Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Science News

ভয়ঙ্কর স্মৃতি মুছে ফেলার পথ দেখালেন শান্তিনিকেতনের সোনা

স্নায়ুবিজ্ঞানী সুমন্ত্র (সোনা) চট্টোপাধ্যায়ের এক নজরকাড়া আবিষ্কার এ বার এই সব ক্ষেত্রেই জোর গলায় ‘হ্যাঁ’ বলার আশাকে রীতিমতো জোরালো করে তুলল। তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণায়।

ছবি- শাটারস্টকের সৌজন্যে।

ছবি- শাটারস্টকের সৌজন্যে।

সুজয় চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২০ ১০:০৯
Share: Save:

যাঁরা ১১ বছর আগের সেই ২৬ নভেম্বরের মুম্বই হামলার ঘটনাগুলি দেখেছেন সামনে থেকে, বুলেটে গুরুতর জখম হয়ে সঙ্কটজনক অবস্থায় দিনের পর দিন যাঁদের কাটাতে হয়েছিল হাসপাতালে, তাঁদের তো এখন প্রতি মুহূর্তেই সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিঁকে থাকতে হয়। মানসিক ভাবে প্রতিবন্ধী হয়েই। তাঁদের কি বাকি জীবনটা সুস্থ ভাবেই বাঁচিয়ে রাখা যেত?

উত্তরটা হল, না।

হায়দরাবাদের সেই ধর্ষিতা যদি শেষমেশ বেঁচে যেতেন, যদি হার্ট ফেল করে দিল্লির হাসপাতালে মারা না যেতেন উন্নাওয়ের সেই তরুণী, তা হলে কি তাঁদের সারাটা জীবন সুস্থ ভাবে বাঁচিয়ে রাখা যেত?

না।

মৃত্যু পর্যন্ত তাঁদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত না, মানসিক ভাবে প্রতিবন্ধী করে দিত না সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি? সেই প্রাণঘাতী স্মৃতির হামলা থেকে বাঁচানো সম্ভব হত হায়দরাবাদ আর উন্নাওয়ের দুই তরুণীকে?

দুঃখজনক হলেও সত্যি, না-ই হয়তো বা।

‘হ্যাঁ’ বলার আশা জোগালেন সুমন্ত্র

এ বার এই সব ক্ষেত্রেই জোর গলায় ‘হ্যাঁ’ বলার আশাকে রীতিমতো জোরালো করে তুলল শান্তিনিকেতনের ‘সোনা’র সাম্প্রতিক গবেষণা। শান্তিনিকেতনের তিন প্রজন্মের বাসিন্দা দেশের বিশিষ্ট স্নায়ুবিজ্ঞানী সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায় এখন বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস (এনসিবিএস)’-এর সিনিয়র প্রফেসর ও ‘সেন্টার ফর ব্রেন ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিপেয়ার’-এর অধিকর্তা।

সুমন্ত্রের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস (পিএনএএস বা পিনাস)’-এর ১৬ ডিসেম্বর সংখ্যায়।

বেঁচে থাকলে হায়দরাবাদ আর উন্নাওয়ের তরুণীদের সারাটা জীবন ধরে ভুগতে হত যে জটিল রোগে, মুম্বই হামলায় সঙ্কটাপন্ন বা প্রত্যক্ষদর্শীদের এখনও ১১ বছর পরেও যে রোগ নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়, তার নাম- ‘পোস্ট ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি)’। যার সার্বিক আরোগ্যের তেমন কোনও ওষুধ এখনও বাজারে নেই। কারণ, কোনও ভয়ঙ্কর ঘটনার কিছু দিন পর থেকে সেই দুর্বিষহ স্মৃতি কী ভাবে আমাদের মস্তিষ্কে ঘাঁটি গাড়তে শুরু করে, ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, সেই কলাকৌশলগুলিই এত দিন জানা ছিল না ওষুধ প্রস্তুতকারকদের।

পিটিএসডি নিয়ে সেই গবেষণাপত্র। ইনসেটে, স্নায়ুবিজ্ঞানী সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়।

তার ফলে, দিন যত গড়াত, একটা ভয়ঙ্কর ভয় খুব দ্রুত চেপে বসত হায়দরাবাদ আর উন্নাওয়ের তরুণীদের উপর। উত্তরোত্তর বাড়ত। সেই হাড়জমানো ভয় তাঁদের জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখত। চেপে বসত রক্তে, অস্থি-মজ্জায়। দ্রুত গ্রাস করে ফেলত তাঁদের। ব্রেন বা মস্তিষ্কের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ (অ্যামিগডালা)-কে করে দিত অসম্ভব সক্রিয় (হাইপার-অ্যাক্টিভ)।

সুমন্ত্রের কৃতিত্ব, তিনিই দেখাতে পারলেন, অ্যামিগডালায় ঘটা পিটিএসডি-র সেই কলাকৌশলগুলি।

অ্যামিগডালা থাকে কোথায়? কী তার কাজ? দেখুন ভিডিয়ো

সেই অ্যামিগডালা, যা আমাদের মস্তিষ্কে ভয়, রাগ, সুখ, দুঃখ, ভালবাসা, সব রকমের অনুভূতির আঁতুড় ঘর। আমাদের যাবতীয় অনুভূতির সেই আঁতুড় ঘরের অতি-সক্রিয়তাই (হাইপার-অ্যাক্টিভিটি) পিটিএসডি রোগীদের মানসিক ভাবে প্রতিবন্ধী করে দেয় অনতিদূর ভবিষ্যতে।

ধর্ষক নয়, জঙ্গি নয়, সেই ভয়টা কীসের?

জঙ্গিরা আবার হামলা চালাতে পারে, সেই ভয়ে কিন্তু তিনি মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েননি, ১১ বছর আগের ঘটনায় যিনি বেঁচে গিয়েছিলেন কোনও ক্রমে বা সামনে থেকে দেখেছিলেন সেই নৃশংস ঘটনা। ধর্ষক বা তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের ভয়ে কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার স্মৃতি ফিরে আসে না ধর্যিতার। সমাজের ভয়েও নয়! ফিরে আসে না আত্মীয়স্বজনের ভয়েও।

সুমন্ত্র বলছেন, ‘‘সেই ভয়ের জন্ম হয় অতীতের কোনও ভয়ঙ্কর ঘটনার স্মৃতি থেকে। অনেক কিছু আপনাআপনি ‘ডিলিট’ করে দিলেও আমাদের স্মৃতি যে ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলিকে কিছুতেই ভুলতে পারে না। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যার নাম- ‘ট্রম্যাটিক মেমরি’।

যতই দিন গড়ায় ততই তা বাড়তে থাকে। চেপে বসে। যেন ভর করে সেই স্মৃতির ধারককে। তখন মনে হয়, যেন ভূত চেপেছে ঘাড়ে!

ভূতের ভবিষ্যত নেই! তাও বাঁচোয়া। কিন্তু এই ‘ট্রমা’র পায়ে যেন চাকা লাগানো আছে! সে গড়িয়ে চলে জীবনের সঙ্গে সঙ্গে। থেকে যায় আমৃত্যু। আক্রান্তকে মনে, দেহে ক্রমশই ক্ষইয়ে দেয়। কেড়ে নেয় যাবতীয় প্রাণশক্তি।

আমাদের মস্তিষ্কের নিউরন।

গাঁজা, মারিজুয়ানায় রোগমুক্তি?

না জেনে গাঁজা, মারিজুয়ানা খেয়ে এত দিন এই রোগের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে‌ছেন রোগীরা। বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর থেকেই এই অভ্যাস রয়ে গিয়েছে রণক্ষেত্র থেকে কোনও রকমে ফিরে আসতে পারা সেনাদের। এই নেশায় এখনও বুঁদ হয়ে রয়েছেন বহু রোগী।

কিন্তু যে সব দেশে মারিজুয়ানা নিষিদ্ধ, সেখানকার ডাক্তাররা তো আর রোগীদের বলতে পারেন না ওই মাদকদ্রব্যটি খেয়ে রোগের যন্ত্রণা ভুলুন! তাতে তো আরও একটি রোগকে ডেকে আনতে হয়, গাঁজা, মারিজুয়ানা সেবনের জন্য!

কোথায় অভিনবত্ব সুমন্ত্রদের?

মারিজুয়ানার গুণাগুণ জেনে বাজারে দু’একটি ওষুধ এসেছিল। তারই মধ্যে একটি বড় সংস্থার বানানো ওষুধ নিয়ে কাজ করেছিলেন সুমন্ত্র ও তাঁর সহযোগী গবেষকরা। তাঁরা দেখতে চেয়েছিলেন, পিটিএসডি রোগের জন্ম দেওয়ার জন্য মস্তিষ্কের অ্যামিগডালার যে অংশগুলি অতি-সক্রিয় হয়ে ওঠে, ওই ওষুধ প্রয়োগ করলে, সেই অংশগুলিকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া সম্ভব হয় কি না। তাঁরা কাজটি করেছিলেন ইঁদুরদের নিয়ে।

সুমন্ত্ররা দেখেছেন, পিটিএসডি রোগীর অ্যামিগডালার অতি-সক্রিয় হয়ে ওঠা অংশগুলিকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া যাচ্ছে। আর সেটা করতে গিয়ে সুমন্ত্ররা এটাও দেখেছেন, পিটিএসডি রোগীদের অ্যামিগডালায় কী ভাবে ঘটনার পর থেকে জন্ম হচ্ছে সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতির, কী ভাবে তা বেড়ে উঠছে দ্রুত, ছড়িয়ে পড়ছে।

সুমন্ত্রের বক্তব্য, ‘‘এর ফলে, পিটিএসডি রোগীদের জন্য আরও ভাল আরও কার্যকরী ওষুধ বানানো সম্ভব হবে অদূর ভবিষ্যতে। অ্যামিগডালায় পিটিএসডি রোগের জন্ম থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে কলাকৌশলগুলি জানা ছিল না বলেই কার্যকরী ওষুধ বানানো সম্ভব হয়নি এত দিন।’’

কী বলছেন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞরা?

সত্যিই কি তাই? প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’-এর তরফে যোগাযোগ করা হয়েছিল বিশিষ্ট স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে।

বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেল্‌থ অ্যান্ড নিউরো-সায়েন্সেস (নিমহ্যান্স)’-এর সাইকিয়াট্রি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর বিশিষ্ট স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ বিজু বিশ্বনাথ ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’-কে বলেছেন, ‘‘এই গবেষণাপত্রটি অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পিটিএসডি একটি ভয়ঙ্কর মানসিক রোগ। এই রোগ চট করে ধরাই পড়ে না। ফলে, রোগীর সংখ্যাটা সরকারি ভাবে যা দেখানো হয়, তার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি। এখনও পর্যন্ত অব্যর্থ কোনও ওষুধ নেই এই রোগের।’’

বিজুর বক্তব্য, এই গবেষণাপত্র যে ভাবে অ্যামিগডালায় রোগের জন্ম, বিকাশের কলাকৌশলগুলি দেখিয়েছে, তা এর আগে কেউ দেখাতে পারেননি। ফলে, অদূর ভবিষ্যতে অব্যর্থ ওষুধ তৈরির সম্ভাবনা আক্ষরিক অর্থেই, জোরালো হল।

বিজু-সহ অন্য বিশিষ্ট স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘‘যে দু’-একটি ওষুধ বাজারে রয়েছে, সেগুলি ‘এটা কাজে না লাগলে ওটা’ এই নীতিতে চলে। ওষুধগুলির বেশির ভাগই কিছুটা কার্যকরী হয় রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে। যে সময়ে রোগটাই অনেক ডাক্তারের চোখে ধরা পড়ে না। পরিবারও বুঝতে পারে না বলে রোগীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় না। তবে সুমন্ত্ররা যা দেখেছেন ইঁদুরের উপর পরীক্ষা চালিয়ে, এ বার তার হিউম্যান ট্রায়ালও প্রয়োজন। তা যদি সফল হয়, তা হলে পিটিএসডি-র অব্যর্থ ওষুধ বাজারে আসতে আর দেরি হবে না।’’

ছবি সৌজন্যে: অধ্যাপক সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy