প্রতীকী ছবি।
আকাশে সিঁদুরে মেঘ। উল্টোডাঙার ব্রিজটা মেরামতির জন্য গাড়িগুলো সব রাজারহাট দিয়ে ঘুরছে। আপনি ঘড়ি দেখছেন। ন’টা পনেরোর ফ্লাইট। পৌঁছবে এগারোটা চল্লিশে। এমএনসি কোম্পানিতে দু’টোয় মিটিং। ছত্রপতি শিবাজিতেই লাঞ্চ সেরে নিতে হবে। ধোসা আর চা। সামনে লম্বা গাড়ির সারি। অতি মন্থর গতি। প্লেনটা মিস না হয়! টপ ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে মিটিং। আপনি ভাবছেন, এই সময় যদি আকাশ দিয়ে উড়ে ট্যাক্সিটা এয়ারপোর্টে যেতে পারত। এই ধরনের ভাবনা এখন একেবারেই অবাস্তব নয়। আরবান এয়ার মোবিলিটি বা ইউএএম। স্বয়ং নাসা থেকে শুরু করে বিশ্বের তাবড় সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো এখন এই প্রযুক্তির বাস্তবায়নের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
ষাটের দশক। রাইট ব্রাদার্সের দৌলতে বিমান তত দিনে আমাদের বাস্তব জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে উঠেছে। অ্যাম্বাসাডর ফিয়েট করভেটেরও তত দিনে ছড়াছড়ি। কিন্তু উড়ন্ত ট্যাক্সি নিয়ে কেউ খুব একটা মাথা ঘামাননি। এ সময় দ্য জেটসন’স নামে কল্পবিজ্ঞান-ভিত্তিক এক সিটকম মার্কিন টেলিভিশনে খুব জনপ্রিয় হয়। ছেলেমেয়ে, রোবট পরিচারিকা ও কুকুর নিয়ে সস্ত্রীক জর্জ জেটসন থাকতেন অরবিট সিটির স্কাইপ্যাড অ্যাপার্টমেন্টে। অফিস, স্কুল, বেড়াতে যাওয়া— সব কিছুতেই জেটসনরা ব্যবহার করত ছোট নিজস্ব উড়োযান। এখনকার ভাষায় জেট ট্যাক্সি।
এ বার ক্লোজআপ একুশ শতকে। ২০০১ সালে নাসা ল্যাঙ্গলে থেকে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে প্রথম স্মল এয়ারক্র্যাফট ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম তৈরির প্রস্তাবনা। বলা হয়, ২০০৫ সালের মধ্যে নাসা প্রায় সাত কোটি ডলার ব্যয় করে এমন এক ছোট জেট ট্যাক্সি তৈরি করবে, যা হাইওয়ের দৈনন্দিন জট ও বিমান ট্রাফিকের অনিশ্চয়তা থেকে যাত্রীদের মুক্তি দেবে। প্রাইভেট গাড়ির মতো ব্যক্তিগত কাজেই এই উড়োযানগুলি ব্যবহার করা হবে। শুধু শহর নয়, গ্রামের মানুষও এতে উপকৃত হবেন।
ইউএএম, জেট ট্যাক্সি বা ফ্লাইং কার। ছোট এই বিমানগুলি ট্যাক্সির মতোই অল্প দূরত্বের কোনও গন্তব্যে নিয়ে যাবে। ৫০০ থেকে ২৫০০ কেজির এই যানগুলিতে ৫০ থেকে ২৫০ কেজি ওজন বহন করা যাবে। বিশেষত ব্যাটারি শিল্পের প্রচুর উন্নতি হওয়াতে ছোট বিমানগুলি ইদানীং ব্যাটারিচালিত করা সম্ভব হয়েছে। এতে তেল, পোড়া, ধোঁয়ার কার্বন দূষণ নেই। ফলে ইলেকট্রিক ভারটিকল টেক অফ অ্যান্ড ল্যান্ডিং সংক্ষেপে ই-ভিটল বলে একটা কথা আজকাল খুব শোনা যাচ্ছে। বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। ইতিমধ্যে এয়ারবাস, উব্র থেকে শুরু করে আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার কমবেশি একশোটি ছোটবড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ইউএএম সেক্টরে নেমে পড়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০৩৯ সালের মধ্যে এই সেক্টরের লগ্নিমূল্য হবে দেড় ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এখনকার হিসাবে এক কোটি কোটি টাকা!
অতএব, ছোটবড় কেউই পিছিয়ে থাকছেন না। গুগলের সৃষ্টিকর্তা ল্যারি পেজ সম্প্রতি কিটি হক কর্পোরেশন নামে একটি ছোট কোম্পানিকে দুটি ইভিটল তৈরির প্রজেক্টে মূলধন জুগিয়েছেন। প্রথম প্রজেক্ট কোরা। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে দুই প্যাসেঞ্জারের এই হাওয়া গাড়ির উদ্বোধন করা হয়। কোরার ফ্লাইট টেস্টিং হয়েছে ক্যালিফর্নিয়া আর নিউজিল্যান্ডে। দ্বিতীয় প্রজেক্ট, কিটি হক ফ্লায়ার। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সমান বিচরণের জন্য এই মাল্টিকপ্টারের সৃষ্টি। এতে দশটি রোটর বা ঘূর্ণিপাখা আছে। আছে ডিস্ট্রিবিউটেড ইলেকট্রিক প্রোপালশন বা ডিইপি নামে এক বৈদ্যুতিন ব্যবস্থা। কিটি হক নর্থ ক্যারোলিনার বিখ্যাত শহর। এখানে ১৯০৩ সালে রাইট ভ্রাতৃদ্বয় তাঁদের প্রথম বিমান উড়িয়েছিলেন। পেজ আরও একটি কোম্পানিতে টাকা ঢালছেন। এদের হাওয়া গাড়ির নাম ব্ল্যাক ফ্লাই। অত্যাধুনিক কম্পোজিট পদার্থ দিয়ে তৈরি বলে খুব হালকা। ইতিমধ্যে চোদ্দোশো ফ্লাইট টেস্ট হয়েছে। বারো হাজার মাইল উড়েছে কালো মাছি।
ও দিকে ফ্রান্সের মার্সেই-এর কাছে এয়ারবাস ও গাড়িনির্মাতা আউডি মিলে গোপনে আর একটি জেট ট্যাক্সির পরীক্ষা করছে। সম্প্রতি মাঠে নেমেছে প্লেন কোম্পানি বোয়িং। কিটি হকের সঙ্গে তাদের এক চুক্তি হয়েছে। বিখ্যাত গাড়ির কোম্পানি এস্টন মার্টিন ও রোলস রয়েস জুটি বানাচ্ছে উঁচুমানের হাওয়া গাড়ি। ক্যালিফর্নিয়ার প্যারাগন ভিটল এরোস্পেস জার্মানির সিমেনস কোম্পানির সফটওয়্যার ব্যবহার করে বানাচ্ছে টি-২১ র্যাপটর নামে এক নতুন ডিজাইনের ইউএএম। চুক্তি হিসাবে তা প্রথম উড়বে জামাইকার আকাশে। ২০১৯ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার আন্তর্জাতিক গাড়ির কোম্পানি হুন্ডাই ঘোষণা করেছে তারাও নতুন ইউএএম ডিভিশন খুলছে। এই ডিভিশনের দায়িত্বে থাকছেন নাসা কর্মী জয়ুন শিন। তিনি তিরিশ বছর নাসায় কাজ করেছেন। হুন্ডাই-এ যোগ দেওয়ার আগে তিনি ছিলেন নাসার এরোনটিকস রিসার্চ মিশন ডিরেক্টরেট-এর সহকারী অধিকর্তা। এক্স প্লেন তৈরিতেও তাঁর অবদান আছে। পাশাপাশি পশ্চিম এশিয়াও পিছিয়ে নেই। গত দু’বছর ধরে দুবাই শহরে পরীক্ষামূলক ভাবে টু-সিটার জেট সার্ভিস শুরু হয়েছে। পরিবহণ দফতরের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে শহরের ২৫ শতাংশ যাত্রী জেট ট্যাক্সি ব্যবহারের সুযোগ পাবে।
ট্রেনে-বাসে চিড়েচ্যাপ্টা ভিড়। অ্যাক্রোপোলিস বা আরসিটি মল যেতে আপনি ওলা বা উব্র ভাড়া করেন। তাও জ্যামে পড়ে মুভি-মিটিং মিস হয়। নিজস্ব গাড়ি থাকলেও এ সমস্যা থেকে নিস্তার নেই। জেট ট্যাক্সি চালু হলে অবশ্য আলাদা কথা। পাড়ার মাঠই তখন হেলিপ্যাড। গাড়ির ধোঁয়া নেই। যানজট নেই। ফোন করুন। হাওয়ায় উড়ুন। জায়গামতো পৌঁছে যান। কিছু দিন বাদে হাতের মুঠোয় আসছে জেটসনের দুনিয়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy