নরেন্দ্র ভবন
ভারত স্বাধীন হয়েছে বেশ অনেক দিন হল। এখন নেই রাজ্যপাট। তা সত্ত্বেও আভিজাত্য, সম্মান আর ভালবাসায় কেউ কেউ রাজাই রয়ে গিয়েছেন। যেমন নরেন্দ্র সিংহ। বিকানেরের ২৪তম রাজা ছিলেন তিনি। দেশের নানা প্রান্ত থেকে রাজা-রানি, ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা সম্মানীয় কেউ এলে, তাঁদের বসার বন্দোবস্ত থাকত দেওয়ান-ই-খাসে। রাজার একেবারে খাস বৈঠকখানা যাকে বলে। মেঝেয় পুরু গালচে, চার দেওয়াল জুড়ে রাজকীয় ওয়ালপেপার, ভারী কাঠের আসবাব আর আলোর কারসাজি। আমাদেরও বসার প্রাথমিক ব্যবস্থা হয়েছিল সেখানেই। বিকানেরের গরম আবহাওয়াকে কাবু করতে সঙ্গে সঙ্গে হাজির হয়েছিল ঠান্ডা ফলের কুচি দেওয়া হরেক কিসিমের পানীয়।
আমাদের গন্তব্য ছিল নরেন্দ্র সিংহের রাজপ্রাসাদ। রাজা আজ নেই ঠিকই, কিন্তু তাঁর ছোঁয়া, আতিথেয়তা, বন্ধুবৎসলতার ছাপ রয়ে গিয়েছে প্রতি কোনায়। বিকানেরের এই রাজপ্রাসাদে তাই একুশ শতকেও থমকে আছে সময়। পানীয়ের পরেই সোজা ডাক পড়েছিল রেস্তরাঁয়। ‘পি অ্যান্ড সি— পার্ল অ্যান্ড শিফন’। নামখানা যেমন সুন্দর, চেহারাখানাও। ঝাড়বাতি তো নয়, যেন সমুদ্রের গহীন সেঁচে আনা মুক্তো। আর দেওয়াল জুড়ে শিফনের কাজে চোখে ধাঁধা লেগে যায়। দেশের নানা শহর থেকে ‘ফুড মেডিটেশন’-এ আসা খাদ্যরসিক যখন খেতে বসলেন, তখন হাজির রেস্তরাঁর কর্মীরা। কিছু বলে ওঠার আগেই একের পর এক আসতে থাকল ফুলকা, পরোটা, ভেজ বিরিয়ানি, চিকেন বিরিয়ানি। সঙ্গে শুধুই আচার। কের সাঙ্গরি, হলদি আচার, মুরগির মাংসের আচার, পাঁঠার মাংসের আচার। রীতিমতো আঙুল চাটতে চাটতে যখন উঠতে যাব, থেমে যেতে হল প্যালেসের নিজস্ব বেকারি ‘ম্যাড হ্যাটার’-এর তৈরি অ্যাপ্রিকট-চকলেট পেস্ট্রিতে। রাজার বাড়িতে পেস্ট্রি! বিকানেরি খাবারের সঙ্গে পাশ্চাত্যের ডেজ়ার্ট চেখে অবাকই হয়েছিলাম। তবে তা শুধু চমকের শুরু...
বিকানেরে তিন দিনের সফরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল রাজবাড়ির প্রিন্স রুমে। ঘরের সাজ দেখে যখন মুগ্ধতায় ডুবে গিয়েছি, নজরে পড়ল আমারই ছবি। ‘‘এটা হোটেল নয়। তাই যে ক’দিন থাকছেন, এটা আপনারই বাড়ি। নিজের ঘরে আপনার ছবি থাকবে না?’’ বললেন প্যালেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট সিদ্ধার্থ যাদব। সত্যিই তো, ভারতবর্ষ এ ভাবেই অচেনাকে চেনার, পরকে আপন করে নেওয়ার মন্ত্র শিখিয়েছে বারবার।
আরও পড়ুন: ‘চিলেকোঠা’-য় চলছে পুরনো দিনের রান্নার উৎসব! মেনুর দুই লোভনীয় পদ এ ভাবে বানিয়ে ফেলুন বাড়িতেই
বিকানেরি থালি।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হতেই সোজা গোশালায়। যেটি এক সময়ে প্রচুর গরুর বসবাসের জায়গা ছিল, এখন সেখানে উঁচু সাদা টেবিলে জ্বলছে সারি সারি মোমবাতি। বিকানেরের চড়া তাপমাত্রা তখনও নামেনি খুব একটা। পানীয়-সহ সান্ধ্য আড্ডায় তবু গরমের ছোঁয়া মাত্র নেই। এ পাশ ও পাশ থেকে আসছে আতর মাখা ঠান্ডা জলের ছিটে। তবে রাতের খাবারের জন্য গোশালা নয়, উঠে যেতে হয়েছিল রাজবাড়ির ছাদে। সেখানেই রয়েছে ইনফিনিটি পুল। যত দূর চোখ যায়, নজরে পড়ে গোটা বিকানের। পুলসাইড ডিনার ‘ক্রেসেন্ট অ্যান্ড গ্রিল’-এ একের পর এক পরোটা, রুটি, বিরিয়ানি, কাবাব, সালান, বিরিয়ানি খাইবারি, কোর্মা, পাখতুনি মুর্গ, চানা লকি। পাশাপাশি সদ্য বানানো গরম ফোকাশিয়া, সাওয়ার ব্রেড, সেসমি রোল, মাল্টিগ্রেন ব্রেড... সংখ্যাটা অগুনতি। না, এখানে বুফের ব্যবস্থা নেই। তাই বারবার উঠে খাবার নিয়ে আসার ব্যাপারও নেই। কিন্তু সামান্যতম প্রয়োজনে চোখ ফেরালেই হল। সদাহাস্য কর্মী এসে হাজির হবেনই! আড্ডা-গল্প আর এলাহি ভোজের মাঝে মন যখন মিষ্টির প্রত্যাশা করবে, হাজির হবে মাখনা ক্ষীর। আপেল কুচি আর মাখনায় ভরা সেই ক্ষীরের উপরে সদ্য গাওয়া ঘিয়ে ভাজা মাখনা। মুখে দিলেই মিলিয়ে যায় যেন ম্যাজিকের মতো!
বিকানেরে ভোজবিলাসের তিনটি প্রধান আকর্ষণ তখনও চেখে দেখা বাকি। রেস্তরাঁর ঠান্ডা ঘরে পাঁপড় পুরি, মেথিদানা সবজ়ি, জিলিপি-রাবড়িতে রাজস্থানি মেঠো স্বাদ আসতে বাধ্য। খাস বিকানেরি প্রাতরাশ সেরে এগিয়ে পড়া গেল শহরসফরে। মাঝপথে বিরতি ছিল লক্ষ্মী নিবাস প্যালেসে। রাজা গঙ্গা সিংহের খাস আস্তানা সেটি। শহরের কেন্দ্রবিন্দু ছুঁয়ে গিয়েছে রাজার ঘরের মেঝে দিয়ে। শত শত পশু শিকারের চিহ্ন ছড়িয়ে গোটা প্যালেসে। পায়ে পায়ে এগোলাম গোল্ড রুমে। সে ঘরের দেওয়াল জুড়ে ৪২ কেজি সোনার উস্তা কারিগরি! সাবেক বিকানেরি খাবারের আগে হাজির ফরাসি খাবার। পোটাজ় আন্দালু, ফিলে দে পমফ্রে, ক্রোকে দে কানার্দ শভে, ফ্রোমাজ় এত ফ্রুত... সাত-সাতটি কোর্স। ১৯২৭ সালে মহারাজ গঙ্গা সিংহ অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন দেশের নানা প্রান্তের রাজা-রানিকে। সেখানেই ইউরোপিয়ান খাবার পরিবেশন করেছিলেন তিনি। প্রায় ৯২ বছর পরেও সেই খাবার একই ভাবে রান্না করা হয় অতিথিদের জন্য! যে সব প্লেটে পরিবেশন করা হয়, বিদেশ খুঁজে আনা সে সব ক্রকারিতে বাঁধা পড়ে আছে পুরনো দিনের গাথা।
নরেন্দ্র ভবনের প্রাইভেট ডাইনিং রুমটি ছোট। কারণ, সেখানে জায়গা হয় না খুব বেশি সাধারণ মানুষের। তবে পুরনো গন্ধ মাখা সেই ঘরের ভিতরে যখন ডিনারের আমন্ত্রণ এসেছিল, ফের অবাক হওয়ার পালা। এ ডিনার একেবারে ব্লাইন্ড ফোল্ডেড। চোখ বেঁধে স্পর্শ ও গন্ধের উপরে ভর করে সেই ডিনারের সার্বিক স্বাদই আলাদা। খাওয়ার শেষে বেশ কিছু পদ অনুমান করা গেলেও সাবেক ফরাসি খাবারের সেই মেনু না হয় পাঠকের জন্য রহস্যই থাকুক!
আরও পড়ুন: বাড়িতেই কন্টিনেন্টাল? সম্ভব, শুধু হাতের কাছে মজুত রাখুন এ সব
নানা ধরনের আচার।
সাহিত্যে ঘুরেফিরে এসেছে নানা খাবার। কিন্তু তাকে এ ভাবেও যে পরিবেশন করা যায়, তা আগে জানা ছিল না। ‘লিটারারি লাঞ্চ’-এ তাই উঠে এসেছিল সিলভিয়া প্লাথ, হারমন মেলভিল, জন ফান্তে, ভার্জিনিয়া উল্ফ, জেমস জয়েসের মতো বিশ্বখ্যাত লেখকদের বেশ কিছু কাজের কথা। প্রতিটি লেখাকে নির্ভর করে তৈরি হয়েছিল মেনু। নোকি, চাওডার, ল্যাম্ব ডব থেকে হোয়াইট চকলেট পুডিং... কী নেই!
তিন দিনের সফর শেষে রাজবাড়ি ছেড়ে যখন এয়ারপোর্টে পৌঁছে গিয়েছি, মনে পড়ল কী যেন নেই। আসলে মনটা ফেলে এসেছি নাহলা, এলিজ়াবেথ, জুজুর কাছে। রাজার পোষ্যপ্রেমকে সম্মান জানাতে দু’টি কুকুর ও একটি বিড়াল এখনও রাজবাড়ির অতিথিদের পায়ে পায়ে ঘোরে!
থালির ছবি: অশ্বিন রাজাগোপালন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy