বরফকলের মাঠ ও এক শীতরাতের ঘোড়া
আজব এক দুনিয়ার আরও আজব এক হিমঋতুর কাহিনি কখন কী ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে আমার শিরায় শিরায়। আমি তাকে ছাড়াতে পারি না। যেন অবিকল এক রূপকথার মতোই টানটান সেই দুর্যোগের কাব্যখানি কত বার যে শুনেছি আমার মায়ের মুখে, তার আর লেখাজোকা নেই। তুহিনকালের সেই কাহিনিখানি অনেকটা এই রকম: পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পল্লিশ্রি নামে এক জলজঙ্গলে ঘেরা বিদ্যুৎহীন বাগানবাড়িতে শুয়ে দুগ্গাঠাকুরের মতোই রূপসী মা নাকি খুব কাঁদছিলেন আমি হওয়ার ঠিক প্রাক-পর্বটিতে এবং তা যত না যন্ত্রণায়, তারও বেশি কোনও সাঙ্ঘাতিক অঘটনের ভয়ে। কেননা, অঘ্রাণের শেষাশেষি সেই রাতে হঠাৎই মুষলধারায় অকালবর্ষণ নামায় ওই গ্রামাঞ্চলে কোনও ডাক্তার-আগমনের ক্ষীণতম আশাটিও শেষ হয়ে যাচ্ছিল প্রতি মুহূর্তেই। তা, তখনই নাকি পুব দিকের ধূ ধূ করা এক বরফকলের মাঠ পেরিয়ে, ঘোড়ার পিঠে ছাতি মাথায় জড়সড় বসা কোনও এক মফসসলি ডাক্তার সখেন হালদার এসে হাজির হয়েছিলেন আমাদের বাড়িতে। সৌজন্যে আমার মাতামহ— এবং আর একটু খুলে বললে, তার খাস পরিচারক তথা ওই ‘অতুলনীয়’ হাড়জিরজিরে ঘোড়ার সহিস শ্রীমান অতুল! ব্যস, সে রাতে ওই ঐশ্বরিক অশ্বিনীকুমারের কৃপাস্পর্শেই আমার ধরায় আসা— এবং এই কাহিনির প্রতিটি আসরেই যা আমার সবচেয়ে বেশি ভাললাগত, মায়ের বর্ণনার সেই অংশটি হল: “কিন্তু পরদিন সকালে উঠে দেখি, কী রোদ কী রোদ! সেই সোনার মতো রোদ্দুর দেখে কে বলবে যে, অত বড় একটা দুর্যোগ গেছে আগের রাতেই। আর তার পর তো একটু বেলা বাড়তেই বাড়িভর্তি কত লোক— গ্রামের যারাই তোকে দেখতে এসেছিল, সকলেই একবাক্যে বলল, ভাগ্যিস অতুলের ঘোড়াটা পাওয়া গিয়েছিল সময়মতো, নইলে কী যে হত!”
গাছবাড়ির ইলিয়াস সুরিনম ও কুমডির শীত
শহরের শীতসন্ধ্যায় আলতো হিমেল হাওয়া দিলে প্রেমিকার হাত শক্ত মুঠোয় চেপে যাঁরা পর্যাপ্ত শীতবস্ত্রের আড়াল থেকেও কপট যুদ্ধের মতো হি হি হু হু রব তোলেন, তাঁদের ঠিক বোঝানো যাবে না, দাঁতের পাটি খুলে আনা, হাড় থেকে চামড়া খসিয়ে দেওয়া পাহাড়-জঙ্গলের শীত কাকে বলে! অম্তত আমি তা জেনেছিলাম সারান্ডার জঙ্গলে ঢুকে ১৯৭৬-এর ঘোর শীতকালে। বন বিভাগের অনুমতিপত্র দেখিয়েও কুমডির বনবাংলোতে পৌঁছতে সে যাত্রায় অবশ্য রীতিমতো রাত্রি হয়ে গিয়েছিল আমারই মূর্খতায়। কেননা, আমার বিন্দুমাত্র ধারণাও ছিল না, বড়াজামদা থেকে সেই কোন দুপুরে ভাড়ার জিপে চেপে যখন কুমডির পথ ধরছি, তখনই আমার সপ্তাহখানেকের মতো খাবারদাবার কিনে নেওয়া উচিত ছিল। ফলে ক্রমেই শীতের চড়চাপড় যখন বাড়ছে সমানে, সূর্য পাটে যাওয়ার মুখে এবং এক দীর্ঘ যাত্রাশেষে কোনওক্রমে হেডলাইট জ্বেলে পৌঁছে গিয়েছি ওই অরণ্যপ্রান্তের বনরক্ষীদের চেকপোস্টে— ঠিক তখনই তাঁরা আমার কাগজপত্র সব খতিয়ে দেখার পরও আমার সঙ্গে কোনও রসদ নেই দেখে ফিরে যেতে বললেন বড়াজামদায়— কেননা, খাবার ছাড়া কাউকে জঙ্গলে ঢুকতে দেওয়া আর তাকে গুলি চালিয়ে মেরে ফেলার মধ্যে নাকি কোনও তফাৎই নেই। তা সে যাত্রায় আমার সেই জন্মরাত্রির দুর্যোগে অতুলচন্দ্র নামে সহিসটির অশ্বপৃষ্ঠে ডাক্তার নিয়ে আসার মতোই যেন ওই চেকপোস্টের দোরগোড়ায় হাজির হয়েছিলেন খোদ কুমডি ফরেস্ট বাংলোর কেয়ারটেকার মহম্মদ ইলিয়াস সুরিন! যে মানুষটি কি না মাসে মাত্র এক বারই ও ভাবে জঙ্গল ছেড়ে বাইরে আসেন নিজের মাসকাবারি রসদটুকু নিতে। তা ওই অলৌকিক সন্ধ্যায় তিনি কি না ঈশ্বরপ্রেরিতের মতোই এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন সামান্য একটু অর্থের বিনিময়ে, আমার হপ্তাখানেকের খোরাকের দায়িত্ব নিতে।
ফলে সুরিনের মালপত্র বওয়ার এক পুরনো লজঝরে ট্রাকের সওয়ার হয়ে সেই প্রথম আমার কুমডি অরণ্যে প্রবেশ— তাও হুবহু কোনও ঝড়ের মুখে পড়া খড়কুটোর মতোই কাঁপতে কাঁপতে। স্মৃতিচারণের ঠিক এই জায়গাতে এসেই অবশ্য আমায় দু-দু’টো কথা বলে নিতে হবে। প্রথমত, সেই রাতটা ছিল শুক্লপক্ষের শেষ দিকের— অনেকটা ওই পুকুরের জলে ডুব দিয়ে থেকে ওপরের কোনও লণ্ঠনের আলো দেখার মতোই ফ্যাকাসে আর ভেজা। আর দ্বিতীয়ত, শহুরে মানুষ বলেই বোধহয় নিজের তিন-চার রকম শীতবস্ত্রের আড়াল সত্ত্বেও কাঁপুনির ওই বাড়বাড়ন্তের মাঝে সে রাতে আমি ভুলেও মহম্মদ ইলিয়াস সুরিনের মামুলি একটা চাদরে ঢাকা ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক জড়ানো খড়ি ওঠা চেহারাটিকে দেখেও দেখিনি। কেননা, তখন আমার চোখে পড়ছিল স্রেফ অরণ্যের ভয়ঙ্কর ঘেরাটোপে মোড়া পাহাড়ের সিল্যুট— হাতির পাল যেখানে পাথরের গা থেকে খনিজ নুন চাটতে আসে, কিংবা ভালুক যেখানে ঝোপের ভিতরে ‘ঝোপ’ সেজে বসে থাকে মৌচাকের খোঁজে— অথবা সম্বরের ঝাঁক হঠাৎই চোখের ঝকঝকে আলো জ্বেলে রাস্তা পার হয় ত্রস্ত পায়ে। তার ওপর হঠাৎ হঠাৎ ক্যারক্যার শব্দ তুলে অজানা কোনও রাতচরা পাখির উড়ে যাওয়া— এ সবই বুঁদ হয়ে গিলছিলাম আমার নির্বাক নিস্পন্দ সঙ্গী সুরিনের দিকে এক বারও না তাকিয়েই।
অথচ সে রাতে কুমডির বাংলোতে সুরিনই এক-বেলচা জ্বলন্ত কয়লার আগুন এনে আমার ঘরের ফায়ারপ্লেস জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন অতি যত্নে। বনমোরগের ঝোল আর রুটি খাইয়েছিলেন অনুগত ভৃত্যের কুণ্ঠা নিয়ে। আর সবচেয়ে বড় কথা, সেই রাতের বাংলো ঘিরে বয়ে চলা হাড়হিম করা ঠান্ডা যাতে কষ্ট না দেয় আমাকে, তাই ঘর ছেড়ে বেরোনোর আগে একগাদা ধবধবে পরিষ্কার লেপ-কম্বলে মুড়ে দিয়েছিল আমার বিছানা। শোয়ার আগে ভাবছিলাম, ও নিশ্চয়ই এই এত বড় বাংলোটার অন্য কোনও ঘরে একই রকম বিছানার উত্তাপে ঘুমোতে যাবে।
তবে ভুলটা আমার ভেঙেছিল অবশ্যই পর দিন সকালে উঠে, এবং তা এমনই এক অকল্পনীয় দৃশ্যের মুখোমুখি হয়ে, যার স্মৃতি প্রায় চার-চারটি দশক পার করেও আমি আজও বয়ে বেড়াচ্ছি তো বটেই, সম্ভবত জীবনের শেষ দিনটিতেও ভুলতে পারব না। একটু খুলেই বলা যাক সেই অভাবনীয় ও অসহ্য মুহূর্তটির কথা। আগের রাতে বাংলোর কিছুটা দূরেই ‘সন্ধ্যা ছ’টার পরে কিংবা সকাল ছ’টার আগে বাংলো থেকে বেরোলে যদি কোনও বন্যজন্তুর আক্রমণের ঘটনা ঘটে, সরকার তার দায়িত্ব নেবে না’, ইংরেজিতে লেখা এই সতর্কবার্তা চোখে পড়েছিল বলেই বোধহয় সাড়ে ছ’টা নাগাদ সবে বাংলোর বাইরে একটা পা রেখেছি— দেখি, আমার দিকে কেমন এক অবলা প্রাণীর মতোই আনুগত্যের মুখ তুলে সুরিন একটা সরু আর লম্বা গাছের মাঝামাঝি এক তে-ডালা খোপে বানানো একটা পলকা আর ‘মেকশিফ্ট’ গোছের গাছবাড়ি থেকে ওর সরু লিকলিকে দুটো সম্পূর্ণ অনাবৃত পা বাড়িয়ে নেমে আসছে লালমাটির পথের উপর। হাঁ করে তাকিয়ে দেখি, ওর গায়ের গামছার থেকেও পাতলা একটা ফতুয়া গোছের ছোটখাটো জামার উপরে কাল রাতের সেই ধুলোবালি রঙের সেই চাদরটা— সেটাও এত পলকা আর ফালতু যে পলকেই নিজের সার্জ, উল, কর্ড্যুরয় আর লেদারে মোড়া টুপি-গ্লাভস-মোজা, কি হাইনেক ‘সাফারি’ বুটজুতোর তামাশা-মোড়া এই ‘আমি’ মানুষটা ওর সামনে হুবহু একটা জন্তুর মতোই যেন কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গেলাম। ফস করে কেমন মনে হল: কে জানে— ওর আর আমার মধ্যের এই দুস্তর ব্যবধানটার নামই বোধহয় শীত— আমরা শুধু নানা ভাষায় তাকে বিষাদ বলি, বিষণ্ণতা বলি, হতাশা বা নৈরাজ্য বলি— এমনকী, কখনও অভাব বা দারিদ্র বলেও গাল পাড়ি। যদিও আদতে খুব যত্ন করেই অভ্যাস করি এই ব্যবধানটিকে দেখেও না দেখারই ভান করা। সে যাত্রায় আমি তাই শীতের প্রকৃতি দেখেও বুঁদ হতে পারিনি, সুখী হতে পারিনি কোয়েল বা কয়না নদীর মজা খাতের হিমজলে পা ডুবিয়ে, কিংবা সারা রাত বাংলোর চারপাশে ঘোরা অজস্র বুনো জানোয়ারের ডাক শুনতে শুনতে হিমে ভেজা চাঁদনি রাতে শুয়ে। পারিনি কেননা, একটি মানুষের অসহায়তাই যে আর একটি আপাতসুখি মানুষের কাছে হুবহু শীতের মতোই তীব্র কষ্টদায়ক হতে পারে, সুরিনের সেই অশরীরীপ্রায় জীবনের সামনে দাঁড়িয়ে আমি তা প্রথম জানতে পেরেছিলাম।
আমার সেই জন্মযুদ্ধের সহিস অতুলচন্দ্র মারা গিয়েছে আজ বহু বছর হল। এমনকী, তার সেই গরিবগুর্বো চেহারার ঘোড়াটার একটি বংশধরকেও মাঠেঘাটে কোথাও দেখলে আর আমি চিনতে পারব না কোনও মতেই। কিন্তু ওই যে এই লেখাটার একেবারে গোড়াতেই বলেছিলাম— আজব সেই হিমঋতুর দুর্যোগজয়ের কাহিনিটি কী ভাবে যেন জড়িয়ে গিয়েছিল আমার অস্থিতে-মজ্জায়, অস্তিত্বের গোপন কোটরে— কেন, সে কথাটাই এ বার খুলে বলি। পরিণত বয়সে এসে অনেক ভেবে দেখেছি— না হতে পেরেছি আমি মায়ের মতো ঈশ্বরবিশ্বাসী, না হয়েছি বাবার মতো সংসারী মানুষ। মাঝখান থেকে কোথাকার কোন অতুলচন্দ্রের মতোই যেন এক মাথামুণ্ডহীন অলীক অশ্বের পিছনে ভিজে একসা হয়ে হেঁটে আসতে আসতেই কেটে গেল জীবনের ছ’-ছ’টি দশক। এই লম্বা পথে আমি ব্যথা ও কষ্ট চিনেছি। চিনেছি হতাশা ও গ্লানির কাঁপুনি। পথের পাশে কাঠকুটো জ্বালিয়ে শীত পোহানো মানুষ দেখলেই তাই একটু দাঁড়াই— ওদের আগুনের উত্তাপ নিই দু’হাত বাড়িয়ে। যেন হোমাগ্নিতে এ জন্মের সব পাপ ধোয়ার মতন। কুমডির সেই কেয়ারটেকার সুরিনকে আমার মোট তিনটি শীতবস্ত্রের মধ্যে দু’টি দিয়ে এসেছিলাম। আর ওঁর পাওনার থেকে শ’খানেক বেশি টাকা। তার বেশি আমার কাছে ছিল না। কিন্তু যা ওঁকে দিয়ে আসে পারিনি, তা এক স্বীকারোক্তি। হ্যাঁ, সেই কোন ১৯৭৬-এ ওই মহম্মদ ইলিয়াস সুরিনই আমায় চোখে আঙুল দিয়ে শিখিয়েছিলেন: শীত আসলে অনাদরের কুয়াশায় মোড়া এক হিম অনুভব, যাকে শুধুমাত্র স্বার্থহীন কোনও হৃদয়ের উত্তাপেই উষ্ণ করা যায়। সেই বদলানো চোখের দৃষ্টি মেলে আমি আজ তাই স্পষ্ট দেখি— মাঠ, পাহাড়, অরণ্য বা জনপদের গা শিরশিরানো একটি অনুভূতিই শুধু শীত নয়। তার ঠাঁই আরও গভীর কন্দরে। চালের দোকানে কারও বাকির খাতায়, কারও বকেয়া ভাড়ায়, কিংবা পাওনাদারের ক্রুর তাগাদায় এই ঋতুশাপ বদ্ধ জলার মতোই আজীবন বহমান থাকে। কোটি মানুষের ভিড়ে দুর্বল দু’টি হাত মেলে, অবিকল কোনও শামুকের ক্ষমতায় আমি সেই শীতকেই মুছে দিতে চাই।
সুরিন বা অতুলকে কোনওদিন প্রণাম করিনি কেন, ভেবে নিজেরই নির্জনে নিজে চোখ মুছি।
ছবি: দেবরাজ ঘোষ এবং অসামান্য বসু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy