Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Altruism

আত্মবলিদান: অন্যদের বাঁচাতে প্রাণ দেয় ওরা

সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট? ভুল। পরার্থে জীবন দেয় অনেক প্রজাতিই। তালিকায় রয়েছে কিছু ব্যাকটিরিয়াওসৌভিক ভট্টাচার্যের গবেষণা বলছে, অন্য সদস্যদের বাঁচিয়ে রাখতে বেশ কিছু স্বার্থত্যাগী ব্যাকটিরিয়া মৃত্যুর পথ বেছে নেয়।

অর্ঘ্য মান্না
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০১:৫৭
Share: Save:

থারমোপালি-র বিখ্যাত যুদ্ধের শেষ দিন। মাত্র ৩০০ যোদ্ধা নিয়ে পারস্য সম্রাট জেরক্সেস-এর লক্ষাধিক বাহিনীকে রুখে দেওয়ার পরে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার স্পার্টার রাজা লিয়োনিডাস। তাঁর সামনে দুটো রাস্তা। জেরক্সেসের বশ্যতা শিকার করে গোটা গ্রিসকে পরাধীনতার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া। অথবা, যুদ্ধে বীরের মতো প্রাণ দেওয়া। লিয়োনিডাস তাঁর সৈন্যদলের একমাত্র কবি সিমোনিডিস অব সিয়ো-কে ডেকে পাঠিয়ে নির্দেশ দিয়েছিলেন, স্পার্টার ঘরে ঘরে গিয়ে জানাতে, স্পার্টাবাসীর ভবিষ্যতের কথা ভেবে যুদ্ধে মৃত্যুবরণকেই শ্রেয় মনে করেছেন তাঁদের রাজা। আর আর্জি একটাই, তাঁরা যেন এই ঘটনা ভুলে না যান।

এই ঘটনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কবি জন এডমন্ড ম্যাক্সওয়েল লিখেছিলেন বিখ্যাত চারটি লাইন ‘‘হোয়েন ইউ গো হোম, টেল দেম অ্যান্ড সে। ফর ইয়োর টুমরো, উই গিভ আওয়ার টুডে’’।

অন্যের জন্য নিজেকে বলিদান দেওয়াকে বলা হয় অলট্রুইজ়ম। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এর একাধিক উদাহরণ রয়েছে। তবে এমনটা শুধু যে মানুষের মধ্যে দেখা যায়, তা নয়। সমাজ বা গোষ্ঠী তৈরি ও প্রতিপালনে মানুষের থেকে অনেকটাই এগিয়ে মৌমাছি, পিঁপড়েরা। তাদের মধ্যে অলট্রুইজ়ম দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। তা ছাড়া বাদুড় ও ভার্ভেট প্রজাতির বাঁদরও বিপদে পড়লে নিজের কথা না ভেবে অন্যকে সাহায্য করে। কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থে, দশের জন্য নিজেকে বলিদান দেওয়ার ধর্ম কি ব্যাকটিরিয়ার মতো ক্ষুদ্র জীবের মধ্যেও দেখা যায়?

টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত জীববিজ্ঞানী সৌভিক ভট্টাচার্যের নতুন গবেষণা বলছে, ব্যাকটিরিয়ারাও শত্রুর আক্রমণ থেকে গোষ্ঠীকে বাঁচাতে নিজেদের বলিদান দেয়। শুধু তা-ই নয়, ‘ফার্স্ট লাইন অব ডিফেন্স’ মৃত্যুর সম্মুখীন হয়ে বার্তাও পাঠায়। ঠিক যেন— ফর ইয়োর টুমরো, উই গিভ আওয়ার টুডে। সৌভিক, তাঁর সহকর্মী ডেভিড ওয়াকার ও ল্যাবরেটরির মুখ্য গবেষক রাসিকা হার্শে ব্যাকটিরিয়ার নিজেকে বলিদান দেওয়ার ধর্মই শুধু পরীক্ষা করেননি, গোষ্ঠীর বাকি সদস্যদের পাঠানো শেষ বার্তাটাও পড়ে ফেলেছেন। এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে নেচার কমিউনিকেশনস জার্নালে।

ব্যাকটিরিয়ার বলিদানের রহস্যের আরও গভীরে প্রবেশের আগে এই ক্ষুদ্র জীবকুলের অ্যান্টিবায়োটিক রেজ়িসট্যান্স ধর্মে চোখ রাখা যাক। গোটা পৃথিবীর চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক রেজ়িসট্যান্ট ব্যাকটিরিয়ারা। সংক্রমণ রুখতে লাগামছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার এবং সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যাকটিরিয়ার নিজেকে বিবর্তিত করা— ফল, রেজ়িসট্যান্ট ব্যাকটিরিয়ার উৎপত্তি।

ব্যাপারটা যদি দেখা যায় ব্যাকটিরিয়ার দিক থেকে? জীবজগতের সমস্ত সদস্যের ধর্ম হল, নিজের প্রজাতিকে যে কোনও উপায়ে রক্ষা করা। এ ক্ষেত্রে ব্যাকটিরিয়ার অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ গড়ার তাগিদও সে কারণেই। এই পদ্ধতি খতিয়ে দেখতে গিয়েই খুলে গিয়েছে তাদের সমাজবদ্ধতার এক নতুন দিক, অলট্রুইজ়ম। অ্যান্টিবায়োটিকের হাত থেকে বাঁচতে ব্যাকটিরিয়া একাধিক পদ্ধতি অবলম্বন করে, যার মধ্যে অন্যতম বায়োফিল্ম তৈরি করা। বায়োফিল্ম আসলে অগুনতি ব্যাকটিরিয়ার সমাহারে তৈরি কলোনি। এই কলোনির মধ্যে ব্যাকটিরিয়ার বিপাকক্রিয়ার হার অনেকটাই কমে যায়।

ব্যাকটিরিয়ার কলোনির অ্যান্টিবায়োটিকের হাত থেকে বাঁচার আরও একটি উপায় হল, সোয়ার্মিং। একাধিক ব্যাকটিরিয়া যখন কোনও আপাতকঠিন বস্তুর উপরিভাগে ফ্লাজেলা নামক পায়ের সাহায্যে দৌড়ে পালিয়ে যায়, সেই ঘটনাকে বলা হয় সোয়ার্মিং। এমন ফ্লাজেলাযুক্ত ব্যাকটিরিয়ার কলোনিকে বলা হয় সোয়ার্ম। এই কলোনি বায়োফিল্মের মতো এক জায়গায় আটকে থাকে না। ২০১০ সালে রাসিকা হার্শের গবেষণাগারেই প্রথম প্রমাণিত হয়েছিল যে, ব্যাকটিরিয়ার সোয়ার্ম অ্যান্টিবায়োটিকের আক্রমণের বিরুদ্ধে সুরক্ষাপ্রাচীর গড়ে তোলে। তবে বেশ কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর অজানাই থেকে যায়। দেখা গিয়েছিল, অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাবে সোয়ার্মের মধ্যে অনেক ব্যাকটিরিয়াই মারা যায়। এটা কি একেবারেই কোল্যাটারাল ড্যামেজ? না কি সোয়ার্মের মধ্যের এই ব্যাকটিরিয়ার মৃত্যুরহস্য অন্য?

অধ্যাপক হার্শের গবেষণাগারে যোগ দেওয়ার পরে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা শুরু করেন সৌভিক। জানা যায়, ব্যাকটিরিয়ার সোয়ার্মের মধ্যে বেশ কিছু কোষ থাকে, যারা অ্যান্টিবায়োটিকের আক্রমণে মারা যায় সবার আগে। কিন্তু গোটা সোয়ার্মের অ্যান্টিবায়োটিক রেজ়িসট্যান্স গড়ে তুলতে এই কোষগুলোর কি বিশেষ কোনও ভূমিকা রয়েছে?

এর পরে কয়েক বছরের গবেষণায় উঠে আসে এক চমকে দেওয়ার মতো তথ্য— এই বিশেষ কোষগুলো আসলে অ্যান্টিবায়োটিকের আক্রমণে সোয়ার্মের ফার্স্ট লাইন অব ডিফেন্স, যারা নিজেরা মৃত্যুবরণ করে প্রথমেই, আর মৃত্যুর সময় গোটা সোয়ার্মকে পাঠায় বিপদ সম্পর্কে অ্যালার্ম। পরে সোয়ার্মের বাকি ব্যাকটিরিয়াকে আর মারতে পারে না অ্যান্টিবায়োটিক। গড়ে ওঠে গোষ্ঠীসুরক্ষা।

মৃত ব্যাকটিরিয়াগুলোর পাঠানো বার্তাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘নেক্রোসিগন্যালিং’। মারা যাওয়ার মুহূর্তে ব্যাকটিরিয়াগুলো এক বিশেষ প্রোটিন নিঃসরণ করে। নাম এসিআর-এ। এই প্রোটিন সোয়ার্মের বাকি সদস্য ব্যাকটিরিয়ার গায়ে বসে থাকা টিওএল-সি প্রোটিনের সঙ্গে জোট বাঁধে। টিওএল-সি হল এক ধরনের পাম্পবিশেষ। এদের কাজ ব্যাকটিরিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়া অ্যান্টিবায়োটিককে চটজলদি পাম্প করে বার করে দেওয়া। তবে সাধারণত এই পাম্প বন্ধই থাকে। একে চালু করতে বাইরে থেকে সাহায্য প্রয়োজন। এসিআর-এ ঠিক সেই কাজটাই করে, জোট বাঁধার পরে পাম্প চালু করে দেয়।

তবে শুধু পাম্প চালু করে বিষ বার করে দেওয়া নয়, বিষের প্রবেশও আটকায় এসিআর-এ। অ্যান্টিবায়োটিক পোরিন নামক প্রোটিনের সাহায্যে কোষে প্রবেশ করে, যা বন্ধ করে দেয় এসিআর-এ। এ ভাবেই বিপদ থেকে বাঁচতে বাকিদের প্রস্তুত করে কিছু স্বার্থত্যাগী ব্যাকটিরিয়া।

অলট্রুইজ়ম ধর্মের জন্য রেজ়িসট্যান্স বেড়ে যাওয়া নিশ্চয়ই ব্যাকটিরিয়ার সুরক্ষাকবচ কী ভাবে ভাঙা যাবে, সে বিষয়ে আরও তথ্য দেবে? আনন্দবাজারকে সৌভিক জানালেন, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, তাঁদের গবেষণা অ্যান্টিবায়োটিক রেজ়িসট্যান্স সমস্যার সমাধানে ভবিষ্যতে সহায়ক হবে। কিন্তু নেক্রোসিগন্যালিংয়ের গুরুত্বের পরিধি অনেকটাই বেশি। এই বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে অলট্রুইজ়ম আপাতদৃষ্টিতে বিবর্তনের সারভাইভ্যাল অব দ্য ফিটেস্ট তত্ত্বের সঙ্গে খাপ খায় না। বিবর্তনের ভাষায় ফিটনেস বা অস্তিত্বের লড়াইয়ে টিকে থাকা বলতে বোঝায় রিপ্রোডাকটিভ ফিটনেস বা জেনেটিক ফিটনেস। প্রত্যেক প্রাণীই চায় তার রিপ্রোডাকটিভ ফিটনেস বাড়াতে, অর্থাৎ, সন্তান উৎপাদন করে টিকে থাকতে। সন্তানের মধ্যে প্রাণীর জিন প্রবাহিত হবে এবং তা একের পর এক জননচক্রের মাধ্যমে ভবিষ্যতে স্থায়িত্ব পাওয়ার পথে হাঁটবে। এ ক্ষেত্রে সমস্ত জিনই ‘সেলফিশ’। স্বার্থপরের মতোই প্রতিটি জিন চায় নিজেকেই শুধু টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু এই তত্ত্বে বাদ সাধে অলট্রুইজ়ম। নিজেকে বলিদান দিলে সেই প্রাণীটির জিনের তো আর টিকে থাকা হল না। তা হলে?

অলট্রুইজ়মের ক্ষেত্রেও জিনের টিকে থাকাই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়। তবে একটি প্রজাতির একটি সদস্যের জিনকে নয়, সমগ্র গোষ্ঠীর সামগ্রিক জিনের এবং শেষ পর্যন্ত বিবর্তনের লড়াইয়ে গোটা প্রজাতির টিকে থাকাই গুরুত্ব পায়। বর্তমান পৃথিবীতে শুধু নিজেকে যোগ্যতর প্রমাণ করার চেষ্টায় মরিয়া না হয়ে বরং গোটা প্রজাতির অস্তিত্বের কথা ভেবে স্বার্থত্যাগ— মানবজাতিকে এই শিক্ষাই দেয় ছোট্ট ব্যাকটিরিয়ার আত্মবলিদান।

অন্য বিষয়গুলি:

Altruism Bacteria
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy