শিল্পী: বানাম হাতে ডমন মুর্মু। (ছবি সৌজন্য: www.daricha.org)
‘ছোট ছোট পুখুরি, পানা কেন এলাই রে
ই পানার উপর কুমির সিঁধাইছে...’
গানের প্রতি ছত্রে বদলে যাচ্ছে ইমেজ। কখনও কোনও ফিল্মমেকারের সামনে বসে, কখনও সরকারি অনুষ্ঠানে, পরম আগ্রহ নিয়ে এক জন সেই গান শোনাচ্ছেন। চোখে রসিকতার ঝিলিক, মুখে হাসি। ভাঙা শরীরে প্রাণভরা আনন্দ। গলায় মায়াবী সুর, আঙুলে ম্যাজিক! লোকটার গানের তালে কোন সুতোয় বাঁধা পড়ে নাচে মেয়ের দল, ভাবলে চমক লাগে। শহুরে কানে অচেনা ঠেকে সেই ভাষা।
তাতে মোটেই দমে যান না তিনি। প্রাণপণে ক্যামেরার ও পারের ‘অপর’ মানুষগুলোকে বোঝান তাঁর ম্যাজিক-বাক্সের খুঁটিনাটি, তাঁদের সমাজের অনুভূতি, উৎসবের ইতিবৃত্তান্ত। প্রমিতজনের স্বীকৃতি পেলে যদি বেঁচে যায় তাঁর শিল্প! সেই আশায় ছুটে বেড়িয়েছেন ‘টাউনে, শহরে, লাইন-বাজারে’। গ্রামবাসী বা বড় অফিসার— যে যখন দেখতে চেয়েছেন, বাক্সে মেয়েদের বসিয়ে সাইকেল চেপে পাড়ি দিয়েছেন ডমন।
অবশ্য মেয়েদের ইচ্ছের দামও ডমনের কাছে ষোলো আনা। অনেক দিন খেলা না দেখালেই স্বপ্নে দেখা দেয় আয়নামণি, সোনামণি, সুজ্জুমণি, চানমণিরা। সংসারে তিন মেয়ে থাকলেও তাঁর বেঁচে থাকার সম্বল যেন আয়নামণিরাই। সমষ্টির হারিয়ে যাওয়া কৃষ্টি জিইয়ে রাখতে একার উৎসাহে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছেন কাঠের পুতুলে। রাত-জাগা প্যাশনে কুপির আলোয় জ্যান্ত হয়ে ওঠে টিকোলো নাক, নিখুঁত আঁকা চোখ, কানের ঝুমকো, মাথায় ফুলের সাজে রূপসী এক সারি নৃত্যপটীয়সী মেয়ে। উল্টো দিকে ধামসা, মাদল হাতে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর! তাঁরাই বাজিয়ে ডমন মুর্মুর পুতুল-সংসারে। কাঠের লম্বা রডের উপরে চার পাশ খোলা বায়োস্কোপের মতো বাক্স তাদের মঞ্চ। সেই মঞ্চের বাইরে দাঁড়িয়ে বাক্সের ফ্রেমে মাথা রেখে চোখ বুজে ডমন গেয়ে চলেন, “উপরে মেঘ ডাকে, জলেরো বেঙ কাঁদে/ চুখেরো জল পড়ে যার যার/ নদীরো বান ভাসে মনে মনে।” চার পাশের প্রকৃতির আয়নায় মনের ভাবের প্রতিফলন ফুটিয়ে দু’লাইনের লিরিক। তাতেই রংবেরঙের শাড়ি পরে ডমন মুর্মুর গানের ছন্দে, তাঁরই হাত-পায়ের ইশারায় পাতা-নাচ দেখায় চারখানি পুতুলকন্যা। বাক্সের মাথার উপরে থেকে থেকে ডিগবাজি খায় ছোকরা ‘জোকার’ জরমট কিস্কু।
স্বপ্নে ওরা আবদার করে, “আমাদের এত দিন বসায়ে রাখলি। কুনও আনন্দ নাই। যেতে হবে তো!” এই ডাক না পেলে বেরোনো হয় না ডমনের। ঝাড়খণ্ডের দুমকা থেকে আসা এক আত্মীয়ের কাছে শিখেছিলেন এই প্রাচীন সাঁওতালি পুতুল-নাচ ‘চদর বদর’ বা ‘চাদর বাঁধনি’। বাহারি ‘চাদর’ দিয়ে কাঠের বাক্সের মঞ্চ আর নীচের কাঠের দণ্ডটি ‘বাঁধা’ থাকে বলেই হয়তো এই নাম। অনুষ্ঠানের শুরুতে মঞ্চের পর্দা তোলার মতো করে বাক্সের চাদর সরিয়ে শুরু হয় নাচ-গান। বাংলায় প্রচলিত ডাং পুতুল, বেণী পুতুল, দস্তানা পুতুল বা তার পুতুলের মতো সরল প্রক্রিয়ায় নয়, একাধিক লিভার, সুতোর টান আর হাতপায়ের নিখুঁত সঙ্গতিতে জ্যান্ত হয়ে ওঠে চদর-বদর পুতুলেরা। আধুনিক বিনোদনের আধিপত্যে, পেটের দায় অথবা জটিল কারিগরি— যে কোনও কারণেই হোক, এই শিল্প বিলুপ্তির পথে। বীরভূমের কয়েক জন এরই আর এক সংস্করণ ক্ষীণ ভাবে বয়ে নিয়ে চলেছেন। উত্তরবঙ্গে চদর-বদরের অভিভাবক উত্তর দিনাজপুরের ইটাহারের মহানন্দপুর গ্রামের ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ ডমনই।
পরের প্রজন্মের কাছে ‘শিক্ষা রেখে যেতে মরিয়া। তবে নাড়া বাঁধার ব্যাপারে গুরুর কঠোর কণ্ঠস্বর বেরিয়ে আসে খেটো ধুতি পরা, ক্ষয়াটে ওই উলোঝুলো চেহারা থেকে। ইউটিউবে একটা ভিডিয়ো-সাক্ষাৎকারে ডমন পরিষ্কার জানান, “আমার কাছে আরজ করতে হবে, পায়ে ধরতে হবে। তবে তো শিক্ষা দিব। কেউ ইচ্ছা করছে না শিষ্য হতে।” সাঁওতালি সোহরাই, বাঁধনা, বাহা, লাগড়ে (চড়ক), দং (বিয়ে) উৎসবের মতো দাঁশাই (দুর্গা পুজোর দশমী) পরবেও চদর বদর নাচ দেখানোর চল ছিল। তবে গ্রাম-জীবনের টুকরো ঘটনা, সুখ দুঃখের বারোমাস্যা ধারণ করে যে ভাষা, সে ভাষায় ঠাঁই হয় না পুরাণ-মহাকাব্যের দেবী-মাহাত্ম্যের। পুজোমণ্ডপের জাঁকজমকেও ডমনের পুতুল-মেয়েরা নেচে ওঠে, “হাটে হাটে বেড়াইলাম, গোটা হাটে বেড়াইলাম/ মনের মতন মালা পাইলাম না/ টিবিসে টিবিসে টিবিস/ একটা কালো ছুড়া বেল মালা দিল রে/ মন গেল গোটা বাজারে/ ও গোটা বাজারে/ খাপটে খাপটে খাপটয়”— এমন সহজ আনন্দের কথায়। ধামসার অভাব পূরণ করে গানের মাঝে মাঝে বাদ্যযন্ত্রের বোল।
“হিথারি পিথাড়ি শাগ দি আমার বন্ধু খায় না ভাত/ কোতায় পাব জিয়ল মাগুর মাছ/ হায় রে...” গরিবের এমন অভাবের গল্পকথায় অবশ্য সব সময়ে মন ভরে না আধুনিক দর্শক-শ্রোতার। আর পেট চলে না ডমনের। তাই নিজের হাতে কাঠ খোদাই করে বানানো, রঙিন কাপড়ের ঘাগরা-চেলি পরা, নাকে নথ মাথায় ফুল, অপরূপা সুন্দরী মেয়ের আদলে তৈরি, সারিন্দার মতো দেখতে, সাঁওতালি বাজনা ‘বানাম’ সুর তুলে বেদের মেয়ে জোছনার ফাঁকি দেওয়ার গল্প শোনাতে হয়। প্রচার করতে হয় সরকারি কর্মসূচি। তবে সরকারি আবাস যোজনার টাকায় পাকা ঘরটা গোটা দেখে যেতে পারেননি। বর্ষায় ভেঙেছিল দু’টো মাটির বাড়ির একটা। ভেঙেছে পুতুলের মঞ্চ।
বছরখানেক আগে, এক গরমের দুপুরে গাছের ছায়ায় বসতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়েন। ছুটে আসেন মেজ মেয়ে তালাকুরি। মাথায় চোট নিয়ে আর দু’দিন টানতে পেরেছিলেন ডমন। বহু চেষ্টাতেও শেষরক্ষা হয়নি।
বিদ্যুৎবিহীন সাঁওতাল পাড়ায় সন্ধের ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে ডমনের বাড়ি পৌঁছে দেখা গেল, মাটির বাড়ির চত্বরে স্বামী তান্তি সরেনের সঙ্গে গল্পগাছা করছেন তালাকুরি। চার পাশে খেলে বেড়াচ্ছে ডমনের তিন খুদে নাতি-নাতনি। ধান রোয়ার মরসুমে ক’দিনের জন্যই বাড়ি ফিরেছেন তান্তি। ভিডিয়োয় ডমনের গান শোনাতেই ‘দাদুর গলা না!’ বলে ছুটে এল পাঁচ বছরের খুদে পূর্ণিমা।
ডমন বেঁচে থাকতে যে ‘শিক্ষিত’ সমাজ তাঁর শিল্পরক্ষার দায় নেয়নি, তাঁর মৃত্যুর পরে সেই সমাজের প্রতিনিধি হয়ে সেই শিল্পরক্ষার ইচ্ছা প্রকাশ করতে গেলে সপাট চড় খেতে হয়। ছোটবেলায় বাবার একটা খাতা দেখতেন, “গান লিখা থাকত ওতে”। সে সব কবে হারিয়ে গিয়েছে। সংগ্রহশালা, সংরক্ষণ এ সব ভারী শব্দের গুরুত্ব বোঝায়নি কেউ তালাকুরিদের। তাই বাবার পাশেই এক সঙ্গে তাঁরা কবর দিয়ে দিয়েছেন বাবার সাধের পুতুল-মেয়েদেরও।
শুধু টিনের ঘরে বাঁশের মাচায় জেগে থাকে একা বানাম-সুন্দরী। তার তারে আঙুল বুলিয়ে আর কেউ ছড়া কাটে না, কেউ সাজিয়েও দেয় না আদর করে। পুজোর মুখে তান্তি আবার দিল্লি পাড়ি দিয়েছেন রাজমিস্ত্রির কাজে। ধান রোয়াও শেষ। ‘মা চলে গেছে অনেক দিন, বাবাটোও চলে গেল..’। তবু আর এক মায়ের আগমনীর লগ্নে তিন ছেলে-মেয়ের মুখ চেয়ে রবিবারের হাটে গিয়ে নতুন জামা কিনে আনেন এক লুপ্ত-প্রায় পুতুলনাচের শেষ শিল্পীরমেয়ে তালাকুরি মুর্মু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy