নিমগ্ন: সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অপরাজিত’ ছবির কিশোর অপু। প্রধানশিক্ষকের দেওয়া ভূগোলকটি গভীর মনোযোগে নিরীক্ষণরত ।
খোলা আশমান। নীচে সাঁইসাঁই ঘুরে চলেছে অক্ষ-দ্রাঘিমায় বিন্যস্ত একটি নিপাট বর্তুল ভূগোলক! গ্লোবের উপর ঠায় বসে, পা দুটো ঈষৎ ঝুলিয়ে অন্তরিক্ষে সটান চেয়ে আছেন জনৈক। ছবির তলায় অব্যর্থ ক্যাপশন: ‘হুতোম প্যাঁচা আশমানে বসে নকশা উড়াচ্চেন।’ ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-র এমন অলঙ্করণ মিলবে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত সংস্করণে। এ ছবি কিঞ্চিৎ কৌতুকী। এবং, খানিক প্রতীকীও বটে!
ঘটনাচক্রে, উনিশ শতক পর্যন্ত গ্লোব-ই হয়ে উঠেছিল আশমান-জমিনে বাঙালির দুনিয়াদারির অনিবার্য যষ্টি! বস্তুত, পৃথিবীটা যে দেখতে কেমন, তা নিয়ে কোনও নিঃসন্দেহ ঐকমত্য ঔপনিবেশিক আমলের আগে ছিল না অন্তত। তন্ত্রে সে ত্রিকোণাকার, কূর্মপুরাণে সমতল, আবার সিদ্ধান্তশাস্ত্রে গোল। আর, পুরাণে বলত, পৃথিবী বুঝি বা সাপের মাথায় দাঁড়িয়ে— তাকে পিঠে বইছে কচ্ছপ, আর চার কোণে দাঁড়িয়ে আছে চারটে হাতি। আবার এ-ও শোনা যেত, মহাশূন্যে সে নাকি ভীষণই নির্ভার— ঠায় ঝুলে রয়েছে আলম্বহীন, একাকী।
প্রশ্ন হল, গ্লোবের ইতিহাস জানা আদৌ জরুরি কেন? উত্তরটা সহজ। পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত, গ্লোব পৃথিবীকে যে ভঙ্গিতে দেখিয়েছে, তার কোনও পূর্বাপর নমুনা নেই! গ্লোবের সুবাদেই, বিশ্বচরাচর তার যাবতীয় রক্তমাংস ছেঁটে হয়ে উঠেছিল দখলযোগ্য জড়বস্তু-বিশেষ। এক দিকে দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার তাগিদ, অন্য দিকে সাম্রাজ্যবিস্তার ও অদেখা জমির মারীচী আকর্ষণ— দুইয়ের রসায়নে ‘বিশ্ব’ পর্যবসিত হল নেহাতই ভোগ্যবস্তুতে। হাইডেগার-এর লব্জ ধার করলে বলা যায়, দুনিয়া হয়ে উঠল নেহাতই দৃশ্যমান ছবি! কোপারনিকাস, ব্রুনো, কেপলার, নিউটনদের মধ্যস্থতার পর পৃথিবী সংক্রান্ত কোনও কল্পনাই আর আগের মতো থাকল না। জার্মান আইনবেত্তা কার্ল শ্মিট যাঁকে বলবেন, ‘স্পেশিয়াল রেভলিউশন’— স্থানিকতার বিপ্লব! আশমান আর জমিনে ঘটে গেল অনিবার্য বিচ্ছেদ, ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ পরিত্যাজ্য হল জ্যোতির্বিদ্যার নয়া পাঠে। এত দিনের চেনা, ত্রিমাত্রিক বিশ্বপট পর্যবসিত হতে থাকল নেহাতই দ্বিমাত্রিক একটা গ্লোবের ধারণায়। ঘটনাচক্রে, এই মুহূর্তের প্রাচীনতম গ্লোবটি ১৪৯২ সালের— যা সংরক্ষিত আছে নুরেমবার্গ জাদুঘরে। গ্লোবের ইতিহাসবিদ সিলভিয়া সুমিত্রা জানাচ্ছেন, ষোড়শ শতক থেকেই ইউরোপে বহুলপ্রচারিত হতে থাকছিল ছাপা, কিংবা হাতে-বানানো গ্লোব। আঠেরো শতক থেকে গ্লোবের উত্তুঙ্গ দাপটে বিলেতের ক্লাসঘর ছেয়ে যেতে থাকল। আর উনিশ শতকে এসে, গ্লোব পড়তে-পারা ক্রমে হয়ে উঠল এক ধরনের সাক্ষরতা: ভূগোল-সাক্ষরতা!
কিন্তু বাংলায়? সেখানে গ্লোবের বিস্তার অবশ্য এতটা সোজাসাপটা নয়। সেই বিবর্তনে মিশে আছে ঔপনিবেশিকতার গন্ধ ও দোলাচল, হাজারো জ্ঞানতত্ত্বের বিনিময় আর সংঘাতের আলোছায়া। পৃথিবী যে আসলে কেমন দেখতে, ঔপনিবেশিক আমলের আগে উপমহাদেশে সে বিষয়ে কোনও শেষ কথা ছিল না। ক্রিস বেইলি লিখছেন, ভূমণ্ডলের চরিত্রনির্ণয়ের বেলায় প্রাক্-ঔপনিবেশিক নদিয়া, বারাণসী, গয়া কিংবা উজ্জয়িনীর পণ্ডিতসমাজের মতামত কখনওই মিলবে না। একটা উদাহরণ দেখা যাক। উনিশ শতকের ব্রাহ্মমুহূর্তে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বার করছে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ‘রাজাবলি’। সে বইয়ের সূচনাতেই বিশদ পৃথিবীবর্ণনা! “পাঞ্চভৌতিক এই ভূমিপিণ্ড কেবল শূন্যের উপরে আছেন। ভূমিপিণ্ডের ধারণকর্ত্তা মূর্ত্তিমান কেহ নাই।... এই ভূমিপিণ্ডের অর্দ্ধেক লবণ সমুদ্রের উত্তর এই জম্বুদ্বীপ।... আর অর্দ্ধেকেতে জম্বুদ্বীপের দক্ষিণ দিকে... ছয় দ্বীপের ও... সপ্ত সমুদ্রের সন্নিবেশ হইয়াছে এই রূপে পৃথিবী সপ্তদ্বীপা।”— ১৮০৮ সালে প্রকাশিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের এই বইয়ে পৃথিবী হাজিরা দেয় আগাপাশতলা পৌরাণিক অনুষঙ্গে। গোলীয়তার ঈষৎ নামগন্ধও এখানে মিলবে না!
তা হলে কবে ও কোন উপায়ে ইউরোপীয় জ্যোতির্বিদ্যার কিসিমগুলি আত্মস্থ করল বাঙালি? এই উত্তরের জন্য তাকাতে হবে বাংলা ভাষায় লেখা আদিপর্বের ভূগোল পাঠ্যবইয়ের দিকে। উনিশ শতক পর্যন্ত পৃথিবীর নতুন চেহারাটা বাংলা ভাষায় প্রচারিত হচ্ছিল শ্রীরামপুর মিশন কিংবা স্কুল বুক সোসাইটির এ সব পাঠ্যবই-মারফত। ধরা যাক, ১৮১৮ সালে স্কুল বুক সোসাইটিতে প্রকাশিত পিয়ার্স সাহেবের ভূগোলবইয়ের অনুবাদ, ‘ভূগোল বৃত্তান্ত’। আবির্ভাবেই নিরঙ্কুশ সুপারহিট, তিন দশকে এ বই বিকিয়েছে ৯০০০ কপিরও বেশি! বইটির সুদীর্ঘ উপশিরোনাম চোখে পড়লেই মালুম হবে পৃথিবীর আদত আকার কেমন: “গোলাকার পৃথিবীর দেশ বিভাগ, ও নদী, ও পর্ব্বত নগর, আর রাজত্ব, ও ধর্ম্ম, ও মনুষ্যসংখ্যা, ও বাণিজ্য, ও প্রাচীন সত্য ইতিহাস, ইত্যাদি বিবরণ!” এর ঠিক পরের বছর, শ্রীরামপুর মিশনের ভূগোল সংক্রান্ত শ্রুতিলিখন-বই ‘জ্যোতিষ এবং গোলাধ্যায়’ ঘোষণা করে: “পৃথিবী প্রায় গোলাকৃতি কিন্তু সর্ব্বতোভাবে গোল নহে উত্তর দক্ষিণ কেন্দ্রে কিঞ্চিৎ চাপা আছে।” ঠিক কেমন চাপা? ১৮২৪-এ, স্কুল বুক সোসাইটির আরও একটি বই, ‘ভূগোল এবং জ্যোতিষ ইত্যাদি বিষয়ক কথোপকথন’-এর গোড়ায় পাচ্ছি দুই বন্ধু নিত্যানন্দ আর পরমানন্দের কথোপকথন। সতত-কৌতূহলী নিত্যানন্দ তার বন্ধুকে বলছে: “ভাই পরমানন্দ,... এই জিজ্ঞাসা করি, যে পৃথিবীর আকার কেমন?” সর্বজ্ঞ বন্ধুর ঝটিতি জবাব: “তবে শোন, পৃথিবীর আকার গোল, কিন্তু সর্ব্বতোভাবে গোল নয়, ফলতঃ উত্তর দক্ষিণাংশে কিঞ্চিৎ চাপা আছে। তার একটা দৃষ্টান্ত স্থল বাতাবিলেবু... যেমন তাহার বোঁটার নিকট ও নীচে কিঞ্চিৎ নিম্ন থাকে পৃথিবীরআকারও তেমনি।”
বস্তুত, এ বাংলায় ভূগোলের সম্প্রসারণ আর পৃথিবীর নিরেট গোলীয়তার বয়ানটুকু ছিল একে অন্যের নিটোল সম্পূরক। পরবর্তী আধ শতকব্যাপী কার্যত প্রতিটি বাংলা ভূগোল বই-ই আরম্ভ হয়েছে পৃথিবীর গোলীয়তার অনিবার্য বুড়িটুকু ছুঁয়ে। শোনা যায়, ভূমণ্ডলের গ্লোব-চেহারার প্রথম বাংলা ম্যাপ বানিয়েছিলেন জনৈক কাশীনাথ, স্কুল বুক সোসাইটির মন্টেগ সাহেবের নজরদারিতে যা ছাপা হয়েছিল ১৮২১ সালে। একই ভাবে, ওই সময়ের অজস্র বইয়ের টাইট্ল পেজ বা ফাঁকফোকর খুঁড়লে পাওয়া যাবে গ্লোবের সবেধন আইকনকে। ১৮৭০-এর দশকে বেরোনো গোপালচন্দ্র বসুর ‘ভূগোল সূত্র’, কিংবা নৃসিংহচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রাকৃতিক ভূগোল’-এর পাতা ওল্টালেই দিব্য টের পাওয়া যায় গ্রহের নয়া চেহারাটুকু! পৃথিবীর গোলীয়তাকে সপ্রমাণ সাব্যস্ত করতে, সে সব বইয়ে সাজানো থাকত দৈনন্দিনের বাছাই চার-পাঁচটি অভিজ্ঞতা। এক, জাহাজে চড়লে সমুদ্রের গভীরে যতই যাওয়া যায়, দূরের তীরগুলি ক্রমে অদৃশ্য হতে থাকে। বন্দরের মাস্তুল আবছা হয়ে আসে। এ যদি পৃথিবীর গোলকত্বের অব্যর্থ টিপসই না হয়, আর কী! দুই, পৃথিবী সমতল হলে, কিষাণগঞ্জ কি রায়গঞ্জ থেকে সোজা তাকালেই হিমালয় উল্লম্ব দেখা যেত। তা যায় না। তিন, একই সময়ে পৃথিবীব্যাপী সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত ঘটত। হয় না তা-ও। চার, এবং জরুরিতম: গ্রহণ। চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবীর গোলাকার ছায়া পড়ে চাঁদের গায়ে। তত দিনে ঔপনিবেশিক জ্যোতির্বিদ্যায় পারঙ্গম বঙ্গসন্তান গাণিতিক জ্যোতিষ থেকে ছেঁটে ফেলেছে ফলিত জ্যোতিষকে। রাহু-কেতুর গপ্পো আর মেরু পর্বতের চতুর্দিকে সূর্যের রথ চালানোর আখ্যান তত দিনে পর্যবসিত নিতান্ত নির্জলা কল্পনায়। পৃথিবীর গোলীয়তাকে যথাযথ শনাক্ত করতে প্রত্যক্ষবাদে দীক্ষিত বাঙালির তখন হাতেগরম প্রমাণ চাই। সাক্ষাৎ, অকাট্য।
প্রমাণ অবশ্য ছিল আরও এক রকম। বিস্তর ব্রিটিশ ভূগোল বই পড়ে পড়ে বাঙালি ধরে ফেলেছে, পৃথিবীর গোলীয়তার সব চেয়ে বড় প্রমাণ: ভূপ্রদক্ষিণ! ক্লিফট, কিথ, মিচেলেস-এর ভূগোলতত্ত্ব পড়ে বাঙালি জেনেছে, দরিয়া-বরাবর জাহাজ হাঁকিয়ে সটান চলতে আরম্ভ করলে ফের আট-ন’ মাসের মধ্যেই পুরনো বিন্দুতে ফিরে আসা যায়। উনিশ শতাব্দীর বাংলা ভূগোল বইয়ের পাতায় আস্তে আস্তে উঠে আসবেন ড্রেক, সাইমন করডিস, ব্যান সুটেন, হাইজনস-রা। মহাবিদ্রোহের কয়েক মাস আগে, গ্লোব-বিতর্কের সদর ল্যাবরেটরি শ্রীরামপুরেই চার খণ্ড বিপুল ‘ভূগোল-বিজ্ঞাপক’ লিখছেন কালিদাস মৈত্র। প্রথমেই অবধারিত প্রশ্ন— পৃথিবী আদতে কেমন? কালিদাসের উত্তর: তা একটি ‘গোলাকার’, ‘সচল’ এবং ‘নতন্নোতকার’ পদার্থবিশেষ। এমন নিদানের ঠিক পাশাপাশি, বাছাই অংশে ভূপর্যটকদের নামের এক গুচ্ছ ফিরিস্তি— ম্যাগেলান থেকে আরম্ভ করে সটান ক্যাপ্টেন কুক, ১৫১৯ থেকে ১৮২৩! জাহাজের অবাধ দুনিয়াদারি হয়ে ক্রমেই হয়ে উঠল গ্লোবের সাক্ষাৎ প্রমাণ। সাম্রাজ্যবিস্তার আর অবাধ বাণিজ্যের যুক্তি মিলেমিশে গেল নিপাট ভূগোলচর্চায়!
কিন্তু সে দিনের তক্কাতক্কি কেবল এখানেই আটকে ছিল না। বাহ্য লক্ষণের চৌহদ্দি ডিঙিয়ে বাঙালি ভূগোল-লেখকরা পৃথিবীর উপমা ফাঁদতে থাকলেন। প্রত্যক্ষ নয়, অতঃপর উপমানের শরণ! পৃথিবীটা দেখতে কেমন আদৌ? সে কি কমলালেবু, না বাতাবিলেবু? ১৮৫০ দশকে বারাসতের ছাত্রীদের জন্য লেখা টেক্সটবই ‘ভূগোল-বৃত্তান্ত’-র ভোট পড়বে বাতাবিলেবুতেই। আবার, তত্ত্ববোধিনী সভার ভূগোল বইতে অক্ষয়কুমার দত্ত জানাবেন, “যেমন কমলালেবু গোলাকার অথচ তাহার বোঁটার নিকট কিঞ্চিৎ নিম্ন, সেইরূপ পৃথিবীও গোল কিন্তু উত্তর-দক্ষিণে কিঞ্চিৎ চাপা।” উপমার অভিনব প্রয়োগে গ্লোব আর ইউরোপের হাতফেরতা আমদানি থাকছিল না— হয়ে উঠছিল নিতান্তই ঘরোয়া, প্রাত্যহিকে মথিত পণ্যবিশেষ। আর এখানেই বিপর্যয়! বাংলায় ভূগোলচর্চার অন্যতম ঋত্বিক, রাজেন্দ্রলাল মিত্র ‘প্রাকৃত ভূগোল’-এর পাতায় লিখছেন: “পৃথিবী কদম্বকুসুমবৎ গোলাকার, পরন্তু তাহার দেহের উপরিভাহ সম নহে; কোন স্থান উচ্চ কোন স্থান নিম্নভাবে অবস্থিতি করিতেছে।”
বাতাবিলেবু বা কমলালেবু ইংরিজির হাতফেরতা অনুবাদ, এ না-হয় বোঝা গেল৷ কিন্তু ইউরোপীয় ভূগোলে দস্তুরমতো দীক্ষিত রাজেন্দ্রলাল পৃথিবী ‘কদম্বকুসুমবৎ’-ই বা বলবেন কেন? এমন অদ্ভূতুড়ে উপমার উৎস কী? আসলে, সিদ্ধান্তজ্যোতিষ ঘাঁটলে বোঝা যাবে, রাজেন্দ্রলাল এই উপমা ধার নিয়েছেন খোদ ভাস্করাচার্যের থেকে! ‘গোলাধ্যায়’-এর একটি শ্লোকে ভাস্করাচার্য বলছেন, “সর্ব্বতঃ পর্ব্বতারাম গ্রাম বৈত্যভয়ৈশ্চিতঃ/ কদম্ব কুসুম গ্রন্থিঃ কেসর প্রসরৈরিব।” অর্থাৎ, কদমফুলের গ্রন্থি যেমন কেশরে আচ্ছন্ন থাকে— পৃথিবীপিণ্ডও ঠিক তেমনই, যা কিনা ছেয়ে আছে বন, পর্বত ও গ্রামে!
উনিশ শতকের বাংলার ভূগোল-চেতনাকে তাই কেবলই ম্যাপ, অ্যাটলাস আর জমি জরিপের অভ্যস্ত ছকে পড়লে হবে না। সিদ্ধান্তশাস্ত্রের ধরতাই ছাড়া ভুঁইফোঁড় গ্লোবের এমন বিমিশ্র স্বীকরণ সম্ভবই ছিল না সে দিন! পিয়ার্স সাহেবের বইয়ের ১৮৪৯ সালের সংস্করণ দেখা যাক। আপাদমস্তক ‘রট লার্নিং’-এর ঢঙে ছাত্র-সমীপে সেখানে প্রশ্ন নিক্ষিপ্ত হয়: কোনও পুরাণে বলে পৃথিবী না-কি আয়নার মতো— আবার কেউ বলে ত্রিকোণ বা চতুষ্কোণ। ঠিক কোনটা? জবাব আসে– “তাহার নৈত্য কিছুই পাওয়া যায় না; কিন্তু ব্রহ্মসিদ্ধান্ত, সূর্য্যসিদ্ধান্ত, সিদ্ধান্তশিরোমণি প্রভৃতি, ইউরপীয় গ্রন্থের সহিত ঐক্য করিয়া পৃথিবীর... গোলতার নিশ্চয় হয়।” পিয়ার্স সাহেবের মোক্ষম হাতযশে, এক ধাক্কায় কার্যত পাশাপাশি বসে গেল ইউরোপীয় ভূগোল আর দেশি সিদ্ধান্তশাস্ত্র! বস্তুতপক্ষে, এই সময় থেকেই সিদ্ধান্তশাস্ত্রগুলিকে পড়া হতে থাকে ‘বহিরাগত’ জ্যোতির্বিদ্যার ‘আধুনিক’, গ্রহণযোগ্য, ‘সেকুলার’, অথচ এদেশি বিকল্প হিসেবে।
তত দিনে পৌরাণিক ভূগোলের রাজপাট কিঞ্চিৎ অস্তমিত। কচ্ছপ এবং সাপের পিঠে থিতু পৃথিবীর ছবি পর্যবসিত হয়েছে নিছকই খেজুরে গপ্পে। নর্মাল স্কুলের পড়ুয়াদের জন্য লেখা ‘খগোলবিবরণ’ বইয়ের পৃষ্ঠায় নবীনচন্দ্র দত্ত ১৮৬০ দশকে বলবেন, “প্রকৃত জ্যোতিষশাস্ত্রে নির্ণীত আছে যে, পৃথিবী বর্ত্তুলের ন্যায় গোলাকার, এবং নিরাধার হইয়া শূন্যেতে
স্থিতি করিতেছে।” অতএব, পৃথিবীকে সমতল হিসেবে দাগিয়ে-দেওয়া কূর্মপুরাণ-টুরাণ নয়— নবীনচন্দ্রের চোখে বরং ‘প্রকৃত জ্যোতিষ’-এর তকমা পাবে সিদ্ধান্তশাস্ত্রই। এবং উল্লেখ্য, জ্যোতিষ বলতে বাঙালি নিতান্তই অ্যাস্ট্রোলজি বা ফলিত জ্যোতিষ বুঝত না সে দিন। ওটি পরবর্তী সময়ের
অর্থান্তর মাত্র! ‘খগোলবিবরণ’ বেরোনোর বছরকয়েকের মধ্যে, সংস্কৃত সিদ্ধান্তশাস্ত্রের সঙ্গে ইউরোপীয় জ্যোতির্বিদ্যার তুলনা টেনে ভবানীপুরের সোমপ্রকাশ যন্ত্রে ছাপা হয় ‘মৃণ্ময়ী’। বইয়ের লেখক, বাঙালি পণ্ডিত গোবিন্দমোহন রায় বিদ্যাবিনোদ। রূপকধর্মী হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ পুরাণের বিপ্রতীপে গোবিন্দমোহন এ বইয়ে মাঠে নামালেন ভাস্কর, লাল্লাচার্যকে! ‘গোলাধ্যায়’ উদ্ধৃত করে তাঁর যুক্তি, “গণিতস্কন্ধ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দ্বারা উপপন্নবাক্য ব্যতীত অন্য শাস্ত্র প্রমাণ বলিয়া মান্য হইতে
পারে না।” অতঃপর, গোবিন্দমোহনদের চোখে ভারতীয় জ্যোতিষের সারাৎসার লুকিয়ে সিদ্ধান্তশাস্ত্রেই— ভূগোল এবং খগোল (অ্যাস্ট্রোনমি), দুই যমজ বিদ্যাতেই!
তবে কি সিদ্ধান্তশাস্ত্রের সামনে পড়ে পুরাণ সে দিন হেরে গিয়েছিল পুরোপুরি? ইতিহাস তেমন সাক্ষ্য দেয় না। ১৮৫০-এর শেষ ভাগেও, কালিদাস মৈত্রের বইতে দেখি গ্লোবের পাশাপাশি অন্য ধরনের বিশ্বকল্পনার সাদর স্বীকৃতি! স্কন্দপুরাণ আর শ্রীমদ্ভাগবত উদ্ধৃত করবেন কালিদাস, জানাবেন, এ সবই প্রাক্-মুসলমান আমলের ‘ভূগোল-বিদ্যানুরাগিতা’, যবনরাজ কায়েম হওয়ার পর যা স্তব্ধ হয়ে গেল ক্রমশ। পৃথিবীর আকার যে গোল, খ্রিস্টান মিশনারিদের এ-হেন প্রচারণা মেনে নিতে কিঞ্চিৎ গররাজিই ছিলেন বাঙালি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের একটা অংশ। ১৮৯০-এর আশপাশে, কাঁঠালপাড়ার পণ্ডিত দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ ‘ভূতত্ত্ব বিচার’ বইতে ঔপনিবেশিক ভূগোলবিদ্যাকে ঝাঁঝালো কটাক্ষ করেছিলেন। ওই বইয়ে দ্বারকানাথের পৃথিবীবর্ণনা পুরোদস্তুর পৌরাণিক— পৃথিবী মানে সেখানে অনন্তশায়ী বিষ্ণুর নাভিতে ফোটা পদ্ম। আধুনিক ভূগোলের একচেটিয়া আগ্রাসনের পরেও তামাদি পুরাণকে আঁকড়ে থাকা কেন? বিদ্যাভূষণ জানাবেন: শাস্ত্রে পৃথিবীকে গোলও বলা হয়েছে— কিন্তু সে যে ঠিক গোলই কেন, তার স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ নেই। কিন্তু, কুক, ড্রেক, ম্যাগেলানদের তিন
শতকের সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা? দ্বারকানাথের উত্তর: “স্বচক্ষে দেখাই একমাত্র সত্য নহে, তার জন্য ‘অপর যুক্তি’ প্রয়োগ করা আবশ্যক।” পণ্ডিতসুলভ কূট বাগ্মিতার সামনে ধসে পড়ল অকাট্য, প্রত্যক্ষবাদী প্রমাণের বালাই!
‘হিন্দু ভূগোলচর্চা’র স্রোতে গ্লোবের কিঞ্চিৎ ঠাঁই ছিল অবশ্য আঠারো শতক থেকেই। কালীময় ঘটকের লেখা রাধাকান্ত দেবের জীবনী পড়লে জানা যায়, রাধাকান্তের বাবা গোপীমোহন দেব নাকি হিন্দু প্রণালীতে ‘ভৌগোলিক ও খগোলিক গ্লোব’ আঁকতে পারতেন। আর হালের গ্লোব? ইতিহাসবিদ সুমতি রামস্বামীর লেখা পড়লে জানা যায়, মূলত খ্রিস্টান মিশনারিদের দৌত্যেই বঙ্গভূমে ওই বস্তুটির রমরমা আরম্ভ। ১৮১৩-র সনদের পর দলে দলে মিশনারি বাংলায় ঢুকতে থাকেন, সঙ্গে করে নিয়ে আসেন নবলব্ধ ভূগোলবিদ্যা। মির্জাপুরের মিশনারি স্কুলে পাদরি ছিলেন খোদ জেমস লং। জানা যায়, হাতের কাছে পাওয়া নারকেল-গোছের জিনিস দিয়ে লং নাকি চমৎকার গ্লোব বানাতে পারতেন। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সোসাইটি থেকে হিন্দু কলেজে প্রমাণ আকারের দু’টি গ্লোব এসে পৌঁছেছিল ১৮২৩ সালে। বছর পাঁচেকের মধ্যে, হিন্দু কলেজের ছাত্ররাও প্রাইজ়ে পকেট গ্লোব পেতে আরম্ভ করেন— সঙ্গে গোল্ডস্মিথের ভূগোল বই। জানা যায়, মেকলে মিনিট পেশ হওয়ার বছরে, ১৮৩৫-এ ইংল্যান্ড থেকে ট্রেভেলিয়ান নাকি খান কুড়ি গ্লোব আনিয়েছিলেন! কলকাতার আন্তর্জাতিক এগজ়িবিশনগুলোতেও গ্লোবের রমরমা বহাল ছিল অন্তত ১৮৭০ দশক পর্যন্ত।
কিন্তু গ্লোব কি নিছকই ইউরোপীয়দের চাপিয়ে দেওয়া খুড়োর কল? সম্ভবত তা নয়। জাতীয়তাবাদী পাঠ্যক্রমে গ্লোব অপরিহার্য হতে আরম্ভ করে উনিশ শতকের শেষ থেকে। মাথায় রাখতে হবে, অনেক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতই সে সময় দাবি করতেন, গ্লোব বস্তুটির উল্লেখ রয়েছে প্রাচীন সিদ্ধান্তশাস্ত্রেই। বর্ধমানের ভূগোল-উৎসাহী রাজা মহতবচন্দ সারা বাংলার পণ্ডিতদের কাছে প্রশ্ন ছুড়েছিলেন, সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময় সচরাচর আলাদা হয় কেন? ১৮৭৯-এ সে সব উত্তরের ভিত্তিতে সঙ্কলিত বই ‘প্রশ্নোত্তরমালা’-য় তেলিয়াপাড়ার বেণীমাধব ন্যায়রত্ন জানাচ্ছেন: “শিষ্যশিক্ষার্থে ভূগোলকের প্রয়োজনীয়তা সূর্যসিদ্ধান্তেও আছে।” ঠিক তেমনই, ১৮৯০-এর দশকে নগেন্দ্রনাথ বসু ‘বিশ্বকোষ’-এর পাতায় বাতলে দিচ্ছেন গ্লোব তৈরি করার অআকখ। নগেন্দ্রনাথের বয়ানে অবশ্য গ্লোব আর ইংরিজি
গ্লোব নয় শুধু, তার একটা জুতসই বঙ্গীকরণও মিলেছে তত দিনে— ‘ভূগোলক’। নগেন্দ্রনাথ বসু লিখছেন, “কাষ্ঠ দ্বারা বড় ভাঁটার ন্যায় একটী গোল প্রস্তুত করিয়া জ্যোতিঃশাস্ত্রবর্ণিত মহাদেশ, দেশ, নগর, সাগর, উপসাগর, হ্রদ ও নদী প্রভৃতির স্থানসন্নিবেশ যথাযথরূপে অঙ্কিত করিবে। ইহাকে ভূগোলক বলে।”
শুধুই উনিশ শতক? বিশ শতকে এসে বিবেকানন্দ কিংবা সুভাষচন্দ্রও তো গ্লোবের পক্ষে দাপুটে সওয়াল চালিয়ে গেছেন! শিষ্যদের প্রতি বিবেকানন্দের নির্দেশ ছিল, কতগুলো ম্যাপ, গ্লোব আর রাসায়নিক জোগাড় করে প্রতি সন্ধেয় গরিব আর চণ্ডালদের চলিত ভাষায় জ্যোতিষ ও ভূগোল শেখাতে! আর, এর তিন দশক পর মান্দালয় জেল থেকে সুভাষচন্দ্র চিঠিতে লিখছেন: “যে জিনিষই শেখাবে তা যেন সকল ইন্দ্রিয়ের সামনে উপস্থিত থাকে। যখন ভূগোল শেখাবে তখন মানচিত্র, Globe প্রভৃতি যেন থাকে, ইতিহাস যখন শেখাবে তখন সুবিধামত museum প্রভৃতি স্থানে নিয়ে যাবে।” উপনিবেশের দেওয়া অস্ত্রেই তবে ঔপনিবেশিক লেখাপড়ার বিকল্প-সন্ধান? সুভাষ লিখছেন, “শিশুর চোখ, কান, হাত, জিহ্বা, নাক যদি উপভোগের এবং জানবার বস্তু পায়, তবে... ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে।” গ্লোব আর সাম্রাজ্যের ক্লাসঘরে বন্দি থাকেনি কেবল! ওই একই দশকে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন বাঙালি ‘গ্লোবট্রটার’রাও– যাঁদের পোশাকি ডাকনাম হবে ‘ভূপর্যটক’! নামেই মালুম, বাঙালির পৃথিবীদর্শনে ‘ভূ’ যতটা জায়গা পেয়েছিল সে দিন, সমুদ্র ততটা পায়নি।
অবশ্য, গ্লোবকে কেবলই পাঠ্যক্রম আর শিক্ষাবিস্তারের নিক্তিতে মাপা যাবে না। বিশ শতকের বাঙালি গেরস্তঘরে গ্লোব এক ধরনের ‘সিম্বলিক ক্যাপিটাল’-ও বই কী! বস্তুত, দুনিয়াকে অক্লেশে তালুবন্দি করতে পারার সামর্থ্য এবং আত্মপ্রসাদ তখন হয়ে উঠেছিল বাঙালির রুচির বিজ্ঞাপনও। বিশ শতকের যে উপন্যাসে চুটিয়ে জানান দেবে বাঙালির সদর এবং অন্দর, সেই ‘গোরা’র পাতাতেও গ্লোব যথাস্থানে বহাল! পরেশবাবুর বাড়ি গিয়েছে বিনয়। নেপথ্যে রবীন্দ্রনাথের বর্ণনা: “কোণে একটি ছোট আলমারি, তাহার উপরের থাকে থিয়োডোর পার্কারের বই সারি সারি সাজানো রহিয়াছে দেখা যাইতেছে।” এবং, অনিবার্য ক্লোজ়-আপ: “আলমারির মাথার উপরে একটি গ্লোব কাপড় দিয়া ঢাকা রহিয়াছে।” ওই কাপড়ের প্রসাধনেই মালুম হয়, গ্লোব তত দিনে বৈঠকখানা সাজানোর উপকরণ-বিশেষ! ‘যোগাযোগ’-এর মতো রবীন্দ্র-উপন্যাসেও, মোতির মা কুমুর কাচের গ্লোব মাজতে থাকে। বিশ শতকের সাময়িকপত্রগুলি ঘাঁটলে ইতস্তত চোখে পড়বে গ্লোবের টুকরোটাকরা বিজ্ঞাপন। আর, নতুন প্রতিষ্ঠানের কিঞ্চিৎ সাহেবি খুশবু থাকলে তো কথাই নেই, নাম রাখা হবে গ্লোবের নামেই। গ্লোব থিয়েটার আর গ্লোব লাইব্রেরি তার হাতেগরম সাবুদ বই কি!
আর ছিল আইকনোগ্রাফি। এক শতক আগে ভূগোলবইয়ের পাতায় গ্লোবের যে অভিযাত্রা আরম্ভ হয়েছিল, আধুনিকতার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে চারিয়ে গেল জনসংস্কৃতির আনাচকানাচে। সুমতি রামস্বামী অন্যত্র দেখিয়েছেন, উপনিবেশের পড়ন্ত বেলায়, দক্ষিণ ভারতে গ্লোবের আঁকা ছবিতে দিব্যি মিশে যায় বিষ্ণুর বরাহ অবতার, সেকুলার জ্ঞানকাণ্ড খানিক ‘আবিল’ হয়ে পড়ে ধর্মবিশ্বাসের সামনে। এর সব চেয়ে বড় প্রমাণ, খোদ আনন্দবাজার পত্রিকা! ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের পত্রিকা সংস্করণটি খুঁজলেই মিলবে নবজাত রাষ্ট্রের সেলিব্রেশন-ধর্মী এক গুচ্ছ বিজ্ঞাপন, যার কোনও-কোনওটায় গ্লোবের আঁকাড়া মোটিফ। কমলালয় স্টোর্স থেকে ডালমিয়া জৈন, ফ্রেম কেমিক্যাল থেকে লিলি বিস্কুট, ত্রিবর্ণরঞ্জিত নধর পতাকাদণ্ড কোথাও কোথাও গ্লোবের আদলের উপর প্রোথিত। কখনও আবার গ্লোবের গায়ে ভেসে উঠছে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মিছিল। এ যেন স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের হাতে লেখা নতুন পুরাণকথা!
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার থেকে সাতচল্লিশের আনন্দবাজার পত্রিকা— যাত্রাটা একমুখী ছিল না মোটেই। কিন্তু, এই গোটা ইতিবৃত্তে যা মিলল, চুম্বকে তাকে বলা চলে: কেন্দ্রীকরণ। অক্ষ-দ্রাঘিমার জালে ছয়লাপ, বিপুল সসাগরা ভূমণ্ডলের ভিতর নিজের সত্তাকে একটা বিন্দুতে থিতু করানোর মরিয়া প্রয়াস। গ্রিনিচ নয়— সেই মোক্ষম বিন্দুটিই কালক্রমে হয়ে উঠবে দুনিয়াদারির নির্বিকল্প ভরকেন্দ্র! এমন মরমি অবলোকন আর কোথায়ই বা মিলবে, সত্যজিতের অমোঘ টিপ্পনীটুকু ছাড়া? ‘অপরাজিত’ সিনেমাটি মনে করুন। স্কুলের হেডমাস্টারমশাইয়ের দেওয়া গ্লোব নিয়ে অপু ঘরে ফিরছে। নিশ্চিন্দিপুরে পা দিতেই কলকাতা যাওয়া নিয়ে সর্বজয়ার সঙ্গে এক চোট মনোমালিন্য এবং কিঞ্চিৎ ‘কাথারসিস’। ঢিমে লন্ঠনের আলোয় চাতালে বসে অপু দেখায়, “এটা আমায় হেডমাস্টারমশাই দিয়েছেন। এর নাম গ্লোব। পৃথিবী, আমাদের পৃথিবী। এই যে দাগগুলো দেখছ না, এগুলো দেশ। এগুলো হচ্ছে সমুদ্র।” অজগ্রামের কিশোর ব্রাহ্মণসন্তান সবে ইস্কুলমুখো। নতুন-শেখা কেন্দ্রচেতনায় তালিমও নিচ্ছে অল্প অল্প। ভূগোলকের গায়ে আঙুল বুলিয়ে অপু সর্বজয়াকে ভূগোল পড়িয়ে চলে, “কলকাতা কোথায় চেনো মা? এই যে।”
শেষ পর্যন্ত নিশ্চিন্দিপুরের মায়া ছেড়ে যাওয়া হয়নি সর্বজয়ার। চেনা হয়নি নতুন মেট্রোপলিসের আলোকিত কেন্দ্রগুলো। অপুর ডাক হয়তো বা এসে গিয়েছিল গ্লোবে-আঁকা দূরের রাজধানীর উদ্দেশে— কিন্তু, মায়ের অদৃশ্য পিছুটান? অপু কি জানতে পেরেছিল? তার বেআক্কেলে গ্লোব কি এটুকুও
বুঝত না: যত বড় রাজধানী, সচরাচর ততও বিখ্যাত হয় না হৃদয়পুর!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy