পালকের মতো নামা তো হল না! ছবি:এএফপি।
চন্দ্র অভিযান ব্যর্থ! কেউই তা বলছেন না। যাওয়ার কথা ছিল ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার কিলোমিটার। গিয়েছে প্রায় ৩ লক্ষ ৮৩ হাজার ৯৯৮ কিলোমিটার। ল্যান্ডার বিক্রমের সফ্ট ল্যান্ডিংয়ের জন্য বাকি ছিল ২.১ কিলোমিটার। একে যদি ব্যর্থতা বলতে হয় তবে খাতায় কলমে সেটা ০.০০০৬ শতাংশ। তবু অস্বস্তিতে ইসরো। পালকের মতো নামাটা তো হল না!
গত কাল গভীর রাতে অবতরণ পর্ব শুরুও হয়ে গিয়েছিল। বাকি ছিল মাত্র তিন মিনিট। এমন সময় আমূল বদলে গেল ছবিটা। আনন্দ, উৎসাহ দিয়ে শুরু হওয়া চন্দ্রাবতরণ শেষ হল হতাশা নিয়ে। তীরে এসে উধাও হয়ে গিয়েছে ল্যান্ডার বিক্রম। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। দূরনিয়ন্ত্রিত নয়, বিক্রমের রয়েছে নিজস্ব কৃত্রিম মেধা। তার ভিত্তিতেই নিজের গতি ও অভিমুখ পাল্টে নামার কথা ছিল তার। পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগটা আপাত ভাবে ছিন্ন হলেও, নিজের কাজ কি সুষ্ঠু ভাবে সারতে পেরেছে সে? কী অবস্থা ল্যান্ডার বিক্রম ও তার পেটে থাকা রোভার প্রজ্ঞানের— এ ব্যাপারে শনিবার রাত পর্যন্ত নিরুত্তরই রইল ভারতের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র।
পৃথিবীর সঙ্গে বিক্রম-প্রজ্ঞানের যোগাযোগ হারিয়ে গেলেও অরবিটারই খুঁজে বার করতে পারবে তাদের। শনিবার রাতে ইসরো সূত্রে জানানো হয়েছে, অরবিটারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তার কাছ থেকে সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছে। চাঁদকে পাক খেয়ে সে আবার বিক্রমের মাথার উপরে এসে ছবি তুলে পাঠাবে। কবে হবে সেটা? ইসরোর সূত্র আজ দিনক্ষণ ঘোষণা করেনি। তবে জানিয়েছে, অরবিটারের ফিরে আসতে আরও দিন কয়েক লাগবে।
শেষের সময় • শুক্রবার রাত ১টা ৫৩: কন্ট্রোল রুমে নিস্তব্ধতা। কম্পিউটারের মনিটরে বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগের ইঙ্গিত নেই। মোদী গম্ভীর। • ১টা ৫৭: মোদীর কাছে ইসরো প্রধান কে শিবন • ২টো ১: চন্দ্রযান ২ মিশন ডিরেক্টর রীতু কারিঢালের মুখ আরও থমথমে • ২টো ৭: মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন কয়েক জন বিজ্ঞানী-ইঞ্জিনিয়ার • ২টো ১৬: শিবন ঘোষণা করলেন, ‘পরিকল্পনামাফিক ঠিকঠাকই নামছিল বিক্রম। কিন্তু চাঁদের মাটি থেকে ২.১ কিমি উচ্চতায় আসার পরেই গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের সঙ্গে তার যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কী হয়েছে বুঝতে তথ্য বিশ্লেষণ করা হবে।’
সরকারি ভাবে কোনও ঘোষণা না-হলেও ইসরোর একটি সূত্র বলছে, গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না-পেরে চাঁদের মাটিতে আছড়ে পড়ে থাকতে পারে বিক্রম। প্রজ্ঞানের ওজন ২৭ কেজি। তাকে নিয়ে বিক্রমের ওজন ১৪৭১ কেজি। মাঝারি মাপের চার চাকার একটি গাড়ির কাছাকাছি। চাঁদের অভিকর্ষ বল পৃথিবীর তুলনায় অনেক কম (পৃথিবীর তুলনায় ১৬.৬ শতাংশ) হলেও ২.১ কিমি উপর থেকে আছড়ে পড়লে বিক্রম-প্রজ্ঞানের অক্ষত থাকার আশা নেই বলেই মনে করছে ইসরোর ওই সূত্র। এমনটা ঘটে থাকলে বলতেই হয়, চাঁদে সফ্ট ল্যান্ডিংয়ের প্রযুক্তিগত যে পরীক্ষা চালিয়েছিল ভারত, প্রথম বারে অন্তত তা সফল হয়নি।
ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, অবতরণের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছিল কি বিক্রমের? একটি সূত্রের দাবি, বিক্রমকে পৃথিবীর মাটিতে অবতরণের জন্য পর্যাপ্ত মহড়া ও পরীক্ষা করা হয়নি। অন্তত কয়েক বার অবতরণ করতে গিয়ে ক্ষতি হয়েছিল তার। সব মিলিয়ে অবতরণের পরীক্ষায় মেরেকেটে ২৭ শতাংশ নম্বর পেয়েছিল সে। যদিও সরকারি ভাবে ইসরো থেকে এ ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। তবে ইসরোর অন্যান্য সূত্র এবং মহাকাশবিজ্ঞানীদের অনেকে বলছেন, স্বয়ংক্রিয় গতিতে বিক্রম নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। কেউ কেউ বলছেন, চারটি ইঞ্জিন সমান ভাবে কাজ না-করলেও গতিপথ বদলে যেতে পারে। এবং অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও এর জেরে দুর্ঘটনা ঘটেছে। ইসরোর খবর, তাদের পর্যালোচনা বৈঠকে অবতরণের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না-থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। তা সামলাতে হবে ইসরো-প্রধান কে শিবনকে।
প্রশ্ন উঠেছে বিক্রমকে নামানোর দিন বাছাই নিয়েও। চাঁদের ভোর থেকেই টানা ১৪ দিন (চাঁদের একটি দিন) কাজ করতে পারবে, এই যুক্তিকে সামনে রেখে শুক্রবার গভীর রাতে ল্যান্ডারকে নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইসরো। বিজ্ঞানীদের একাংশ মনে করছেন, এটা ২৪ বা ৪৮ ঘণ্টা পরে করলে হয়তো বিপত্তি এড়ানো যেত। কী ভাবে? ওই বিজ্ঞানীদের যুক্তি, সূর্য থেকে আসা এক্স-রে বায়ুমণ্ডলহীন চাঁদের অতিসূক্ষ্ম ধূলিকণা তথা ‘রেগোলিথ’-কে উত্তেজিত করে। গরম হলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার জন্য ধূলিকণার অণুঋণাত্মক কণা ইলেকট্রন ছেড়ে দেয়। রোগেলিথগুলি হয়ে দাঁড়ায় ধনাত্মক কণা। দিন শুরু হলে চাঁদের কাল্পনিক রেখা টার্মিনেটরের এক পাশের অংশ সূর্যের আলো পায়, অন্য দিকটি থাকে খুবই ঠান্ডা। তাপমাত্রার বিপুল ফারাক, আলো ও এক্স-রের প্রভাবে দিনের শুরুতে ওই টারমিনেটরের কাছে শুরু হয় ধূলিঝড়। অভিকর্ষের টান কম বলে, ধূলোর মেঘ এক কিলোমিটার পর্যন্ত উঠে যায়। নামতে সময় নেয়।
ইসরোর কম্পিউটার মনিটরে নিথর বিক্রমের অবস্থান।
বিক্রমকে নামানো হচ্ছিল ওই টার্মিনেটরের কাছে। তাও দিনের শুরুতে, যখন ধূলি ঝড় প্রবল। হতে পারে, সেই ঝড়েই দিক্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল বিক্রম। চাঁদের দিন আরও কিছুটা গড়াতে দিলে, সেই ঝড় এত তীব্র থাকত না। বিক্রম সুষ্ঠু ভাবেই নামতে পারত। ইসরোর তরফে অবশ্য এ বিষয়ে কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি এখনও। তবে এই ঝড়ের বিষয়টি সামনে আসায় এমন প্রশ্নও উঠে আসছে যে, মোদী সরকারের ১০০ দিন পূর্ণ হওয়ার দিনেই
চন্দ্রবিজয়ের চেষ্টা করতে হল কেন? কোনও চাপ ছিল কি?
ব্যর্থতা ও সাফল্যের তুল্যমূল্য বিচার করতে গিয়ে বিক্রমের অবতরণের রেখচিত্র দেখিয়ে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজ়িক্সের বিজ্ঞানী সুজন সেনগুপ্ত অবশ্য লিখেছেন, ‘‘শেষ লগ্নে গতিপথ বদলে গিয়েছিল। এই দুর্ঘটনায় ইসরোর কিছু করার ছিল না।’’ তিনি এ-ও উল্লেখ করেছেন, চাঁদে অবতরণ করতে রাশিয়ার ১১ বার চেষ্টা করতে হয়েছিল। অরবিটার পাঠাতেই ছ’বার সময় লেগেছিল। চিন অরবিটার পাঠাতে পেরেছে তিন বারের চেষ্টায়। ভারত প্রথম বারেই সে কাজ করেছে। এবং তা কাজও করছে।’’
ইসরো বলছে, শনিবার পর্যন্ত অভিযানের ৯০-৯৫% লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। সাফল্যের আর একটি দিকের কথা আজ বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছে তারা। বিক্রম-প্রজ্ঞানের কাজ করার কথা ছিল ১৪ দিন। আর অরবিটারের এক বছর। ইসরো জানাচ্ছে, ‘জিএসএলভি মার্ক-থ্রি’, ভারতের বাহুবলী রকেট এতটাই নিখুঁত ভাবে চন্দ্রযান ২-কে তার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে দিয়েছিল যে, এক বছর নয়, আগামী সাত বছর ধরে সেটি কাজ করে চলবে বলে তাদের বিশ্বাস। অর্থাৎ চাঁদের উপর থেকে ছবি তুলে বিক্রম-প্রজ্ঞানের চেয়ে ঢের বেশি তথ্য পৃথিবীতে পাঠাবে সে। চাঁদের যে ত্রিমাত্রিক মানচিত্র তৈরি হবে তা থেকে চাঁদে কোথায় কতটা জল বা অন্য ধাতু-অধাতু ছড়িয়ে রয়েছে, মিলতে থাকবে সেই তথ্যও।
অভিযানে সাফল্য বা ব্যর্থতা যা-ই আসুক, ইসরো প্রধান সাংবাদিক বৈঠক করে থাকেন। ইসরো-প্রধান কে শিবন সেই রীতি ভেঙে শুক্রবার গভীর রাতে সাংবাদিক বৈঠকে পাঠান মুখপাত্র দেবীপ্রসাদ কার্নিককে। অবতরণে যে বিপদ ঘটে গিয়েছে, সেটা অবশ্য বোঝা গিয়েছিল দেবীপ্রসাদের ঘোষণার আগেই। ইসরো-প্রধানের সঙ্গে মোদীর বৈঠক এবং তার পরেই ‘হোপ ফর দ্য বেস্ট’ বলে মোদীর প্রস্থানে স্পষ্ট হয়ে যায়, বিপত্তি ঘটছে বিক্রমের অবতরণে। অবতরণ ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে খুবই বিধ্বস্ত দেখিয়েছে শিবনকে। কেঁদেও ফেলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সামনে। মোদী দু’হাতে তাঁর মাথা ধরে বুকে টেনে নেন, পিঠে বেশ খানিক ক্ষণ হাত বুলিয়ে তাঁকে সান্ত্বনা দেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy