এখন যেখানে লালবাজার, তখন সেখানে ‘হারমনি ট্যাভার্ন’ হোটেল। বিলেত থেকে আসা হ্যাট-সুট-পরা সাহেবরা সন্ধেবেলায় সেখানে পানাহার করতেন। সেই সময় হোটেলটির হেড কুক ছিলেন মিস্টার ট্রেন হোম। তিনি ‘ক্যালকাটা গেজেট’ কাগজে ১৭৮৪-র ৬ মে একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন যে কষাইটোলা বাজারে, মানে এখনকার বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে তিনি একটি হোটেল খুলেছেন, যেখানে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ এবং ডিনারের উপযোগী নানা রকম খাবারদাবারের পাশাপাশি সব ধরনের বিস্কিটও পাওয়া যাবে।
যত দূর আন্দাজ করা যায়, এই বিজ্ঞাপনটিই কলকাতা শহরে বিস্কিট নিয়ে বেরনো প্রথম বিজ্ঞাপন। তখন এখানে যে সব বিস্কিট পাওয়া যেত তার সবই ছিল বিলিতি। কলকাতায় বেকারি তৈরি হয়ে বিস্কুট বানানো শুরু হয়েছিল এরও প্রায় একশো কুড়ি বছর পরে। হগমার্কেটের ‘নাহুম’ (১৯০২)-এ যার সূত্রপাত। নাহুম-এর বিস্কুট ছিল ছিমছাম এবং দামি। এদের আসল খদ্দের ছিল সম্ভ্রান্ত মহল। আর কলকাতার গরিবগুর্বোদের জন্য লোকাল বেকারির শস্তা বিস্কুট বানানো শুরু হয় মোটামুটি চারের দশকের গোড়ার দিকে। এই বেকারিগুলোর বেশির ভাগই ছিল পার্ক সার্কাস এবং হাওড়ার ছোট ছোট গলিঘুঁজিতে।
মুখে যতই স্বদেশি-স্বদেশি করি না কেন, আজও যেমন বিদেশি কুকুর , বিদেশি পোশাক, বিদেশি ভাষা এবং বিদেশি আদবকায়দা আমাদের চোখে শ্রেষ্ঠ, তেমনই বিদেশি বিস্কিটও যেন স্বচ্ছন্দ্য-জীবনের প্রতিচ্ছবি। সে জায়গায় লোকাল বিস্কুট যেন পাশের বাড়ির লুঙ্গি-ফতুয়া পরা চক্রবর্তীদা, যাকে জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালেই হুট-হাট দেখতে পাওয়া যায়। তাই লোকাল বেকারিতে যারা তৈরি হত, তারা কিন্তু কখনওই বিস্কিট নয় । তারা হল ‘বিস্কুট’। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল এই যে, উচ্চবিত্তরা তো দূরস্থান, মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালিরাও কিন্তু এদের কোনও দিনই নিজের ঘরে আদর করে ডেকে নেয়নি। তাই পাড়া বা স্থানীয় বাজারের পাঁচমেশালি দোকানে এদের টিকির দেখাও পাওয়া যেত না। এদের পাওয়া যেত কয়েকটি স্পেশাল চায়ের দোকানের কাচের বয়ামে। বিভিন্ন বেকারি কোম্পানির সাইকেল ভ্যানের ভেতরে রাখা মুখবাঁধা থলেতে এরা আদুল গায়ে শুয়ে থাকত। ভ্যানদাদা তাদের খোলামকুচির মতো মুঠোয় তুলে বয়ামের মধ্যে ঢেলে দিতেন। বিস্কুটের চল শুরু হওয়ার আগে পুরনো দিনের বাঙালি বাড়িতে চায়ের সঙ্গে গরম হাতরুটি পাকিয়ে খাওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল। পরে পাঁচ বা ছয়ের দশকের মাসকাবারি বাজারে লিলি বা কোলে বিস্কুট ছিল একচেটিয়া। অতিথি এলে দেওয়া হত ব্রিটানিয়ার থিন অ্যারারুট। দৌড়ের ট্র্যাকে প্রচুর ঘাম ঝরালেও নয়ের দশকের আগে মেরি বিস্কুট কিন্তু থিন অ্যারারুটের এই অহঙ্কারের জায়গাটা নিয়ে নিতে পারেনি। টানা কয়েক দশক ধরে হেমন্তবাবুর গানের মতোই থিন অ্যারারুট বিস্কুট, স্মৃতিমেদুর বাঙালির মনের মধ্যে একের পর এক ‘ডাউন মেমরি লেন’ তৈরি করে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: ‘হা’ বললে ‘হালিম’ বোঝেন! কেন কলকাতায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই পদ জানেন?
লোকাল বেকারির বিস্কুটের গায়ে কোনও দিনই কোনও নাম লেখা থাকত না। এদের গড়ন একটু এবড়োখেবড়ো। কাউকে দেখতে বাতাসার মতো, তো কারও পিঠে কাঠবেড়ালির মতো দু-তিনটি খয়েরি দাগটানা। সুজিবিস্কুট গোল, লেড়োবিস্কুট লম্বাটে, সন্দেশবিস্কুট ফুটফুটে সাদা আর তুসতুসে। কিন্তু এ সব বিস্কুটের থেকে প্রজাপতি বিস্কুট ছিল একেবারেই আলাদা। এদের গড়ন অনেকটা হরতন বা হার্ট-এর মতো। গায়ে সামান্য পোড়া পোড়া কালচে দাগ আর মাঝখানটায় চিনি ছড়ানো। বড় ডানা দুটোর সেন্টারে প্রজাপতির পাখার মতো পাকানো ডিজাইন থাকার জন্যই বোধহয় এদের এই রকম নাম হয়েছে। ওই পাকানো জায়গাটার ভেতরে দু’আঙুলে টুক করে টোকা দিলে ছোট্ট গোল একটা অংশ বেরিয়ে আসে। তখন সেই ফুটোর ভেতর দিয়ে আঙুল গলিয়ে আঙটির মতো পরে নিয়েও বিস্কুটটি খাওয়া যায়। হাতে নিয়ে ছাড়ালে পুরো বিস্কুটটাই ভাঁজে ভাঁজে লাচ্চা পরোটার মতো খুলে আসে, অথচ একপাশে কামড় দিলে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে না। খেতে খেতে গায়ে-জামায় একটু গুঁড়ো পড়ে কিন্তু সেটাও মন্দ লাগে না। এতে কামড় দিয়ে চায়ে চুমুক দিলে চমৎকার, কিন্তু চায়ে ডুবিয়ে খেলে ঠিক ততটা জমে না। কারণ, এতে এখন আর ঘি নয়, ডালডার ময়াম দেওয়া থাকে— যা টাকরায় আর দাঁতের পিছনে আঠার মতো আটকে যায়। হালে পাইকারি বিস্কুট বিক্রেতাদের কাছে নানা ধরনের বেকারি বিস্কুটের প্যাকেট পাওয়া গেলেও, প্রজাপতি বিস্কুট কিন্তু সবাই রাখেন না। তবে যিনি রাখার তিনি ঠিকই রাখেন।
একদা প্রজাপতি বিস্কুট তৈরি করেছিলেন সেই সব মুসলমান কারিগর, যাঁরা পাকিস্তান এবং কাশ্মীর থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে কোনও ভাবে বাংলায়, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদে এসে থাকতে শুরু করেছিলেন। এঁরা এক চিমটে নুন এবং দেশি ঘিয়ের ময়াম দিয়ে ময়দা মেখে, একদম ছোট্ট সাইজের রুটি বা ‘শুখা-পরাঠা বানাতে জানতেন। কোথাও কোথাও সামান্য ঘি-মাখানো তাওয়ায় ভাজা হলেও, বেশির ভাগ জায়গায় সেগুলো তন্দুরেই সেঁকা হত। শোনা যায়, এই খাবার বা ‘খানা’টি নাকি মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-র ছেলে আগা বাকের খাঁ-র ভারি পছন্দের ছিল। আর তাই থেকেই এর নাম হয়েছিল ‘বাকের খানা’, যা লোকমুখে হয়ে উঠেছিল ‘বাখরখানি’ । এই বাখরখানির আবার নানা জায়গায় নানা রকমের । তার মধ্যে কাশ্মীরি বাকরখানির একটি রূপই যে এই প্রজাপতি বিস্কুট, এটা হয়তো অজানাই থেকে যেত, যদি না শেষ রাতে ডাল লেকের জলবাজারে গিয়ে এক কাশ্মীরি বিস্কুটওয়ালার শিকারা থেকে সেই বিশেষ ধরনের কাশ্মীরি বিস্কুটটি আমরা কিনে খেতাম, যার চ্যাপ্টা-গোল গড়ন বাদে আর সব কিছুই প্রজাপতি বিস্কুটের মতো। একসময় কলকাতাতেও নাকি ওই রকম গোল আর চ্যাপ্টা চিনি-ছড়ানো বিস্কুট পাওয়া যেত যা পরতে পরতে খুলে আসত। তারাই প্রজাপতির মতো চেহারা পেয়েছিল পাঁচের দশকে এসে।
আরও পড়ুন: পালং শাক আর কিমার কেরামতিতে বিরিয়ানি এখানে কথা বলে
আমাদের কিশোর বয়সে কলকাতার সব চায়ের দোকানে কিন্তু প্রজাপতি বিস্কুট পাওয়া যেত না। পাওয়া যেত ভবানীপুর, রবীন্দ্রসদন, কলেজস্ট্রিট, শ্যামবাজার বা যাদবপুরের কিছু সাবেক চায়ের দোকানে। মানে, পাওয়া যেত সেই সব চত্বরে যেখানে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা বেশি ঘোরাফেরা করে অথবা শরতশেষের রোদ্দুরে রংবেরঙের প্রজাপতিরা মনের আনন্দে উড়ে বেড়ায়। ভবানীপুরের এক পাড়াতুতো দাদা এক বার আড্ডার মাঝে বলেছিলেন, ‘‘আমাদের সময়ে কোনও ছেলে কোনও মেয়েকে ভালবাসলে, তাকে চায়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে প্রজাপতি বিস্কুট খাওয়াতে চাইলে, সে যদি সেটা হাসিমুখে খেয়ে নিত তা হলে পরের ছবিগুলো বেশ সহজেই মিলে যাবে বলে ধরে নেওয়া যেত। আর, ‘এই বিস্কুটটা খেলে-না, আমার কেমন অম্বল হয়!’ বলা মেয়েরা যে পরের রাখিপূর্ণিমায় নিশ্চিত ভাবেই হাতে রাখি পরিয়ে দেবে, সেটাও পরিষ্কার বুঝতে পারা যেত। কারণ, এটা তত দিনে আর হাইপোথিসিস ছিল না, হয়ে গিয়েছিল বোস-আইনস্টাইনের মতো জ্বলজ্বলে একটা থিওরি!
(অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy