Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

পাখির পালকের মতো নামবে চন্দ্রযান-২

সাধারণ ভাবে চাঁদের অন্যান্য স্থানের তুলনায় দক্ষিণ মেরু এলাকায় অবতরণ করা দুরূহ। দক্ষিণ মেরু এলাকা দুর্গম, বন্ধুর, ছোটবড় ক্রেটার আর নিম্নভূমিতে পূর্ণ। রয়েছে উঁচু পাহাড়-পর্বত, ঢালু জমি, গভীর খাদ।

যাত্রাশুরু: অন্ধ্রপ্রদেশে শ্রীহরিকোটায় সতীশ ধওয়ন মহাকাশ কেন্দ্র, ২২ জুলাই, ২০১৯

যাত্রাশুরু: অন্ধ্রপ্রদেশে শ্রীহরিকোটায় সতীশ ধওয়ন মহাকাশ কেন্দ্র, ২২ জুলাই, ২০১৯

তপন কুমার বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৯ ০০:০৭
Share: Save:

এখন চাঁদের চারদিকে ঘুরছে চন্দ্রযান-২। তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ৭ সেপ্টেম্বর চাঁদের দক্ষিণ মেরু এলাকায় ম্যানজিয়াস-সি এবং সিম্পেলিয়াস-এন ক্রেটারের মাঝের মোটামুটি সমতল এক উচ্চভূমিতে পালকের মতো ধীরে নামবে ল্যান্ডার বিক্রম এবং রোভার প্রজ্ঞান। সোভিয়েট ইউনিয়ন, আমেরিকা, চিনের পর ভারত হবে বিশ্বের চতুর্থ দেশ, যারা চন্দ্রপৃষ্ঠে মহাকাশযান ধীরে অবতরণ করাতে সক্ষম হবে।

সাধারণ ভাবে চাঁদের অন্যান্য স্থানের তুলনায় দক্ষিণ মেরু এলাকায় অবতরণ করা দুরূহ। দক্ষিণ মেরু এলাকা দুর্গম, বন্ধুর, ছোটবড় ক্রেটার আর নিম্নভূমিতে পূর্ণ। রয়েছে উঁচু পাহাড়-পর্বত, ঢালু জমি, গভীর খাদ। এই সব এড়িয়ে নিরাপদে চাঁদের দক্ষিণ মেরু এলাকায় অবতরণ করা সম্ভব। এই কারণে আগে এই এলাকায় অবতরণের চেষ্টা করেনি আমেরিকা বা সোভিয়েট ইউনিয়ন। এপ্রিল মাসে ইজ়রায়েলের বেরেশিট মহাকাশযান এই এলাকায় নামতে গিয়ে ভেঙে পড়েছে। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা বাতিল করে।

চিন অবশ্য ভারতের আগে ৩ জানুয়ারি তাদের মহাকাশযান চ্যাং ই৪ চাঁদের যে দিকটা পৃথিবী থেকে কখনও দেখা যায় না, সেই পিঠের দক্ষিণ মেরু এলাকার সুবিশাল আইটকেন বেসিনের ভিতরের বেশ বড়সড় ভন কারম্যান ক্রেটারের মধ্যে অবতরণ করাতে সক্ষম হয়েছে। চন্দ্রযান-২ নামবে দক্ষিণ মেরুর আরও অনেকটা কাছে। চ্যাং ই৪ থেকে চাঁদের মাটিতে নেমে রোভার ইয়ুতু তখন থেকে চাঁদের উপর ঘুরছে ফিরছে। চাঁদে যখন রাত্রি নেমে আসে, তখন অবশ্য তার কাজ বন্ধ থাকে। চাঁদের অদেখা পিঠের কোথাও থেকে পৃথিবীর সঙ্গে সরাসরি বেতার যোগাযোগ করা যায় না। তাই চিন একটি রিলে মহাকাশযান কিউয়েকিউয়াও-কে আগেই কক্ষপথে স্থাপন করেছে, যেটি পৃথিবীর সঙ্গে চ্যাং ই৪-এর বেতার যোগাযোগ রিলে পদ্ধতিতে বজায় রেখে চলেছে। পৃথিবীর আর কোনও দেশ এখনও এই রিলে মহাকাশযান পাঠায়নি। চ্যাং ই৪ চিনের নিজেদের তৈরি যন্ত্র ছাড়াও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে জার্মানি, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি-র তৈরি যন্ত্র।

২২ জুলাই অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটায় ইসরোর সতীশ ধওয়ন মহাকাশ কেন্দ্র থেকে চাঁদের উদ্দেশ্যে চন্দ্রযান-২ রওনা হয়েছিল। তা ২০ অগস্ট ভারতীয় সময় সকাল সাড়ে ন’টায় চাঁদের কক্ষপথে চন্দ্রযান-২ প্রবেশ করে। কক্ষপথটি খুবই উপবৃত্তাকার। তার আগে রেট্রো রকেট চালিয়ে চন্দ্রযান-২-এর গতিবেগ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কক্ষপথে প্রবেশ থেকে বোঝা যাচ্ছে, এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক। ইতিমধ্যেই চন্দ্রপৃষ্ঠের ৪,০০০ কিলোমিটার দূর থেকে ছবিও পাঠাতে শুরু করেছে।

এর পর ধাপে ধাপে গতিবেগ এবং চাঁদ থেকে উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ করে চন্দ্রযান-২-কে স্থাপন করা হবে চূড়ান্ত কক্ষপথে। চাঁদের দক্ষিণ মেরু এলাকার উপর দিয়ে যাবে এই চূড়ান্ত কক্ষপথ। তখন চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে তার উচ্চতা হবে প্রায় ১০০ কিলোমিটার। ৭ সেপ্টেম্বর বিক্রম এবং প্রজ্ঞানকে নামিয়ে দেওয়ার আগে ১০০ কিলোমিটার উচ্চতায় কক্ষপথ থেকে অবতরণ এলাকার ছবি তুলে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখবে অরবিটার; উঁচুনিচু জমি, বোল্ডার, খাদ ইত্যাদি বাদ দিয়ে নিরাপদ অবতরণস্থল চিহ্নিত করবে। তার পরই অরবিটার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধীরে অতি ধীরে অবতরণ করবে বিক্রম ল্যান্ডার, তার পেটের ভিতর প্রজ্ঞান রোভারকে সঙ্গে নিয়ে।

তখন সেখানে চন্দ্ররজনী শেষে সবেমাত্র নির্মল ভোরের সূচনা হচ্ছে। কিছু পরে বিক্রম চাঁদের মাটিতে নামিয়ে দেবে এক ঢালু পথ। সেই পথ বেয়ে চাঁদের মাটিতে নামবে রোভার প্রজ্ঞান এবং তার ছয় চাকা দিয়ে চলতে শুরু করবে। চাঁদের একটি দিন, অর্থাৎ পৃথিবীর প্রায় চোদ্দো দিন ধরে অতি ধীর গতিতে চাঁদের জমি প্রতি ইঞ্চি পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করতে করতে অগ্রসর হবে প্রজ্ঞান। পৃথিবীর চোদ্দো দিন পরে চাঁদের একটি দিন শেষ হয়ে চাঁদে যখন তীব্র শীতল ঘোর কৃষ্ণরাত্রি শুরু হবে, তখন প্রজ্ঞান শীতঘুমে চলে যাবে। আবার পৃথিবীর চোদ্দো দিন পরে যখন চাঁদের নতুন দিন শুরু হবে, প্রজ্ঞানের সঙ্গে লাগানো সোলার প্যানেল বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করবে, তখন আবার নতুন করে কাজ শুরু করবে প্রজ্ঞান। তবে চোদ্দো দিন জুড়ে চন্দ্ররাত্রির -২৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা সহ্য করে প্রজ্ঞান সচল থাকবে কি না, সেটা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। আশা করা যায়, সচল থাকবে। তবে অরবিটার অন্তত এক বছর সক্রিয় থাকবে; তার বেশিও থাকতে পারে; সাধারণত তাই থাকে। যেমন, ২০০৮ সালে পাঠানো চন্দ্রযান-১ এখনও চাঁদকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে, যদিও তার সঙ্গে ইসরোর বেতার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। চিনের চ্যাং ই৪ রোভার অবশ্য ইতিমধ্যে একাধিক চন্দ্ররজনীর পরেও সচল রয়েছে।

পাশাপাশি দেশ চিন এবং ভারত যখন মেতে উঠেছে চন্দ্রাভিযান নিয়ে, তখন পশ্চিমে কী হচ্ছে, তা এক বার দেখে নেওয়া যাক। সেখানে প্রশ্ন, চাঁদে জল আছে কি না, থাকলে কোথায় কতটা আছে, তা নিয়ে এত অর্থব্যয় করা কেন? এত লোকবল, এত মেধার সমন্বয় করা কতটা যুক্তিযুক্ত? এই সব প্রশ্নে চাঁদে অবতরণের পরে আমেরিকা বা সোভিয়েট ইউনিয়নের চন্দ্র অভিযানের বাজেট ছাঁটাই হয়েছে, কেউই তার পর চাঁদে মানুষ পাঠানোর মতো ব্যয়বহুল উদ্যোগ নেয়নি।

চন্দ্রাভিযান বা মহাকাশ অভিযান থেকে মানুষ পেয়েছে উন্নত ইন্টারনেট, জিপিএস ব্যবস্থা, রিমোট সেন্সিং, রিমোট কন্ট্রোল, বায়োমেট্রিক সেন্সর, উন্নত মানের কাচ, দীর্ঘস্থায়ী হালকা ব্যাটারি, অগ্নিনিরোধী পোশাক, নতুন নতুন রাসায়নিক পদার্থ, রোবোটিক সার্জারি বা সাধারণ কম্পিউটার গেম খেলার জয়স্টিক ইত্যাদি।

২০১১ সালে স্পেস শাটলের সর্বশেষ উড়ানের পরে নাসা নিজেদের মহাকাশযানে করে চাঁদে বা মহাকাশে আর মহাকাশচারী পাঠায়নি। তারা আন্তর্জাতিক মহাকাশকেন্দ্রের অংশীদার হয়েছে এবং নিজেদের মহাকাশচারী সেখানে পাঠাচ্ছে রাশিয়ার বৈকনুর মহাকাশ কেন্দ্র থেকে রাশিয়ার সোয়ুজ মহাকাশযানের সাহায্যে, আসনপিছু প্রায় আট কোটি ডলার ভাড়া গুনে। সম্প্রতি আমেরিকার নীতি পরিবর্তিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ২০২৪ সালের মধ্যে চাঁদে নতুন ভাবে মানুষ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তৈরি হবে চাঁদের বুকে স্থায়ী মহাকাশ কেন্দ্র। এগিয়ে এসেছে স্পেস-এক্স, ব্লু অরিজিন, অর্বিটাল সায়েন্সেস, ইউনাইটেড অ্যালায়েন্স-এর মতো বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি।

স্পেস-এক্স কোম্পানি ২০২০ সালের মধ্যে মহাকাশে মনুষ্যবাহী মহাকাশযান এবং ২০২৩ সালের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠাবে। তারা চাঁদে স্থায়ী কেন্দ্র গড়বে। স্পেস-এক্স এবং অর্বিটাল সায়েন্সেস কোম্পানির মনুষ্যবিহীন মহাকাশযান কয়েক বার পৃথিবী এবং আন্তর্জাতিক মহাকাশকেন্দ্রের মধ্যে যাতায়াত করেছে। ব্লু মুন কোম্পানি ২০২৪ সালের মধ্যে তাদের অবতরণযান চন্দ্রপৃষ্ঠে নামিয়ে দেবে।

চাঁদে মহাকাশ কেন্দ্র এবং দীর্ঘস্থায়ী বাসস্থান স্থাপন এখন সময়ের অপেক্ষা। মহাকাশ কেন্দ্রের জন্য বা চাঁদে বসবাসকারীদের জন্য চাই জল। পৃথিবী থেকে জল বয়ে নিয়ে যাওয়া মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। চাঁদে যে জলের সন্ধান মিলেছে, তা থেকে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন তৈরি করে নেওয়া যাবে। এই দুটিই অত্যন্ত উচ্চমানের রকেট জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। এই অক্সিজেন ব্যবহারযোগ্য কি না, গবেষকরা তা নিয়ে ভাবছেন। জল ব্যবহৃত হতে পারবে চাঁদেই ফসল ফলানোর কাজে। পৃথিবী থেকে খাদ্য পাঠানোর উপর নির্ভর করতে হবে না। এখানেই চাঁদে জলের গুরুত্ব।

অন্য বিষয়গুলি:

Chandrayaan 2 Moon
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy