Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

পলান্ন, বিরিয়ানি বা ভুনি খিচুড়ি বানানোর কায়দাকানুন

দুই বাংলা জুড়ে পদের বৈচিত্র নেহাত কম নয়। কোথাও মশলা পড়ে কম, কোনওটা আবার মশলাদার। কোনওটা গুরুপাক, আবার কারও স্বাদ ফিকে। তবে এই বিপুল বৈচিত্রই স্বতন্ত্র করেছে বাংলার রান্নাবান্নাকে।

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৯ ০১:১৬
Share: Save:

নদীমাতৃক দেশে প্রধান খাদ্য যে চালনির্ভর, তা শুধু ভারত বা বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানচিত্রে চোখ রাখলেই মালুম হয়। চালের ব্যবহার হয়ে আসছে কোন যুগ থেকে। অস্ট্রিকভাষী আদিবাসী থেকে শুরু করে হরপ্পা, মহেঞ্জোদড়ো সভ্যতা, বৈদিক যুগ, উপনিষদ যুগে চালের ব্যবহার ছিল। চর্যাপদে চালের ব্যবহারের প্রমাণ মেলে। মধ্যযুগে ভাত ও চালজাত নানা পদের বিপুল ব্যবহার দেখা গিয়েছে। এত বছর পেরিয়ে গেলেও চালের সেই ভূমিকা আজও অব্যাহত।

মোটা দাগে ভাগ করলে চাল দু’রকমের— সিদ্ধ ও আতপ। ‘বাঙালির খাদ্যকোষ’-এ মিলন দত্ত লিখছেন, ‘‘১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বাংলায় সাড়ে পাঁচ হাজার জাতের ধানের নাম পাওয়া যায়। তার বেশিরভাগই লুপ্ত।’’ তবে এখন যা যা চাল পাওয়া যায়, তা-ও নেহাত কম নয়। বাঙালি রোজকার পাতে সিদ্ধ চালের ভাত খেতে ভালবাসে।

তবে শুধু ভাত নয়, তাকে বাহারি করে তোলাতেই খাদ্যসুখ। খিচুড়ি, পোলাও, বিরিয়ানি এসেছে সেখান থেকেই। প্রাচীন সংস্কৃতে পোলাওয়ের উল্লেখ ছিল ‘পল্লাও’। পল অর্থাৎ মাংস ও অন্ন মিলিয়ে পলান্ন নামটাই বেশি পরিচিত। সাবেক পলান্ন মাংস ছাড়া হত না।

পলান্ন

মুসলমান-রাজত্বের সময় থেকে পদটির নাম বদলে যায় পোলাওয়ে। প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী লিখেছেন, ‘‘সামান্য ভাতও রাঁধিবার গুণে রাজভোগ্য খাদ্যে পরিণত হইতে পারে, পোলাও তাহার প্রমাণ।’’ বাঁকতুলসী, চিনিশর্কর, বাসমতী, পেশোয়ারী, চামরমণি চাল দিয়ে পোলাও ভাল হয়। না পাওয়া গেলে কাজ চালানো যেতে পারে খাড়াবেড়ে, মুচিরাম, চিনিশঙ্কর জাতীয় আতপ চালেও। ‘‘বাদাম, পেস্তা এবং কিসমিস ইহারা প্রায় সকল পোলাওয়েই ব্যবহৃত হয়। ইহারা খাদ্যের ‘সোহাগ’ উৎপাদন করে।’’ তবে পোলাওয়ের স্বাদ আসে আখনি থেকেই।

রামমোহন দোলমা পোলাও (এ পার বাংলা)

উপকরণ: পটোল ২৩টি, ঘি ৪ টেবিল চামচ, মোরব্বা ২৫০ গ্রাম (কমলালেবু, কুমড়ো মিঠাই, আদা), পোলাওয়ের চাল ২৫০ গ্রাম, জল ১ লিটার, বাদাম ১২০ গ্রাম, পেস্তা ৩০ গ্রাম, কিশমিশ ১৫০ গ্রাম, দুধ ১/৪ লিটার, চিনি ২৫০ গ্রাম, বড় কাগজিলেবু ২টি, জাফরান ৭০০-৮০০ মিলিগ্রাম, গরমমশলা গুঁড়ো এক চিমটি।

প্রণালী: বীজ ফেলে সাতটি পটোল কুচিয়ে নিন। বাকি পটোল খোসা ছাড়িয়ে বীজ বার করে নিন। মোরব্বা, বাদাম, পেস্তা কুচি করে নিন। আধ লিটার জলে পটোল কুচি সিদ্ধ করুন। ছ’-সাত মিনিট পরে গোটা পটোলও ছেড়ে দিন। কয়েক মিনিট সিদ্ধ করে, নামিয়ে, জল নিংড়ে নিন। পটোল কুচির মধ্যে ৩০ গ্রাম করে কিশমিশ, বাদাম ও ৬০ গ্রাম মোরব্বা মেশান। গোটা পটোলের মধ্যে পুর ভরে সুতো জড়িয়ে নিন। দেড় কাপ জলে দারচিনি, এলাচ, লবঙ্গ দিয়ে আঁচে বসান। চিনি ঢেলে গলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। একটি লেবুর রস দিন। তাতে পটোলের দোলমা, বাদাম, কিশমিশ, মোরব্বা, অর্ধেক জাফরান, অল্প গরমমশলা গুঁড়ো দিয়ে ঢাকা দিন। রস ঘন হলে নামিয়ে আর একটি লেবুর রস দিন। অন্য দিকে ঘি গরম করে তেজপাতা, এলাচ, দারচিনি, লবঙ্গ দিন। তাতে কিশমিশ দিন। কিছুটা কিশমিশ তুলে নিন। বাকি কিশমিশের উপরে এলাচ ও ভিজিয়ে রাখা চাল দিন। চাল নেড়ে বাদাম-পেস্তা দিন। ভাজা হলে দুধ ও জল দিয়ে ঢাকা দিন। জল ফুটলে বাকি জাফরান দিন। তিন-চার মিনিট অন্তর নাড়ুন। ভাত নরম হলে ৪ চামচ চিনির শিরা দিয়ে নেড়ে নামিয়ে নিন। গভীর পাত্রে বাদাম-পেস্তা-কিশমিশ-মোরব্বা রাখুন। তার উপরে পোলাও দিন। উপরে দোলমা, রস ও মোরব্বা সাজান। একই ভাবে স্তর সাজান। কোফতার সঙ্গে পরিবেশন করুন।

রেসিপি: আমিষ ও নিরামিষ আহার (প্রথম খণ্ড), প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী (রেসিপি সংক্ষিপ্ত, বানান পরিবর্তিত)

বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘পরিমিত জল, মাংস ও মসলাদি দ্বারা সিদ্ধ করিলে, সেই জলকে আপযূষ বা অাখ্‌নি কহিয়া থাকে। আখ্‌নির দোষ-গুণে পোলাও-এর আস্বাদন ভাল হয়।’’ স্বাদ ছাড়াও রয়ে যায় গন্ধের প্রসঙ্গ। তার জন্য ‘সৌরভবিশিষ্ট পুষ্প কিংবা আতর, গোলাপ-জল ও মৃগনাভি’ ব্যবহার করাই ছিল দস্তুর। ‘পাক-প্রণালী’তে মেলে বেল, জুঁই, গোলাপ, চামেলির পোলাওয়ের কথা। পোলাও রান্নার শেষের দিকে ঢাকনা খুলে ফুলের পাপড়ি উপরে সাজিয়ে দিতে হয়। দমে চড়াতে হয় হাঁড়ি। ফুলের সুবাস টেনে নেয় পোলাও। পোলাওয়ে পড়ত আনারস, কমলালেবু, আপেল, তেঁতুল, বেগুন, শালগম, গাজর, ধনে শাক, কড়াইশুঁটি, পাকা আম, ডুমুর... আবার সোনা মুগ দিয়ে মোকশ্বর পোলাও, বাটা মশলার পোলাও, শুলফা শাকের মোসব্বৎ পোলাও ছিল। নিরামিষের মধ্যে ছানার পোলাও, সর মালাই পোলাও, রাজভোগ পোলাওয়ের নাম না করলেই নয়। যাঁরা এখন রসগোল্লার কেক বা কোর্মা তৈরি করেন, তাঁরা মিহিদানা, কুন্দনের পোলাও শুনলে অবাক হলেও হতে পারেন। নিরামিষ ও আমিষ পলান্ন ছাড়াও ছিল হরেক ধরন। যেমন খেচরান্ন, হেমান্ন, চোলাও। পোলাওয়ের মতো খেতে হলেও হেমান্নের উপকরণের সংখ্যা ছিল কম। আবার খিচুড়ি ও পোলাওয়ের নানা উপকরণ নিয়ে রান্না করে তৈরি হত খেচর-পলান্ন। মুসলমান শাসনের সময় থেকেই জনপ্রিয় হতে শুরু করে গুরুপাক লোকমা পলান্ন। খাদ্যরসিক রাজা রামমোহন রায়ের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে পটোল, মোরব্বা দিয়ে তৈরি মিঠা দোলমা বা রামমোহন দোলমা পোলাও। স্বাদ ও রাজকীয় উপকরণে সে পোলাও একেবারে আলাদা। মিছরি, আতপ চাল, খোবানি, সাবু মিলেমিশে দ্বারকানাথ ফির্নি পোলাও বা দ্বারকানাথ মতিহার অনন্য। ভারতবর্ষে নানা সময়ে রাজত্ব করেছে নানা বংশ। ফলে মিলেমিশে গিয়েছে খাবারের চলও। ইহুদি, খয়বরি জেরবিরিয়ান, জবরী, কসেলি, নরগেসি, নাগরঙ্গ পোলাও তার উজ্জ্বল প্রমাণ। হিন্দুস্থানি বা মুর্শিদাবাদি মাহী পোলাওয়ের সঙ্গে যেমন জড়িয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গে মুর্শিদকুলি খাঁ-র আগমনের গল্প। আমিষ পোলাওয়ে যোগ করা হত মাংস, চিংড়ি, কাঁকড়া, মাছ। মাছের কোফতা পোলাও, মুরগি পিশপ্যাশ, সিরাজি পোলাও সে রকমই।

বিয়েবাড়ির জর্দা পোলাও

তবে পোলাওয়ের সঙ্গে বিরিয়ানির ফারাক বিশাল। পারস্য থেকে বিরিয়ানি ভারতবর্ষে এসেছিল চতুর্দশ শতকে। বিরিয়ানিতে মাংস ব্যবহার করাই নিয়ম। হাকিম হাবিবুর রহমানের লেখায়, ‘‘ঢাকার বিরিয়ানির নাম ছিল ‘দোগাসা’। ঢাকায় ‘মোতাজান’ নামক যে রঙিন ও মিষ্টি বিরিয়ানি পাওয়া যেত, তার উপাদান ছিল ছাগল, ভেড়া বা দুম্বার গোশত।’’ অর্থাৎ নিজেদের স্বাদ অনুযায়ী বদলে গিয়েছে রান্নার উপকরণ ও পদ্ধতি। ঠিক যেমন পর্তুগিজদের দৌলতে কলকাতার বিরিয়ানিতে আলুর ব্যবহার শুরু হয়েছে।

ভাজা চালের বিরিয়ানি (ও পার বাংলা)

উপকরণ: সিদ্ধ চাল ২ কাপ, ডিম ১টি, মুরগির মাংস ৩০০-৪০০ গ্রাম, পেঁয়াজ কুচি ২ কাপ, কাঁচা লঙ্কা স্বাদ মতো, পেঁয়াজ বাটা ১ কাপ, রসুন বাটা ১ কাপ, আদা বাটা আধ কাপ, জিরে বাটা ২ টেবিল চামচ, ধনে গুঁড়ো ২ টেবিল চামচ, হলুদ গুঁড়ো অল্প, গোটা জিরে ২ চা চামচ, লঙ্কা গুঁড়ো স্বাদ মতো, গোটা গরমমশলা প্রয়োজন মতো, নুন স্বাদ মতো, তেল বা ঘি প্রয়োজন মতো।

প্রণালী: সিদ্ধ চাল মাটির খোলায় মুড়ি ভাজার মতো করে ভেজে নিন। চালের গায়ে লালচে ভাব দেখা দিলে নামিয়ে নিন। চাল যেন পুড়ে না যায় বা মুড়ি না হয়ে যায়। ভাজা গরম চাল ঠান্ডা করে ধুয়ে নিন। জল থেকে চাল চেপে চেপে তুলে নিন। অন্য একটি কড়াইয়ে ঘি অথবা তেল গরম করুন। তাতে কুচিয়ে রাখা পেঁয়াজ দিন। লালচে রং ধরতে শুরু করলে একে একে কাঁচা লঙ্কা, তেজপাতা, গোটা গরমমশলা, আদা বাটা, রসুন বাটা, পেঁয়াজ বাটা ও জিরে বাটা দিয়ে কষিয়ে নিতে হবে। ভাজা হলে লঙ্কা গুঁড়ো দিন। লালচে রং আনতে চাইলে কাশ্মীরি লঙ্কা গুঁড়ো দিন। এর পরে জিরে গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো, হলুদ গুঁড়ো, গোটা জিরে, স্বাদ মতো নুন দিয়ে ভাল ভাবে কষতে থাকুন। এখানে প্রয়োজন হলে আরও তেল বা ঘি দেওয়া যেতে পারে। মশলা কষানো হলে মাংসের টুকরো দিন। নেড়ে জল দিয়ে ঢাকা দিন। মাংস থেকে তেল ভেসে উঠলে ধুয়ে রাখা ভাজা চাল দিন। আস্তে আস্তে নাড়তে থাকুন। এই সময়ে আঁচ একেবারে কম রাখুন। চাল ও মশলা সব মিলেমিশে গেলে জল দিন। জল যেন চালের উপরে ভেসে ওঠে। অতিরিক্ত জল দেবেন না। ঢাকা দিয়ে সিদ্ধ করতে দিন। একটি বাটিতে ডিম ফেটিয়ে সামান্য নুন দিন। ঢাকনা খুলে কড়াইয়ের মাঝে গর্ত করে ফেটানো ডিম দিয়ে দিন। হালকা নেড়ে ঢাকা দিন। ভাত টিপে দেখে নিন সিদ্ধ হয়েছে কি না। না হলে অল্প অল্প গরম জলের ছিটে দিয়ে নিভু আঁচে সিদ্ধ হতে দিন। ঝুরো হয়ে গেলে নামিয়ে নিন।

রেসিপি: অঙ্কন চট্টোপাধ্যায়

আবার বাংলাদেশের বিরিয়ানির স্বাদ আলাদা। খিচুড়িকে যতই সাধারণ ভাবা হোক না কেন, বাংলাদেশি রান্নার দৌলতে নিভু আঁচে মশলাদার ভুনি খিচুড়ি রীতিমতো গোল দিতে পারে অন্য পদকে। বিরিয়ানির মতোই তিহারি বা তাহারি বাংলাদেশের জনপ্রিয় পদ। তবে জাফরান বা কোনও রং ও গন্ধ ব্যবহার করা যায় না সেই পদে। আবার বাংলাদেশি বিয়েবাড়ির জর্দা পোলাও টুকটুকে হলুদ ও আতর-বাদামে ভরপুর, স্বাদে মিষ্টি। বউখুদির সঙ্গে জড়িয়ে সমাজের অর্থনৈতিক দিক। কম মশলায়, খুদ দিয়ে তৈরি এই বউখুদির উপকরণ নেহাতই কম। কিন্তু রান্নার পদ্ধতি আর স্নেহ-ভালবাসা মিলে তার স্বাদ বেড়েছে বহু গুণ। দুই বাংলার অলি-গলি খুঁজলে এখনও উঠে আসবে নতুন পদ। তাদের ঘিরে ঘর করে অনেক গল্পও। তবে সব গল্পই এক সূত্রে বাঁধা। তা হল রসনাবিলাস।

রান্না করেছেন:

সায়ন্তনী মহাপাত্র

ছবি: দেবর্ষি সরকার

রুপোর বাসন:

অঞ্জলি জুয়েলার্স

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy