ছবি: এএফপি।
হিজড়ে বলতেই তোর কী মনে হয়?
যা সব সময় দেখি। বাচ্চা হলেই বাড়ি বয়ে ঝামেলা করতে আসে। উত্কট গান গায়। নাচে, বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি করে। আর দমাদ্দম হাততালি। টাকা চায়। গাদা গাদা টাকা। ওটা যেন ওদের জন্মগত অধিকার। আমরা দেব বলেই বসে আছি। না দিলেই অকথ্য গালিগালাজ, খিস্তি। তার পর অসভ্যতা শুরু। জামাকাপড় খুলে ফেলে প্রায়!
আমি কিন্তু অনেক হিজড়েকে ভদ্র ভাবে কথা বলতে দেখেছি। আমার বাবার কাছ থেকে এক জন বই চেয়ে পড়ত। সে মণীন্দ্র কলেজের গ্র্যাজুয়েট।
পড়াশুনো? আর ওরা? বলছিস কী? ট্রেনে-বাজারে-দোকানে-রাস্তায় তোলা আদায় ছাড়া আর কিছু জানে ওরা?
ফেসবুকে এক মিউজিশিয়ানের কথা পড়লাম। ট্রেনে বান্দ্রা থেকে আন্ধেরি যাওয়ার পথে এক হিজড়ে এসে টাকা চায় তাঁর কাছে। ওই বৃহন্নলার নাম ছিল মায়া। ভদ্রলোক দশ টাকা দেওয়ার পরে মায়া তাঁর কাছে জানতে চান, আপনি কী করেন? মিউজিশিয়ান শুনেই মায়া তাঁকে বলেন, একটু মোত্সার্ট বা বেঠোফেন শোনাতে পারেন? চমকে যান উনি। জানতে পারেন, মায়ার পড়াশোনা ট্রিনিটিতে। তার পর দেশে ফেরা। কিন্তু নিজের লিঙ্গ-পরিচয়ের জন্য অন্য কাজ জোটেনি। বার্নাড শ আর শেলির লেখা পড়তে ভালবাসেন মায়া।
বাব্বা, হেবি আঁতেল ছক্কা তো!
আরও শোন। এ বার ভোটে মাদুরাই থেকে নির্দল প্রার্থী হিসেবে ছিলেন ভারতী কান্নাম্মা। বয়স ৫৩। রূপান্তরকামী ‘মহিলা’। আমাদের দেশে এই প্রথম কোনও রূপান্তরকামী ভোটে দাঁড়াতে পারলেন। ভারতী বলেছেন, ‘লোকে আগে থেকেই কিছু ধারণা মাথায় নিয়ে আমার বক্তৃতা শুনতে আসে। তবে আমার কথা শুনে কারও কারও মত বদলায়।’ ভারতী গত দশ বছর ধরে সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন, লড়ছেন রূপান্তরকামীদের জন্যও। এ বার বারাণসীতে মোদীর বিরুদ্ধে লড়ার সাহস দেখিয়েছেন আর এক বৃহন্নলা, বসির কিন্নর। তিনিও নির্দল।
সে দু’এক জন থাকে ও রকম ছুটকোছাটকা। কিন্তু টাকা রোজগারের রাস্তা ওইটাই। আজকাল তো সিগনালে গাড়ি দাঁড়ালেই হল। কাচের জানলায় ঠকঠক।
শোন, সোশাল মিডিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে একটা ভিডিয়ো। ‘সিটবেল্ট ক্রু’। বৃহন্নলা সম্প্রদায়ের বেশ কয়েক জন এয়ারহোস্টেসের মতো সেজে একটা ট্র্যাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে। সব গাড়ির চালকদের ওঁরা সিটবেল্ট পরার কথা বলছেন। ‘সিটবেল্ট পহেনো, দুয়া লো।’ এ রকম প্রচার তো ভাল।
ফালতু গিমিক! অন্য কাজ করুক। খেটে খাক।
কোন কাজটা করবে বল? সমাজের কোন কাজটায় ওরা লাগলে আমরা খুশি হব? আমরা তো ওদের দেখলেই নাক সিঁটকোই। ভয় পাই। কাছাকাছি এলে অস্বস্তি হয়।
সে তো স্বাভাবিক! উগ্র চলন-বলন, কেঠো পিঠ- দেখানো লটকান্-লাগানো ব্লাউজ! নিতে পারি না জাস্ট। তার মধ্যে আবার সুপ্রিম কোর্টের নতুন রায় হল। ন্যাকামি! তৃতীয় লিঙ্গে রেখেছিস ভাল কথা। তা বলে ওদের জন্য চাকরি আর স্কুল কলেজে রিজার্ভেশন? এই এক ফ্যাশন। দুমদাম সংরক্ষণ। এ বার কি ওরা আমাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে স্কুলে পড়বে? আমাদেরই পাশে বসে চাকরি করবে? অসহ্য!
এই দ্যাখ। ফোস্কা পড়ল তো? এই বললি ওরা কাজ করে না কেন? এই বলছিস ওরা কেন আমাদের সঙ্গে কাজ করবে! ওদের তো একটা ‘অমানুষ’ খোপে পুরে দিয়েছি আমরা। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চাকরি কোত্থাও ওদের জন্য কোনও ভাবনা নেই।
সন্তোষ। নামটা পালটাতে হয়েছিল। আসল নাম বলা বারণ। ক্লাস টেন পর্যন্ত একটা গল্প সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিল। কলকাতা শহরের নামী স্কুলের পড়াশোনায় ভাল ‘ছাত্র’টি সব সময় ভয়ে থাকত, এই বুঝি সবাই বুঝে ফেলল। এই বুঝি বার করে দিল স্কুল থেকে! ভয়টা এক দিন সত্যি হয়ে গেল। নিজের পরিচয় চেপে রাখার অভ্যাস ভুলে ক্লাস টেনে পড়ার সময়ে হঠাত্ এক দিন সল্টলেকে রূপান্তরকামীদের একটি অনুষ্ঠানে চলে গেল। সেখানে দেশ-বিদেশ থেকে নানা মানুষ এসেছিলেন। ছিল সংবাদমাধ্যমও। পর দিন হুলস্থূল। কাগজে সন্তোষের ছবি দেখে আশপাশের লোকজন জানান ওর বাবাকে। বলেন, তোমার এত ভাল ছেলে ‘এই সব’ করছে! বাবা সেই সন্ধ্যাতেই সটান বাড়ি থেকে বের করে দেন নিজের সন্তানকে। ধাক্কা এক দিন না এক দিন খেতেই হবে, জানত সন্তোষ। লড়াইটা বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে হওয়ার ছিল। নিজের বাবাই এমন করবেন, ভাবেনি।
তার পর?
‘কান্না চেপে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মাথায় এল এক জনের কথা। তিনি দিল্লিতে আমাদের মতোই মানুষদের নিয়ে কাজ করেন। ফোন করলাম তাঁকে। রাত্তির একটার সময় দিল্লি থেকে এসে তিনি উদ্ধার করেন আমাকে। তার পর নিজের মতো করে বাঁচার শুরু। কিন্তু যত সহজে বলছি, তেমন হুস করে কিছুই হয়নি। অনেক অপমান পেরিয়ে, অনেক পাথর-ডিম ছোড়া গায়ে মেখে আজ ‘আমি’ হয়েছি।
‘বাবা-মা অনেক দিন পরে সব মেনে নিয়েছে। বুঝেছে। আমার দিদিরা পাশে ছিল। দিদিরা অনেক বুঝিয়েছে। পড়াশুনোটা তাই আর আটকে থাকেনি। যে সংগঠনের হয়ে কাজ করি, তার প্রধান অফিসটাই আমার বাড়িতে। তবে সবার এত ভাল অভিজ্ঞতা হয় না। আমার এক বন্ধুকেই বাড়িতে ইলেকট্রিক শক দিত। ‘সিধে’ করার জন্য!
‘সংরক্ষণ নিয়ে কী বলব? সুপ্রিম কোর্ট অনেক বড় ব্যাপার। আসল কথা, নিজের ঘরে কী হয়, লোকের মানসিকতা কতটা পালটায়। সংরক্ষণ মানে সুবিধা নেওয়া? তো তা-ই। সুবিধাটা আমাদের দরকার। অনেক দিন ধরে অচ্ছুত করে রেখেছে সমাজ। মানুষের সম্মান দেয়নি। এ বার সুবিধা পেলে, ক্ষতি কী?
‘বাচ্চা হলে আমরা কেউ কেউ আশীর্বাদ করতে যাই। এটা তো শুভ বলেই মানে সবাই। টাকা চাওয়া বেড়েছে কারণ বাজারদরও বেড়েছে। আমরা খাব কী করে? অন্য কাজ করতে চাই তো আমরা। শপিং মলে, লোকের বাড়িতে। কী হয় তার পর? খবর রাখো?’
শপিং স্টোরে কাজ পেয়েছিলেন কাঞ্চন। ক’দিন পরেই মালিক বলল, লম্বা চুল রেখেছ কেন? কাটো। মেয়ে-মেয়ে হাবভাব কেন? ছেলেদের পোশাক পরে আসবে। আমাদের ‘ছেলে’ই দরকার! মেয়েলি ছেলে নয়। চাকরি গেল।
কৃষ্ণ এই শহরেই একটা বাড়িতে কাজ করতেন। খুব ভাল রান্না করতেন। অনেক দিন ধরে। বাড়ির লোকের আপত্তি ছিল না। কিন্তু ওই বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এসে বলতে লাগল, এ কী করেছ? সকালে উঠে এদের মুখ দেখছ? শিগ্গির ছাড়াও। তাঁরও চাকরি রইল না। তার পর থেকে ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে রোজগারের রাস্তা ধরেছেন। ‘রোদ্দুর-ঝড়-বৃষ্টি মাথায়। সঙ্গে গাড়ির বাবুবিবিদের খিস্তি। আমাদের দুঃখ ট্রাফিক পুলিশ একটু বোঝে। কিন্তু আমরা যে টাকা তুলি, তাতে ভাগ বসায় সেই পুলিশই!’ বললেন কৃষ্ণ।
রূপান্তরকামী রুচিরা কাজ করতেন বেসরকারি সংস্থায়। ‘অনেক মেয়েই কাজের জায়গায় যৌন হয়রানির শিকার হয়। আমাকেও বস কুপ্রস্তাব দিতেন। বিরক্ত করতেন।’ কিন্তু অন্য মেয়েরা যেটা শুনতে অভ্যস্ত নয়, সেটা শুনতে হয়েছিল রুচিরাকে। বস বলেছিলেন, ‘আরে তোমার আপত্তি কীসের? ভয়টাই বা কী? তুমি তো আর প্রেগন্যান্ট হবে না!’ বসের কাছে ওটা দুর্দান্ত রিলিফ! এর পরে রুচিরা বাধ্য হন কাজ ছেড়ে দিতে।
চামেলি মাঝবয়স ছুঁয়েছেন। পিছুটান নেই। কুড়িয়ে পাওয়া একটি মেয়ের ভার নিয়েছেন। ‘ওর মুখ দেখেই বাঁচি এখন। কিন্তু ওকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে খুব ঝামেলা। তা-ও অনেক বন্ধু এগিয়ে এসেছিলেন বলে সেটা সম্ভব হল।’ মেয়ের স্কুলে মুখ দেখাতেও যেতে কুণ্ঠা চামেলির। লোকে জানতে পেরে যদি মেয়েটাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে দেয়? যতটা সম্ভব পরদার আড়ালে থেকেই তাই অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন। সঙ্গে রয়েছে আরও একটু ভয়। ‘মেয়ে এখনও ছোট। বোঝে না সব। এর পরে থাকবে তো পাশে? আমাকে বৃহন্নলা জেনে ঘেন্না করবে না তো?’
সমাজকর্মী পবন ঢাল অনেক দিন ধরেই রূপান্তরকামী মানুষদের সঙ্গে কাজ করেন। বললেন, ‘সংরক্ষণ কতটা ঠিকঠাক জানি না। কিন্তু স্কুলে তো খুব দরকার। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধির সময়ে। যখন থেকে সমস্যা শুরু।’ পবনের প্রশ্ন, সুপ্রিম কোর্টের রায় কবে প্রয়োগ হবে, তার জন্য বসে থাকব? আমরা নিজেরাই কেন উদ্যোগী হব না? যদি স্কুল থেকেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতোই? তোমার লিঙ্গ-পরিচয়ের জন্য কেউ তোমায় আলাদা ভাবে না? এই বোধ কাজ করলে এত সংরক্ষণেরই বা কী দরকার?
আরে তোর এ-সব বুলি কাগজে ছাপতে ভাল। সভা-সমিতি-মঞ্চে আওড়াতে ভাল। তার পর? তুই কোন বৃহন্নলার পাশে গিয়ে দাঁড়াবি? তোর মনের মধ্যে কুরকুর করবে না? তোকে সবাই ছেড়ে দেবে ভাবছিস? যেই তুই ওদের হয়ে কিছু বলবি, সবাই ভাববে তোরও কিছু গোলমাল আছে।
বাবার কাছে গপ্পো শুনেছিলাম সুন্দরীমাসির। মাসি ছিল লিডার গোত্রের। বাকি বৃহন্নলারা তাঁর নির্দেশে চলত। আর বাবারা তখন ছেলেছোকরা, রকে বসে আড্ডা দেন। সুন্দরীমাসি ওই ছেলেগুলোর সঙ্গে সুখদুঃখের গল্প করতেন। আর মাঝেমধ্যেই এগ রোল, চপ শিঙাড়া মুড়ি খাওয়াতেন। সহজ আলাপ। কেউ কারও দিকে আঙুল তুলত না।
তুইও তা হলে শুরু কর। হিজড়েমি উইথ চপ-শিঙাড়া!
অথবা শুরু করি কথা। কথা। কথায় কী না হয়...
anwesha.datta@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy