Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪

ঘটি-বাঙালের পাতে মৎস্যই ন্যায়

কথায় বলে, ‘ঘরের বাছা, খেতে‌র গাছা আর পুকুরের মাছা’ নিয়েই বাঙালির জীবন। রইল মাছের ঝোলের নানা বৃত্তান্ত।

অন্তরা মজুমদার
শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৯ ০০:২৯
Share: Save:

মাছেভাতে বাঙালি... শব্দবন্ধটি বহু ব্যবহারে এখন ক্লিশের মতো শোনালেও, এত বড় সত্যকথন বোধহয় আর কোনও জাতি সম্পর্কে উক্ত হয়নি। বাঙালির সঙ্গে মাছের সম্পর্ক বাংলার জল-মাটির ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। চন্দ্রকেতুগড়ে ১৭০০ বছরের পুরনো মাছের ছবি খোদাই করা ফলক পাওয়া গিয়েছে। শুধু কি তাই? মধ্যযুগের ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ ফুল্লরার বিশদ পাকপ্রণালী বা ‘অন্নদামঙ্গল’-এ মাছবৃত্তান্ত পড়লে বোঝা যায়, সেই কোন কাল থেকে অবিভক্ত বাংলার আইডেন্টিটির সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে মাছ, মাছের ঝোল আর তার রসনাকে শাসন করার ক্ষমতা।

বাঙালির দুপুরের খাওয়াদাওয়া যেখানে মাছের ঝোল ছাড়া অসম্পূর্ণ, সেখানে রান্নার ধরন, স্বাদ আর গন্ধ কিন্তু দুই বাংলায় স্থানভেদে ভিন্ন। চিরকালই রান্নাবান্নায় মশলাপাতি নিয়ে ঘটি-বাঙালের মধ্যে ঝগড়া! ও পার বাংলার মানুষের অভিযোগ, ঘটিরা ঝোল রাঁধার আগে মাছ ভেজে ভেজে এমন পর্যায়ে নিয়ে যান যে, তার সরস ভাবের কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। এ পার বাংলার মানুষ আবার বলেন, তেল-মশলায় চুবিয়ে না দিলে বাঙালদের মাছ রান্না হয় না। তা এই কৌতুকপূর্ণ মতভেদের মধ্যেই কিন্তু স্বাদের রোম্যান্স দিব্যি জারি। রাধাপ্রসাদ গুপ্ত তাঁর লেখায় এই মর্মেই একটি প্রবাদের উল্লেখ করে গিয়েছেন, ‘জোলা মরে তাঁতে। বাঙালি আর কাঙালি মরে মাছে আর ভাতে।’

তবে রন্ধন বিশেষজ্ঞদের মতে, কিছু নিয়মকানুন দুই বাংলার মাছের ঝোলের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। এ পার বাংলায় রুই মাছের পাতলা ঝোল রাঁধা হয় পাঁচফোড়ন দিয়ে, ধনেবাটা-হলুদবাটা দিয়ে হালকা নেড়েচেড়ে। বাঙাল বাড়িতে আবার কালো জিরে ফোড়ন দিয়ে রাঁধা হয় রুইয়ের ঝোল। তাতে পড়ে হলুদ গুঁড়ো, কাঁচা লঙ্কা আর ধনে পাতা। মশলাপাতিতে অল্প কিছু রকমভেদেই তৈরি হয়ে যায় স্বাদের ফারাক। আবার ধরুন, শিঙি বা মাগুরের ঝোলের কথা। এই বাংলায় জিরে-হলুদে ফুটিয়ে পাতলা করে রাঁধা শিঙি মাছের ঝোল কিন্তু রীতিমতো পথ্য। মনে পড়ে, টেনিদার সেই পেটরোগা প্যালারামের কথা? সারা বছর যে বেচারা শিঙি মাছের পাতলা ঝোল আর ভাত খেয়েই কাটিয়ে দিত? মাগুরও কিন্তু এ বঙ্গে তাই-ই। আবার পদ্মাপারে এসে সেই মাগুরই শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ‘মুদগুর মৎস’— যা কি না তেলেঝোলে গা-মাখামাখি মাছের কালিয়া!

শোল-মাগুর তো গেল, কিন্তু মাছের রাজা ইলিশ নিয়েও দ্বন্দ্ব রয়েছে তুমুল। পদ্মার ইলিশ সরেস বেশি না কি গঙ্গার? রূপনারায়ণের ইলিশই বা কম যায় কীসে... এ সব নিয়ে তর্ক গড়িয়েছে বহু দূর। কিন্তু রন্ধন প্রণালীতেও রয়েছে ফারাক। সরষে বাটা, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ইলিশ-সরষের ঝোল যেমন ক্লাসিক বাঙালি রেসিপি। দুই বাংলাতেই সমান জনপ্রিয়। কিন্তু ইলিশের পাতুরি (কলাপাতায় মুড়ে ভাপানো মাছ) আবার মূলত বাংলাদেশের রান্না বলেই পরিচিত। যদিও ঘটি-বাঙাল নির্বিশেষে বিয়ে বাড়িতে নিমন্ত্রিতদের পাতে এখন পাতুরি পড়ে। তবে পেঁয়াজ-ঘি দিয়ে বাঙালদের ইলিশের কোর্মা রাঁধার গল্প শুনে আঁতকে ওঠেননি, এমন ঘটি বিরল!

লাউ পাতায় কাতলা

রেসিপিটি সাত টুকরো মাছের জন্য। হলুদ-নুন মাখিয়ে মাছের টুকরো কিছুক্ষণ রেখে ভেজে ফেলুন। চারটি পটোল লম্বালম্বি করে দু’ভাগে চিরে নিন। চারটি আলু লম্বায় চার টুকরো করে কাটুন। কড়াইয়ে দু’কাপ সরষের তেল দিয়ে গোটা জিরে, তেজপাতা ফোড়ন দিন। তার পরে এক চিমটি হিং দিন। এর মধ্যে আলু-পটোল দিয়ে ভেজে নামিয়ে রাখুন। দুটো কেটে রাখা লাউ ডগা কড়াইয়ে দিয়ে দেড় চা-চামচ ধনে-জিরে বাটা আর এক চা চামচ আদা বাটা দিয়ে কষান। নুন, হলুদ ও পরিমাণ মতো জল দিয়ে আলু ও পটোল ছেড়ে দিন ঝোলে। ঝোল ফুটে উঠলে মাছ দিন। সামান্য চিনি দিন। মাছ-আনাজ সিদ্ধ হলে কাঁচা লঙ্কা দিয়ে নামিয়ে নিন।

মরিচ-আদার রসে কই

রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’-এ আবার এ দেশীয় মাছের ঝোল রান্নার বেশ স্বাদু বর্ণনা পাওয়া যায়। ভারতচন্দ্রের লেখা থেকেই জানা যায়, ধনপতির জোড়া বউ লহনা-খুল্লনা জমিয়ে রাঁধতেন কাঁঠালবিচি দিয়ে চিংড়ি, মরিচ আর আদার রস দিয়ে কই, কাঁচা আম দিয়ে শোল। সেই রীতি কিন্তু এ বঙ্গে এখনও চলছে মাছ রাঁধার। আবার চিতল মাছের কাঁটা ছাড়িয়ে, তাতে পেঁয়াজ কুচি, রসুন বাটা, জিরে বাটা, আদা বাটা দিয়ে মেখে মুইঠ্যার ঝোল বাংলাদেশের আইকনিক ডেলিকেসি। এই রান্নায় মুঠো পাকিয়ে মাছের বড়া বানানো হয় বলেই ‘মুইঠ্যা’ নাম। আবার কচু দিয়ে তেলাপিয়ার ঝোল বা পোস্ত দিয়ে কাতলা যথাক্রমে বাঙাল এবং ঘটিদের রান্না হলেও স্বাদের বিশ্বায়নের ফলে যে কোনও বাঙালির মুখেই এনে দেয় চেনা স্বাদের ইঙ্গিত।

দুই বাংলা ছাড়াও আর এক রীতি রয়েছে মাছের ঝোল রাঁধার। বারেন্দ্র মতে মাছের ঝোল। তার গূঢ় তত্ত্ব অবশ্য যাঁরা জানেন, তাঁরা কেউই তেমন খোলসা করতে চান না। তবে সেই ঝোলেও পাঁচফোড়ন পড়ে। যার স্বাদ-গন্ধ দুই-ই আলাদা। বারেন্দ্র পদ্ধতিতে মাছের শুক্তোও চমকপ্রদ। এতে আবার সরষে ফোড়ন পড়ে।

সুতরাং ভাপিয়ে, সেঁকে, ভেজে, পুড়িয়ে, ঝাল-ঝোল-অম্বল করে দেশ-কাল-সীমান্ত ব্যতিরেকে একশো পদে মাছ রেঁধে দিতে পারে বাঙালি। তার জীবন থেকে আর সব কিছু চলে গেলেও মাছ কিন্তু রয়ে যাবে চিরকাল!

তথ্য ঋণ: ‘মাছ আর বাঙালি’, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত,

‘বেঙ্গলি কুকিং’, চিত্রিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

অন্য বিষয়গুলি:

Fish Recipes Bengali Fish Recipes Bengali Recipes
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy