অটিজ়ম শিশুদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ক্রমবর্ধমান সমস্যা। গত কয়েক দশক ধরে শিশুদের মধ্যে অটিজ়মের ঘটনা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে প্রায় প্রতি ১৬০ জনের মধ্যে এক জন শিশু অটিজ়মে আক্রান্ত বলে মনে করা হয়। ভারতেও অটিজ়মে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা নেহাত কম নয়। ২ এপ্রিল ছিল বিশ্ব অটিজ়ম সচেতনতা দিবস। রাষ্ট্রপুঞ্জ এই উপলক্ষে জানিয়েছে, কোভিড অতিমারির কারণে অটিজ়ম নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর কর্মসূচি বিশ্ব জুড়েই ধাক্কা খেয়েছে। এই অসুখে মস্তিষ্কের বিকাশ ঠিকমতো না হওয়ার ফলে এক জন মানুষ অন্যদের সঙ্গে কথাবার্তা, ভাব বিনিময় এবং সামাজিক আচরণের দিক দিয়ে ঠিক আর পাঁচ জনের মতো ‘স্বাভাবিক’ হন না। তাই ছোটদের স্বাভাবিক বিকাশের পথে অটিজ়ম একটি বড় অন্তরায়। অটিজ়মে আক্রান্ত শিশুরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ‘স্বাভাবিক’ সমবয়সিদের সঙ্গে মিশতে পারে না। অনেক সময় তারা অন্যদের কাছে তেমন গ্রহণযোগ্যও হয় না। তবে তথাকথিত স্বাভাবিক মানুষরা যা পারেন না, অনেক সময়ই দেখা গিয়েছে অটিজ়মে আক্রান্ত কেউ সেটা করে দেখাচ্ছে। ধরা যাক স্টিফেন উইল্টশায়ারের কথা। অটিজ়মে আক্রান্ত স্টিফেন একটা গোটা শহরের ছবি এঁকে ফেলতে পারেন শুধুমাত্র স্মৃতিতে ভর করে। মুশকিল হল, অটিজ়মের কোনও একটি নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। শরীরের বহু জিনের কাজ (বা অকাজ), স্নায়ুতন্ত্রের গঠন ও পরিবেশ, সব মিলিয়ে অনেক কিছুর ফল হিসেবে অটিজ়মকে দেখা যেতে পারে। তাই এর কোনও নির্দিষ্ট চটজলদি সুরাহাও নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে এমন ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে, যাতে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ঘটিয়ে অটিজ়মের উপসর্গ কমানো যেতে পারে। আর এই ব্যবস্থার প্রধান মাধ্যম হবে অন্ত্রপ্রণালীর জীবাণুসমষ্টি। শুনতে অবাক লাগলেও এটা ঘটনা যে, অন্ত্রে বসবাসকারী জীবাণুদের উপর একটি শিশুর মানসিক গঠন ও বিকাশ অনেকটাই নির্ভরশীল।
এক জন মানুষের শরীরে যতগুলি কোষ আছে (প্রায় ৩৭,০০০,০০০,০০০,০০০), তার দশগুণ বেশি জীবাণু সে সব সময় বয়ে বেড়ায়। এরা শরীরের প্রায় অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই জীবাণুগুলিকে এক সঙ্গে শরীরের জীবাণুসমষ্টি বলা যেতে পারে। জীবাণুসমষ্টির সবচেয়ে বেশি ঘনত্ব ও বৈচিত্র দেখা যায় অন্ত্রপ্রণালীতে। এরা মূলত চারটি পর্বের— ব্যাকটিরিয়া ফার্মিকিউট, ব্যাক্টিরয়ডিটিস, অ্যাকটিনোব্যাকটিরিয়া এবং প্রোটিয়োব্যাকটিরিয়া। অন্ত্রপ্রণালীর জীবাণুসমষ্টির ৯০ শতাংশ জুড়ে এরা রাজত্ব করে। ভ্রূণ অবস্থাতেই শরীরের ভিতরে জীবাণুদের প্রবেশ ঘটতে শুরু করে, এবং জন্মের পরে শিশুর অন্ত্রে জীবাণুর বৈচিত্র বাড়তে থাকে। মোটামুটি তিন বছর বয়স থেকে অন্ত্রপ্রণালীর জীবাণুসমষ্টি একটি স্থায়ী রূপ নেয়। পৃথিবীর সব মানুষের মধ্যেই জীবাণুরা বসবাস করে। খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রা ও ভৌগোলিক অবস্থানের পার্থক্যের কারণে মানুষে মানুষে জীবাণুসমষ্টির চরিত্র আলাদা হলেও দেখা গিয়েছে যে, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষদের অন্ত্রের জীবাণুসমষ্টির সদস্যদের প্রকৃতি ও সংখ্যার অনুপাত অনেকটা একই রকম। সুস্থ এবং অসুস্থ মানুষের জীবাণুসমষ্টির মধ্যেও অনেক পার্থক্য দেখা যায়। কোনও কারণে জীবাণুসমষ্টির চরিত্র (অর্থাৎ, সদস্য জীবাণুদের অনুপাত) স্বাভাবিকের থেকে বদলে গেলে সেই অবস্থাকে ডিসবায়োসিস বলে। ডিসবায়োসিসের সময়ে অন্ত্রপ্রণালীতে কিছু পর্বের ব্যাকটিরিয়ার সংখ্যা অন্যদের তুলনায় বেশি বা কম হয়ে যায়; সেই সঙ্গে জীবাণুদের বৈচিত্রও কমে যায়। বিভিন্ন ধরনের অসুখের সঙ্গে ডিসবায়োসিসের সম্পর্ক আবিষ্কৃত হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করার পরে অনেক সময়ে ডিসবায়োসিস হয়, যার ফলে শরীরে নানা রকম উপসর্গ দেখা যায়। অটিজ়মের সঙ্গেও এর যোগাযোগ আছে। অটিজ়মে আক্রান্ত অনেক শিশুকেই কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ডায়েরিয়া জাতীয় পেটের গোলমালে ভুগতে দেখা যায়, যা ডিসবায়োসিসের দিকে ইঙ্গিত করে। এই রকম অনেক শিশুকে পরীক্ষা করে জানা গিয়েছে যে, খুব কম বয়সে তাদের উপর দীর্ঘ দিন ধরে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রয়োজন হয়েছিল। এর স্থায়ী প্রভাব পড়ে তাদের জীবাণুসমষ্টির উপরে। এই ধরনের শিশুদের অন্ত্রে জীবাণুর বৈচিত্র অনেকটাই কম হয়। সুতরাং, খুব দরকার না হলে তিন বছরের কমবয়সি শিশুদের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করাই ভাল
তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে যে, অটিজ়মে আক্রান্ত শিশুদের জীবাণুসমষ্টির প্রকৃতি অন্য ‘স্বাভাবিক’ শিশুদের থেকে আলাদা। অটিজ়মে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ব্যাক্টিরয়ডিটিস পর্বের ব্যাকটিরিয়া এবং বিফিডোব্যাক্টেরিয়াম প্রজাতির ব্যাকটিরিয়া স্বাভাবিকের থেকে কম পরিমাণে দেখা যায়। অন্য দিকে, এই শিশুদের মধ্যে ফিকালিব্যাকটেরিয়াম, ল্যাক্টোব্যাসিলাস, ও ক্লসট্রিডিয়াম জাতীয় ব্যাকটিরিয়ার উপস্থিতি বেশি দেখা গিয়েছে। অন্ত্রপ্রণালীর জীবাণুরা খাবারে থাকা বিভিন্ন অণুকে ভেঙে নানা ধরনের জৈব-রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে, যেগুলি শরীরের উপর নানা রকম প্রভাব ফেলে। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, অ্যাসেটিক অ্যাসিড, প্রোপিয়নিক অ্যাসিড, বিউটিরিক অ্যাসিড প্রভৃতি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ফ্যাটি অ্যাসিড (শর্ট চেন ফ্যাটি অ্যাসিড বা এসসিএফএ), শরীরের সার্বিক স্বাস্থ্যের পিছনে যাদের বিশেষ অবদান আছে। কিন্তু প্রোপিয়নিক অ্যাসিডের সঙ্গে অটিজ়মের সম্পর্ক আবিষ্কৃত হয়েছে। অটিজ়মে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে প্রোপিয়নিক অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার পরে অসুখের উপসর্গ বাড়তে দেখা গিয়েছে। প্রোপিয়নিক অ্যাসিড বেড়ে গেলে বিভিন্ন ধরনের নিউরোট্রান্সমিটারের স্বাভাবিক পরিমাণে পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে অটিজ়ম দেখা দিতে পারে। অন্ত্রে ক্লসট্রিডিয়াম জাতীয় ব্যাকটিরিয়া বেড়ে গেলে শরীরে প্রোপিয়নিক অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যায়।
তা ছাড়া অন্ত্রপ্রণালীর জীবাণুরা সেরোটোনিন, ডোপামিন, গামা অ্যামাইনো বিউটিরিক অ্যাসিড ইত্যাদি নিউরোট্রান্সমিটার তৈরি করে, যা শরীরের স্নায়ুতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয়। সুতরাং, ডিসবায়োসিসের ফলে এগুলির পরিমাণের হেরফের হলে তার প্রভাব মস্তিষ্কের উপরেও পড়বে। অটিজ়মে আক্রান্ত বহু শিশুর রক্তে সেরোটোনিনের পরিমাণ সাধারণের থেকে বেশি মাত্রায় দেখা গিয়েছে।
অটিজ়মের সঙ্গে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা অনাক্রম্যতারও যোগ রয়েছে। অটিজ়ম আক্রান্ত মানুষের মধ্যে ইন্টারলিউকিন ৬, ইন্টারলিউকিন ৮, টিউমার নেক্রোসিস ফ্যাক্টর আলফা প্রভৃতি সাইটোকাইনের পরিমাণ বেশি দেখা যায়। সাধারণত অনাক্রম্যতা সক্রিয় হলেই শরীরে এই সাইটোকাইনগুলি বেশি মাত্রায় তৈরি হয়। এর পিছনেও ডিসবায়োসিসের হাত রয়েছে। সুস্থ অবস্থায় অন্ত্রপ্রণালীর কোষগুলি টাইট জাংশন নামক দুর্ভেদ্য বন্ধনে পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে থাকে। এই বেড়া টপকে ব্যাকটিরিয়ার বিভিন্ন পদার্থ রক্তে প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু ডিসবায়োসিসের সময় টাইট জাংশন স্যাকারাইড-সহ অন্ত্রের জীবাণুর বিভিন্ন উপাদান রক্তে মিশে গিয়ে অনাক্রম্যতাকে জাগিয়ে তোলে। দেখা গিয়েছে যে, অটিজ়মে আক্রান্ত মানুষদের মধ্যে অন্ত্রপ্রণালীর শিথিল হয়ে যাওয়ার ঘটনা অন্যদের থেকে তুলনামূলক ভাবে বেশি হয়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, কোনও শিশুর মধ্যে অটিজ়ম দেখা দেওয়ার একটি কারণ হল, তার অন্ত্রপ্রণালীর জীবাণুসমষ্টির চরিত্র। একটি শিশু কী ভাবে ভূমিষ্ঠ হচ্ছে (স্বাভাবিক উপায়, নাকি অস্ত্রোপচার), জন্মের পরে কী ধরনের খাবার খাচ্ছে, কোন ধরনের পরিবেশে বেড়ে উঠছে, কী রকম ওষুধ খাচ্ছে— এই সব কিছুর উপরেই তার অন্ত্রের জীবাণুসমষ্টির চরিত্র নির্ভর করে। সাধারণত অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুদের মধ্যে অটিজ়মের সম্ভাবনা বেশি দেখা যায়। অন্য দিকে, যারা জন্মের পরে অন্তত ছ’মাস মাতৃদুগ্ধ পান করেছে, তাদের মধ্যে অটিজ়মের ঝুঁকি কম বলে মনে করা হয়। অ্যান্টিবায়োটিকের কথা আগেই আলোচনা করা হয়েছে। শিশুর জন্মের আগে তার মায়ের খাদ্যাভ্যাস, স্থূলতা, ডায়াবিটিস ও অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারও শিশুর অন্ত্রপ্রণালীর জীবাণুসমষ্টির ধরনকে প্রভাবিত করে।
তা হলে এটাও অনুমান করা যেতে পারে যে, অটিজ়মে আক্রান্ত শিশুদের জীবাণুসমষ্টিকে যদি সুস্থ ‘স্বাভাবিক’ শিশুদের মতো করে দেওয়া যায়, তবে অটিজ়মের উপসর্গ কমার সম্ভাবনাও থাকবে। মানুষের জীবাণুসমষ্টির প্রকৃতি মূলত নির্ভর করে তার দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসের উপর। ডায়েটারি ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার অন্ত্রপ্রণালীতে উপকারী জীবাণু বাড়িয়ে দেয়। অন্য দিকে, অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার খেলে অপকারী জীবাণুর পরিমাণ বাড়ে। তাই সঠিক খাদ্যের মাধ্যমে অটিজ়মের উপসর্গ কমানো যায় কি না, তা এখন বিশ্ব জুড়ে আধুুনিক গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy