ওপার বাংলার সুস্বাদু পদেই হোক বর্ষবরণের ভূরিভোজ। ছবি: সায়ন্তনী মহাপাত্র।
আমাদের এই রোজকার জীবনে কত কী তো হারিয়ে যায়! কালের নিয়মে কিছু জিনিসের প্রয়োজন ফোরায় আর কিছু যায় বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে। কিন্তু যা যায়, তার সবটুকুই কি যায়? স্মৃতির অতলে ডুব দিতে তারও কি কোনও দিন ভেসে ওঠার সাধ জাগে না! হয়তো বা জাগে!
একলা দিনে, ঝাপসা চোখে, এক এক দিন মেয়েবেলায় ফেলে আসা এমন চৈত্রের রোদ্দুরমাখা দিনখানিতে ফিরে যেতে ইচ্ছা হয় বইকি। কিন্তু পর্দা টানা, আধো ছায়ার ঝিম লাগা সেই দুপুর, কারও আঁচলের সোহাগী গন্ধ আর সোভিয়েত নারীর সে কোন সুদূরের হাতছানি চাইলেই কি সে সব ছুঁতে পারা যায়? তাই তো মানুষ কাউকে মনে করে হেঁশেলে কাঁসার থালায় ভাত বাড়ে, পাতের ধারে যত্নে সাজিয়ে দেয় চিচিঙের ছেঁচকি, সজনে পাতার ডাল। কাঁচা আম ফালি করে কেটে, এক কড়াই ছোট এলাচের গন্ধ মাখা আম ঝোল রাঁধে আর তাতে লম্বা চুমুক দিয়ে, চোখ বুজে স্পর্শ করতে চায় সেই কোন জন্মান্তরের ফেলে আসা জীবনটুকু। সেই পুরনো স্বাদ-গন্ধ, স্মৃতির আনাচ-কানাচে জমিয়ে রাখা ছোট ছোট কত গল্প। এ গল্প জুড়ে কেউ ইতিহাস লেখে না। ওটুকু শুধু আপনার নিজের।
বাড়ির সাধারণ হেঁশেলও কিন্তু মানুষের ইতিহাসের অনেক গল্প বলে। যেমন এই চিংড়ি মাছের পিঠের কথাই ধরুন না! পণ্ডিতেরাও যে প্রশ্নের উত্তর জানেন না, সেই উত্তর রয়েছে রান্নাঘরে সার দিয়ে সাজিয়ে রাখা ওই মশলার কৌটো আর এলিয়ে থাকা শীল নোড়ার কাছে। শীলের পাটায় নারকেল আর চিংড়ি মাছ বাটার গন্ধে আপনি টের পাবেন এ রান্না খাঁটি বরিশালের। বিশ্বাস না হয় মিলিয়ে নাও এ অঞ্চলের বিখ্যাত চারণকবি বিজয়গুপ্তের পদ্মপুরাণের রান্নার গল্পের সঙ্গে। সেই কবে তিনি নারকেলের দুধ দিয়ে মুগের ডাল, নারকেল কোরা দিয়ে বরবটি, নারকেলের দুধে রাঁধা পোলাও আর ভাজা নারকেল দিয়ে মাংস রান্নার কথা লিখে গিয়েছেন। এ রান্নাও যে সেই ঘরানারই।
চোখ বুজলেই দেখতে পাবে, নদীমাতৃক বাংলাদেশের উপকূলের কোনও এক আঁধার করে আসা দিনের ছবি। আকাশপানে চেয়ে চেয়ে ওই দেখ এক ডুরে শাড়ি পড়া মা ব্যস্ত হাতে ছাঁকনি জাল থেকে ঝেড়ে, ছাড়িয়ে তুলছে ছোট ছোট চিংড়ি মাছ। পুকুর ধারের নারকেল আর চিংড়ি বেটে, ভাত রাঁধার পরের নিভু আগুনে, কলাপাতায় পরম যত্নে বিছিয়ে দিচ্ছে কাঁচালঙ্কার সুবাস মাখা নারকেল চিংড়ি। খানিক পরে নেয়ে এসে আবার উল্টে দেবে। আগুনের তাপে এপাশ-ওপাশ রান্না হয়ে রং ধরবে চিংড়ি বাটায়। কচি নারকেল, সামান্য পোড়া কলাপাতার গন্ধে ঘরের মানুষেরও খানিক তাড়া লাগবে ঘরে ফেরার। বালাম চালের ভাতের পাতে, কাঁচালঙ্কা ডলে, নরম চিংড়ির পিঠের এই সামান্য আয়োজন অমৃতের চেয়ে কম কিসে!
রাঁধার পরে খাওয়া আর খাবার পরে রাঁধার বাইরে গিয়ে, রোজকার খাবারে এই ভালবাসার ওম মাখিয়ে শ্রী মণ্ডিত করল যে মেয়ে, তার খবর ইতিহাস বিস্মৃত হলেও, স্মৃতির খেরোখাতায় তার স্থান অমর।
মায়ের হাতের রান্না তাই তো আজও এত আশ্চর্য মায়াময়।
উপকরণ:
কুচো চিংড়ি: ২৫০ গ্রাম
কচি নারকেল কোরা : ৩/৪ কাপ
রসুন: ৩-৪ কোয়া
কাঁচালঙ্কা: স্বাদ মতো
নুন: স্বাদ মতো
চিনি: ১/৩ চা চামচ
হলুদ: ১ চা চামচ
সর্ষের তেল: ৩ বড় চামচ
কলাপাতা: ২টি
পদ্ধতি:
চিংড়ি পরিষ্কার করে খোসা ছাড়িয়ে নিন। সর্ষের তেল ও কলাপাতা ছাড়া সব উপকরণ বেটে নিন। খুব মিহি বাটা হবে না। এতে মেশান ২ চামচ তেল। একটি তলা ভারী লোহার পাত্রে বা চাটুতে একটি কলাপাতা বিছিয়ে দিন। উপরে সর্ষের তেল মাখিয়ে সমান করে চিংড়ির মিশ্রণ ছড়িয়ে দিন। আর একটি কলাপাতা উপরে দিন। এ বার উপর থেকে একটি ঢাকা দিয়ে বন্ধ করুন যেন ভাপ বেরিয়ে যেতে না পারে। খুব কম আঁচে রান্না করুন। ১০-১২ মিনিট পরে সাবধানে কলাপাতা উল্টে অন্য পিঠটা রান্না করুন। এক চামচ তেল এই সময়ে সাইড থেকে ছড়িয়ে আবার ঢাকা বন্ধ করুন। ৫-৬ মিনিট পরে একটু পোড়া পোড়া হলে আঁচ বন্ধ করে দিন। ছোট ছোট টুকরোয় কেটে সর্ষের তেল ছড়িয়ে গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy