনের বর্মেও মানুষের লোভাতুর দৃষ্টি। ১০০ কিলোগ্রাম আঁশের জন্য মারা পড়ে দু’হাজার প্যাঙ্গোলিন, মোট সংখ্যাটা বছরে প্রায় ২৭ লক্ষ। মারার পর তাকে সেদ্ধ করে গায়ের আঁশগুলি ছাড়িয়ে শুকিয়ে নেওয়া। তার পর গুঁড়ো করে বিক্রির বন্দোবস্ত। এই প্রাণীগুলোর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশ কম, প্রায়শই শ্বাসকষ্ট আর আলসারে ভোগে। আত্মরক্ষার জন্য বড় নখ ছাড়া বিশেষ কোনও ব্যবস্থা নেই। চিনা ওষুধ তৈরিতে বেড়াল, রেকুন কুকুর, ইঁদুর সব কিছুরই ব্যবহার আছে। প্যাঙ্গোলিনের আঁশ থেকে হজম, গনোরিয়া, হৃদ্রোগ, কুষ্ঠ, জলবাহিত রোগ, কোমরের ব্যথা, এমনকি মানসিক রোগেরও চিকিৎসাও করা হয়। ধারালো নখগুলোও জাদুবিদ্যার কাজে লাগে। এদের ফুসফুস বার করে নিয়ে হাঁপানির ওষুধ, পাকস্থলি ব্যবহার করে পেটের কৃমির ওষুধ, রক্ত দিয়ে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার উপায় কল্পনা করেছে মানুষ!

পশু ভক্ষণের ফলেই করোনাভাইরাস মানুষের দেহে ছড়িয়েছে, সেটির জোরদার প্রমাণ না থাকলেও সেই আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ‘নেচার মেডিসিন’-এ গত ১৭ মার্চ প্রকাশিত গবেষণা বলছে, ল্যাবরেটরিতে নয়, ২০১৯-এর নভেম্বরের শেষ দিকে প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি হয়েছে এই ভাইরাস। সম্ভবত নভেম্বরের শেষে এই ভাইরাসগুলো চিনে বাদুড়ের দেহ থেকে প্যাঙ্গোলিন হয়ে মানুষে সংক্রমিত হতে শুরু করেছিল। অর্থাৎ, শুরু হয়েছিল জুনোটিক ট্রান্সফার। এই ঘটনার প্রথম ধাপেই ভাইরাসটি মানুষের দেহে মারণ পরিবর্তনগুলো ঘটিয়ে নিয়েছিল। চিন হিসেব করেছে, খামারে বাঘ প্রতিপালনের খরচ ৭,০০০ মার্কিন ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা), কিন্তু চোরাশিকারে খরচ ২০ মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় মাত্র ১,৫০০ টাকা। শুধু চিনেই চোরাবাজারের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। ভাইরোলজিস্ট ব্রায়ান বার্ড বলছেন, ভাইরাসগুলো যে ভাবে দ্রুত হারে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে আমাদেরও খুব তাড়াতাড়ি এর উত্তর খুঁজতে হবে। উত্তরগুলো হবে নিজেদের ব্যবহারিক ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে, এবং পরিবশমুখী লগ্নিতে।

রেড-ক্যাপড ম্যাঙ্গাবে নামে এক বাঁদরের দেহ থেকে শিম্পাঞ্জিদের দেহে যায় সিমিয়ান ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস। তার পর তা মানুষের দেহে হিউম্যান ইমিউনো ভাইরাস নামে মারণ ভাইরাস হয়ে ওঠে— এডস রোগ সংক্রমণ শুরু হওয়ার এটিই সবচেয়ে প্রচলিত তত্ত্ব। যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, সিফিলিস, গুটিবসন্ত, হাম ইত্যাদি রোগ উৎপত্তিগত ভাবে বন্যপ্রাণীর সঙ্গে জড়িত। চিনে বন্যপ্রাণ নিধন ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে। আমাজন জঙ্গলের ১০০ গ্রাম ওজনের সেই ছোট্ট বাঁদর বিপন্ন প্রাণীর তালিকায়— ১,০০০ মার্কিন ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ৭৫০০০ টাকা) বিক্রি হচ্ছে। বিপন্ন প্রজাতির বেড়াল জাতীয় প্রাণী লিংস-এর দাম ৮,০০০ মার্কিন ডলার (প্রায় ছ’লক্ষ টাকা)। চিনে হাতির দাঁতের ৯০ শতাংশই চোরাচালান।

পশ্চিম আফ্রিকার ক্যামেরুনের দিকে তাকানো যাক। সেখানে প্রতি বছর প্রায় তিন হাজার গোরিলাকে মারা পড়তে হয় মাংসের জন্য। এটা একটা বিরাট চক্র— গোরিলা পিছু দক্ষ ও অদক্ষ চোরাশিকারির আয় তিন থেকে এগারো হাজার টাকা, পাইকারি বাজারে দাম আট হাজার এবং মধ্যস্বত্বভোগীর আয় আঠেরো হাজার টাকা। এর ফলে ক্যামেরুনে এখন গোরিলার সংখ্যা মাত্র এক হাজার। কঙ্গোয় এখনও ৩৫ হাজার শিম্পাঞ্জির বড় দল বেঁচেবর্তে আছে। কিন্তু প্রতি বছরই প্রায় ৪৫০ শিম্পাঞ্জিকে ভক্ষণ করছে মানুষ। তাদের বাচ্চারা জঙ্গলে অনাথ। শিম্পাঞ্জি এমনিতে অত্যন্ত নিরীহ, মূলত গাছপালা খেয়ে বাঁচে। প্রয়োজনে লাল মাথা বাঁদর বা রেড-ক্যাপড ম্যাঙ্গাবে-কে শিকার করে। শিকার করা বাঁদরের খুলি ফুটো করে নরম মাংস থেকে প্রয়োজনীয় ভিটামিন এ, বি টুয়েলভ ও খনিজ পায় শিম্পাঞ্জি। এ ছাড়াও, শিম্পাঞ্জির পছন্দ স্নেহপদার্থ-ভর্তি যকৃৎ। একটা মাঝারি মাপের শিম্পাঞ্জি থেকে তিন কিলোগ্রাম মাংস পাওয়া যায়।

খাদ্যতালিকা থেকে সাপও বাদ পড়েনি। একটা গোটা র্যাটল স্নেক বা ঝুনঝুনি সাপ ওজন অনুযায়ী ৪,০০০ থেকে ৪০,০০০ টাকায় বিক্রি হয়। এই সাপের মাংসই সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয়। চিনের মানুষ শেয়াল, কুমির, ইঁদুর, এমনকি জ্যান্ত নেকড়ে শিশুও খেয়ে ফেলছে। বাঁদরের মাথায় ছোট গর্ত করে নরম মাংস পরম তৃপ্তি সহকারে ভক্ষণ করছে। আফ্রিকার বহু জনগোষ্ঠীর কাছে হাতির মাংসের পাশাপাশি শুঁড় এবং জিভ মহার্ঘ্য। মহিষের কুঁজ বা ষাঁড়ের জিভও বহু জনগোষ্ঠীর রসনা তৃপ্ত করে।

২০১৫ সালে একটা টক শোয়ে বিল গেটস বলেছিলেন, ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া মহামারিই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। চার বছরের মাথায় নোভেল করোনাভাইরাসের আত্মপ্রকাশে তা মিলেও গেল। গেটস কতগুলো আপৎকালীন উপায়ের কথাও বলেছিলেন। যেমন, আক্রান্তদের মধ্যে যাঁরা সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তাঁদের রক্ত নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে ফের নতুন আক্রান্তের মধ্যে চালান করা দরকার। কেননা, সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তির মধ্যে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি গড়ে উঠেছে। দক্ষ চিকিৎসক ও কর্মিবৃন্দ, যাঁরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই চালাবেন, তার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছিলেন গেটস। শেষ বার ইবোলা মহামারিতে এই দল তৈরি করতেই অনেকটা সময় চলে গিয়েছিল। তাই তাঁর মতে, দরকার কুইক অ্যাকশন মেডিক্যাল মিলিটারি টিম, যারা তৎক্ষণাৎ অসুখের এপিসেন্টার বা ভরকেন্দ্রে গিয়ে সংক্রমণকে ঘিরে ফেলতে পারবে।

তবে মূল সমস্যা কোথায়? ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন-এর অধ্যাপক জন কেটস বলছেন, “অর্থনৈতিক উন্নয়নের গোপন মূল্য মানুষ দিতে শুরু করেছে মাত্র।” অভিশাপ পূর্বপুরুষের।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy