শিল্পীর আঙুলের চাপে কাঁচা মাটিতে ক্রমেই ফুটে উঠছে নারী মূর্তির অবয়ব। একটা নয়, দুটো নয় অসংখ্য। এই সব নারী মূর্তির হাতে, কখনও বা চালিতে দেখা যায় একাধিক মাটির প্রদীপ। ‘দশভুজা’, ‘সাতবহিনা’ কিংবা ‘গয়লানি’। এগুলি হল দেওয়ালি পুতুল। উজ্জ্বল নানা রঙের ছোঁয়ায় ফুটে ওঠে সেই পুতুলের বিচিত্র রূপ।
মেদিনীপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে দীপাবলির রাতে জ্বলে ওঠে হাজারো এমন প্রদীপ। লক্ষ্মীপুজোর আগে থেকেই মেদিনীপুর শহরের মির্জাবাজারের কুমোরপাড়ায় রাস্তার দু’ধারে দেখা যায় সারি সারি দেওয়ালি পুতুল রোদে শুকোচ্ছে।
দেওয়ালি পুতুলের সৌন্দর্য তার সরলতায়। প্রয়াত গবেষক তারাপদ সাঁতরা লিখেছিলেন, কুমোরদের আত্মীয়তা সূত্রে পুরুলিয়া থেকে মেদিনীপুরে এসেছিল দেওয়ালি পুতুলের ঐতিহ্য। দীর্ঘ দিন এই দেওয়ালি পুতুলের উপর অনুসন্ধান ও গবেষণা করছেন মেদিনীপুরের বাসিন্দা চিন্ময় দাস। তিনি জানালেন, পুতুলগুলির গড়ন এবং নারী মূর্তিগুলিতে শাড়ির পরিবর্তে ঘাঘরার ব্যবহার দেখে বোঝা যায় এতে বিহারের প্রভাব রয়েছে। এই প্রদীপে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারী মূর্তি দেখা যায়। তবে অনেক সময় কিছু জন্তু জানোয়ারও দেখা যায়।
বর্ষার সময় থেকে তৈরির কাজ শুরু হলেও দেওয়ালি পুতুল বিক্রি হয় কিন্তু কালীপুজোর মাত্র দু’-তিন দিন আগে থেকে। কালীপুজোর দু’-তিন দিন আগেই মির্জাপুর কুমোরপাড়ায় দেওয়ালি পুতুলের এক মেলা বসে। বিক্রির জন্য কুমোরদের ঘরের সামনে সিঁড়িতে থরে থরে সাজানো থাকে দেওয়ালি পুতুল। দীপাবলির দু’-তিন দিন আগে থেকেই মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হয় এই পুতুল। মেদিনীপুর শহরের এলআইসি মোড়ে দেওয়ালি পুতুল কিনতে এসে অভিরূপ জানা বলছিলেন, “উজ্জ্বল রূপের জন্য ভাল লাগে এই প্রদীপ।”
মেদিনীপুরের মির্জাবাজার থেকে এই প্রদীপ যায় খড়্গপুর, ঝাড়গ্রাম-সহ বিভিন্ন জায়গায়। বিশ্বের নানা সংগ্রহালয়ে বাংলার লোকশিল্পের আকর্ষণীয় উদহরণ হিসেবে স্থান পেয়েছে এই দেওয়ালি পুতুল। আগে মেদিনীপুরে এই পুতুলের ক্রেতা ছিলেন মূলত অবাঙালিরা। দীপেন দাস, বিশ্বরূপ পাল, অরূপ পালের মতো পুতুল শিল্পীরা জানালেন, খড়্গপুর এবং তার আশপাশের এলাকায় বসবাসকারী অবাঙালি সম্প্রদায়ের মানুষই মূলত এই পুতুল কেনেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি পরিবারেও এই পুতুলের চাহিদা বেড়েছে।
দীর্ঘ দিন ধরে দেওয়ালি পুতুল তৈরি করছেন শিল্পী অরুণ পাল। তাঁর কথায়: “এখন ছোট পুতুলের চাহিদা বেশি। যেমন এক হাতি, দু’হাতি, চার হাতি কিংবা ছ’হাতি পুতুল। এই নামকরণ আসলে পুতুলের হাতের সংখ্যার উপর নির্ভর করে হয়। তবে আগে ঝাড়পুতুল, হাতিপুতুল, ঘোড়াপুতুল তৈরি হত।” তিনি জানান, এখন একটি দেওয়ালি পুতুলের দাম প্রায় ৩০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে আসছে শিল্পীর সংখ্যাও। আগে এখানে প্রায় ১০০ ঘর কুমোর থাকলেও আজ মাত্র ৩০ ঘর শিল্পী এই পেশার সঙ্গে যুক্ত। অরুণবাবু আরও জানালেন, সময়ের সঙ্গে জনপ্রিয়তা বেড়েছে এই শিল্পের। এ বছর কলকাতার নাগেরবাজারে একটি দুর্গা পুজোর থিম ছিল প্রদীপ। সেখানেও স্থান পেয়েছে দেওয়ালি প্রদীপ।
কী ভাবে তৈরি হয় এই পুতুল?
শিল্পীরা জানালেন, পুতুল তৈরি হয় কুম্ভকারের চাকায় মাটি দিয়ে। ছাঁচে মুখ এবং দেহের অংশবিশেষ তৈরি করে, তার সঙ্গে হাত জোড়া হয়। এর পরে রোদে শুকানোর পরে তা আগুনে পোড়ানো হয়। তার পর হয় রঙের কাজ। প্রথমে পড়ে খড়ি মাটির প্রলেপ। তার পরে অন্যান্য রং। পুতুলে আজও ব্যবহার করা হয় প্রাকৃতিক রং। দেওয়ালি পুতুল প্রসঙ্গে গবেষক দীপঙ্কর ঘোষ বলছিলেন, “মেদিনীপুরের পাশাপাশি পুরুলিয়ার বেশ কিছু জায়গায় পাওয়া যায় এই পুতুল। এর মধ্যে বলরামপুর, কাটিং উল্লেখযোগ্য।”
পুরুলিয়ায় দেওয়ালি পুতুল তৈরি হয় বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই। কেননা কালীপুজোর অনেক আগেই এগুলি পাড়ি দেয় ঝাড়খণ্ড এবং বিহারের বিভিন্ন অঞ্চলে। সেখানে এই পুতুলের ভাল চাহিদা আছে। তবে মেদিনীপুরের দেওয়ালি পুতুলের থেকে পুরুলিয়ার পুতুলের আকার ও রূপে কিছু পার্থক্য আছে।
এক দিকে দিনে দিনে বাড়ছে দেওয়ালি পুতুলের চাহিদা। অন্য দিকে কমছে ভাল শিল্পীর সংখ্যা।
ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy