মনস্তাত্ত্বিক: সিনেমা ‘দি স্ট্যানফোর্ড প্রিজ়ন এক্সপেরিমেন্ট’ (২০১৫) ছবির দৃশ্য।
চমকে উঠেছিলাম। প্রয়াত কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষের লাইব্রেরি দেখে। কত বই! অনেক দিন আগে ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত ওঁর স্মৃতিকথা ‘কষ্টকল্পিত’ পড়েছিলাম। মানুষটি সম্পর্কে শ্রদ্ধা জেগেছিল। তার অনেক বছর পরে কী একটা কাজে গিয়েছিলাম বিধান শিশু উদ্যান। সাংবাদিকতার শুরুতে লিখতাম রাজনীতির খবর। সে সুবাদে নেতাদের সংস্পর্শে আসতে হয়েছিল অল্পবিস্তর। কারও বাড়িতে এমন লাইব্রেরি তো দেখিনি! এখনকার অধিকাংশ নেতানেত্রীর মুখের ভাষা শুনলে মনে হয় ক-অক্ষর গোমাংস। রাজনীতি এমনই দীনহীন। এঁদের তুলনায় অতুল্য ঘোষকে মনে হয় অন্য গ্রহের মানুষ।
তাঁর সংগ্রহে মেলা বইয়ের অথর-তালিকা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তার মধ্যে এক জনের উপস্থিতি দেখে বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। হানা আরেনড্ট। বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পলিটিক্যাল ফিলসফার। রাজনীতির চালিকাশক্তি যে জনতা বা ‘মব’, তার মানসিকতা বিশ্লেষণকারী। ‘গালিলেও’ নাটকে বারটোল্ট ব্রেশ্ট ইটালীয় বিজ্ঞানীর মুখে একটা বাক্য বসিয়েছিলেন— ‘সে দেশ বড় দুর্ভাগা, যে দেশে নায়কের প্রয়োজন হয়।’ ব্রেশ্ট-এর দেশ জার্মানির মানুষ হানা জার্মান এবং সোভিয়েট একনায়কতন্ত্র দেখে লিখেছিলেন, ‘জনতা সব সময় চায় বলশালী নেতা, কারণ জনতা যে সমাজ থেকে নির্বাসিত তাকে ঘৃণা করে।’
অনেক বই লিখেছিলেন হানা। ‘দি ওরিজিন অব টোটালিটারিয়ানিজ়ম’, ‘ক্রাইসিস ইন দ্য রিপাবলিক’, ‘মেন ইন ডার্ক টাইম্স’, ‘বিটুইন পাস্ট অ্যান্ড ফিউচার’। কিন্তু যে বই লেখার সূত্রে ওঁর নাম সবাই জানে, যে বই ১৯৬৩ সালে প্রথম প্রকাশের পর এ পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ কপি, তা হল, ‘আইখমান ইন জেরুসালেম: আ রিপোর্ট অন দ্য বেনালিটি অব ইভিল’।
অটো অ্যাডলফ আইখমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জার্মান নাৎসি অফিসার। অ্যাডলফ হিটলারের বিশেষ আস্থাভাজন। দায়িত্ব সামলেছিলেন বিশেষ এক। হিটলার দখল করেছিলেন বিশ্বের যে সব দেশ, সেখানকার লক্ষ-লক্ষ ইহুদি, বিকলাঙ্গ, কমিউনিস্ট, সমকামী এবং জিপসিদের বেছে বেছে গ্রেফতার। তার পর গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে হত্যা— হলোকস্ট। যুদ্ধশেষে হিটলার এবং তাঁর কিছু অফিসার আত্মহত্যা করলেও, আইখমান তা করেননি। বরং জেল থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন আর্জেন্টিনা। ছদ্মনামে গা-ঢাকা দিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন ওখানে। ফলে গ্রেফতার হওয়ার পর নুরেমবুর্গে যখন যুদ্ধাপরাধে বিচার হয় কিছু নাৎসি অফিসারের, তাঁদের মধ্যে ছিলেন না আইখমান। ১৯৬০ সালের ১১ মে তারিখে ওঁকে আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেস থেকে গ্রেফতার করে ইজ়রায়েলের গোয়েন্দা-পুলিশ মোসাদ। একান্ত গোপন অপারেশন। কারণ, আর্জেন্টিনা সরকার দেশের সার্বভৌমত্বের কারণ দেখিয়ে আগে বেশ কয়েক জন যুদ্ধাপরাধীকে অন্য দেশের হাতে তুলে দেওয়ার বিরোধিতা করেছে। গ্রেফতারের পর আইখমানকে ড্রাগ খাইয়ে আধা-অচেতন করে ইজ়রায়েলি বিমানে বুয়েনস আইরেস থেকে নিয়ে আসা হয় জেরুসালেম। ২৩ মে ১৯৬০। ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গারিয়ন তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ইজ়রায়েলি পার্লামেন্ট নেসেটে ঘোষণা করেন, ‘আইখমান আমাদের কব্জায়। আমরা ওঁর বিচার করব।’
অনেক দিন পর বিশ্ববাসী খবর পেল হারিয়ে-যাওয়া আইখমানের। আর্জেন্টিনা জুড়ে দিল চেঁচামেচি। প্রতিবাদে শামিল হল নানা দেশ। এক দেশে অপরাধ, আর এক দেশে অপরাধী গ্রেফতার, আরও এক দেশে তাঁর বিচার— এ কী রকম ব্যাপার! ব্যাপার গড়াল রাষ্ট্রপুঞ্জ পর্যন্ত। ছলচাতুরি করে কোনও রকমে সামাল দিল ইজ়রায়েল। ১১ এপ্রিল, ১৯৬১। জেরুসালেম শহরে বিশেষ আদালতে শুরু হল আইখমানের বিচার। সারা পৃথিবীর প্রায় ৫০০ রিপোর্টার শুনানির খবর লিখতে তখন ওই শহরে। আমেরিকার সাপ্তাহিক ‘দ্য নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকার তরফে রিপোর্ট পাঠাতে এলেন হানা। দুই কিস্তিতে ওই ম্যাগাজ়িনে ছাপা হল সে প্রতিবেদন।
১৫ ডিসেম্বর, ১৯৬১। বিচারের পর রায় ঘোষণা। যা আগেই অনুমান করা গেছিল, সেই রায়ই দিলেন বিচারকরা। ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড। ইজ়রায়েলি সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হল। ২৯ মে, ১৯৬২। সুপ্রিম কোর্ট সে আপিল খারিজ করল। এর পর দয়াভিক্ষা। আইখমানের স্ত্রী এবং ভাই ইজ়রায়েলের প্রেসিডেন্ট ইৎঝাক বেন-ভি-র কাছে আইখমানের প্রাণভিক্ষা চাইলেন। ৩১ মে। প্রেসিডেন্ট সে আর্জি বাতিল করলেন। ১ জুন মধ্যরাতে ফাঁসি হল আইখমানের।
ফাঁসিকাঠে যাওয়ার আগে পাদ্রি এলেন আইখমানকে বাইবেল পড়ানোর জন্য। বন্দি তাঁকে ফেরত পাঠালেন, তাঁর সময় নেই বাজে কাজে নষ্ট করার। তিনি বরং জেল কর্তৃপক্ষের কাছে এক বোতল রেড ওয়াইন চাইলেন। এবং তা এলে, আধবোতল শেষ করলেন। পিছমোড়া অবস্থায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল ফাঁসিকাঠের দিকে। এক বার বললেন, দড়িতে ব্যথা লাগছে। ওয়ার্ডেন মুখের উপর কালো কাপড় চাপা দিতে চাইলে বললেন, লাগবে না। চেঁচিয়ে বললেন, ‘লং লিভ জার্মানি, লং লিভ আর্জেন্টিনা।’
রিপোর্ট তো ৫০০ সাংবাদিকের সকলেই করলেন। কিন্তু রিপোর্ট লিখতে গিয়ে তাতে ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করলেন হানা। নিজে দার্শনিক বলেই বোধহয় রিপোর্টে ঢুকিয়ে দিলেন দর্শনশাস্ত্রের দাবি। কী? যা আছে ওঁর বিখ্যাততম বইয়ের সাবটাইটেলে। হ্যাঁ, বেনালিটি অব ইভিল। শয়তানির তুচ্ছতা। শয়তান না হয়ে কি শয়তানি করা সম্ভব? যেন এ প্রশ্নেরই উত্তর দিলেন হানা ‘দি নিউ ইয়র্কার’-এ প্রকাশিত রিপোর্টে। ওঁর চোখে আইখমান ‘পারভার্টেড’ কিংবা ‘সেডিস্টিক’ (যা যা তাঁকে ইজ়রায়েল প্রমাণ করেছিল) নন, বরং ‘টেরিফাইংলি নর্মাল’ এক জন মানুষ। তিনি আদর্শ আমলা। আমলার যা কাজ, তা তিনি কায়মনোবাক্যে করে গেছেন। আমলার কী কাজ? ওপরওয়ালার সুপারিশ মেনে চলা এবং এ ভাবেই পদোন্নতি। নাৎসি আমলাতন্ত্রে এ ভাবেই নিজের কেরিয়ার গুছিয়েছেন আইখমান। হানার বর্ণনায় তিনি শয়তানি করেছেন, শয়তান না হয়েও। পাপ কাজের বাস্তবতা থেকে তাঁর মন বিচ্ছিন্ন ছিল। তিনি কী করেছেন, তা বোঝেননি, কারণ তিনি অন্যের দৃষ্টিতে বাস্তবকে দেখতে পারেননি। তাঁর চোখে পাপ ধরা পড়েনি। শয়তানি একটা তুচ্ছ ব্যাপার। সে রকম পরিস্থিতিতে পড়লে, আমরা যে কেউ তা করতে পারি।
যেন আগুনে ঘি পড়ল! লোকজন রে-রে করে উঠল হানার প্রতিবেদন পড়ে। অনেকের মতে, হানা আইখমানের হয়ে সাফাই গাইলেন। তাঁকে দোষমুক্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন। এমনকি হানার বন্ধুবান্ধবীরাও ছি ছি করতে লাগলেন। ব্যতিক্রম এক জন। স্ট্যানলি মিলগ্রাম। আমেরিকায় ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক। জন্ম ইহুদি পরিবারে। সে কারণেই হলোকস্টের ব্যাপারে আগ্রহ স্বাভাবিক। হানার নতুন থিয়োরিতেও তাঁর কৌতূহল। আইখমান এবং আরও নাৎসি অফিসাররা কি শুধুই হুকুম তামিল করেছিলেন? নুরেমবুর্গ শহরে যুদ্ধাপরাধী অফিসারদের যে বিচার হয়, তাতেও অফিসাররা নিজেদের সাফাই গেয়েছিলেন ওই একই যুক্তিতেই। ব্যাপারটা মনস্তত্ত্বের। ওই বিষয়ের প্রফেসর হিসেবেই মিলগ্রাম বিষয়টা খতিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। ১৯৬১ সালে পরিকল্পনা করলেন এক এক্সপেরিমেন্টের। এ বছর ওই এক্সপেরিমেন্টের ডায়মন্ড জুবিলি।
১৮ জুন, ১৯৬১। ইয়েল ইউনিভার্সিটি যে শহরে অবস্থিত, সেখানকার পয়লা নম্বর খবরের কাগজ ‘নিউ হাভেন রেজিস্টার’-এ পুরো পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন বেরোল। ‘স্মৃতিশক্তি পরীক্ষার জন্য লোকজন চাই। আপনার এক ঘণ্টা সময় আমাদের ল্যাবরেটরিতে ব্যয় করার জন্য পাবেন চার ডলার।’ বিজ্ঞাপনে কাজ হল। এলেন শ’য়ে শ’য়ে ভলান্টিয়ার। তাঁদের ভূমিকা? শিক্ষক। ওঁরা ছাত্রদের পড়াবেন। কী পড়াবেন? শব্দের সঙ্গে শব্দ ম্যাচ করানো। এক বার শিখিয়ে তার পর পড়া ধরা।
তখন ছাত্ররা ভুল করলে শাস্তি। শাস্তি দেওয়ার হুকুম দেবেন এক কর্তাব্যক্তি। কী শাস্তি? ইলেকট্রিক শক। ক্রমাগত ভুল করে চললে ছাত্রের শাস্তির পরিমাণও বাড়বে। প্রথম বার ভুল করলে ১৫ ভোল্টের শক। পরের বার ভুল করলে ৩০ ভোল্টের শক। এ রকম করে বাড়তে বাড়তে ৪৫০ ভোল্ট অবধি ইলেকট্রিক শক। ৪৫০ ভোল্টের শক পেলে কেউ বাঁচে না। মরেই যায়। তার বহু আগে শকের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়ে চলার সময়ই ছাত্ররা যন্ত্রণায় চিৎকার করতে শুরু করে।
আসলে, হুকুম দেওয়ার কর্তাব্যক্তিটি এবং ছাত্ররা— সবই সাজানো। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ফেক’। আর সবচেয়ে বড় কথা, শক দেওয়ার মেশিনটিও ফেক। কর্তাব্যক্তিটি এবং ছাত্ররা সবাই মিলগ্রামের ছাত্রছাত্রী। শক মেশিনে ইলেকট্রিক শকের ব্যবস্থা নেই। সবই অভিনয়। এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে শিক্ষকদের, যাঁরা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে ভলান্টিয়ার হতে এসেছেন। কর্তাব্যক্তির হুকুম মেনে তাঁরা নকল শক দিয়ে যান কি না, তা পরীক্ষা করা। নকল শকের পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে কর্তাব্যক্তির হুকুমও বদলাবে। প্রথমে, নকল শকের পরিমাণ যখন কম, তখন যদি হুকুম হয়, ‘দয়া করে চালিয়ে যান’, তা হলে পরের ধাপগুলো হবে এ রকম : ‘পরীক্ষা আপনাকে চালিয়ে যেতে বলছে’, ‘আপনাকে অবশ্যই চালিয়ে যেতে হবে’ এবং ‘চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আপনার অন্য পথ খোলা নেই’। নকল শক পাওয়া ছাত্ররা শিক্ষকদের সঙ্গে এক ঘরে বসবে না। যাতে নকল শক খেয়ে যন্ত্রণায় চিৎকার—এবং শক বাড়লে নিস্তেজ হয়ে গিয়ে মরার— অভিনয় শিক্ষক টের না পান।
পরীক্ষার ফল? হ্যাঁ, দেখা গেল, ৬৫ শতাংশ শিক্ষক বা ভলান্টিয়ার ছাত্রকে শাস্তি দিতে ৪৫০ ভোল্টের শক দিয়ে গেলেন। ছাত্ররা ৪৫০ ভোল্টের শক খাওয়ার অনেক আগেই নিস্তেজ হয়ে গিয়ে মরার অভিনয় করার পরও তারা শক চালিয়ে গেলেন। তাঁরা কারা? সমাজের সাধারণ মানুষ। অর্থাৎ, পরীক্ষার ফলাফল পরিষ্কার। মনুষ্যচরিত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সারমেয়-সদৃশ। যে কোনও হুকুম তামিল করায় সে পটু। নুরেমবুর্গ শহরে বিচারকালে একের পর এক নাৎসি অফিসার নিজেদের সাফাই গেয়ে বলতেন, ‘বেফেল ইস্ট বেফেল (হুকুম মানে হুকুম)।’ ওরা শয়তান নয়, সাধারণ মানুষ। আমেরিকায় জনপ্রিয় টেলিভিশন প্রোগ্রাম ‘সিক্সটি মিনিটস’ পরীক্ষার ফলাফল জানার জন্য আমন্ত্রণ জানাল মিলগ্রামকে। অনুষ্ঠানে তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন, ‘আমেরিকায় যদি গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে মানুষ মারার ব্যবস্থা গড়া হয়, তা হলে সে গ্যাস চেম্বার পরিচালনার জন্য প্রচুর আমেরিকান পাওয়া যাবে।’ নাৎসি অফিসারদের শয়তান ভাবা ভুল, শয়তানি মনুষ্যচরিত্রেই মিশে আছে। বেনালিটি অব ইভিল। হানা যে তত্ত্ব খাড়া করলেন, তার পরীক্ষামূলক প্রমাণ জোগালেন মিলগ্রাম।
১৯৬৩। মিলগ্রাম তাঁর এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল সবিস্তার লিখলেন ‘জার্নাল অব অ্যাবনরমাল অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকোলজি’ পত্রিকায়। শুরু হয়ে গেল প্রতিক্রিয়া। ‘দি নিউ ইয়র্ক টাইম্স’-এ বিখ্যাত বিজ্ঞান সাংবাদিক ওয়াল্টার সুলিভান লিখলেন রিপোর্ট। ‘সিক্সটি ফাইভ পারসেন্ট ইন টেস্ট ব্লাইন্ডলি ওবে অর্ডার টু ইনফ্লিক্ট পেন’। এক সপ্তাহ পর, ‘সেন্ট লুই পোস্ট ডিসপ্যাচ’ কাগজে মিলগ্রাম এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়কে তুলোধোনা করে সম্পাদকীয় লেখা হল। ভলান্টিয়াররা তো জানছে না শক নকল। তারা তো জেনেবুঝে ইলেকট্রিক শক দিচ্ছে। এ রকম একটা পরীক্ষা চালানোর অনুমতি দিল কে বা কারা? শুরু হল বিতর্ক। চাপে পড়ে নীতির দোহাই দিয়ে আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন আটকে রাখল মিলগ্রামের সভ্যপদ। অবশ্য ১৯৬৪ সালে আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স-এর পক্ষ থেকে ওঁকে দেওয়া হল মনস্তত্ত্ব গবেষণার জন্য পুরস্কার। ১৯৭৪ সালে মিলগ্রাম লিখলেন বই— ‘ওবিডিয়েন্স টু অথরিটি: অ্যান এক্সপেরিমেন্টাল ভিউ’।
মিলগ্রাম যদি তাঁর এক্সপেরিমেন্ট করতে নামেন আইখমানের বিচারের রিপোর্ট পড়ে, তবে আর এক জনও মনস্তত্ত্বের আর এক পরীক্ষা করেন সমসাময়িক আর এক ঘটনা দেখে। তিনি মিলগ্রামের স্কুলের বন্ধু ফিলিপ জর্জ জ়িমবারডো। ১৯৭১ সালে তিনি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে সাইকোলজির প্রফেসর। ওই বছর আমেরিকার রাজনৈতিক জীবনে ঝড়। চলেছে ভিয়েতনাম যুদ্ধ। যুবকদের তাতে যোগ দিতে আমেরিকার সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে হচ্ছে। পৃথিবীর বিপরীত গোলার্ধে যুদ্ধে তারা মারা পড়ছে। কী লাভ ওই যুদ্ধে? প্রশ্নে আমেরিকার কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে যুবক-যুবতীরা আন্দোলনে উত্তাল। তার ওপরে আর এক খবর। ঘোর আপত্তিকর। আমেরিকান সেনারা ভিয়েতনামি জনগণের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছে। ভদ্র শিক্ষিত যুবকেরা কী করে ও রকম অত্যাচারী হয়? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে জ়িমবারডো পরীক্ষায় নামলেন। সে পরীক্ষারও গোল্ডেন জুবিলি এ বছর।
ওঁর পরীক্ষা স্ট্যানফোর্ড প্রিজ়ন এক্সপেরিমেন্ট নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। পরীক্ষা কেমন? ১৫ অগস্ট, ১৯৭১। ভোরবেলা। আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে পালো অল্টো শহরে পুলিশ এসে কিছু বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল। গৃহস্বামী দরজা খুললে প্রত্যেক বাড়ি থেকে এক জন করে যুবকের ঘুম ভাঙাল। হাতকড়া পরিয়ে ভ্যানে তুলল। প্রতিবেশীরা জানলায় উঁকি মেরে থ। এরা অপরাধী! মোট ২৪ জন যুবককে নিয়ে আসা হল এক জেলখানার সামনে। হোর্ডিংয়ে বড় বড় করে লেখা ‘স্ট্যানফোর্ড কাউন্টি জেল’। নকল জেলখানা ওটা। আসলে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টকে জেলখানা হিসেবে সাজানো হয়েছে। ভেতরে ছ’ফুট বা ন’ফুটের ছোট ছোট কুঠুরি। এক-একটা সেল। জেলখানা যেমন নকল, তেমনই যুবকরাও কেউই নয় অপরাধী। ওরা পরীক্ষার জন্য গিনিপিগ। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনের উত্তর দিয়ে নির্বাচিত হওয়ায় আনা হয়েছে। ওই ভলান্টিয়ারদের জিজ্ঞেস করা হল, কী হতে চাও— গার্ড না বন্দি? প্রায় সবাই বলল, গার্ডকে কেউ পছন্দ করে না, বন্দি হওয়া অনেক ভাল। শেষে কয়েন টস করে ভূমিকা নির্ধারিত হল। কয়েকজন গার্ড, বাকি সবাই বন্দি। জ়িমবারডো নিজে জেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট।
শুরু হল পরীক্ষা। গার্ডদের নাম থাকলেও বন্দিদের তা নেই, তারা শুধুই নম্বর। গার্ডরা এমন অত্যাচার শুরু করল যে, বন্দিদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেলে একটা বালতি, তার মধ্যেই মলমূত্র ত্যাগ। দুর্গন্ধে টেকা দায়। যখন-তখন বন্দিদের হাত পা শেকলে বাঁধা। একটু কথার অবাধ্য হলে লাঠির বাড়ি তো আছেই। দ্বিতীয় দিনেই বন্দিরা বিদ্রোহ করল। দমন করতে গার্ডরা ছুড়ল জলকামান। কয়েকজন বন্দি নিদ্রাহীনতার শিকার। কয়েদি নম্বর ৮৬১২ সেলের দরজায় মাথা ঠুকে চেঁচাতে লাগল, ‘তোমরা বুঝতে পারছ না। ভেতরে আমি জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছি। আমি মুক্তি চাই। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আর একটা রাত, ওহ্ অসহ্য!’ গার্ডরা তাকে মুক্তি দিল না। পরীক্ষা চলার কথা ছিল ১৪ থেকে ২১ দিন। ছ’দিনের মাথায় মনস্তত্ত্বের পিএইচ ডির ছাত্রী ক্রিশ্চিনা মাসলাক (পরে জ়িমবারডোর স্ত্রী) ওঁকে বললেন, ‘বন্দি যুবকদের মানসিক ক্ষতির জন্য তুমি দায়ী হবে।’ জ়িমবারডো সে দিনই বন্ধ করে দিলেন পরীক্ষা।
কেন গার্ডরা বিষম অত্যাচারী হয়ে উঠল? ব্যাখ্যা দিলেন জ়িমবারডো। ক্ষমতা ইন্ধন জুগিয়েছে অত্যাচারের। এক দিকে ক্ষমতা, অন্য দিকে অসহায়তা। জ়িমবারডোর কথায়, বন্দিরা অসহায়। অসহায়তার শুরু নকল পুলিশের হাতে ওদের গ্রেফতার হওয়ার সময় থেকে। ওই যে প্রতিবেশীরা উঁকি মেরে দেখল ওদের ভ্যানে তোলা হচ্ছে, সেই সময় ওরা লজ্জা পেল। হীনমন্যতার শুরু। তা আরও বেড়ে গেল নাম হারিয়ে ওরা যখন এক-একটা সংখ্যায় পরিণত হল। উল্টো দিকে গার্ডরা দেখল, বন্দিরা অসহায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি ওদের ক্ষমতাবান করে তুলল। বন্দিদের অসহায়তাই গার্ডদের অত্যাচারী হয়ে উঠতে সাহায্য করল। ভিয়েতনামিরা অসহায় বলেই আমেরিকান সেনারা ওদের ওপর অকথ্য অত্যাচার করেছে। মানুষ পরিস্থিতির দাস। ক্ষমতা পেলে ক্ষমতাবানরা অসহায়ের ওপর সেই ক্ষমতা ফলায়। কেউই শয়তান বা ভাল নয়। পরিস্থিতি মানুষকে শয়তান বা ভাল করে তোলে। সেই বেনালিটি অব ইভিল। শয়তানি একটা তুচ্ছ ব্যাপার। যে কোনও সময় মানুষের মধ্যে আসতে পারে।
এই স্ট্যানফোর্ড প্রিজ়ন এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে কিন্তু বিতর্ক আছে। অনেকে অভিযোগ করেন, এক্সপেরিমেন্টার হিসেবে জ়িমবারডো গার্ডদের বেশি বেশি করে অত্যাচারী হতে ‘নির্দেশ’ দিয়েছিলেন। যাতে তাঁর পরীক্ষার ফলাফল প্রকট হয়, আর তিনি তা ফলাও করে প্রচার করতে পারেন। নির্দেশ বা প্ররোচনা নিয়ে কিছু বলেননি জ়িমবারডো। তবে ঠারেঠোরে তা স্বীকারও করে নিয়েছেন এক রকম। লিখেছেন, ‘যখন দরকার ছিল, তখন আমি পরীক্ষায় পর্যাপ্ত নজরদারি করতে পারিনি। ফলাফল এসেছিল মানবিক কষ্টের বিনিময়ে। তার জন্য আমি দুঃখিত। আজও ক্ষমা চাইছি ওই অমানবিকতায় মদত জোগানোর জন্য।’
২০০৩। আমেরিকা দখল করে নিয়েছে ইরাক। প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন পলাতক। বাগদাদ শহরের ৩২ কিলোমিটার পশ্চিমে আবু ঘ্রাইব কারাগারে বন্দি তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ। তাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার। মলমূত্র ত্যাগে বাধাদান থেকে শুরু করে উলঙ্গ করে যৌনসঙ্গমের অভিনয় করতে বাধ্য করা। আমেরিকান সেনাদের কীর্তি। ধন্য ও দেশের সাংবাদিকতা। জেলের বাইরে বেরোল অত্যাচারের ছবি। দেখাল সিবিএস নিউজ়। পৃথিবী জুড়ে হইচই। আমেরিকা না সভ্য দেশ? সে দেশের এ হেন আচরণ! ছিঃ! আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। তাঁর প্রশাসন ব্যাপারটা প্রথমে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করল। পারল না। বসাতে হল তদন্ত কমিশন। বিশেষজ্ঞ হিসেবে ডাকা হল জ়িমবারডোকে। তিনি বললেন, জেলরক্ষীদের অত্যাচারী হতে সময় লাগে না। ২০০৭। স্ট্যানফোর্ড প্রিজ়ন এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে তিনি বই লিখলেন— ‘দি লুসিফার এফেক্ট: আন্ডারস্ট্যান্ডিং হাউ গুড পিপল টার্ন ইভিল’।
উপন্যাসে কিংবা চলচ্চিত্রে ঘুরে-ফিরে আসে মিলগ্রাম এবং জ়িমবারডোর এক্সপেরিমেন্ট। ২০১৫ সালে তৈরি হয়েছে দুটো ছবি। কাইল প্যাট্রিক আলভারেজ-এর পরিচালনায় ‘দি স্ট্যানফোর্ড প্রিজ়ন এক্সপেরিমেন্ট’ এবং মাইকেল আলমেরেইডা-র পরিচালনায় ‘এক্সপেরিমেন্টার’। দ্বিতীয় ফিল্ম অবশ্যই মিলগ্রামের পরীক্ষা নিয়ে। প্রথম চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে বন্দি ৮৬১২-এর ওপর মানসিক অত্যাচার। গোপনাঙ্গের চুলে উকুন তাড়াতে হবে তার। তাই তাকে চটপট ল্যাংটো হতে বলা হচ্ছে।
আর সাইকোলজিস্টরা এখনও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে করে যাচ্ছেন স্ট্যানলি মিলগ্রামের পরীক্ষা। মাত্র পাঁচ বছর আগেও ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক প্যাট্রিক হ্যাগার্ড করেন পরীক্ষা। বিজ্ঞানের জার্নাল ‘নেচার’ পরীক্ষাটিকে বলেছিল ‘থরোলি মডার্ন মিলগ্রাম’। পরীক্ষায় হ্যাগার্ড দু’জন দু’জন করে টেবিলের এ দিকে-ও দিকে বসান এজেন্ট এবং ভিক্টিমকে। টেবিলের পাশে দাঁড়ান এক্সপেরিমেন্টর। ভিক্টিম ভুল করলে থাকে তার তরফে এজেন্টকে পাঁচ পেন্স করে দেওয়ার ব্যবস্থা। এজেন্টের সে শাস্তি পছন্দ না হলে তিনি ভিক্টিমকে ইলেকট্রিক শকও দিতে পারেন। তার সামনে দুটো সুইচ আছে। একটা সুইচ টিপলে কিছু হয় না, অন্যটা টিপলে ভিক্টিমের ইলেকট্রিক শক লাগে। সত্যিকারের শক।
তবে ভিক্টিমের সহ্যসীমার মধ্যে। এজেন্ট শক দেবে কি না, তা নির্ভর করবে এক্সপেরিমেন্টারের নির্দেশের ওপর।
এ রকম আয়োজনের পর শুরু হল পরীক্ষা। ভিক্টিম ভুল করল। সে পাঁচ পেন্স জরিমানা দিয়ে ছাড় পেল। কিছু ভিক্টিম তা পেল না। কোনও ক্ষেত্রে এক্সপেরিমেন্টারের নির্দেশে এজেন্টকে স্পষ্ট করে বলা হল, দুটো সুইচের মধ্যে যে সুইচটায় ভিক্টিমকে শক দেওয়া যায়, সেটি টিপতে। আবার কোনও ক্ষেত্রে এক্সপেরিমেন্টর মুখ ঘুরিয়ে থাকল। এজেন্টকে বলল, দু’টি সুইচের মধ্যে যে কোনওটা টিপতে। অর্থাৎ, এজেন্ট ভিক্টমকে শক দিল বা দিল না। এ বার সুইচ টেপার কয়েক মিলিসেকেন্ড পর একটা ঘণ্টা বাজল। এজেন্টকে বলা হল, তার সুইচ টেপার এবং ঘণ্টা বাজার মধ্যে সময়ের ব্যবধান খেয়াল করতে। দেখা গেল, যে সব ক্ষেত্রে এক্সপেরিমেন্টর মুখ ঘুরিয়ে ছিল অন্য দিকে, এজেন্ট স্বেচ্ছায় সুইচ টিপেছে, সে সব ক্ষেত্রে এজেন্টের মনে হয়েছে, ঘণ্টা আগে বেজেছে। আর যে সব ক্ষেত্রে এক্সপেরিমেন্টর সরাসরি এজেন্টকে দেখিয়ে দিয়েছে, কোন সুইচটা টিপতে হবে, সে সব ক্ষেত্রে এজেন্ট বলছে, ঘণ্টা পরে বেজেছে। আসলে কিন্তু দু’ক্ষেত্রেই সুইচ টেপা এবং ঘণ্টা বাজার মধ্যে সময়ের ব্যবধান এক। তা হলে কেন এজেন্ট বলছে, ঘণ্টা আগে-পরে বেজেছে? ওটা এজেন্টের মনের ভুল। মন স্বেচ্ছায় কাজ এবং তার প্রতিক্রিয়াকে চটজলদি ভাবে। অন্যের নির্দেশে কাজ এবং তার প্রতিক্রিয়াকে দেরিতে ঠাহর করে।
হ্যাগার্ড এজেন্টদের মস্তিষ্কের ইইজি করে দেখেছেন, অন্যের নির্দেশে কাজ করলে মন সে কাজের দায় কম ভাবে। এটাই নিয়ম। এটাই তো দেখাতে চেয়েছিলেন মিলগ্রাম। তাই নয় কি?
ফিরে আসি বিস্ময়ের প্রসঙ্গে। অতুল্য ঘোষ কেন উৎসুক হয়েছিলেন হানা আরেনড্ট-এর রচনায়?
চ
মকে উঠেছিলাম। প্রয়াত কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষের লাইব্রেরি দেখে। কত বই! অনেক দিন আগে ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত ওঁর স্মৃতিকথা ‘কষ্টকল্পিত’ পড়েছিলাম। মানুষটি সম্পর্কে শ্রদ্ধা জেগেছিল। তার অনেক বছর পরে কী একটা কাজে গিয়েছিলাম বিধান শিশু উদ্যান। সাংবাদিকতার শুরুতে লিখতাম রাজনীতির খবর। সে সুবাদে নেতাদের সংস্পর্শে আসতে হয়েছিল অল্পবিস্তর। কারও বাড়িতে এমন লাইব্রেরি তো দেখিনি! এখনকার অধিকাংশ নেতানেত্রীর মুখের ভাষা শুনলে মনে হয় ক-অক্ষর গোমাংস। রাজনীতি এমনই দীনহীন। এঁদের তুলনায় অতুল্য ঘোষকে মনে হয় অন্য গ্রহের মানুষ।
তাঁর সংগ্রহে মেলা বইয়ের অথর-তালিকা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তার মধ্যে এক জনের উপস্থিতি দেখে বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। হানা আরেনড্ট। বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পলিটিক্যাল ফিলসফার। রাজনীতির চালিকাশক্তি যে জনতা বা ‘মব’, তার মানসিকতা বিশ্লেষণকারী। ‘গালিলেও’ নাটকে বারটোল্ট ব্রেশ্ট ইটালীয় বিজ্ঞানীর মুখে একটা বাক্য বসিয়েছিলেন— ‘সে দেশ বড় দুর্ভাগা, যে দেশে নায়কের প্রয়োজন হয়।’ ব্রেশ্ট-এর দেশ জার্মানির মানুষ হানা জার্মান এবং সোভিয়েট একনায়কতন্ত্র দেখে লিখেছিলেন, ‘জনতা সব সময় চায় বলশালী নেতা, কারণ জনতা যে সমাজ থেকে নির্বাসিত তাকে ঘৃণা করে।’
অনেক বই লিখেছিলেন হানা। ‘দি ওরিজিন অব টোটালিটারিয়ানিজ়ম’, ‘ক্রাইসিস ইন দ্য রিপাবলিক’, ‘মেন ইন ডার্ক টাইম্স’, ‘বিটুইন পাস্ট অ্যান্ড ফিউচার’। কিন্তু যে বই লেখার সূত্রে ওঁর নাম সবাই জানে, যে বই ১৯৬৩ সালে প্রথম প্রকাশের পর এ পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ কপি, তা হল, ‘আইখমান ইন জেরুসালেম: আ রিপোর্ট অন দ্য বেনালিটি অব ইভিল’।
অটো অ্যাডলফ আইখমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জার্মান নাৎসি অফিসার। অ্যাডলফ হিটলারের বিশেষ আস্থাভাজন। দায়িত্ব সামলেছিলেন বিশেষ এক। হিটলার দখল করেছিলেন বিশ্বের যে সব দেশ, সেখানকার লক্ষ-লক্ষ ইহুদি, বিকলাঙ্গ, কমিউনিস্ট, সমকামী এবং জিপসিদের বেছে বেছে গ্রেফতার। তার পর গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে হত্যা— হলোকস্ট। যুদ্ধশেষে হিটলার এবং তাঁর কিছু অফিসার আত্মহত্যা করলেও, আইখমান তা করেননি। বরং জেল থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন আর্জেন্টিনা। ছদ্মনামে গা-ঢাকা দিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন ওখানে। ফলে গ্রেফতার হওয়ার পর নুরেমবুর্গে যখন যুদ্ধাপরাধে বিচার হয় কিছু নাৎসি অফিসারের, তাঁদের মধ্যে ছিলেন না আইখমান। ১৯৬০ সালের ১১ মে তারিখে ওঁকে আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেস থেকে গ্রেফতার করে ইজ়রায়েলের গোয়েন্দা-পুলিশ মোসাদ। একান্ত গোপন অপারেশন। কারণ, আর্জেন্টিনা সরকার দেশের সার্বভৌমত্বের কারণ দেখিয়ে আগে বেশ কয়েক জন যুদ্ধাপরাধীকে অন্য দেশের হাতে তুলে দেওয়ার বিরোধিতা করেছে। গ্রেফতারের পর আইখমানকে ড্রাগ খাইয়ে আধা-অচেতন করে ইজ়রায়েলি বিমানে বুয়েনস আইরেস থেকে নিয়ে আসা হয় জেরুসালেম। ২৩ মে ১৯৬০। ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গারিয়ন তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ইজ়রায়েলি পার্লামেন্ট নেসেটে ঘোষণা করেন, ‘আইখমান আমাদের কব্জায়। আমরা ওঁর বিচার করব।’
অনেক দিন পর বিশ্ববাসী খবর পেল হারিয়ে-যাওয়া আইখমানের। আর্জেন্টিনা জুড়ে দিল চেঁচামেচি। প্রতিবাদে শামিল হল নানা দেশ। এক দেশে অপরাধ, আর এক দেশে অপরাধী গ্রেফতার, আরও এক দেশে তাঁর বিচার— এ কী রকম ব্যাপার! ব্যাপার গড়াল রাষ্ট্রপুঞ্জ পর্যন্ত। ছলচাতুরি করে কোনও রকমে সামাল দিল ইজ়রায়েল। ১১ এপ্রিল, ১৯৬১। জেরুসালেম শহরে বিশেষ আদালতে শুরু হল আইখমানের বিচার। সারা পৃথিবীর প্রায় ৫০০ রিপোর্টার শুনানির খবর লিখতে তখন ওই শহরে। আমেরিকার সাপ্তাহিক ‘দ্য নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকার তরফে রিপোর্ট পাঠাতে এলেন হানা। দুই কিস্তিতে ওই ম্যাগাজ়িনে ছাপা হল সে প্রতিবেদন।
১৫ ডিসেম্বর, ১৯৬১। বিচারের পর রায় ঘোষণা। যা আগেই অনুমান করা গেছিল, সেই রায়ই দিলেন বিচারকরা। ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড। ইজ়রায়েলি সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হল। ২৯ মে, ১৯৬২। সুপ্রিম কোর্ট সে আপিল খারিজ করল। এর পর দয়াভিক্ষা। আইখমানের স্ত্রী এবং ভাই ইজ়রায়েলের প্রেসিডেন্ট ইৎঝাক বেন-ভি-র কাছে আইখমানের প্রাণভিক্ষা চাইলেন। ৩১ মে। প্রেসিডেন্ট সে আর্জি বাতিল করলেন। ১ জুন মধ্যরাতে ফাঁসি হল আইখমানের।
ফাঁসিকাঠে যাওয়ার আগে পাদ্রি এলেন আইখমানকে বাইবেল পড়ানোর জন্য। বন্দি তাঁকে ফেরত পাঠালেন, তাঁর সময় নেই বাজে কাজে নষ্ট করার। তিনি বরং জেল কর্তৃপক্ষের কাছে এক বোতল রেড ওয়াইন চাইলেন। এবং তা এলে, আধবোতল শেষ করলেন। পিছমোড়া অবস্থায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল ফাঁসিকাঠের দিকে। এক বার বললেন, দড়িতে ব্যথা লাগছে। ওয়ার্ডেন মুখের উপর কালো কাপড় চাপা দিতে চাইলে বললেন, লাগবে না। চেঁচিয়ে বললেন, ‘লং লিভ জার্মানি, লং লিভ আর্জেন্টিনা।’
রিপোর্ট তো ৫০০ সাংবাদিকের সকলেই করলেন। কিন্তু রিপোর্ট লিখতে গিয়ে তাতে ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করলেন হানা। নিজে দার্শনিক বলেই বোধহয় রিপোর্টে ঢুকিয়ে দিলেন দর্শনশাস্ত্রের দাবি। কী? যা আছে ওঁর বিখ্যাততম বইয়ের সাবটাইটেলে। হ্যাঁ, বেনালিটি অব ইভিল। শয়তানির তুচ্ছতা। শয়তান না হয়ে কি শয়তানি করা সম্ভব? যেন এ প্রশ্নেরই উত্তর দিলেন হানা ‘দি নিউ ইয়র্কার’-এ প্রকাশিত রিপোর্টে। ওঁর চোখে আইখমান ‘পারভার্টেড’ কিংবা ‘সেডিস্টিক’ (যা যা তাঁকে ইজ়রায়েল প্রমাণ করেছিল) নন, বরং ‘টেরিফাইংলি নর্মাল’ এক জন মানুষ। তিনি আদর্শ আমলা। আমলার যা কাজ, তা তিনি কায়মনোবাক্যে করে গেছেন। আমলার কী কাজ? ওপরওয়ালার সুপারিশ মেনে চলা এবং এ ভাবেই পদোন্নতি। নাৎসি আমলাতন্ত্রে এ ভাবেই নিজের কেরিয়ার গুছিয়েছেন আইখমান। হানার বর্ণনায় তিনি শয়তানি করেছেন, শয়তান না হয়েও। পাপ কাজের বাস্তবতা থেকে তাঁর মন বিচ্ছিন্ন ছিল। তিনি কী করেছেন, তা বোঝেননি, কারণ তিনি অন্যের দৃষ্টিতে বাস্তবকে দেখতে পারেননি। তাঁর চোখে পাপ ধরা পড়েনি। শয়তানি একটা তুচ্ছ ব্যাপার। সে রকম পরিস্থিতিতে পড়লে, আমরা যে কেউ তা করতে পারি।
যেন আগুনে ঘি পড়ল! লোকজন রে-রে করে উঠল হানার প্রতিবেদন পড়ে। অনেকের মতে, হানা আইখমানের হয়ে সাফাই গাইলেন। তাঁকে দোষমুক্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন। এমনকি হানার বন্ধুবান্ধবীরাও ছি ছি করতে লাগলেন। ব্যতিক্রম এক জন। স্ট্যানলি মিলগ্রাম। আমেরিকায় ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক। জন্ম ইহুদি পরিবারে। সে কারণেই হলোকস্টের ব্যাপারে আগ্রহ স্বাভাবিক। হানার নতুন থিয়োরিতেও তাঁর কৌতূহল। আইখমান এবং আরও নাৎসি অফিসাররা কি শুধুই হুকুম তামিল করেছিলেন? নুরেমবুর্গ শহরে যুদ্ধাপরাধী অফিসারদের যে বিচার হয়, তাতেও অফিসাররা নিজেদের সাফাই গেয়েছিলেন ওই একই যুক্তিতেই। ব্যাপারটা মনস্তত্ত্বের। ওই বিষয়ের প্রফেসর হিসেবেই মিলগ্রাম বিষয়টা খতিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। ১৯৬১ সালে পরিকল্পনা করলেন এক এক্সপেরিমেন্টের। এ বছর ওই এক্সপেরিমেন্টের ডায়মন্ড জুবিলি।
১৮ জুন, ১৯৬১। ইয়েল ইউনিভার্সিটি যে শহরে অবস্থিত, সেখানকার পয়লা নম্বর খবরের কাগজ ‘নিউ হাভেন রেজিস্টার’-এ পুরো পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন বেরোল। ‘স্মৃতিশক্তি পরীক্ষার জন্য লোকজন চাই। আপনার এক ঘণ্টা সময় আমাদের ল্যাবরেটরিতে ব্যয় করার জন্য পাবেন চার ডলার।’ বিজ্ঞাপনে কাজ হল। এলেন শ’য়ে শ’য়ে ভলান্টিয়ার। তাঁদের ভূমিকা? শিক্ষক। ওঁরা ছাত্রদের পড়াবেন। কী পড়াবেন? শব্দের সঙ্গে শব্দ ম্যাচ করানো। এক বার শিখিয়ে তার পর পড়া ধরা।
তখন ছাত্ররা ভুল করলে শাস্তি। শাস্তি দেওয়ার হুকুম দেবেন এক কর্তাব্যক্তি। কী শাস্তি? ইলেকট্রিক শক। ক্রমাগত ভুল করে চললে ছাত্রের শাস্তির পরিমাণও বাড়বে। প্রথম বার ভুল করলে ১৫ ভোল্টের শক। পরের বার ভুল করলে ৩০ ভোল্টের শক। এ রকম করে বাড়তে বাড়তে ৪৫০ ভোল্ট অবধি ইলেকট্রিক শক। ৪৫০ ভোল্টের শক পেলে কেউ বাঁচে না। মরেই যায়। তার বহু আগে শকের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়ে চলার সময়ই ছাত্ররা যন্ত্রণায় চিৎকার করতে শুরু করে।
আসলে, হুকুম দেওয়ার কর্তাব্যক্তিটি এবং ছাত্ররা— সবই সাজানো। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ফেক’। আর সবচেয়ে বড় কথা, শক দেওয়ার মেশিনটিও ফেক। কর্তাব্যক্তিটি এবং ছাত্ররা সবাই মিলগ্রামের ছাত্রছাত্রী। শক মেশিনে ইলেকট্রিক শকের ব্যবস্থা নেই। সবই অভিনয়। এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে শিক্ষকদের, যাঁরা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে ভলান্টিয়ার হতে এসেছেন। কর্তাব্যক্তির হুকুম মেনে তাঁরা নকল শক দিয়ে যান কি না, তা পরীক্ষা করা। নকল শকের পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে কর্তাব্যক্তির হুকুমও বদলাবে। প্রথমে, নকল শকের পরিমাণ যখন কম, তখন যদি হুকুম হয়, ‘দয়া করে চালিয়ে যান’, তা হলে পরের ধাপগুলো হবে এ রকম : ‘পরীক্ষা আপনাকে চালিয়ে যেতে বলছে’, ‘আপনাকে অবশ্যই চালিয়ে যেতে হবে’ এবং ‘চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আপনার অন্য পথ খোলা নেই’। নকল শক পাওয়া ছাত্ররা শিক্ষকদের সঙ্গে এক ঘরে বসবে না। যাতে নকল শক খেয়ে যন্ত্রণায় চিৎকার—এবং শক বাড়লে নিস্তেজ হয়ে গিয়ে মরার— অভিনয় শিক্ষক টের না পান।
পরীক্ষার ফল? হ্যাঁ, দেখা গেল, ৬৫ শতাংশ শিক্ষক বা ভলান্টিয়ার ছাত্রকে শাস্তি দিতে ৪৫০ ভোল্টের শক দিয়ে গেলেন। ছাত্ররা ৪৫০ ভোল্টের শক খাওয়ার অনেক আগেই নিস্তেজ হয়ে গিয়ে মরার অভিনয় করার পরও তারা শক চালিয়ে গেলেন। তাঁরা কারা? সমাজের সাধারণ মানুষ। অর্থাৎ, পরীক্ষার ফলাফল পরিষ্কার। মনুষ্যচরিত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সারমেয়-সদৃশ। যে কোনও হুকুম তামিল করায় সে পটু। নুরেমবুর্গ শহরে বিচারকালে একের পর এক নাৎসি অফিসার নিজেদের সাফাই গেয়ে বলতেন, ‘বেফেল ইস্ট বেফেল (হুকুম মানে হুকুম)।’ ওরা শয়তান নয়, সাধারণ মানুষ। আমেরিকায় জনপ্রিয় টেলিভিশন প্রোগ্রাম ‘সিক্সটি মিনিটস’ পরীক্ষার ফলাফল জানার জন্য আমন্ত্রণ জানাল মিলগ্রামকে। অনুষ্ঠানে তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন, ‘আমেরিকায় যদি গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে মানুষ মারার ব্যবস্থা গড়া হয়, তা হলে সে গ্যাস চেম্বার পরিচালনার জন্য প্রচুর আমেরিকান পাওয়া যাবে।’ নাৎসি অফিসারদের শয়তান ভাবা ভুল, শয়তানি মনুষ্যচরিত্রেই মিশে আছে। বেনালিটি অব ইভিল। হানা যে তত্ত্ব খাড়া করলেন, তার পরীক্ষামূলক প্রমাণ জোগালেন মিলগ্রাম।
১৯৬৩। মিলগ্রাম তাঁর এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল সবিস্তার লিখলেন ‘জার্নাল অব অ্যাবনরমাল অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকোলজি’ পত্রিকায়। শুরু হয়ে গেল প্রতিক্রিয়া। ‘দি নিউ ইয়র্ক টাইম্স’-এ বিখ্যাত বিজ্ঞান সাংবাদিক ওয়াল্টার সুলিভান লিখলেন রিপোর্ট। ‘সিক্সটি ফাইভ পারসেন্ট ইন টেস্ট ব্লাইন্ডলি ওবে অর্ডার টু ইনফ্লিক্ট পেন’। এক সপ্তাহ পর, ‘সেন্ট লুই পোস্ট ডিসপ্যাচ’ কাগজে মিলগ্রাম এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়কে তুলোধোনা করে সম্পাদকীয় লেখা হল। ভলান্টিয়াররা তো জানছে না শক নকল। তারা তো জেনেবুঝে ইলেকট্রিক শক দিচ্ছে। এ রকম একটা পরীক্ষা চালানোর অনুমতি দিল কে বা কারা? শুরু হল বিতর্ক। চাপে পড়ে নীতির দোহাই দিয়ে আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন আটকে রাখল মিলগ্রামের সভ্যপদ। অবশ্য ১৯৬৪ সালে আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স-এর পক্ষ থেকে ওঁকে দেওয়া হল মনস্তত্ত্ব গবেষণার জন্য পুরস্কার। ১৯৭৪ সালে মিলগ্রাম লিখলেন বই— ‘ওবিডিয়েন্স টু অথরিটি: অ্যান এক্সপেরিমেন্টাল ভিউ’।
মিলগ্রাম যদি তাঁর এক্সপেরিমেন্ট করতে নামেন আইখমানের বিচারের রিপোর্ট পড়ে, তবে আর এক জনও মনস্তত্ত্বের আর এক পরীক্ষা করেন সমসাময়িক আর এক ঘটনা দেখে। তিনি মিলগ্রামের স্কুলের বন্ধু ফিলিপ জর্জ জ়িমবারডো। ১৯৭১ সালে তিনি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে সাইকোলজির প্রফেসর। ওই বছর আমেরিকার রাজনৈতিক জীবনে ঝড়। চলেছে ভিয়েতনাম যুদ্ধ। যুবকদের তাতে যোগ দিতে আমেরিকার সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে হচ্ছে। পৃথিবীর বিপরীত গোলার্ধে যুদ্ধে তারা মারা পড়ছে। কী লাভ ওই যুদ্ধে? প্রশ্নে আমেরিকার কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে যুবক-যুবতীরা আন্দোলনে উত্তাল। তার ওপরে আর এক খবর। ঘোর আপত্তিকর। আমেরিকান সেনারা ভিয়েতনামি জনগণের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছে। ভদ্র শিক্ষিত যুবকেরা কী করে ও রকম অত্যাচারী হয়? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে জ়িমবারডো পরীক্ষায় নামলেন। সে পরীক্ষারও গোল্ডেন জুবিলি এ বছর।
ওঁর পরীক্ষা স্ট্যানফোর্ড প্রিজ়ন এক্সপেরিমেন্ট নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। পরীক্ষা কেমন? ১৫ অগস্ট, ১৯৭১। ভোরবেলা। আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে পালো অল্টো শহরে পুলিশ এসে কিছু বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল। গৃহস্বামী দরজা খুললে প্রত্যেক বাড়ি থেকে এক জন করে যুবকের ঘুম ভাঙাল। হাতকড়া পরিয়ে ভ্যানে তুলল। প্রতিবেশীরা জানলায় উঁকি মেরে থ। এরা অপরাধী! মোট ২৪ জন যুবককে নিয়ে আসা হল এক জেলখানার সামনে। হোর্ডিংয়ে বড় বড় করে লেখা ‘স্ট্যানফোর্ড কাউন্টি জেল’। নকল জেলখানা ওটা। আসলে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টকে জেলখানা হিসেবে সাজানো হয়েছে। ভেতরে ছ’ফুট বা ন’ফুটের ছোট ছোট কুঠুরি। এক-একটা সেল। জেলখানা যেমন নকল, তেমনই যুবকরাও কেউই নয় অপরাধী। ওরা পরীক্ষার জন্য গিনিপিগ। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনের উত্তর দিয়ে নির্বাচিত হওয়ায় আনা হয়েছে। ওই ভলান্টিয়ারদের জিজ্ঞেস করা হল, কী হতে চাও— গার্ড না বন্দি? প্রায় সবাই বলল, গার্ডকে কেউ পছন্দ করে না, বন্দি হওয়া অনেক ভাল। শেষে কয়েন টস করে ভূমিকা নির্ধারিত হল। কয়েকজন গার্ড, বাকি সবাই বন্দি। জ়িমবারডো নিজে জেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট।
শুরু হল পরীক্ষা। গার্ডদের নাম থাকলেও বন্দিদের তা নেই, তারা শুধুই নম্বর। গার্ডরা এমন অত্যাচার শুরু করল যে, বন্দিদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেলে একটা বালতি, তার মধ্যেই মলমূত্র ত্যাগ। দুর্গন্ধে টেকা দায়। যখন-তখন বন্দিদের হাত পা শেকলে বাঁধা। একটু কথার অবাধ্য হলে লাঠির বাড়ি তো আছেই। দ্বিতীয় দিনেই বন্দিরা বিদ্রোহ করল। দমন করতে গার্ডরা ছুড়ল জলকামান। কয়েকজন বন্দি নিদ্রাহীনতার শিকার। কয়েদি নম্বর ৮৬১২ সেলের দরজায় মাথা ঠুকে চেঁচাতে লাগল, ‘তোমরা বুঝতে পারছ না। ভেতরে আমি জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছি। আমি মুক্তি চাই। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আর একটা রাত, ওহ্ অসহ্য!’ গার্ডরা তাকে মুক্তি দিল না। পরীক্ষা চলার কথা ছিল ১৪ থেকে ২১ দিন। ছ’দিনের মাথায় মনস্তত্ত্বের পিএইচ ডির ছাত্রী ক্রিশ্চিনা মাসলাক (পরে জ়িমবারডোর স্ত্রী) ওঁকে বললেন, ‘বন্দি যুবকদের মানসিক ক্ষতির জন্য তুমি দায়ী হবে।’ জ়িমবারডো সে দিনই বন্ধ করে দিলেন পরীক্ষা।
কেন গার্ডরা বিষম অত্যাচারী হয়ে উঠল? ব্যাখ্যা দিলেন জ়িমবারডো। ক্ষমতা ইন্ধন জুগিয়েছে অত্যাচারের। এক দিকে ক্ষমতা, অন্য দিকে অসহায়তা। জ়িমবারডোর কথায়, বন্দিরা অসহায়। অসহায়তার শুরু নকল পুলিশের হাতে ওদের গ্রেফতার হওয়ার সময় থেকে। ওই যে প্রতিবেশীরা উঁকি মেরে দেখল ওদের ভ্যানে তোলা হচ্ছে, সেই সময় ওরা লজ্জা পেল। হীনমন্যতার শুরু। তা আরও বেড়ে গেল নাম হারিয়ে ওরা যখন এক-একটা সংখ্যায় পরিণত হল। উল্টো দিকে গার্ডরা দেখল, বন্দিরা অসহায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি ওদের ক্ষমতাবান করে তুলল। বন্দিদের অসহায়তাই গার্ডদের অত্যাচারী হয়ে উঠতে সাহায্য করল। ভিয়েতনামিরা অসহায় বলেই আমেরিকান সেনারা ওদের ওপর অকথ্য অত্যাচার করেছে। মানুষ পরিস্থিতির দাস। ক্ষমতা পেলে ক্ষমতাবানরা অসহায়ের ওপর সেই ক্ষমতা ফলায়। কেউই শয়তান বা ভাল নয়। পরিস্থিতি মানুষকে শয়তান বা ভাল করে তোলে। সেই বেনালিটি অব ইভিল। শয়তানি একটা তুচ্ছ ব্যাপার। যে কোনও সময় মানুষের মধ্যে আসতে পারে।
এই স্ট্যানফোর্ড প্রিজ়ন এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে কিন্তু বিতর্ক আছে। অনেকে অভিযোগ করেন, এক্সপেরিমেন্টার হিসেবে জ়িমবারডো গার্ডদের বেশি বেশি করে অত্যাচারী হতে ‘নির্দেশ’ দিয়েছিলেন। যাতে তাঁর পরীক্ষার ফলাফল প্রকট হয়, আর তিনি তা ফলাও করে প্রচার করতে পারেন। নির্দেশ বা প্ররোচনা নিয়ে কিছু বলেননি জ়িমবারডো। তবে ঠারেঠোরে তা স্বীকারও করে নিয়েছেন এক রকম। লিখেছেন, ‘যখন দরকার ছিল, তখন আমি পরীক্ষায় পর্যাপ্ত নজরদারি করতে পারিনি। ফলাফল এসেছিল মানবিক কষ্টের বিনিময়ে। তার জন্য আমি দুঃখিত। আজও ক্ষমা চাইছি ওই অমানবিকতায় মদত জোগানোর জন্য।’
২০০৩। আমেরিকা দখল করে নিয়েছে ইরাক। প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন পলাতক। বাগদাদ শহরের ৩২ কিলোমিটার পশ্চিমে আবু ঘ্রাইব কারাগারে বন্দি তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ। তাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার। মলমূত্র ত্যাগে বাধাদান থেকে শুরু করে উলঙ্গ করে যৌনসঙ্গমের অভিনয় করতে বাধ্য করা। আমেরিকান সেনাদের কীর্তি। ধন্য ও দেশের সাংবাদিকতা। জেলের বাইরে বেরোল অত্যাচারের ছবি। দেখাল সিবিএস নিউজ়। পৃথিবী জুড়ে হইচই। আমেরিকা না সভ্য দেশ? সে দেশের এ হেন আচরণ! ছিঃ! আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। তাঁর প্রশাসন ব্যাপারটা প্রথমে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করল। পারল না। বসাতে হল তদন্ত কমিশন। বিশেষজ্ঞ হিসেবে ডাকা হল জ়িমবারডোকে। তিনি বললেন, জেলরক্ষীদের অত্যাচারী হতে সময় লাগে না। ২০০৭। স্ট্যানফোর্ড প্রিজ়ন এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে তিনি বই লিখলেন— ‘দি লুসিফার এফেক্ট: আন্ডারস্ট্যান্ডিং হাউ গুড পিপল টার্ন ইভিল’।
উপন্যাসে কিংবা চলচ্চিত্রে ঘুরে-ফিরে আসে মিলগ্রাম এবং জ়িমবারডোর এক্সপেরিমেন্ট। ২০১৫ সালে তৈরি হয়েছে দুটো ছবি। কাইল প্যাট্রিক আলভারেজ-এর পরিচালনায় ‘দি স্ট্যানফোর্ড প্রিজ়ন এক্সপেরিমেন্ট’ এবং মাইকেল আলমেরেইডা-র পরিচালনায় ‘এক্সপেরিমেন্টার’। দ্বিতীয় ফিল্ম অবশ্যই মিলগ্রামের পরীক্ষা নিয়ে। প্রথম চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে বন্দি ৮৬১২-এর ওপর মানসিক অত্যাচার। গোপনাঙ্গের চুলে উকুন তাড়াতে হবে তার। তাই তাকে চটপট ল্যাংটো হতে বলা হচ্ছে।
আর সাইকোলজিস্টরা এখনও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে করে যাচ্ছেন স্ট্যানলি মিলগ্রামের পরীক্ষা। মাত্র পাঁচ বছর আগেও ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক প্যাট্রিক হ্যাগার্ড করেন পরীক্ষা। বিজ্ঞানের জার্নাল ‘নেচার’ পরীক্ষাটিকে বলেছিল ‘থরোলি মডার্ন মিলগ্রাম’। পরীক্ষায় হ্যাগার্ড দু’জন দু’জন করে টেবিলের এ দিকে-ও দিকে বসান এজেন্ট এবং ভিক্টিমকে। টেবিলের পাশে দাঁড়ান এক্সপেরিমেন্টর। ভিক্টিম ভুল করলে থাকে তার তরফে এজেন্টকে পাঁচ পেন্স করে দেওয়ার ব্যবস্থা। এজেন্টের সে শাস্তি পছন্দ না হলে তিনি ভিক্টিমকে ইলেকট্রিক শকও দিতে পারেন। তার সামনে দুটো সুইচ আছে। একটা সুইচ টিপলে কিছু হয় না, অন্যটা টিপলে ভিক্টিমের ইলেকট্রিক শক লাগে। সত্যিকারের শক।
তবে ভিক্টিমের সহ্যসীমার মধ্যে। এজেন্ট শক দেবে কি না, তা নির্ভর করবে এক্সপেরিমেন্টারের নির্দেশের ওপর।
এ রকম আয়োজনের পর শুরু হল পরীক্ষা। ভিক্টিম ভুল করল। সে পাঁচ পেন্স জরিমানা দিয়ে ছাড় পেল। কিছু ভিক্টিম তা পেল না। কোনও ক্ষেত্রে এক্সপেরিমেন্টারের নির্দেশে এজেন্টকে স্পষ্ট করে বলা হল, দুটো সুইচের মধ্যে যে সুইচটায় ভিক্টিমকে শক দেওয়া যায়, সেটি টিপতে। আবার কোনও ক্ষেত্রে এক্সপেরিমেন্টর মুখ ঘুরিয়ে থাকল। এজেন্টকে বলল, দু’টি সুইচের মধ্যে যে কোনওটা টিপতে। অর্থাৎ, এজেন্ট ভিক্টমকে শক দিল বা দিল না। এ বার সুইচ টেপার কয়েক মিলিসেকেন্ড পর একটা ঘণ্টা বাজল। এজেন্টকে বলা হল, তার সুইচ টেপার এবং ঘণ্টা বাজার মধ্যে সময়ের ব্যবধান খেয়াল করতে। দেখা গেল, যে সব ক্ষেত্রে এক্সপেরিমেন্টর মুখ ঘুরিয়ে ছিল অন্য দিকে, এজেন্ট স্বেচ্ছায় সুইচ টিপেছে, সে সব ক্ষেত্রে এজেন্টের মনে হয়েছে, ঘণ্টা আগে বেজেছে। আর যে সব ক্ষেত্রে এক্সপেরিমেন্টর সরাসরি এজেন্টকে দেখিয়ে দিয়েছে, কোন সুইচটা টিপতে হবে, সে সব ক্ষেত্রে এজেন্ট বলছে, ঘণ্টা পরে বেজেছে। আসলে কিন্তু দু’ক্ষেত্রেই সুইচ টেপা এবং ঘণ্টা বাজার মধ্যে সময়ের ব্যবধান এক। তা হলে কেন এজেন্ট বলছে, ঘণ্টা আগে-পরে বেজেছে? ওটা এজেন্টের মনের ভুল। মন স্বেচ্ছায় কাজ এবং তার প্রতিক্রিয়াকে চটজলদি ভাবে। অন্যের নির্দেশে কাজ এবং তার প্রতিক্রিয়াকে দেরিতে ঠাহর করে।
হ্যাগার্ড এজেন্টদের মস্তিষ্কের ইইজি করে দেখেছেন, অন্যের নির্দেশে কাজ করলে মন সে কাজের দায় কম ভাবে। এটাই নিয়ম। এটাই তো দেখাতে চেয়েছিলেন মিলগ্রাম। তাই নয় কি?
ফিরে আসি বিস্ময়ের প্রসঙ্গে। অতুল্য ঘোষ কেন উৎসুক হয়েছিলেন হানা আরেনড্ট-এর রচনায়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy