পথপ্রদর্শক: জন স্নো।
লন্ডন শহরে ৫৪ ফোর্থ স্ট্রিটের চেম্বারে রোগী দেখতেন ডাক্তার জন স্নো। শল্য-চিকিৎসক। তবে সাধারণ রোগীরও চিকিৎসা করতেন। পসার মন্দ নয়। জনবহুল এলাকা। মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত রোগীর ভিড়ই বেশি।
বেশ চলছিল চিকিৎসাপর্ব। গন্ডগোলটা শুরু হল ১৮৫৪ সালের অগস্ট মাসের মাঝামাঝি। হঠাৎ করে বেড়ে গেল কলেরা রোগীর সংখ্যা। ডাক্তার প্রতি বছরই দেখেন কিছু কলেরা রোগী। কলেরা তো আর নতুন অসুখ নয় ইংল্যান্ডে! প্রথম কলেরা রোগীর খবর এসেছিল ইংল্যান্ডে সেই ১৮৩১ সালে। কারণও জানা ছিল কলেরার। দূষিত বাতাস। জঞ্জাল-আবর্জনার পচনে দূষিত হয় বাতাস। সেই বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে কলেরায় আক্রান্ত হয় মানুষ। ‘মিয়াসমা থিয়োরি’, বলেছিলেন নামী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা— ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, সমাজবিজ্ঞানী এডউইন চ্যাডউইক। সে ভাবেই চলত কলেরার চিকিৎসা। দূষিত বাতাসের থেকে দূরে থেকে।
তবে অগস্ট মাসে ফোর্থ স্ট্রিটের চেম্বারের ঘটনা যেন অন্য রকম। ডাক্তার স্নো-র অনুসন্ধিৎসু মন বার বার বলছিল, কোথায় যেন বিজ্ঞানের একটা হিসেব মিলছে না। নিজেই নিজেকে তিনটে প্রশ্ন করলেন স্নো, এই হঠাৎ বেড়ে যাওয়া কলেরা রোগীর সংখ্যার নিরিখে। এক: হঠাৎ এখন, এই সময়েই কেন এত রোগী? বছরের অন্য সময় তো এত রোগী আসে না! দুই: হঠাৎ এই এলাকাতেই এত রোগী কেন? তিনি অন্যত্র খোঁজ নিয়েছেন, সেখানে তো এই হারে বৃদ্ধি হয়নি কলেরা রোগীর সংখ্যা! আর তিন: একটা নয়, দুটো নয়, তিনটে নয়... হঠাৎ এক সঙ্গে এত রোগী আসছে কেন?
সময়। স্থান। সংখ্যা। তিনটে প্রশ্ন। সাজানো চেম্বার ছেড়ে অনুসন্ধান করতে রাস্তায় নেমে পড়লেন স্নো। ঠিক যেমন ভাবে অপরাধের অনুসন্ধান করে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের পুলিশ। বেশি ক্ষণ লাগেনি। ডাক্তারবাবু বুঝে গেলেন, গোলমালটা নিকটবর্তী ব্রড স্ট্রিট এলাকায়। ওখানেই তো তার সব কলেরা রোগীর আবাস। এ বার শুরু হল আরও গভীর অনুসন্ধান, ব্রড স্ট্রিট এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় ঘুরে ঘুরে। সব অনুসন্ধান যেন তাঁকে টেনে নিয়ে এল একটা হ্যান্ড পাম্প বা হাত-কলের কাছে। ব্রড স্ট্রিটের বহু মানুষের পানীয় জলের উৎস সেই কল।
ব্রড স্ট্রিটের সেই হ্যান্ড পাম্প, এখন সংরক্ষিত
তিনটে কাজ করলেন ডাক্তার স্নো। ব্রড স্ট্রিট অঞ্চলের বাসিন্দাদের প্রশ্ন করলেন, ‘‘আপনাদের খাবার জলের উৎস কী? আপনারা কি এই বিশেষ হাত-কলের জল খান?’’ আশপাশের যত ছোট-বড় হাসপাতাল আছে, স্নো ঘুরে ঘুরে তথ্য নিলেন ওই বিশেষ সময়ের মধ্যে সেখানে চিকিৎসার জন্য আসা কলেরা রোগীর নাম, সংখ্যা ও ঠিকানার। তার পর একটা বিন্দু-মানচিত্র বা ডট ম্যাপ তৈরি করলেন, ওই সময়ের মধ্যে চিকিৎসার জন্য আসা সব কলেরা রোগীর। তথ্য হাতে আসার পর আর দেরি করেননি স্নো। কারণ মানুষ ক্রমাগত কলেরায় আক্রান্ত হচ্ছিল। মারা যাচ্ছিল।
১৮৫৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, যাবতীয় তথ্য নিয়ে স্থানীয় নগর আধিকারিকের দফতর, বোর্ড অব গার্ডিয়ান্স অব সেন্ট জেমস প্যারিশের অফিসে এলেন ডাক্তার স্নো। জানালেন, তাঁর তথ্য বলছে, কলেরার উৎস ব্রড স্ট্রিটের ওই হ্যান্ড পাম্পটি। ওই কলের জল সরবরাহ বন্ধ করতে হবে এক্ষুনি। কলেরার সঙ্গে জীবাণুর সম্পর্ক তখনও পর্যন্ত অজানা, ডাক্তার স্নো-ও তেমন কিছু বলেননি। তিনি শুধু বলেছিলেন, তথ্য বলছে— এই কলেরা মহামারির জন্য দায়ী ব্রড স্ট্রিটের ওই হাত-কল। ওই কল অচল না করলে এই রোগ থামানো যাবে না।
সময় নষ্ট করেনি প্রশাসন। পরের দিনই ভেঙে দেওয়া হয়েছিল সেই হাত-কলের হাতল, যাতে সেখান থেকে আর জল না নিতে পারে ব্রড স্ট্রিটের বাসিন্দারা। বিজ্ঞান তো তথ্যনির্ভর, সঠিক উপায়ে সংগৃহীত তথ্য অনুসন্ধানের উপর দাঁড়িয়ে থাকে সে। প্রশাসনের এই কাজের ফল হল চমকপ্রদ। সংক্রমণের উৎস বন্ধ হল। ব্রড স্ট্রিট এবং সংলগ্ন অঞ্চলে দ্রুত কমে গেল কলেরা রোগীর সংখ্যা।
বিজ্ঞানের সাফল্যের গল্প এখানেই শেষ হতে পারত। কেমন করে শুধুমাত্র সুচিন্তিত অনুমান, অনুসন্ধান এবং অনুধাবনের মধ্যে দিয়ে এক জটিল অসুখের সমাধান করলেন এক চিকিৎসক-বিজ্ঞানী, বোঝা যেত তাতেও। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ডাক্তার স্নো যখন তাঁর প্রথম রিপোর্ট পেশ করেন, তখনও সংক্রমণের মূল কারণ অজানা। পরে জানা যায়, ব্রড স্ট্রিটের সেই হাত-কলের জল আসত এক জলাধার থেকে। সেখানে এক কলেরা আক্রান্ত শিশুর কাপড়-জামা ধুয়েছিলেন তার মা। সেই কলেরা আক্রান্ত শিশুর পোশাক থেকেই ছড়িয়ে পড়ে রোগের সংক্রমণ।
কিন্তু সাফল্যের গল্প এ ভাবে শেষ হয় না। কিছু উপাদান থাকে সাফল্যের গল্পে, যা হয়ে ওঠে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রেরণা। এই গল্প শুধুমাত্র ডাক্তার স্নো-র অসামান্য বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণের গল্প নয়। এ গল্প এক বিজ্ঞানীর অদম্য জেদ এবং মহানুভবতার গল্পও বটে।
হাত-কলের হাতল খুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কলেরা রোগও ব্রড স্ট্রিট অঞ্চল থেকে প্রায় উধাও হল। এত ক্ষণে যেন দম ফেলার সময় পেলেন ডাক্তার স্নো। যাবতীয় তথ্য ও অভিজ্ঞতা একত্র করে লিখে ফেললেন এই ঘটনাপ্রবাহের এক দলিল। তার পর এক দিন লন্ডনের চিকিৎসকমণ্ডলীর সামনে পড়লেন সেই রচনা। উত্তর দিলেন যাবতীয় প্রশ্নের। বাদানুবাদ এবং যাবতীয় তথ্যের ভিত্তিতে ডাক্তার স্নো-র মতবাদ ও তত্ত্ব খারিজ করল ‘মেডিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডন’। যাঁরা এই তত্ত্ব খারিজ করলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ডাক্তার উইলিয়াম ফার। ইংল্যান্ডের প্রসিদ্ধ সংখ্যাতত্ত্ববিদ। তিনি মানলেন না স্নো-র পরিসংখ্যানযুক্ত এই গবেষণা। তাতে নাকি অনেক ফাঁকফোকর, তেমন বৈজ্ঞানিক নয়। তেমনই ধেয়ে এল বিখ্যাত ‘ল্যান্সেট’ পত্রিকার উপেক্ষাও। স্নো আপন খেয়ালের জেদে এক গর্তে পড়েছেন, এখন আর বেরোতে পারছেন না, তাঁর কাছে তথ্য আছে কিন্তু প্রমাণ নেই— এই ধরনের মন্তব্য করা হল সেখানে। তবু নিজের বিশ্বাস আর তথ্যের ভিত্তিতে আরও চার বছর লড়ে গেলেন জন স্নো। বার বার খারিজ করলেন কলেরা এবং দূষিত বায়ূর সম্পর্ক, মিয়াসমা থিয়োরি। ১৮৫৮ সালের ১৬ জুন, মাত্র ৪৫ বছর বয়সে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অব্যাহত ছিল স্নো-র লড়াই।
‘ল্যান্সেট’ পত্রিকা শোকবার্তায় লিখল, ‘বিখ্যাত চিকিৎসক ডাক্তার স্নো এই মাসের ১৬ তারিখ দুপুরে নিেজর বাড়িতে পরলোক গমন করেছেন। ক্লোরোফর্ম এবং এই সংক্রান্ত ওষুধের ওপর তাঁর গবেষণা প্রশংসনীয়।’ উপেক্ষা করা হয়েছিল স্নো-র কলেরা সংক্রান্ত যাবতীয় গবেষণার উল্লেখ।
তবে সত্যই সব সময় শেষ হাসি হাসে। জন স্নো-র মৃত্যুর আট বছর পর, ১৮৬৬ সালে তাঁর প্রধান সমালোচক ডাক্তার উইলিয়াম ফার লন্ডনের ব্রমলি-বাই-বাও অঞ্চলে কলেরা রোগীদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে একই পরিসংখ্যান পেলেন। কলেরার মূল কারণ হিসেবে সেখানেও উঠে এল দূষিত জল। ঠিক যেমন বলেছিলেন স্নো, ১২ বছর আগে। ফার এ বার মেনে নিলেন নিজের ভুল। সেই সঙ্গে স্বীকার করলেন স্নো-র বলে যাওয়া দূষিত জল এবং কলেরার সম্পর্কের তত্ত্ব। আরও ১৭ বছর পর, ১৮৮৩ সালে রবার্ট কখ আবিষ্কার করলেন কলেরার জীবাণু। তার নাম ‘ভিব্রিও কলেরি’। দূষিত বায়ুর তত্ত্বে এ বার চিরতরে যবনিকাপাত।
চিকিৎসা বিজ্ঞান ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা তার পর এগিয়েছে বিস্তর পথ। কিন্তু অনুসন্ধান, গবেষণা আর তথ্যের উপর অটল বিশ্বাস ডাক্তার জন স্নো-কে আজও আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy