দুর্গাপুজো চলে যাবার পরে যে মন-খারাপ, তার তুলনা অন্য কিছুর সঙ্গে করা চলে না। যেন প্রায় জীবনটাই শেষ হয়ে গেল, এই রকম একটা ব্যাপার। এটা অবশ্য ছোটবেলাকার অনুভূতি। রঙিন জামা আর হইচইয়ের দিন শেষ, প্রতিমা ঝুপ্পুস করে জলে পড়ার পরেই ট্রাঙ্ক থেকে হালকা চাদরগুলো মন-খারাপের রোঁয়া নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। সে মন-খারাপের, আবারও, জুড়ি নেই। তবে সেই অতুলনীয় জখমে উপশম ছিল একটাই। সামনেই কালীপুজো।
এই একখানা পুজো বাকি সব পুজো থেকে এতটাই আলাদা যে, সে আসছে ভেবেও মনটা ফুলঝুড়ি হয়ে উঠত। বিশ্বকর্মা পুজোয় আকাশের মালিকানা, দুর্গাপুজোয় নতুন জামা আর ঠাকুর দেখা, সরস্বতী পুজোয় স্কুলের অঞ্জলি আর বান্ধবীদের শাড়ির মোড়ক। এ জিনিস একরকম। আর তাক বুঝে সলতেয় আগুন দেওয়া অন্য জিনিস। চরকি থেকে তুবড়ি, হাউই থেকে ইলেকট্রিক তার, পটকা থেকে দোদোমা এবং সর্বোপরি মহামহিম চকোলেট বোম... কেবলমাত্র এক সন্ধেয় এই লাইন-আপ ভাবা যায় না!
অঙ্কন: সুমিত্র বসাক।
আরও একটা ব্যাপার কিন্তু কালীপুজোকে সব পুজো থেকে আলাদা করে রেখেছিল, হয়তো আজও রেখেছে। সেটা হল, এই শক্তির আরাধনা নামক বিষয়টি। ছোট থাকতেই আমরা কালীমূর্তিকে দেদার ভয় পেতে শিখেছিলাম। স্বাভাবিক। ডাকের সাজে ধোপদুরস্ত হাসি মুখের দুর্গা দেখার দিন পনেরো পরেই জামাকাপড় ছেড়ে জিভ কেটে হাতে খাঁড়া আর গলায় নরমুণ্ডের মালা নিয়ে যিনি হাজির হচ্ছেন, সেই কৃষ্ণাঙ্গীকে ভয় না পেয়ে উপায় কী? একটু বেচাল হয়েছ কি খপাৎ... মেজাজটাই এই রকম। সেই দেবীর পুজোয় যে এন্তার বুকফুলানো বোমাবাজি হবে, এ আর নতুন কী! বহু পরে, যত দিনে দীপাবলির আদত ইতিহাসটা জেনেছি, তত দিনে কয়েক কুইন্টাল বুড়িমা উৎসর্গ করে ফেলেছি বাতাসে। সেই দীপাবলি কী ভাবে আজকের কালীপুজোয় মার্জ করে গেল, সেটা অবশ্য মাথায় ঢোকেনি।
যাই হোক, কথা হচ্ছিল শক্তির আরাধনার। ছোট থেকেই দেখতাম, যারা হয়তো অন্যান্য পুজোয় ঠিক ততটা অ্যাকটিভ নয়, তারা জমিয়ে কালীপুজো করছে। তারা হচ্ছে সেই সব দমদার ছেলে বা লোক, যাদের আমরা একটু সমঝেই চলতাম। জিতেন্দ্র বা শশী কপূর ছাড়া একমাত্র তারাই শার্টের উপর দিক থেকে চারটে বোতাম খুলে ঘুরত। ওই মাগ্যির বাজারে তাদের দমদমানো বাইক থাকতই, রাতবিরেতে গলা তুলে কথা বলার অধিকারও থাকত তাদেরই। তারা চাকরি করত না, এমনকী খুঁজতও না। পাড়ার মোড়ে, ইটভাটায়, আন্ডার কনস্ট্রাকশন বাড়ির আনাচে-কানাচে, ক্লাবঘরের আশেপাশে তাদের দেখা যেত। হাতে নিশ্চিত বালা, গলায় অবধারিত চেন। আমরা কেন, আমাদের বাবা-কাকারাও এদের কিঞ্চিৎ সমঝেই চলতেন। কারণ, মায়ের হাতের খাঁড়ার মতো, এদেরও কোমরে মিনি-খাঁড়া গোঁজা থাকত। চমকে দিতে মিনিটও লাগত না। এরা, এককথায়, মাস্তান। শব্দটাও ওই ছোটবেলাতেই শোনা। একটা আলাদা প্রজাতি, ভিন্ন সম্প্রদায়। দরকারে কখনও সখনও এদের পাওয়া যায়, অ-দরকারে সব সময় হাজির।
এরা কিন্তু জমিয়ে কালীপুজোটা করত। দেমাকপূর্ণ এবং ভয়সমৃদ্ধ। কারণ কী? কারণ, কালী তাদের দেবী। মাস্তানদের মামণি। গুন্ডাগর্দির গর্বিতা মা। এই রকমটাই চাউর হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। ওই যে শক্তির আরাধনা। এখন আমরাও তেমন। শক্তি বলতেই প্রথমে, এবং শেষেও, পেশিশক্তির কথাই মনে পড়ে। মগজাস্ত্র বলে যে একটা ব্যাপার আছে, সে তো আমরা ফেলুদার কাছ থেকে শিখলাম। অতএব, শক্তি মানেই কপূর এবং বাইসেপস। সে জিনিস যাদের আছে, তারাই কালীপুজোর অধিকারী।
আর এ যুগের মাস্তানরা যে হঠাৎ গজিয়ে উঠে কালীর আরাধনায় প্রাণ ঢেলেছে, তা তো নয়। আদি বাংলায় কালীর উপাসক ছিল ডাকাতেরা। সে যুগের দিলদার মাস্তান তারাই। অতএব আজকের এরা জাস্ট উত্তরাধিকার সূত্রে কালীপুজোটা পেয়েছে। আমরা ছোটবেলায় বাংলার ডাকাত সিরিজ পড়েছি, ডাকাতদের প্রতি একটা হালকা রবিনহুড-গন্ধী ভক্তিভাবও জেগেছে। কিন্তু বাংলার মাস্তানদের আমরা খুব সুবিধের চোখে দেখিনি কখনওই। তাই তাদের কালীপুজো তাদের হয়েই থেকেছে বরাবর। আমরা প্রসাদ নিইনি।
এখন কথা হচ্ছে, এরা সব ঘোষিত মাস্তান। এদের লাইসেন্স আছে। পাড়ায় কোনও কুকীর্তি হলে এদেরই আগে সন্দেহ করার একটা অলিখিত অধিকার আমরা পেয়েছি। এরা শক্তিতে পেশি অব্দিই এগোতে পেরেছে, তাই কালীকে গোটা ব্যাপারটা ডেডিকেট করেছে। কিন্তু পেশির চাইতেও যেটা বেশি শক্ত, সেই মগজকে ব্যবহার করে কত মানুষ আমাদের চারপাশে নিভৃত মাস্তানি ফলিয়ে চলেছেন, সেটা আমরা, সাধারণেরা, ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারি না। তাঁরা পাড়ার মতো ছোট কোর্টে খেলেন না। তাঁদের এরিয়া মিনিমাম রাজ্য কিংবা দেশ। দু’একটা বৈঠকে, তিন চারটে সই বিনিময়ে তাঁরা এক মুহূর্তে অগুনতি মানুষের ভাগ্যের মুচকি মাস্তানি করে ফেলতে পারেন, তার জন্যে বাইসেপ লাগে না। এই মহামাস্তানরাও কি কালীর উপাসক? জানতে খুব ইচ্ছে করে আমার।
কালী তো অশুভের বিরুদ্ধে শুভশক্তির প্রতীক, কাপুরুষ শাসনের বিরুদ্ধে টানটান শিরদাঁড়ার প্রতীক। সেই প্রতীকের কতটুকু নিতে পেরেছি আমরা? নির্লজ্জ মহামাস্তানদের সঙ্গে রাতের পার্টিগুলোয় খোশগল্প করেছি হয়তো, কিন্তু পাড়ার বিল্টু-টোটন-দীপু-বাবলুদের মেনস্ট্রিম সরস্বতীপুজোয় অন্তর্ভুক্ত করে উঠতে পারিনি আজও। সেটা আমাদেরই শিড়দাঁড়ার অভাব।
সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। আজও পাড়ার মাস্তানদের মাতলামোপূর্ণ কালীপুজোকে আমরা হালকা নিচু নজরেই দেখি। তাদের পেশিফোলানো মাস্তানি যেমন কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়, তেমনই চেষ্টাবিহীন বাতিলপনাও প্রশ্নযোগ্য।
এ সব তর্ক আপাতত তুলে রেখে বলি, আমার ছোটবেলা বহু আগে পার হয়েছে। তখন কালীপুজোয় ভাল শীত পড়ত, হিম নামত আকাশ থেকে। সন্ধের পর মায়ের কাঁটায় বোনা উলের হাফ হাতা সোয়েটার পরে বোতলে বসানো হাউই-এর মুখে আগুন দেবার দিনও মিইয়ে গেছে সেই কবেই। ফাঁকা বোতলটা পড়ে রয়েছে এখন, শ্যাওলাধরা পাঁচিলের ওপরে। কিন্তু সেই পাঁচিলের এক পাশে বড় হতে হতেই আমি বেছে নিয়েছি আমার প্রিয় মাস্তানকে।
হ্যাঁ, সকলের জীবনেই আইডল থাকে, নিভৃত প্রাণের দেবতা থাকে। স্পাইডারম্যান থেকে ছোড়দা, সে-মাস্তানকুলের বিরাট রেঞ্জ। আমি খুঁজে পেয়েছি মাথা নিচু করে সরোদ বাজিয়ে চলা এক মাস্তানকে, যাঁর নাম উস্তাদ আলি আকবর খান। পণ্ডিত রবিশঙ্কর যাঁকে আখ্যা দিয়েছিলেন সঙ্গীত জগতের খলিফা বলে, তিনিই আমার প্রিয় মাস্তান। প্রশ্ন হতেই পারে, এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ সম্বোধন কেন? তা হলে বলি, একবার আধ ঘণ্টার অনবদ্য ভাটিয়ার বাজাতে বাজাতে, একেবারে শেষের দিকে গিয়ে কোমল নিখাদে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছু ক্ষণ। ওই স্বরটি ভাটিয়ারে বর্জিত, ঠিক যেমন চায়ে ফিনাইল দেওয়া হয় না। বাজনাটি ক্যাসেট আকারে প্রকাশিত হবার পর বহু সমালোচক, যাঁরা ওঁর কাছে পৌঁছতে পেরেছেন, জানতে চেয়েছিলেন কেন এই ‘হঠকারিতা’। ওই রকম সম্পূর্ণ একটি পারফরম্যান্সে হঠাৎ এক ফোঁটা কোমল নিখাদ লাগিয়ে সর্বনাশ ডেকে আনার কারণ কী? শোনা যায়, সামান্য হেসে খানসাহেব বলতেন, ‘সেই দিন হঠাৎ মনে হল, লাগিয়ে ফেললাম।’ এঁকে মাস্তান বলব না, তো কাকে বলব? আর হ্যাঁ, খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে, কারণ এই আশ্চর্য শিল্পী আদ্যন্ত কালীর উপাসক ছিলেন।
আর আমি নিজে? কালীপুজো করি না ঠিকই, কিন্তু শক্তির আরাধনায় সেই কবে থেকে মেতে আছি। শক্তির পদ্যসমগ্রের পাতা না-উলটে এক দিনও ঘুমোতে যাই না যে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy