Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪

আয় মিষ্টি ঝেঁপে, রেসিপি মেনে বাড়িতেই এ বার হরেক মিষ্টান্ন

বিজয়া থেকে বিশ্বকাপ, মিষ্টি বিনা আনন্দ জমে কি? রইল সেরা মিষ্টিদের সরেস লিস্টি।

চিরশ্রী মজুমদার
শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৯ ০১:০২
Share: Save:

হাল্লা রাজার সেনাকে থামাতে গুপি-বাঘার সুরের মায়াও যথেষ্ট ছিল না। শেষবেলায় নামল মিষ্টির বৃষ্টি। কাঁড়ি কাঁড়ি মন্ডা মিঠাই, হাঁড়ি হাঁড়ি মিহিদানা, পুলিপিঠে, জিভেগজা মিঠে মিঠে। তাতেই শত্রুরা কুপোকাত। যে সময়ের গল্পটি, তখন বাঙালি মোটামুটি এই ক’রকম মিষ্টিতেই রাজ্যজয় করত। দুধে গুড় বা চিনি মিশিয়ে বা বেসনের মধ্যে নারকেল কোরা, মিহি করে পেষাই ডালসিদ্ধ মাখিয়ে উপাদেয় সব মিষ্টি ও লাড্ডু পাকানো চলত। চালের গুঁড়ো, ময়দার গুলি ভেজে বারকোশে চুড়ো করে তোলা হত দেবভোগ্য অন্নভোগ। তার পরে এল পর্তুগিজ বণিক। তাঁদের থেকে ছানা কাটানোর কৌশল শিখলেন বাঙালি কারিগর। হাতাখুন্তির গুণে জন্ম নিল রংবেরঙের, সুস্বাদু সন্দেশবর্গ। ব্যস, মিষ্টি চলল দিগ্বিজয়ে!

কাসনিদানা আবার খাব

উনিশ শতকে নবীনচন্দ্র দাশের রসগোল্লা আবিষ্কারের আগে আতা সন্দেশ, কাঁঠাল সন্দেশ এবং মন্ডার জাঁক ছিল। মেলায় পার্বণে ছেলেপিলেরা চাইত আদাকুচি, মৌরি বসানো চৌকো গজা আর চটচটে খাজা। বিয়েবাড়ি আলো করত পেনেটির গুপো সন্দেশ। খাইয়েরা সে মিষ্টি এক বারেই তিরিশ-চল্লিশটা উড়িয়ে ম্লান মুখে দেখতেন, জালায় চড়ে আসছে ক্ষীর ও দই। রসগোল্লা কলকাতা জুড়ে তুফান তুললেও, সঙ্গেই জনপ্রিয় হয় তিলকূট, আমসন্দেশ ও কামরাঙা মিঠাই। তখন কলকাতায় ব্রিটিশের রাজত্ব আর তাদের রসনার শাসনে বঙ্গজ মিষ্টি, শুকনো আর ভিজে। রসগোল্লার পথে এল পান্তুয়া, কালোজাম বা লেডি ক্যানিংয়ের সম্মানে ভীম নাগের তৈরি লেডিকেনি। এই পঙ্‌ক্তিরই শেষতম আগন্তুক রসমালাই। কাছাকাছি সময়ে এসেছে গোলাপি পেড়া, চন্দ্রপুলি, পাপড়ি-সন্দেশ। নতুন জামাইকে ঠকাতে হুগলির হালুইকররা তৈরি করেন জলভরা তালশাঁস। কড়াপাকের মিষ্টি ভেবে গম্ভীর বাবাজীবন কামড় বসালেই তাঁর নতুন পাঞ্জাবিটি ভিজে টুসটুসে। রবীন্দ্রনাথেরও বড় শখের ছিল জলভরা তালশাঁস। ঠাকুরবাড়ির অতিথি আপ্যায়নের রেকাবিতে তালশাঁস ছাড়াও থাকত মনোহরা, ক্ষীরকমলা, ক্ষীরতুষার, কাসনিদানা এবং আবার খাবো। শেষ মিষ্টির নামকরণের ইতিহাসটিও মধুর। রসগোল্লার কলম্বাস নবীনচন্দ্রকে কাশিমবাজারের মহারানি ফরমায়েশ করেছিলেন নতুন মিষ্টি তৈরির। তিনি তাঁর সৃষ্টিটি রানিকে উপঢৌকন পাঠাতেই, আপ্লুত রানি বলেন ‘আবার খাবো!’

সন্দেশে মিলিল নোবেল

বহু দিন ধরেই মিষ্টির ওস্তাদরা কেবল বিশিষ্ট অতিথির সম্মানে ও দিনক্ষণকে স্মরণীয় করতে কড়ায় জাদুদণ্ড থুড়ি খন্তা ঘুরিয়ে অবলীলায় বানিয়ে চলেছেন নিত্যনতুন কীর্তি। স্বাধীনতার সময়ে তৈরি তেরঙা সন্দেশ আজও ১৫ অগস্ট ও ২৬ জানুয়ারির শোভাবর্ধক। পঞ্চাশের দশকে রুশ প্রেসিডেন্ট চমচম গালে পুরে নাকি মাতৃভাষায় বলে ওঠেন, ‘বাহবা! বেশ তো! আর দুটো পেলে ভালই হত।’ সেই থেকে ওই মিষ্টির নাম বুলগানিন চমচম।

কড়াপাক, নরমপাকের অগণিত হিরে-জহরত প্রসঙ্গে সাহিত্যিক শংকরের বিখ্যাত উক্তি, এই ময়রাকুল পাইকারি হারে মিষ্টিশাস্ত্রে নোবেল পাওয়ার যোগ্য। শীতে, গ্রীষ্মে ফলফুলের মতো মিষ্টিরও যে নানা রূপ, সে তো সকলেই জানেন। এমনকি, মাসভেদেও মিষ্টি ভিন্ন ভিন্ন। প্রভেদ আছে একই গলির প্রথম ও শেষ দোকানের স্পেশ্যালিটিতেও। কোনও ময়রার দোকানে ভিড় হয় চিত্রকূটের নামে, কোথাও খদ্দের ছুটে আসেন পারিজাতের টানে।

দোহাই, মাথাটি কাটবেন না

কলস রসগোল্লা বা বেকড, অমৃতকুম্ভ (গ্রীষ্মে পায়েসে ভরা, শীতে নলেন গুড়ে মোড়া), ভাপা দইরা এখন মিষ্টিকুলের বিশ্বজনীন সেলেব্রিটি। তাঁরা বাদেও, বঙ্গের গ্রামেগঞ্জে একুশ শতকেও জমিদারি বজায় রেখেছেন মিষ্টিকুলের মহারথীরা। কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে ময়রারা জ়াফরান দিয়ে চারটি স্তরে সোনালি করে ভেজে তৈরি করেন সরপুরিয়া। সেই সরপুরিয়া ও তার তুতো ভাই সরভাজা মুঘল দরবারের পর্যন্ত মন কেড়েছিল। তার মতোই আজও মহিমায় অম্লান জয়নগরের মোয়া, বালুরঘাটের বালুসাই, মেচেদার অমৃতি, রানাঘাটের পান্তুয়া, শক্তিগড়ের ল্যাংচা, বর্ধমানের সীতাভোগ ও মিহিদানা। তবে উচ্চবংশ কিনা, তাই এঁদের পরিবেশনেও কয়েকটি বিধি মেনে চলা কর্তব্য। যেমন নবদ্বীপের লাল দই এমন পারিপাট্যে ভাগ করতে হবে, যাতে কারও পাত থেকেই এই দইয়ের মাথাটি না কাটা পড়ে। আলখাল্লা রঙের দরবেশ যদি পাতের ’পরে গুঁড়ো হয়ে যায়, তবে তার সম্মানহানি হয়। পান্তুয়া যদি কড়া থেকে এক সঙ্গে ঠিক দুটো করে না তোলা হয়, তবে তার রসক্ষুণ্ণ হওয়ার তুমুল সম্ভাবনা ইত্যাদি!

তুমি ছদ্মবেশী, মরীচিকা তুমি

ফিউশন মিষ্টি বহু আগে থেকেই এই বাংলায় বিদ্যমান। দুধেল আমসত্ত্বের প্রলেপ দেওয়া ক্ষীরসন্দেশ, তবকের চূর্ণে সাজানো পটোলপুলির স্বাদগন্ধের কাছে আজকের চকলেট সন্দেশ বালখিল্য। ছদ্মবেশ ধরতেও এই সব মিষ্টিদের জুড়ি নেই। হালুয়া নামে যা সাধারণের জলখাবার, তাই সোনার পাত্রে মোহনভোগ রূপে নবাব-বাদশাদের দেখা দিয়েছে। রাস্তাঘাটে যা সাদাসিধে জিভেগজা, দারচিনি, কাজু, কিশমিশের প্রসাধন শেষে রাজদরবারে সেই নাকি সুরভিত লবঙ্গলতিকা!

ইদানীং বঙ্গসন্তানরা টার্ট, মুজ় নামের বিলেতি সুইটিতে মন ভিড়িয়েছেন। কিন্তু যে দিন সকালে পিৎজ়া-স্যান্ডউইচে বিরক্তি বোধ করবেন, দুটো ফুলকো লুচি দিয়ে ঝাল ঝাল শুকনো আলুরদম খেয়েই তিন নম্বর লুচিটির প্রান্তদেশ ছিঁড়ে, সামান্য মাখা সন্দেশে ভরে খেয়ে দেখবেন প্লিজ়! স্বাদকোরকে স্বর্গের ঘণ্টা বাজবে!

অন্য বিষয়গুলি:

Sweet Recipes Bengali Sweets মিষ্টি
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy