অতীত: ১৭৫৬ সালে গঙ্গার খাঁড়ি বা ‘ক্রিক’। কাছেই জোব চার্নকের সমাধি। নীচে, ১৯০০ সালের বৌবাজার। ছবি নির্মলচন্দ্র কুমারের সংগ্রহ থেকে
মরমিয়া কবি বলেছিলেন, ‘ঘরবাড়ি ভালা নয় আমার’। বৌবাজারের অভিশপ্ত গলির ঘরহারা বাসিন্দারা তা এখন টের পাচ্ছেন। ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর সুড়ঙ্গ বিপর্যয় তবু সময় দিয়েছিল মৃত্যুগুহা থেকে বেরোনোর। কলকাতার মাটির তলার দৈত্যের নড়াচড়া ইডেন গার্ডেন্সের ভরা স্টেডিয়াম বা পার্ক স্ট্রিটের নিশ্চিন্ত নৈশভোজের ছন্দও নিমেষে টালমাটাল করতে পারে।
প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছিলেন, ‘আমার শহর নয়কো তেমন বুড়ো/ অতীতকালের অস্থি, মুদ্রা, চৈত্য, বিহার কিছু/ পাবে না তার কোথাও মাটি খুঁড়ে’। ইতিহাসবিদ থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই সে দিন পর্যন্ত কলকাতার অতীতের সীমানা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে বাঁধতে চেয়েছেন। ইংরেজ আমল, বড়জোর তার আগের জমিদারি-পর্ব— এর মধ্যেই যেন আটকে শহরটার অস্তিত্ব। বৌবাজারের মাটি ধসে যাওয়ার সূত্রে এ বার কলকাতার মাটির নীচের আদিম ইতিহাস-ভূগোলও গা-ঝাড়া দিচ্ছে।
গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চলের ভূখণ্ড যে কত বার ডুব দিয়েছে আর ভেসে উঠেছে তার ইয়ত্তা নেই। পৌনে তিন শতক আগেও জলজ্যান্ত গঙ্গার একটি খাঁড়ির গল্প ফের জেগে উঠছে। চাঁদপাল ঘাট থেকে হেস্টিংস স্ট্রিট (আজকের কিরণশঙ্কর রায় রোড), ওয়াটারলু স্ট্রিট, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, প্রিন্সেপ স্ট্রিট হয়ে ধর্মতলার উত্তর ছুঁয়ে ক্রিক রো বেয়ে সল্টলেক অভিমুখী ছিল সেই খাল। যা পরে বিদ্যাধরীতে মিশে যায়। বিদ্যাধরীও এখন মজে গিয়েছে। একমাত্র বেলেঘাটা খাল সেই স্রোতের অংশ। ইতিহাসবিদেরা অনেকেই একমত নন, তবে কলকাতার রাজপথের খুঁটিনাটির ইতিহাসকার পরমেশ্বরন থনকপ্পন নায়ারের মত, এই ‘খাল কাটা’ থেকেই কলকাতা নামকরণ। ১৭৩৭ সালের এক ভয়াল ভূমিকম্প ও ঘূর্ণিঝড় সেই খালের বড় অংশ প্রায় বুজিয়ে ছাড়ে। সন্দেহ, মেট্রোর সুড়ঙ্গ কলকাতার পাতালঘরে সেই সুপ্ত নদীখাতকেই জাগিয়ে তুলেছে। ভূমিকম্পবিদেরা বলেন, শুধু এক জায়গায় নয়, কলকাতার বুকের তলার আদিম জলের ভাঁড়ার কোনও জোরালো অভিঘাতে জ্যান্ত হয়ে অন্যত্রও পায়ের তলার মাটি সরাতে পারে।
২০১১- ২০১৬ কলকাতার পেটের ভিতরে ‘গ্রাউন্ড পেনিট্রেটিং রেডার’ সমীক্ষা চালিয়েছিলেন আইআইটি খড়্গপুরের ভূতত্ত্ববিদ এবং ভূপদার্থবিদেরা
অনেকে মনে করেন, ১৭৩৮-এর জুনে বিলেতের ‘লন্ডন’ ম্যাগাজ়িনে ঝড়, ভূমিকম্প, বন্যায় ধ্বস্ত কলকাতার সঙ্গে জেরুসালেমে জিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ভূমি গলগথার তুলনা করা হয়েছিল। তার আগের বছর ১১ অক্টোবরের বিপর্যয়ের যা ফিরিস্তি উঠে আসে, তার পাশে কলকাতার ইতিহাসের যে কোনও দুর্যোগস্মৃতি প্রায় শিশু। সে কালের কলকাতার জনসংখ্যার নিরিখে লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু নিয়ে তর্ক আছে। তবে আজকের মহাকরণের রোটান্ডার জায়গায় শহরে ব্রিটিশদের আদি গির্জা সন্ত অ্যানের চার্চ চুরমার হয়ে যায়। তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ গোবিন্দরাম মিত্রের আমল। কুমোরটুলিতে সেই গোবিন্দরামের মন্দির বা ব্ল্যাক প্যাগোডার মূল পঞ্চরত্ন চুড়ো ওই ঝড়েই ভেঙে পড়ে। তার ভগ্নাংশটুকু আজও টিকে আছে। অক্টারলোনি মনুমেন্টের থেকেও নাকি উঁচু ছিল তা!
জলোচ্ছ্বাসে ব্রিটিশ-ওলন্দাজ-ফরাসিদের ভাসমান জাহাজগুলির দফারফা হলেও জোব চার্নকের সমাধিসৌধ ও আজকের রাইটার্স বিল্ডিংস-এর মধ্যবর্তী পরিসরের খালটি পলিতে ঢাকা পড়ে যায়। তখনকার গঙ্গা ছিল প্রায় আজকের নব মহাকরণ অবধি বিস্তৃত। তাও প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার পেরিয়ে তার খাঁড়িটি ধরে একটি বড় বার্জ ক্রিক রো এলাকার খালে আটকে পড়ে। ঠিক কী ভাবে কোন স্রোত ধরে গঙ্গা থেকে এত ভিতরে বার্জটা এসে পড়ল তা নিয়ে কলকাতা-বিশারদেরা কেউ কেউ সন্দিগ্ধ। কিন্তু আঠেরো শতকে মার্ক উড ও বেলি বা অ্যারন আপজন-এর করা কলকাতার মানচিত্রে ওই তল্লাট স্পষ্টত ‘ডিঙাভাঙা’ বলেই আখ্যা পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মত, ভূমিকম্পের দাপটে এই ওলটপালট অসম্ভব নয়। ২০১১- ২০১৬, পাঁচ বছর ধরে কলকাতার পেটের ভিতরে ‘গ্রাউন্ড পেনিট্রেটিং রেডার’ সমীক্ষা চালিয়েছিলেন আইআইটি খড়্গপুরের ভূতত্ত্ববিদ এবং ভূপদার্থবিদেরা। তাতেই শহরের ভূমিকম্প-প্রবণতার মানচিত্র উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞ দলের নেতা, ভাটনগর পুরস্কারজয়ী বিজ্ঞানী শঙ্করকুমার নাথের চোখে, ‘‘কলকাতার জমির নীচে ৪-৫ কিলোমিটার পুরু পলিস্তর। তার পরে অজস্র ‘প্যালিয়ো চ্যানেল’ বা সাবেক জলখাত। তার সঙ্গে শহরের সাড়ে তিন কিলোমিটার নীচেই দুই বাংলাকে জুড়ে ভূমিকম্পপ্রবণ কলকাতা-ময়মনসিংহ হিঞ্জ জ়োন।’’ চিড় ধরলে যা সব টলিয়ে দেবে। রিখটার স্কেলে ৬.১ থেকে ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্প এ শহরে ঘটার সম্ভাবনা।
ভূমিকম্পে জলের পকেটগুলি ফাটলেও গাঙ্গেয় বালি-কাঁকরে ভরা পলিমাটি নরম কাদার তাল হয়ে উঠতে পারে নিমেষে। মাটি তখন চোরামাটির স্তর। যেমনটা বৌবাজারের সেকরাপাড়া বা দুর্গা পিতুরী লেনের বাড়িগুলোর নীচে ঘটেছে। কলকাতার বুকের ভিতরে জলখাতের উপস্থিতির নিরিখে ডিঙাভাঙার পুরনো খালের মুখে ইডেন গার্ডেন্সের নীচেও এমন বিপজ্জনক ভূস্তর। বৌবাজারের মতোই বিপজ্জনক পরিস্থিতি পার্ক স্ট্রিট, পার্কসার্কাস, নিকো পার্ক, সল্টলেক, রাজারহাট, নিউটাউন, বেলগাছিয়াসুদ্ধ বহু তল্লাটেই। শ্যামবাজার, যাদবপুর, বেহালা, কালীঘাট-সহ কলকাতার বহু এলাকাই নিরাপদ নয়।
প্রখ্যাত অতীত-সংগ্রাহক নির্মলচন্দ্র কুমারের পুত্র, কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশনস বিভাগের শিক্ষক অলোক কুমারের সংগ্রহে কলকাতার ভূগর্ভ নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে জমা পড়া ১৯০৫-এর রিপোর্টও কলকাতার হৃদয়-খোঁড়াখুঁড়ি নিয়ে সাবধান করছে। উনিশ শতকে লন্ডনে মাটির তলায় রেললাইন পাতার পরে ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞেরা কলকাতার অবস্থাও খতিয়ে দেখেন। শহরের নীচে বিপজ্জনক নরম পলি ও অন্তঃসলিলা খালের আঁকিবুকি নিয়ে তখনই শঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
বৌবাজারের পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাওয়া সেকরাপাড়া লেন বা দুর্গা পিতুরী লেনকে বাঁয়ে রেখে হিদারাম ব্যানার্জি লেন ধরে মিনিট দশের হাঁটাপথ ক্রিক রো। নামেই মালুম, বিস্মৃত খালের স্মারক। আশি বছর আগে কলকাতা পুরসভা নাম পাল্টে রাজা সুবোধ মল্লিকের নাম বসাতে গেলে এলাকাবাসী রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। পুর কর্তৃপক্ষকে লেখা প্রতিবাদপত্রে ইতিহাসের নানা নথি পেশ করে তাঁরা বলেন, শহরের একটি প্রাচীন নৌপথের ইতিহাস মুছে দেওয়া যাবে না। লোকবিশ্বাস, লখিন্দরের শব নিয়ে বেহুলাও ওই খাল ধরে ভেসেছিলেন। আবার কলকাতার চালু মেট্রোরেলের লাইনের নীচে গড়িয়া-বৈষ্ণবঘাটা লাগোয়া আদিগঙ্গার খালকেও বেহুলার ভেসে চলার গাঙুর বলে মনে করেন অনেকেই। আজ পোশাকি নাম অন্য হলেও, লোকমুখে রয়ে গেছে ‘ক্রিক রো’ নামটাই। সেই পাড়াতেই এক মানুষ চওড়া গলি জেলিয়াপাড়ায় কথা হচ্ছিল অতনু ওঝা, সৌভিক গুণিনদের সঙ্গে। কারও শিয়ালদায় মাছের আড়ত, কেউ নিউমার্কেটের কারবারি। অতনু ক্যালকাটা ভেটকি-র ডাকসাইটে জোগানদার বি সি ওঝার পরিবারের এক জন। ট্যাংরার ‘গোল্ডেন জয়’, ‘বিগ বস’-এর ভেটকি-গরিমার পিছনেও তাঁদের হাতযশ।
অলোকবাবুর কাছে শুনেছি, নির্মলচন্দ্রের সংগ্রহের পুরনো বটতলার বইয়ে আবার এ তল্লাটের বৌরানির খাল ঘিরে নানা গালগল্প। ১৮৪০-এ প্রকাশিত ‘নটী এল নৌকা’য় গল্প জুড়েও বৌরানির খাল। কারও কারও অনুমান, এটাই ক্রিক রো বা ডিঙাভাঙা খাল। ১৭৩৭-এর বিপর্যয়ের পরেও টিকে ছিল তা। বোজানোর সিদ্ধান্ত হয় ভিক্টোরিয়ার আমলে। যখন শহরে সদ্য মাটির তলার নর্দমার লাইন তৈরি হচ্ছে, রেললাইন বসছে শিয়ালদহে। বৌবাজারের জনপদও তখন সুপরিচিত। পলাশির যুদ্ধের পরে কোম্পানির নতুন গড়ের ঠিকাদার, নুনের কারবারের দাপুটে দেওয়ান দুর্গা পিতুরীর ভাগ্নে বিশ্বনাথ মতিলালের এক বিধবা বৌমার নামেই বৌবাজারের নামমহিমা। পুরনো কলকাতাপ্রেমী মহলেও সন্দেহ, ডিঙাভাঙার ঘাট বা খালের সঙ্গে পরে সেই বৌরানিটির পরিচিতিও মিশেছে।
নিউটাউনে ফ্ল্যাট কিনেছেন ভূতত্ত্ববিদ শঙ্করবাবু। পেটের ভিতরে জলের ভাঁড়ার নিয়ে ভূমিকম্পের বিপদে যে পাড়ার নাম সামনের সারিতে। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, মাটির তলায় বিপদ বেশি থাকলে বাড়ির ভিত গড়ায় বাড়তি জোর দিতে হবে। পাইলিংয়ের সময়েই মাটির গলে যাওয়ার সম্ভাবনা রুখতে হবে। ‘‘মাটির নীচের সুড়ঙ্গই হোক বা মাটির উপরের বহুতল, জলস্তর কতটা নীচে— খেয়াল রাখতে হয়। সাবধানের মার নেই, তাই মাটি থেকেই জলস্তর শুরু ধরে নিয়ে কাজটা করা উচিত। এটাই দাওয়াই,’’ বলছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক গুপিনাথ ভাণ্ডারী।
বৌবাজারে হিদারাম ব্যানার্জির গলি দিয়ে দুর্গা পিতুরী লেনের ভিতর দিকে দাঁড়ালে এখনও অদূরে গ্রাউটিংয়ের কাজের শব্দ। হলুদরঙা বাড়িটার ফলকে কষ্ট করে পড়া যায় ‘বাবু বিস্সোনাথ মতিলাল’-এর নাম। পরিবারের অষ্টম প্রজন্ম, এমএসসি পড়ুয়া অর্ক মতিলাল দেখান, পাশের বাড়িটাই দুর্গা পিতুরীর ঠাকুরদালান। ‘‘মাটির তলার খালটা বোধহয় পাশের সেকরাপাড়া বা গৌর দে লেনের নীচেই পড়েছিল, তাতেই অঘটন,’’ অর্কের অনুমান। তবে দুর্গা পিতুরী লেনে দে, শীল, জয়সোয়ালদের বাড়ি পর পর ধসে পড়লেও মতিলালদের বাড়িতে আঁচড় পড়েনি।
ধ্বংসস্তূপের গা ঘেঁষেই দুর্গা পিতুরীর দালানে এখন দুর্গাপুজোর তোড়জোড় মতিলালদের। তবু খুশিতে কোথাও তাল কাটছে। এমন হবে কে-ই বা ভেবেছিল! লোককথা থেকে শুরু করে এত পুরনো মানচিত্রের ছড়াছড়ি, তবু বৌবাজারের সুড়ঙ্গ খোঁড়ার সময়ে খালটাকে কেউ খেয়ালই করল না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy