Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Blue Tick Anxiety

কালো টিক থেকে নীল টিক ও উত্তর পাওয়ার দ্বিধাদ্বন্দ্ব

হোয়াটসঅ্যাপে নীল টিক চালু হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর। এর দশ বছর পূর্ণ হল ঠিক পাঁচ দিন আগে। এই নীল রঙের টিকচিহ্ন মানুষকে স্বস্তি দিয়েছে যত, পাল্লা দিয়ে বাড়িয়েছে যাতনাও। জন্ম নিয়েছে উদ্বেগ-যাপনের নয়া অধ্যায়—ব্লু টিক অ্যাংজ়াইটি।

নীল টিক না দেখা অবধি অস্বস্তি।

নীল টিক না দেখা অবধি অস্বস্তি। প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:৫৪
Share: Save:

আকাশের দিকে ঠায় তাকিয়ে রয়েছেন এক ব্যক্তি। সুট-বুট পরা। বুকপকেটে মোবাইল। মুষ্টিবদ্ধ হাত। ঊর্ধ্বপানে চেয়ে বিড়বিড় করছেন কিছু। মুখ নামাচ্ছেন। ফের তাকাচ্ছেন উপরের দিকে। শরীরী ভাষা দেখে বোঝা যায়, ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে ক্রমশ। এ বারে গলা শোনা গেল। বললেন, “ভগবান শুনতে পাচ্ছ?” উত্তর এল না। গলাটা চড়ালেন ফের। “ভগবান, ও ভগবান, শুনতে পাচ্ছ? বুঝব কী করে আমি?” মহাকাশ নিরুত্তর। এ বারে লোকটির চিলচিৎকারে মাতল রে ভুবন। “তুমি কি শুনতে পাচ্ছ আমার প্রার্থনা? কী করে বুঝব? জবাব চাই, জবাব দাও। বলতেই হবে।” গলাটা সারসের মতো উঁচু করে ফের বললেন, “ভাল্লাগছে না আর। কী করে বুঝব আমি!”

এর পরে এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল। বজ্রবিদ্যুৎ খেলে গেল। ধূসর মেঘ চিরে বেরিয়ে এল নীল রঙের ডবল টিক। জোড়া রাইট চিহ্ন। লোকটির মুখে খেলে গেল দৈব হাসি। ভগবান তাঁর মনের বার্তা পড়ে ফেলেছেন। নীল রং না দেখা পর্যন্ত স্বস্তিতে থাকা যায় নাকি?

নীলরঙা জোড়া রাইট চিহ্ন নিয়ে নানা কৌতুক-ছবি কিংবা উদ্ধৃতি ঘুরে বেড়াচ্ছে আন্তর্জালে। এ টিক যেমন-তেমন টিক নয়! কালো টিকের নীলবর্ণ ধারণ করায় মজেছে এ দুনিয়া। না হলে এক জন কেন লিখবেন, “কালো টিক নীল হওয়ার মধ্যে যে সময়টুকু লুকিয়ে থাকে, তার গর্ভে কত সম্পর্ক জুড়তে জুড়তে জোড়া লাগল না, গড়তে গড়তে গড়ে উঠল না—তার উত্তর কি এই বাইনারি নিঠুর দুনিয়া রাখে? ওহে ও হোয়াটসঅ্যাপের কালো টিক, হও নীল, হও নীল, বুঝব সব ঠিক। আর যদি থাকো কালো, দূরে থাকাই ভাল।”

আজ থেকে বছর পনেরো আগে, ২০০৯ সালে জন্ম নিয়েছিল হোয়াটসঅ্যাপ। ২০১০-এ তা চলে আসে ভারতে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, হোয়াটসঅ্যাপ-ব্যবহারকারীর সংখ্যা ইতিমধ্যেই পেরিয়েছে ২০০ কোটি। বিশ্ববাসীর সংখ্যা যদি ৭৯৫ কোটি ধরা যায়, বলা যেতে পারে, প্রতি চার জন মানুষের মধ্যে এক জন জড়িয়ে গিয়েছেন হোয়াটসঅ্যাপে। এই প্ল্যাটফর্মে আমরা গড়ে প্রতিদিন বুঁদ হয়ে থাকছি ৩৮ মিনিট। শ্রীকেশবচন্দ্র নাগ জীবিত থাকলে পাটিগণিতের বইয়ের নয়া সংস্করণে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হয়তো প্রশ্ন রাখতেন, “সমীক্ষা বলছে, দৈনিক ১৪০০০ কোটি বার্তা বিনিময় করা হয় হোয়াটসঅ্যাপে। তা হলে প্রতি সেকেন্ডে ক’টি মেসেজ চালাচালি হচ্ছে নির্ণয় করো।” উত্তরটা জানতে পারলে বুকের মধ্যে উথালপাথাল হয়, চোখে ঝিলমিল লেগে যায়। সংখ্যাটি হল ১৬ লক্ষ, প্রতি সেকেন্ডে। এক কবি-বন্ধু বলেছিল, “কেন্নোর পায়ের মতো সারা শরীরে আমরা লেপে দিয়েছি অজস্র আঙুল। আর এর সবগুলো দিয়েই আমরা বৈঠা চালাই হোয়াটসঅ্যাপের স্ক্রিনে। ১ সেকেন্ডে ১৬ লক্ষের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে আমাদের সার্বিক এলেম ও ঠান্ডা দেওয়ালে প্রেম!”

কিম জং-উনের কোনও পরমাত্মীয়ের মতো দেখতে এক ব্যক্তির ছবি ফুটে উঠল সার্চ ইঞ্জিনের ওয়ালে। দু’চোখে যেন দাবানল। দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। বলছেন, “হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠানোর পরে উত্তর পাওয়ার জন্য যদি দু’দিন অপেক্ষা করতে হয়, তা হলে আমি এই মাধ্যম ব্যবহারই করতাম না। পায়রা পাঠাতাম।” মেসেজটি পাঠানোর পরে কালো টিক হয়তো নীল হয়ে গিয়েছিল তৎক্ষণাৎ। কিন্তু উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল ৪৮ ঘণ্টা। কিংবা মেসেজটি হয়তো কালো থেকে নীল হল এইমাত্র। রং পাল্টাতে এত সময় লাগল কেন? ছবি থেকে এর উত্তর মেলে না মোটে।

উল্লেখ করা বৃথা। তাও বলে রাখা যাক। হোয়াটসঅ্যাপে কোনও বার্তা পাঠানোর পরে মেসেজের নীচে কালো রঙের একটি টিক দেখা যাওয়ার অর্থ হল, বার্তাটি পাঠানো হয়ে গিয়েছে। বলা যেতে পারে, কোনও চিঠি ডাকবাক্সে ফেলার পরে সেটি ক্লিয়ার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পোস্ট অফিসে। দু’টি কালো টিকের অর্থ হল, বার্তাটি প্রাপকের ফোনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানে, চিঠিটি যিনি পাবেন, তাঁর বাড়ির ডোরবেল বাজিয়ে পিওনমশাই চিঠিটি প্রাপকের হাতে তুলে দিলেন। এর পরেই অপেক্ষা মাহেন্দ্রক্ষণের— কালো টিকের নীল হওয়ার পালা। নীল হওয়ার অর্থ হল, বার্তার প্রাপক মেসেজটি পড়ে ফেলেছেন। অর্থাৎ, চিঠি পাওয়ার পরে খামটি খোলা হল, অবশেষে! ওঁ স্বস্তি! হোয়াটসঅ্যাপের ইতিহাস বলে, নীল টিকের প্রবর্তন করা হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর। দশ বছর পূর্ণ হয়েছে ঠিক পাঁচ দিন আগে। আর মনোবিদরা বলছেন, “এই নীল রঙের টিকচিহ্ন মানুষের মনে স্বস্তি দিয়েছে যত, পাল্লা দিয়ে বাড়িয়েছে যাতনাও। হোয়াটসঅ্যাপকে ঘিরে জন্ম নিয়েছে উদ্বেগ-যাপনের নয়া অধ্যায়— ব্লু টিক অ্যাংজ়াইটি।”

হোয়াটসঅ্যাপের প্রতিটি মেসেজের মধ্যেই যেন লুকিয়ে থাকে ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’। শুধু বার্তা পাঠিয়েই আমাদের মনের সাধ মেটে না আজকাল। ‘সেন্ড’-এ আঙুল ছোঁয়ানোর পরে তড়িৎগতিতে বার্তা পৌঁছে যায় এক ফোন থেকে অন্য ফোনে। নীল টিক যেন কোনও স্বয়ংক্রিয় প্রাপ্তিস্বীকার। বাড়তে থাকে কৌতূহলের পারদ। পিউপা কৌতূহল খোলস ছাড়ায়। ডানা মেলে উদ্বেগ। আমাদের মনের অন্দরমহল নিয়ে গবেষণা করা এক পরিচিত অধ্যাপক সম্প্রতি জানিয়েছিলেন, কালো টিক নীল হতে যদি সময় বেশি লাগে, তা হলে আমাদের মনের মধ্যে যে প্রশ্নগুলো বুড়বুড়ি কাটা শুরু করে, তা অনেকটা এ রকম—

পর্ব এক : এখনও অবধি কালো ডবল টিক—

অনলাইন তো দেখাচ্ছে, তা হলে আমার মেসেজ দেখল না কেন?

নামের নীচেই সবুজ অক্ষরে দেখাচ্ছে টাইপিং। কিন্তু আমি উত্তর পাচ্ছি না কেন?

‘লাস্ট সিন’-এর সময় তো আমার মেসেজ পাওয়ার অনেক পরে। তা হলে আমারটা নীল হল না কেন?

ও কি আমায় ইগনোর করছে? ইচ্ছে করে আমার মেসেজ দেখছে না?

আমি কি ওর থেকে কম নাকি?

ও নিজেকে বিরাট কিছু ভাবে নাকি? ইত্যাদি...

পর্ব দুই : কালো টিক নীল হয়েছে, তবে উত্তর আসেনি—

পড়ার টাইম তো হল। উত্তর দেওয়ার ভদ্রতাবোধটুকুও নেই?

কিছু কি ভুল লিখে ফেললাম? দেখেও উত্তর দিল না!

ও আমায় এড়িয়ে যেতে চাইছে? মেসেজ দেখেও উত্তর দিচ্ছে না!

নিজেকে বেশি ব্যস্ত প্রমাণ করতে চাইছে নাকি?

আমি কি ওর থেকে কম নাকি?

ও নিজেকে বিরাট কিছু ভাবে নাকি? ইত্যাদি..

বাইনারি বার্তা প্রেরণ করার অ্যাপের নয়া নীতিমালা কলার তুলে বলে, আজকের দুনিয়ায় কোনও মানুষের গ্রহণযোগ্যতা, সামাজিক সম্মান ও গুরুত্বের মহানির্ণায়ক হল নীল টিক। আমরা যতটা বাঁচি প্রকাশ্যে, তার থেকে বেশি বাঁচার সাধ লালন করি সামাজিক মাধ্যমে। ‘আমাকে দেখুন’ টিশার্ট পরে অনলাইনে ঘুরে বেড়াই যত্রতত্র, অহোরাত্র। সেখানে কালো টিক নীল না হওয়ার অর্থ একটাই— আমাকে দেখেও দেখল না। এমন অভিজ্ঞতা ক্রমাগত হতে থাকলে তার তেতো স্বাদ গলার কাছে জমতে থাকে পাথরের মতো। হীনম্মন্যতা খেতে শুরু করে দেয় আমাদের অস্তিত্ব। অবসাদের আঁকশিগুলো চেপে ধরতে থাকে আমাদের সারা শরীর। আনুষঙ্গিক রোগগুলো বাড়িয়ে দেয় দু’হাত। ব্লু টিক অ্যাংজ়াইটি এ ভাবেই আমাদের মন জবরদখল করে নেয়। হুমকি দিলেও নড়ে না আর। মনোবিদের চেম্বারে ভিড় বাড়ে।

বহু মানুষ উল্টো পথে হাঁটা শুরু করেছেন ইদানীং। ‘সব কিছু এক্ষুনি চাই’-এর বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন তাঁরা। আওয়াজ উঠছে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে, সমস্বরে। হোয়াটসঅ্যাপের জোড়া নীল টিকের অপশন ডিজ়এবল করে দিয়ে তাঁরা বলছেন, “বাঁচলাম।” বলছেন, “নীল রং ছিল ভীষণ প্রিয়? কভি নেহি।” এই অপশন বন্ধ করে দিলে অ্যাপের পর্দা থেকে উধাও হয়ে যাবে ব্লু টিক। এর আপাত-উপকারিতা দু’টি। এক, কাউকে পাঠানো মেসেজ প্রাপক পড়েছেন কি না, তা জানার কোনও উপায় থাকবে না। দুই, যাঁরা আমায় কিছু বার্তা পাঠালেন, আমি পড়েছি কি না, তাও তাঁরা জানতে পারবেন না। পুরনো, ফেলে আসা, কালো রঙের জোড়া টিকেই থেমে থাকবে গাড়ি। বিভিন্ন মানুষের ব্লগ জানান দেয়, উপকারিতার আগে ‘আপাত’ শব্দটির গায়ে শান্তির বৃষ্টি নামে। নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণায় জায়গা পায় নীল টিক-জনিত উদ্বেগ।

বেসরকারি সংস্থায় কাজ করা আমার এক বন্ধু চাকরি হারিয়েছিল শুধুমাত্র ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হোয়াটসঅ্যাপ বার্তার উত্তর দিতে পারেনি বলে। মেসেজটি এসেছিল প্রায় মধ্যরাতে, একটি রিপোর্টের আবদার নিয়ে। বন্ধু বার্তাটি দেখেছিল ঘুমচোখে। ঘুমিয়ে পড়েছিল ফের। পরের দিন ওকে শুনতে হয়েছিল, “দেখলে যখন, পাঠালে না কেন? আর পাঠাবে না ঠিক করে রাখলে দেখতে গেলে কেন? আর ইউ প্লেয়িং উইথ দ্য ব্লু টিকস?”

‘নীলকর’ বন্ধ করার পরে এক জন তাঁর ব্লগে লিখেছেন, ‘উত্তর দেওয়ার যে ঠুনকো সামাজিক ব্যাকরণ তৈরি করেছিলাম আমরা, তা ভাঙার আনন্দই আলাদা। অক্ষৌহিণী সেনার মতো অক্ষরগুলো ঘুরছে আমার চারপাশে। কিন্তু একটি তিরও গায়ে লাগছে না। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।’

অন্য বিষয়গুলি:

Whats APP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy