Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

বাঙালির রম্য রসনায় প্রাচীন কালের হারিয়ে যাওয়া রান্নারা

কার্জনের কলম তখনও ভাগ করতে পারেনি বাংলাকে। ঘটি-বাঙালে নয়, অবিভক্ত বাংলা তখন একসূত্রে বাঁধা। তাঁদের রান্নাতেও তাই মিলমিশ, কতশত পদ। ডুমুর, কাঁকুড়, নালতে শাক থেকে বাইন মাছ, পায়রার মাংস, এঁচোড়ের দইবড়া... কালের নিয়মে হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু স্মৃতি? তারা আজও হাতছানি দেয়...

রূম্পা দাস
শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৯ ০০:৫৪
Share: Save:

একটা জাতি গোটা বিশ্বের কাছে সুপরিচিত তাদের খাদ্যাভ্যাসের গুণে। কেউ খেতে ভালবাসেন, কেউ খাওয়াতে, কেউ বা ততটা খেয়ে উঠতে না পারলেও খাওয়ার গল্প শুনতে ভালবাসেন। কেউ দু’টি ডাল-ভাতের সংস্থানে খুশি, কারও পাখির চোখ রাজকীয় আহার, কেউ আবার সন্তানকে ‘দুধে ভাতে’ জড়িয়ে রাখতে চান।

বাঙালির আত্মপরিচিতির বেশ অনেকটাই খাবারের সঙ্গে জড়িয়ে। দেশভাগ, ভিটেমাটি ছেড়ে আসা, ছিন্নমূলের ব্যথা তখনও নীল করেনি বাঙালিকে। মিলেমিশে এই অবিভক্ত বাংলাতেই তৈরি হয়েছে একের পর এক স্বাদ। মঙ্গলকাব্য থেকে শুরু করে সমকালীন প্রবন্ধ... সবেতেই মেলে তার প্রমাণ। এই বাঙালিই বোধহয় একমাত্র, যে ফলের খোসা থেকে ডগা, কাণ্ড থেকে শিকড়, ফুল থেকে পাতা সব কিছু দিয়ে তৈরি করে ফেলতে পারে নানা ব্যঞ্জন। আর রান্না? ভাজা, ভাতে, পোড়া, সিদ্ধ, শুক্তো, ঘণ্ট, ছ্যাঁচড়া, ছেঁচকি, চচ্চড়ি, ছক্কা, ছোকা, ঘ্যাঁট, লাবড়া, ঝাল, ঝোল, ভাপা, ডালনা, দোলমা, অম্বল, টক... এক পঙ্‌ক্তিতে ধরানোই মুশকিল।

বাঙালির সাবেক ব্যঞ্জনে শুক্তো বা তেতো দিয়ে শুরু করে ডাল-ভাজা, চচ্চড়ি কিংবা ডালনার পরে পাতে পড়ে মাছ-মাংস। অম্বল বা চাটনিতেও শেষ হয় না ব্যঞ্জন। তাই পিঠে-পায়েস-মিষ্টির মধুরেণ সমাপয়েৎ জরুরি। কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী খুল্লনার রান্নার বিবরণে লিখেছেন শুক্তো রান্নার পদ্ধতি— ‘বেগুন কুমড়া কড়া, কাঁচকলা দিয়া শাড়া/ বেশন পিটালী ঘন কাঠি।/ ঘৃতে সন্তলিল তথি, হিঙ্গু জীরা দিয়া মেথী/ শুক্তা রন্ধন পরিপাটী।।’ তার পরে ঘি দিয়ে নালিতা শাক ভাজা, কাঁঠালের বীজ দিয়ে চিংড়ি, আখের রস দিয়ে মুগ ডাল, আদা-লঙ্কা গুঁড়ো মাখানো কই ভাজা, চিতলের পেটি ভাজা, রুইয়ের ঝোল, আম শোল, তেঁতুল দিয়ে পাঁকাল মাছ, ভাঁটির জ্বালে রান্না করা ক্ষীর— পদ নেহাত কম নয়!

গলদা চিংড়ির ধোঁকা

বিজয়গুপ্তের ‘পদ্মপুরাণ’ বা ‘মনসামঙ্গল’-এ লখিন্দরের জন্মের আগে সনকার পঞ্চামৃতের ভোজও মনে রাখার মতো। ‘চেঙ্গ মৎস্য দিয়া রান্ধে মিঠা আমের বৌল/ কলার মূল দিয়া রান্ধে পিপলিয়া শৌল/ কৈ মৎস্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল/ জিরামরিচে রান্ধে চিতলের কোল/ উপল মৎস্য আনিয়া তার কাঁটা করে দূর/ গোলমরিচ রান্ধে উপলের পুর/ আনিয়া ইলিশ মৎস্য করিল ফালাফালা/ তাহা দিয়া রান্ধে ব্যঞ্জন দক্ষিণসাগর কলা।’ রয়েছে ডুমো ডুমো করে কাটা আলু আর মানকচু দিয়ে শোল মাছের পদ, মাগুর মাছের ঝুরি। যে জাতির কোন প্রাচীন মঙ্গলকাব্যের সময় থেকেই এত ধরনের সুবিশাল ব্যঞ্জনের আয়োজন, সে জাতি যে খাদ্যরসিক হবে, তা বলাই বাহুল্য।

কালের নিয়মে হারিয়ে গিয়েছে অনেক রান্না। লোকমুখে প্রচার পেয়ে পেয়ে ফিরে এসেছে মোচা, থোড়, ডুমুর, কোফতা, দোলমা। কিন্তু পানিফলের ডালনা? কিংবা নালতে পাতা দিয়ে সজনে ফুলের ঘণ্ট, তাল আঁটির ডালনা, শাক শশ্‌শরি, রসজ, বেগুনের বিরিঞ্চি, তিলেপটেশ্বরী, গলদা চিংড়ির ধোঁকা, ডিমের জিলিপি, কপির দম্‌পক্ত, ভেড়ার হাঁড়ি কাবাব, পিটুলি বাটা দিয়ে মাছের শুক্তো, থোড়ের কড়ুই, মাংসের অম্লমধুর শুষ্ক প্রলেহ কিংবা হেমকণার পায়েস? ইতিহাস ঘাঁটতে শুরু করলে নজরে পড়বে এমন শত শত পদের কথা, যা বাঙালি একেবারে ভুলে গিয়েছে। তবে ভুলে গিয়েও যে নতুন করে মনে করার প্রয়াস চলছে, সেটাও কম নয়।

এ প্রসঙ্গেই বলি, এত ধরনের খাবার এবং তার প্রতি প্রেম শুধু নয়, খাওয়ার দম থাকাটাও তো জরুরি। শান্তনু গঙ্গোপাধ্যায় ‘উদরপুরাণ এবং অন্যান্য বৈঠকি গল্প’য় লিখেছেন, রামমোহন রায় শুধু গোটা ছাগলের মাংসই নয়, দিনে বারো সের দুধও খেতে পারতেন। জলযোগ করতেন গোটা পঞ্চাশেক আম দিয়ে! এক বার হুগলিতে মোক্তার গুরুদাস বসুর বাড়িতে গিয়ে সুন্দর কচি ডাব দেখে তা খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন রামমোহন। একটি ডাব কেটে তাঁকে পরিবেশন করা হলে রামমোহন বলেছিলেন, ‘‘ওতে আমার কী হবে? ওই কাঁদিসুদ্ধ ডাব পেড়ে ফেল।’’ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রামমোহনকে সম্মান জানানোর জন্য প্রকাশ্য ভোজের ব্যবস্থা করে। সেখানে বাকিরা যখন মাংস আর মদে মেতে, রামমোহন ‘কেবল মাত্র ভাত ও শীতল জল সেবন করিতেছিলেন।’ এককাঁদি ডাব বা নেহাত জল-ভাত... কতটা খাবেন, তা নির্ধারণ করতেন রামমোহন নিজেই। খাবারের ব্যাপারে গোঁড়া অর্ধেন্দুকুমার গঙ্গোপাধ্যায় আবার চিনদেশে যান এক মাসের খাবার আর ব্রাহ্মণ রাঁধুনি সঙ্গে নিয়ে।

সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় ‘জীবন তীর্থ’য় লিখেছেন খাবারের জন্য নিজের খিদেকে শান দিয়ে রাখার কথা। কারণ, ‘‘প্রথমে ভাতের সঙ্গে প্রচুর ঘি আর আলুভাতে; দ্বিতীয় পর্যায়ে ঘন ভাজা অড়রডাল, আলুর বড় তরকারি, প্রচুর তৈলসিক্ত; তৃতীয় পর্যায়ে একবাটি মহিষের দুধ। ঘন ক’রে জ্বাল দেওয়া। ঘি আর দুধ একেবারে খাঁটি। দুধটা বাবা সংগ্রহ করবার চেষ্টা করতেন এমন মহিষের, যার শেষের দিকে দুধটা শুকিয়ে ঘন হ’য়ে এসেছে।’’

এই বিপুল ভোজের জন্য শুধু মাত্র খিদে কেন, হজমক্ষমতাকেও শান দিতে হয় বইকি!

সুকুমার সেন ‘দিনের পরে দিন যে গেল’র ‘আর্টস ফ্যাকাল্‌টির টোল’-এ লিখেছিলেন অমিয়কুমার সেনের ভোজনপ্রীতির কথা। এক ভোজে ময়দার লুচি ভাজা হত ঘিয়ে। সঙ্গে মাংসের কালিয়া, আলুর দম, চিংড়ির কাটলেট, ছোলার ডাল, বেগুন বা পটোল ভাজা, ভাল চাটনি, উৎকৃষ্ট দই। ভীম নাগ বা পুঁটিরাম কিংবা দ্বারিকের কাঁচাগোল্লা ও নবীনের স্পঞ্জ রসগোল্লা। এক বার নাকি ভোজশেষে সব খাওয়ার পরে অমিয়বাবু ‘অতিরিক্ত চিংড়ির কাটলেট খেয়েছিলেন ডজন তিনেকের বেশি।’

পিটুলি বাটা দিয়ে মােছর শুক্তো

তবে শাক-ভাত হোক বা কালিয়া-কোর্মা, খাবারের আসল রহস্যটা ঠিক বুঝেছিলেন লীলা মজুমদার। ‘‘একেক সময় ভাবি, ভাল খেতে, মন্দ খেতে বলে কিছু নেই; যার যেমন অভ্যেস। পঞ্চাশ বছর আগে শান্তিনিকেতনের কাছে সাঁওতালদের গ্রামে, বিশ্বভারতীর ছেলেরা একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় করেছিল। বেশ পড়াশুনো করত ছেলেমেয়েরা। ...পুরস্কার বিতরণের দিন সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া হল। আমরা চাঁদা তুলে দিয়েছিলাম। তাই দিয়ে শিঙাড়া জিলিপি কেনা হয়েছিল। ...ছেলেমেয়েরা মহা খুশি। পরে একটা ছোট ছেলেকে বললাম, ‘কী রে, জিলিপি শিঙাড়া কেমন লাগল?’ সে এক গাল হেসে বলল, ‘খুব ভাল। কিন্তুক্‌ মেঠো ইঁদুর আরও ভাল’।’’

রান্না করেছেন:

সায়ন্তনী মহাপাত্র

ছবি: দেবর্ষি সরকার

রুপোর বাসন: অঞ্জলি জুয়েলার্স

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy