Advertisement
E-Paper

মেঘ সরিয়ে নতুন পৃথিবীর উদয়

১৮৪৩ সালে দুই ভাই, আলেকজান্ডার ও ড্যানিয়েল ম্যাকমিলান কেমব্রিজে একটি বইয়ের দোকান ও প্রকাশনা সংস্থা শুরু করেন। ১৮৫৭ সালে ড্যানিয়েলের মৃত্যুর পর আলেকজান্ডার ব্যবসার হাল ধরেন।

অর্ঘ্য মান্না

শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৪:২৩
Share
Save

সালটা ১৮৬৮। ৩২ বছরের নরম্যান লকইয়ের তখনও রয়্যাল সোসাইটি-র সভ্য নির্বাচিত হননি। উইম্বলডনে স্থাপিত এক যুদ্ধ-সংক্রান্ত দফতরে তিনি কেরানির কাজ করছেন। বাধ সাধল কর্তৃপক্ষ। মন দিয়ে কাজ করা সত্ত্বেও চাকরিতে কোনও রকম উন্নতি হল না লকইয়ের-এর। পেট চালানোর জন্য কেরানির চাকরি করতে হলেও লকইয়ের-এর প্রথম প্রেম ছিল বিজ্ঞান। নামী কোনও গবেষণাগারে কাজের সুযোগ না মিললেও বিজ্ঞান সাংবাদিকতা করে তিনি দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতেন। ১৮৬২ সালে থমাস হিউগস ‘রিডার’ নামে এক পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন। লকইয়ের সেখানে মাঝে মাঝে বিজ্ঞান বিষয়ক খবর লিখতেন। কেরানির চাকরিতে ইতি টেনে লকইয়ের ঠিক করেন পুরোপুরি বিজ্ঞান সাংবাদিকতায় মন দেবেন। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। মালিকানা বদল হওয়ায় রিডার-এ লেখার সুযোগটাও হারান তিনি। সে সময় প্রায়ই মানসিক অবসাদে ভুগতেন তিনি। লকইয়ের বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি যে ভাবে বিজ্ঞান সাংবাদিকতা করতে চান, সে সুযোগ ব্রিটেনে নেই। এর জন্য প্রয়োজন একটি নতুন পত্রিকা, যা ছাপতে রাজি হবে কোনও নতুন প্রকাশক। নিজেও জানতেন না পরের বছরই তাঁর ভাগ্য বদলাতে চলেছে।

১৮৪৩ সালে দুই ভাই, আলেকজান্ডার ও ড্যানিয়েল ম্যাকমিলান কেমব্রিজে একটি বইয়ের দোকান ও প্রকাশনা সংস্থা শুরু করেন। ১৮৫৭ সালে ড্যানিয়েলের মৃত্যুর পর আলেকজান্ডার ব্যবসার হাল ধরেন। সে সময় ইংল্যান্ডে সাপ্তাহিক পত্রিকার খুব চল। তবে সে সমস্ত পত্রিকার বেশির ভাগই ছিল শিল্প, সাহিত্য বা রাজনীতি বিষয়ক। উনিশ শতকের ব্রিটিশ তরুণদের সিংহভাগই চাইতেন পার্লামেন্টে যোগ দিতে। তাতে সামাজিক অবস্থার উন্নতি হত খুব দ্রুত। বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন হাতে গোনা কয়েক জন। আলেকজান্ডার তাঁর ম্যাকমিলান প্রকাশনা সংস্থার পক্ষ থেকে একটি পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করেন, ‘ম্যাকমিলান’স ম্যাগাজিন’। তাতে অবশ্য বিজ্ঞানের খবর থাকত খুবই কম। কিন্তু আলেকজান্ডার নিজে ছিলেন বিজ্ঞানভক্ত, তাই প্রতি বৃহস্পতিবার বইয়ের দোকানে এক বিশেষ আলোচনাচক্রের আয়োজন করতেন। ‘টক, টোব্যাকো অ্যান্ড স্টিপল’ নামের সেই সাপ্তাহিক আলোচনাচক্রে জড়ো হত বিজ্ঞানে উৎসাহী তরুণ প্রজন্ম। সেখানেই আলেকজান্ডার ও নরম্যান লকইয়ের-এর দেখা হয়, গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। ম্যাকমিলান প্রকাশনা লকইয়ের-এর লেখা এলিমেন্টারি ‘লেসনস ইন অ্যাস্ট্রনমি’ বইটি ছাপতে রাজি হয়। নতুন বিজ্ঞানপত্রিকা প্রকাশের প্রস্তাবেও সায় দেন আলেকজান্ডার। ১৯৬৯ সালের ৪ নভেম্বর ব্রিটেনের সমস্ত বইয়ের দোকানে অন্য পত্রিকার পাশাপাশি দেখা যায় এক নতুন পত্রিকা ‘নেচার: আ উইকলি ইলাস্ট্রেটেড জার্নাল অব সায়েন্স’। প্রথম পাতায় এনগ্রেভার জেমস ডেভিস (যিনি পরে চার্লস ডারউইনের ‘এক্সপ্রেশনস অব ইমোশনস ইন ম্যান অ্যান্ড অ্যানিম্যাল’ বইয়ের ইলাস্ট্রেশন করে বিখ্যাত হন)-এর শিল্পকর্ম। বিষয়, মেঘের পর্দা সরিয়ে মহাকাশে উদয় হচ্ছে এক নতুন পৃথিবী।

‘নেচার’ পত্রিকা প্রকাশ নিঃসন্দেহে বিজ্ঞান প্রকাশনার জগতে ছিল এক নতুন পৃথিবী উদয়ের মতোই ঘটনা। এই বছরের নভেম্বর মাসে ১৫০ বছর পূ্র্ণ করল পত্রিকাটি। অস্বীকার করার উপায় নেই, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক বিজ্ঞানপত্রিকা এটি। এখানে গবেষণাপত্র ছাপানোর জন্য মুখিয়ে থাকেন বিজ্ঞানীরা। তবে শুরুর দিনগুলি এমন গৌরবময় ছিল না। উনিশ শতকের আগে পর্যন্ত ব্রিটেন তথা গোটা বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত বিজ্ঞানের জার্নাল ছিল লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি প্রকাশিত ‘ফিলজ়ফিকাল ট্রানজ়াকশন’। ১৬৬৫ সাল থেকে প্রকাশিত এই পত্রিকায় জায়গা পেয়েছে রবার্ট হুক, অ্যান্টনি ভন লিউয়েনহোয়েক থেকে শুরু করে আইজাক নিউটনের লেখা। কিন্তু ‘ফিলজ়ফিকাল ট্রানজ়াকশন’ পড়ার সুযোগ মিলত হাতেগোনা কিছু মানুষের। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরেই ছিল এটি। ১৮৪৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হতে শুরু করে ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’। ছবি ও লেখায় সমৃদ্ধ জনপ্রিয় এই পত্রিকা বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি সাধারণ পাঠকের কাছেও জনপ্রিয় ছিল। অনেকটা সেই ধরনের পত্রিকাই প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন লকইয়ের। ব্রিটেনে সে সময় ‘কেমিক্যাল নিউজ’ নামে এক পত্রিকা জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘নেচার’ পত্রিকার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন মেলিন্ডা বল্ডউইন। তাঁর পিএইচডি থিসিস (যা পরে ‘মেকিং নেচার: দ্য হিস্ট্রি অব আ সায়েন্টিফিক জার্নাল’ নামে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়) থেকে জানা যায় লকইয়ের ‘নেচার’ পত্রিকা ছাপানোর আইডিয়া পেয়েছিলেন ‘কেমিক্যাল নিউজ’ দেখেই। এমনকি পত্রিকার বিভাগগুলিও তিনি ঠিক করেছিলেন ‘কেমিক্যাল নিউজ’-এর ধাঁচে। কিন্তু ১৮৯০ সাল পর্যন্ত ‘নেচার’ পত্রিকা লাভজনক ব্যবসা করতে পারেনি। ১৮৭১ সালে লকইয়েরকে লেখা আলেকজান্ডার ম্যাকমিলানের চিঠি সেই সাক্ষ্য বহন করে। চিঠিতে ম্যাকমিলান স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, ‘নেচার’-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি চিন্তিত। পত্রিকা প্রকাশের খরচ সামলানো তাঁর পক্ষে কষ্টকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তা ছাড়া সে সময় ব্রিটেনে একাধিক জনপ্রিয় পত্রিকা। ‘কর্নহিল ম্যাগাজ়িন’, ‘চেম্বার্স এডিনবরা জার্নাল’, ‘স্টুডেন্টস অ্যান্ড ইন্টেলেকচুয়াল অবজ়ার্ভার’দের ছাপিয়ে শুধুমাত্র বিজ্ঞান বিষয়ক একটি পত্রিকার ব্যবসা করা প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও টিকে গেল ‘নেচার’। কী ভাবে?

এডিটর: নরম্যান লকইয়ের শুরু করেন জার্নাল ছাপা। (নীচে) প্রথম সংখ্যার প্রথম পাতায় ব্যবহৃত ছবি

লকইয়ের প্রথম থেকেই ‘নেচার’কে একটি বিজ্ঞান বিষয়ক সংবাদপত্র হিসেবে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন, পুরোদস্তুর সায়েন্টিফিক জার্নাল হিসেবে নয়। ফলে প্রথম দিকে ব্যবসায় লাভ করতে না পারলেও অন্য সায়েন্টিফিক জার্নালের তুলনায় এই পত্রিকা সাধারণ মানুষ বেশি পড়ত। এ ছাড়াও বল্ডউইনের গবেষণা থেকে জানা যায় ‘নেচার’ খবর ছাপায় ছিল দ্রুততম। পাঠকের চিঠিপত্র, বিজ্ঞানের কোনও আবিষ্কার যে সপ্তাহে ঘটছে, সেই সপ্তাহেই পাতায় জায়গা দেওয়া, পাঠকের চিঠির দ্রুত উত্তর দেওয়া, এই সমস্ত বিষয়ে অন্য পত্রিকার সম্পাদকদের থেকে এগিয়ে ছিলেন লকইয়ের। ১৮৮০ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে বিজ্ঞান বিষয়ক মৌলিক গবেষণাপত্র ছাপা শুরু করে ‘নেচার’। লকইয়ের নিজেও তত দিনে বিজ্ঞান গবেষক হিসেবে নাম করে ফেলেছেন। সাউথ কিংসস্টোন সোলার ফিজিক্স ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করছেন। ১৮৯০ সালের পর থেকে লাভের মুখ দেখা শুরু করে ‘নেচার’। তখন বিজ্ঞান বিষয়ক খুচরো খবর, গবেষণা-সংক্রান্ত কোনও যন্ত্রপাতির বিজ্ঞাপন বা মৌলিক গবেষণা ছাপানোর আদর্শ পত্রিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে এই পত্রিকাটি।

১৯০৩ সালে উইলিয়াম র‌্যামসের হিলিয়াম গ্যাস আবিষ্কারের গবেষণা ছাপে ‘নেচার’। ১৯২১ সালে রসায়নে নোবেল প্রাইজ পান র‌্যামসে। এর পর একের পর এক নোবেলজয়ী গবেষণা জায়গা পেতে থাকে ‘নেচার’-এর পাতায়। ১৯২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারির প্রথম বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে ‘নেচার’। সেই সংখ্যার প্রতি পাতাতেই ছিল অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি তত্ত্ব সংক্রান্ত আলোচনা। আইনস্টাইন তখন গোটা বিশ্বের বিজ্ঞান জগতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। তাঁকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা ছিল ‘নেচার’-এর সম্পাদক মণ্ডলীর মাস্টারস্ট্রোক।

জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছতে ‘নেচার’-এর আর দেরি হয়নি। দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝের বছরগুলিতেই বিজ্ঞান গবেষণাপত্র প্রকাশের সবচেয়ে পছন্দের জার্নাল হয়ে দাঁড়ায় এটি। সেই সময় ভারতীয় বিজ্ঞানকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল এই সাপ্তাহিক পত্রিকা। ১৯৩০ সালের ২২ মে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর ‘গ্রোথ অ্যান্ড ট্রপিক মুভমেন্টস অব প্লান্ট’ বইয়ের পাতাজোড়া গ্রন্থ সমালোচনা ছাপে ‘নেচার’।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী অধ্যায়ে পত্রিকায় বেশি করে জায়গা পেতে শুরু করে জীববিদ্যা-সংক্রান্ত নতুন নতুন গবেষণা। ১৯৫৩ সালের ২৫ এপ্রিল জেমস ডিউই ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ক্রিকের ডিএনএ অণুর গঠন আবিষ্কার-সংক্রান্ত গবেষণা ছেপেছিল ‘নেচার’। সঙ্গে ডিএনএ-র যুগ্ম সর্পিল (ডাবল হেলিক্স)-এর হাতে আঁকা ছবি। পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর ভোটে গত ১০০ বছরে এটিই পত্রিকায় প্রকাশিত সবচেয়ে চর্চিত ও জনপ্রিয় গবেষণাপত্র। মাত্র ৯ বছরেই নোবেল প্রাইজ় আসে ওই পেপারের সুবাদে।

১৫০ বছর পরে ‘নেচার’ এখন শুধুমাত্র একটি পত্রিকা নয়, একটি প্রতিষ্ঠানও। বর্তমানে ১০০-রও বেশি বিভিন্ন শাখা-জার্নাল এখন ছাপা হয় ‘নেচার’-এর নামে। পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞান গবেষণায় উৎসাহ দিতে একাধিক বৃত্তি চালু করেছে ‘নেচার’। তবে ১৮৬৯ সালে যে পত্রিকার যাত্রা শুরু, তাতে প্রথম মহিলা সম্পাদক নিয়োগ করতে লেগে গিয়েছে ১৪৯ বছর। ২০১৮ সালে পত্রিকার ইতিহাসে প্রথম মহিলা প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী অ্যান ওরমেরড। আশা করা যায়, তাঁর হাত ধরে গবেষণাপত্র ছাপানোর পাশাপাশি বিজ্ঞানে লিঙ্গবৈষম্য দূর করতেও নতুন পদক্ষেপ করবে চিরসবুজ এই পত্রিকা।

Science Science Journal Nature

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।