নিরঞ্জন: গঙ্গা আমাদের দেশের সবচেয়ে দূষিত নদী। প্রতি বছর বিসর্জনের পর এই দূষণ বেড়ে যায় আরও কয়েক গুণ।
সে দিন নীল আকাশের গায়ে ছিল কোদালিয়া মেঘ। বিকেলের পড়ন্ত সূর্য একটু পরেই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তলিয়ে যাবে। তার যাওয়ার তাড়া আছে। অন্য দেশে মুখ দেখাতে দেরি হয়ে যাবে না হলে। এ দেশে তখন নামবে আঁধার। আজ মানুষের মনেও যে একটু অন্ধকারের ছোঁয়া। কারণ আজ দশমী। বাঙালির দুর্গাপুজো কিংবা অবাঙালি নবরাত্রির শেষ দিন। কয়েক দিনের আলো উৎসব রোশনাই নিভিয়ে দিয়ে এ বার স্বামীর কাছে ফিরবেন দুর্গা। বিসর্জন হবে জোহিলা নদীতে।
জায়গাটা মধ্যপ্রদেশের সাতপুরা পর্বতমালা। জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। পেন্ড্রা রোড স্টেশন থেকে পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় পৌড়কি গ্রামে। এখানেই গোন্ড জনজাতির মানুষরা বসবাস করেন। এঁরা এখানকার বহু যুগের প্রাচীন বাসিন্দা। পৌড়কির পাশ দিয়েই বয়ে গেছে জোহিলা নদী। বেশ কয়েক বছর হল এখানে চেক ড্যাম হয়েছে। জোহিলার ওপর থাকা ছোট চেক ড্যামের জল অনেকটা পাহাড়ি জায়গা ডুবিয়ে দিয়েছে। নদীর এই জলেই আজ বছরের বেশ কিছুটা সময় ধরে এলাকায় চাষ হয়। খাদ্যসমস্যা অনেকটাই মিটেছে নদীর কল্যাণে। ফলে এই নদী এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীবনদায়িনী।
নদীটা থেকেই অল্প খানিকটা হাঁটা পথের দূরত্বে ছোট দু’একটা দোকান, ছোট বাজার বসে। সেখানেই গোন্ড জনজাতির মানুষেরা এক সঙ্গে মিলে আয়োজন করেন তাঁদের দুর্গাপুজো। রীতি-পদ্ধতি আর দেবীপ্রতিমা খানিকটা আলাদা। পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতার বাঙালি বারোয়ারির মতো নয়। দশভুজা সিংহবাহিনী, কিন্তু দেবীর দু’পাশে লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ কেউ থাকেন না। এখানে দুর্গার সঙ্গে পূজিত হন বজরঙ্গবলী এবং ভৈরব। দুর্গার দু’পাশে থাকে শুধু দুটো পতাকা। একটা লাল আর একটা কালো। লাল পতাকা বজরঙ্গবলী এবং কালোটি ভৈরবের প্রতীক।
দশমীর দিন পুজো শেষ হয়। দেবীমূর্তি একটা গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া হয় জোহিলা নদীর ধারে। এখন গাড়ি ব্যবহার হলেও আগে প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হত কাঁধে করে। গ্রামের প্রবীণদের মুখে এমনটাই শোনা যায়। সঙ্গে যান গ্রামের মানুষেরা।
নদীর ধারে এসে নামানো হয় প্রতিমা। তার পর তাঁকে আরতি করেন ব্রাহ্মণ পুরোহিত বা পণ্ডিতজি। এক দিকে আরতি চলে, আর অন্য দিকে চলে শুকনো নারকেল ছাড়ানোর পালা। জামাকাপড় ছেড়ে কিছু স্থানীয় অল্পবয়সি তরুণ গামছা পরে তৈরি হয় নদীর জলে নামার জন্য। এর পর দু’-তিন জন খোসা ছাড়ানো নারকেলগুলো অনেকটা দূরে দূরে ছুড়ে দেয় জলের ভেতর। জোহিলা নদীর বুকে। গামছা পরে তৈরি থাকা ছেলেরা তখন জলে ঝাঁপ দেয়। জল থেকে ওই নারকেলগুলো তুলে আনার জন্য। ঠিক ওই সময়ের মধ্যেই মা দুর্গার বিগ্রহ জলে বিসর্জন দেওয়া হয়। সঙ্গে পুজোর ফুল-সহ অন্যান্য সামগ্রীও।
জলে ভেসে থাকা নারকেল নিয়ে ফেরার সময় অল্পবয়সি সব তরুণ পুজোর প্রতিমা-সহ জলে ভেসে থাকা সমস্ত সামগ্রীকে এক সঙ্গে জড়ো করে। তার পর জল থেকে সে-সব তোলা হয়। নদীর পাশ থেকে অনেকটা দূরে নিয়ে সেই সব পুজোর জিনিসগুলোকে রাখা হয়। জল কিছুতেই তারা নোংরা হতে দেয় না।
একটু অবাক লাগছিল। এরা কি জলদূষণের কুফল সম্বন্ধে এতটাই সচেতন? না হলে উৎসবকে কেন্দ্র করে আনন্দ-উল্লাসে জলের প্রতি এমন ভালবাসা কী করে এল? উত্তর খুঁজতে যাওয়া হল গোন্ড জনজাতির এক প্রবীণ মানুষের কাছে। তিনি শোনালেন জল নিয়ে তাদের বিশ্বাসের গল্প। ভালবাসা কিংবা দূষণ সম্পর্কে সচেতনতার কথা নেই। আসলে জলকে তারা বড় ভয় পান। কেন? জানা গেল সেই আশ্চর্য লৌকিক আখ্যান।
বহু দিন আগের কথা। এক সময় এক পৃথিবী তৈরি করেছিলেন সৃষ্টিকর্তা। এক বিপর্যয়ে সমস্ত বিশ্বচরাচর জলমগ্ন হয়ে যায়। জলের ভিতরে হারিয়ে যায় পৃথিবী। ব্রহ্মা তার বুকের রোমকূপে জমা ময়লা থেকে সৃষ্টি করলেন এক কাক। তাকেই দায়িত্ব দেওয়া হয় জলময় চরাচর থেকে পৃথিবীকে খুঁজে আনতে। বহু দিন নিরলস ভাবে জলের ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে একটা কালো উঁচু জায়গা দেখতে পেল সেই কাক। সে বসল তার ওপর। মনে মনে কাক ভাবছিল, সে পৃথিবী খুঁজে পেয়ে গেছে। এমন সময় কাকের বসার জায়গাটি নড়েচড়ে উঠল। কাক দেখল, সে যার উপর বসেছে, সেটা পৃথিবী নয়। একটা কাঁকড়া।
এ বার আলাপ-আলোচনা শুরু হল কাক আর কাঁকড়ার মধ্যে। কাঁকড়া জানতে চাইল, কাক কেন ঘুরে বেড়াচ্ছে চরাচর জুড়ে? প্রশ্ন শুনে কাক উত্তর দেয়, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার দূত হয়ে সে খুঁজে বেড়াচ্ছে হারিয়ে যাওয়া পৃথিবী। এই কথা শুনে কাঁকড়া জানায়, সে জানে হারিয়ে যাওয়া পৃথিবী কোথায় আছে।
কাক তখন কাঁকড়াকে অনুরোধ করে হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর কাছে তাকে নিয়ে যেতে। কাঁকড়ার পিঠের ওপর চড়ে কাক পৌঁছে গেল জলের তলায়। সেখানে গিয়ে কাক দেখে, কেঁচো পুরো পৃথিবী খেয়ে মাটি করে ফেলেছে। আর কোনও অস্তিত্ব নেই পৃথিবীর। কাক তখন কেঁচোর অনুমতি নিয়ে পৃথিবীর একটু মাটি মুখে করে নিয়ে আসে ব্রহ্মার কাছে। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা তখন পুরনো পৃথিবীর মাটি দিয়ে আবার তৈরি করে দেন নতুন পৃথিবী।
গোন্ড জনজাতির মানুষদের মধ্যে এই লোকবিশ্বাস আজও বয়ে চলছে। অন্তঃসলিলার মতো। জল তারা ভুলেও নোংরা করে না। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, জল এক বার নোংরা করলেই জন্মাবে কেঁচোর বংশ। আর সেই কেঁচো সারা পৃথিবীর সৃষ্টি খেয়ে মাটি করে দেবে।
কথায় বলে, বিশ্বাসে মেলায় বস্তু। আর তর্ক জুড়লে তা চলে যায় বহু দূর। ভারত এক বিশ্বাসময় দেশ। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের মধ্যেও, বিবিধের মাঝে মিলন এই দেশের বৈশিষ্ট্য। বৈচিত্র দিয়েই সে গেঁথে তোলে ঐক্যসূত্র। ছোটবেলার ইতিহাস-ভূগোলের বই থেকে আমরা সবাই জেনে এসেছি, আমাদের এই দেশ নদীমাতৃক। মানুষ নদীর পুজো করে এসেছে বরাবর। ভারতের পুণ্যসলিলা গঙ্গা-যমুনা-গোদাবরী-নর্মদা-সরস্বতী-কাবেরী ও সিন্ধু, এই সপ্তনদীর জল পুজোর কোশায় স্মরণ-আবাহন করেই তো শুরু হয় হিন্দুদের যে কোনও পূজার্চনা বা শুভ অনুষ্ঠান।
তবু এই দেশে নদীর প্রতি অবহেলা অত্যাচার সীমাহীন! শাস্ত্রাচার অনুযায়ী দর্পণে প্রতিবিম্বিত দেবীর মুখচ্ছবিতে পবিত্র জলসিঞ্চন করেই দেবীর বিসর্জন হয়। পুরোহিত তিরকাঠিতে বাঁধা বন্ধনসূত্র ছিন্ন করে নাড়িয়ে দেন ঘট। মাকে বিদায় দেন, বলেন ‘সংবৎসরব্যতীতে তু পুনরাগমনায় চ’ মানে, আসছে বছর আবার এসো মা। তখনই মা মহামায়া ফের কৈলাসে। তাঁকে ঘরে তুলে নিচ্ছেন শূলপাণি। তার পর এখানে পড়ে থাকলেন আধারটুকু, অর্থাৎ মাটির সিংহবাহিনী।
আমাদের মনে থাকে না, এই মুহূর্তে আমাদের দেশে গঙ্গা সবচেয়ে দূষিত নদী। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, বিসর্জনের পর সেই নদীর দূষণ আরও অনেক গুণ বেড়ে যায়। নদী তখন প্রাণদায়িনী নয়, বিষজলের ধারা। গঙ্গার অতল গর্ভে কৈলাস পর্বত নেই, এটুকু আমরা সবাই জানি। কিন্তু মানি কোথায়?
খুব বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়নি, কমবেশি বছর আষ্টেক আগের কথা। দিল্লির যমুনার দূষণ কমাতে বিসর্জনের জন্য বড় বড় লোহার চাদরের অস্থায়ী চৌবাচ্চা তৈরি করা হয়েছিল। দমকল দফতর সেখানে জল ভর্তি করেছিল। তার পর তাতে হয়েছিল বিসর্জন। আবার মহারাষ্ট্রে গণপতি উৎসবের শেষে অনেকেই একটা ছোট্ট গামলা কিংবা একটা বড় মাপের জলের ট্যাঙ্কে জল ভর্তি করে তাতে গণপতির বিসর্জন দেন বাড়িতে পূজিত বিগ্রহ। বিসর্জনের পর গণপতির শরীরের গলে যাওয়া মাটি দেওয়া হয়েছে গাছের টবে। বিসর্জনের জল পড়েছে বাড়ির গাছের গোড়ায়। বারোয়ারি পুজোর বড় বড় গণপতি বিসর্জনের জন্য তৈরি হয়েছে অস্থায়ী জলের চৌবাচ্চা। উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে আরব সমুদ্রের দূষণ।
নদিয়ার নবদ্বীপে, শান্তিপুরে একটা সময় রাসযাত্রার বড় বড় ঠাকুর নির্দিষ্ট পুকুরগুলোয় বিসর্জন হত, গঙ্গার দূষণ কমানোর জন্য। কলকাতার বড় বড় পুজোও দিল্লিকে অনুসরণ করে বিকল্প বিসর্জনের কথা ভেবেছে এই বছরে, কেউ কেউ শুরুও করেছে। পাড়ার মধ্যেই কৃত্রিম জলাধার তৈরি করে প্রতিমা নিরঞ্জনের ঘটনাও নজরে আসছে। তবে সে সংখ্যা অতি নগণ্য। প্রশ্ন হল, সবাই সে পথ কেন নিচ্ছেন না! সরকারি নিষেধাজ্ঞাই কি সব? তার আগে শুভবুদ্ধি কাজে লাগানোই তো শ্রেয়! কারণ দূষণচিত্র তো কারও অজানা নয়। তাঁরা ভাবছেন না, নদী কারও একার নয়, নদী সভ্যতার, আগামী সমস্ত প্রজন্মের!
কলকাতার গর্ব গঙ্গা। ভারতের প্রাণপ্রবাহিনী সে। এই নদীর মৃত্যু, আমাদের নিজেদের হেমলক দিয়ে মেরে ফেলার মতো। আমাদের অবিমৃশ্যকারী কাজের জন্য দূষিত হবে গঙ্গা। আর এই দূষণের দায় আর ভার দুটোই আমাদের উত্তরসূরিদের নিতে হবে। সময় তো অনেক পেরোল। এই করব-এই করছি গড়িমসি আর চলবে না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে দেশের নদী বাঁচানোর লড়াইয়ে নামতে হবে অবিলম্বে। উৎসবের অন্তে বিসর্জন হোক প্রতিমার, বোধবুদ্ধির নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy