পলাশির যুদ্ধের পর তিরিশ বছরও কাটেনি। ১৭৮০ সালের কোনও এক সময়ের কথা। ওয়ারেন হেস্টিংস তখন বাস করছেন আলিপুরে বেলভেডিয়ারের তিরিশ একর জমির উপর তৈরি বাগানবাড়িতে। এক দিন সামরিক বিভাগের সচিব কর্নেল রবার্ট কিড এলেন হেস্টিংসের বাগানবাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। সে কালে প্রায় সব ইংরেজই ছিল বাগানবিলাসী। ব্যতিক্রমী ছিলেন না হেস্টিংস এবং কিডও। হেস্টিংসের বাগান ঘুরে দেখতে গিয়ে কিডসাহেব চমকে উঠলেন একটা গাছ দেখে। সেটা দারচিনি গাছ। ফৌজি মানুষ হলেও উদ্যানচর্চার প্রতি তাঁর নিবিড় টান ছিল। নিজের একটা বেশ বড়সড় বাগানও ছিল তাঁর, গঙ্গার ধারে শালিমারে। বিদেশ থেকে আসা জাহাজি ক্যাপ্টেনদের মাধ্যমে বিদেশের বিচিত্র গাছের চারা এবং বীজ সংগ্রহ করে গড়ে তুলেছিলেন বাগানটা। তাই প্রথাগত অর্থে উদ্ভিদবিদ না হলেও গাছপালা চেনায় শিকারির নজর ছিল তাঁর।
হেস্টিংসের বাগানে দারচিনির গাছ দেখে মুহূর্তে তাঁর মনে ভেসে উঠল একটা ভাবনা। একটা বিশাল আকারের বাগান তৈরি করে কোম্পানির জন্য দারচিনি গাছের সঙ্গে অন্যান্য উপযোগী গাছপালা উৎপন্ন করা যেতে পারে সেখানে। হেস্টিংসের বাগানে দারচিনি গাছ দেখে তাঁর মনে এই প্রত্যয় সৃষ্টি হয় যে, বাংলার মাটিতে দারচিনি গাছ উৎপন্ন করার পাশাপাশি অন্যান্য মশলাও চাষ করা সম্ভব। আর তা যদি সম্ভব হয়, প্রাচ্যের মশলা বাণিজ্যে ওলন্দাজদের একচেটিয়া একাধিপত্য গুঁড়িয়ে দেওয়া যাবে।
বস্তুত সে সময় প্রাচ্যের মশলা বাণিজ্য নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে চলছিল তীব্র প্রতিযোগিতা। সে প্রতিযোগিতা মাঝে-মাঝে পরিণত হত নৌ-যুদ্ধে। তা ছাড়া, আঠেরো শতকের শেষের ক’টা দশক কোম্পানির পক্ষে তেমন শুভ ছিল না। কয়েকটা প্রাকৃতিক এবং রাজনৈতিক বিপর্যয় উভয়ের অর্থনীতিকে ঠেলে দিয়েছিল সঙ্কটের দিকে। কোম্পানি বড় ধাক্কা খায় ১৭৭০-এ, বাংলার সর্বনাশা মন্বন্তরে। আপাত দৃষ্টিতে প্রকৃতির রোষ সেই মন্বন্তরের কারণ হলেও কোম্পানির কর্মচারীদের দায়ও নেহাত কম ছিল না। এই মন্বন্তর এবং কর্মচারীদের দুর্নীতির পরিণামে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা এমন তলানিতে ঠেকে গেল যে, প্রায় দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। বিলেতের সরকারের কাছে আর্জি পেশ করতে হল, সরকারের প্রাপ্য চার লক্ষ পাউন্ড দেওয়ার দায়বদ্ধতা থেকে রেহাই পেতে।
তার পর এল আর এক আর্থ-রাজনৈতিক বিপর্যয়। ১৭৮৩ সালে আমেরিকা হাতছাড়া হয়ে গেল ব্রিটেনের। নেভিগেশন আইন অকেজো হয়ে যাওয়ায় আমেরিকাকে বাধ্য করা গেল না কেবলমাত্র ল্যাঙ্কাশায়ারকে কাপড়ের কলে তুলোর জোগান দিতে। রাজকীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ তৈরি, বিশেষ করে মাস্তুল নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় মার্কিন কাঠের গুঁড়ি অন্য বিদেশি শক্তির নাগালের বাইরে রাখা সম্ভব হল না।
এই প্রেক্ষাপটে রবার্ট কিড ১৭৮৬ সালে গভর্নর জেনারেল স্যর জন ম্যাকফারসনের কাছে পেশ করলেন একটা বোটানিক্যাল গার্ডেন স্থাপনের পরিকল্পনা। রবার্ট কিড তাঁর আর্জিতে লিখলেন, ‘শুধুমাত্র কৌতূহল মেটানো কিংবা বিলাসের সামগ্রী হিসেবে বিরল গাছপালা সংগ্রহ এই বাগানের উদ্দেশ্য নয়। লক্ষ্য হবে বাগান থেকে উপযোগী চারাগাছ বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানান্তরিত করা। যাতে ভারত ও গ্রেট ব্রিটেনের মানুষ উপকৃত হয় এবং সঙ্গে-সঙ্গে জাতীয় ব্যবসা বাণিজ্যের বিস্তার ও সম্পদের বৃদ্ধি ঘটে।’
এক জটিল দমবন্ধ সঙ্কটে পরিচালন সমিতির কাছে কিডের প্রস্তাব যেন বয়ে আনল এক ঝলক সুবাতাস। মূলত বাণিজ্যিক স্বার্থের কথা ভেবে তাঁর পরিকল্পনাকে সমর্থন করে ১৭৮৭-র ৩১ জুলাই বিলেতের কর্মকর্তারা লিখলেন, সিংহলের মতো বাংলাতেও দারচিনি গাছ ব্যাপক ভাবে উৎপন্ন করা যায় কি না, তা নিশ্চিত করতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন। এ কাজে বিশাল পরিমাণ অর্থব্যয়ের ঝুঁকি থাকলেও তাঁরা পিছিয়ে গেলেন না। কারণ তাঁরা দারচিনি গাছের সঙ্গে অন্যান্য মশলা উৎপাদনের মধ্যে বিশাল সম্পদের উৎসের ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। আর একটা সম্ভাবনার কথাও স্থান পেয়েছিল তাঁদের মনে। বিগত মন্বন্তরে খাদ্যের অভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু তাঁদের বাধ্য করেছিল মানুষের জন্য বিকল্প খাদ্য উৎপাদনের কথা ভাবতে, যাতে ভবিষ্যতে দুর্ভিক্ষ হলে সামাল দেওয়া যায়। তাঁদের মনে হয়েছিল, অর্থকরী ফসলের সঙ্গে অন্য রকম খাদ্যফসল উৎপাদনের প্রচেষ্টা করা যেতেই পারে।
বিলেত থেকে সবুজ সঙ্কেত পাওয়া মাত্র কিড উদ্যোগী হলেন বাগানের জন্য উপযুক্ত জমির সন্ধানে। তিনি কোম্পানির জনৈক কর্মচারী হে-র কাছ থেকে গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে এক খণ্ড জমির সন্ধান পেলেন। কিন্তু জানা গেল, সে জমি পাওয়া যাবে না, কারণ রাজস্ব দফতরের আধিকারিক জোনাথন ডানকান জানিয়েছেন, এই জমি তিব্বতের তিশোর লামার অনুগামীদের দেওয়া হয়েছে, ধর্মীয় উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। দ্বিতীয় জমির সন্ধান পেতে দেরি হল না। সে জমিতে এক সময় মুঘলদের একটা ছোটখাটো কেল্লা ছিল। নবাব সিরাজউদ্দৌলার কাছ থেকে কলকাতা উদ্ধারের সময় ক্লাইভ সেই কেল্লা গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন কামানের গোলায়। জমিটা ছিল বুনো গাছপালা আর ঝোপঝাড়ে ভরা একটা পরিত্যক্ত স্থান। গঙ্গায় জোয়ার এলে ভেসে যেত, এতটাই নিচু। এই জমির সংলগ্ন ছিল কিডের নিজস্ব বাগান ও বাড়ি। তবে সেই জমি ছিল বর্ধমান রাজার সম্পত্তি। তাই কোম্পানির দখলে থাকা অন্য এক জমির বিনিময়ে রাজার কাছ থেকে পাওয়া গেল সেই জমি। জমিতে বাস করত রাজার কিছু প্রজা। কোম্পানি তাদের অন্যত্র ১৪৮ বিঘা ৯ কাঠা জমি ও ৩,১৬৬ টাকা ৪ আনা ক্ষতিপূরণ দিয়ে বাধ্য করল সেই জমি ছেড়ে দিতে।
জমি পাওয়ার ঝামেলা চুকেবুকে গেলে কিড শুরু করলেন আসল কাজ। ১০৯ জন মজুর লাগিয়ে জমির চারপাশে একটা খাল খনন করে, পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেললেন জমিটা। পাঁচিল দেওয়ার কারণ, বুনো মোষের উপদ্রব। খরচ হল ৩৮৪ টাকা। কয়েকটা মাস লাগল জমি সুরক্ষিত করতে।
১৭৮৭ সালে বাগানের সূচনা ৩১০ একর জমি নিয়ে। পরে ৪০ একর জমি— যা কিড সাহেবের সম্পত্তি ছিল— দিয়ে দেওয়া হয় বিশপ’স কলেজকে। সে কলেজ আর নেই। সেই জমিতে এখন বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি। আঠারো শতকে বিশ্বের কোনও বাগান এমন বিশাল পরিধি নিয়ে জন্ম নেয়নি। এমনকি ১৮৪০ সালের আগে বিলেতের বিখ্যাত ‘কিউ গার্ডেনস’ ছিল মাত্র এগারো একর জমি নিয়ে। কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেন বিশ্বের বৃহত্তম গার্ডেনের শিরোপা পরে ছিল বহু বছর ধরে। তবে ভারতে কোম্পানির আমলে এটাই প্রাচীনতম বাগান নয়। এর আগে ১৭৮০ সালে উইলিয়াম রক্সবার্গ— যিনি রবার্ট কিডের পর বাগানের কর্তা হন— তৎকালীন মাদ্রাজের কাছে একটা বোটানিক্যাল গার্ডেন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
কিড ছিলেন মূলত এক জন ফৌজি অফিসার, পেশাদার উদ্ভিদবিদ তিনি ছিলেন না। বোটানিক্যাল গার্ডেনের মতো বস্তু গড়ে তোলার সাংগঠনিক ক্ষমতা তাঁর ছিল। কিন্তু প্রশিক্ষিত উদ্ভিদবিদ না হওয়ার কারণে দারচিনি বা অন্যান্য মশলার গাছ উৎপন্ন করার উপযুক্ত যোগ্যতা তাঁর ছিল না। তাই তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যর্থ হয়। শুধু মশলা গাছেরই উৎপাদন নয়, তাঁর পরিকল্পনা ছিল আরও বড় মাপের। এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের ব্রিটিশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি সংগ্রহ করেছিলেন আশ্চর্য বৈচিত্রপূর্ণ গাছপালা, যেমন পারস্য থেকে খেজুর ও তামাক, চিন থেকে চা, বিলেত থেকে আপেল ও চেরি, মালাবার থেকে চন্দন ও গোলমরিচের গাছ। অতি উৎসাহে এগুলি বাগানে রোপণ করা হয়েছিল, কিন্তু কর্মীদের অভিজ্ঞতার অভাবে এবং বাংলার জল-মাটি-হাওয়া সহ্য করতে না পারায় শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ গাছ নষ্ট হয়ে যায়।
অবশ্য বাগানের পরের ইতিহাস স্বতন্ত্র। অতি গৌরবময়। তার সাক্ষী বর্তমানে বোটানিক্যাল গার্ডেনের ১৪০০ প্রজাতির প্রায় ১৭,০০০ গাছ, বিরল প্রজাতির গাছগাছড়া, ম্যাগনোলিয়া, রোডোডেনড্রন এবং অ্যালপাইনের মতো বিচিত্র পুষ্পসম্ভার। পঁচিশ লক্ষ শুকনো গাছের সংগ্রহ আছে এর হার্বেরিয়াম বা সংগ্রহশালায়।
বিশ্বের উদ্ভিদজগতের প্রতিরূপ এই বোটানিক্যাল গার্ডেন। স্বাধীনতার পর থেকে এই বাগানের তত্ত্বাবধান করে ভারত সরকারের পরিবেশ ও বনমন্ত্রকের অধীন বোটানিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া, যার প্রতীক এই বাগানের মহাবিস্ময়— মহাবটবৃক্ষ। বাগানের প্রতিটি গাছের ইতিহাস আছে। সেগুলি নিশ্চয়ই আকর্ষণীয়, কিন্তু এই মহাবটবৃক্ষের তুলনায় তা কিছু নয়। বস্তুত এই বৃক্ষই দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে প্রধান আকর্ষণ। বয়সে এই গাছ বাগানের থেকেও প্রাচীন। অর্থাৎ বাগান গড়ে ওঠার আগেই ছিল এর অস্তিত্ব। বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ জোসেফ ডালটন হুকার-এর ‘হিমালয়ান জার্নালস’ থেকে জানা যায়, মাটি ফুঁড়ে জন্ম হয়নি এই গাছের। পরগাছা হয়ে সে জন্ম নিয়েছিল এক খেজুর গাছের মাথায়। কালক্রমে গাছটা পুষ্টিলাভ করে, মাটিতে শেকড় চারিয়ে দিয়ে মা খেজুর গাছটিকে মেরে ফেলে। মূল কাণ্ডের অস্তিত্ব নেই। উনিশ শতকের ষাটের দশকে ঘন ঘন দু’বছর প্রবল ঝড়ে বাগানের প্রায় অর্ধেক মহীরুহ ভূপতিত হলেও এই বটবৃক্ষের গায়ে আঁচড়ও কাটতে পারেনি কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ২০১৫ সালেও দেখা গিয়েছে, ৩৭৭২টি ঝুরি মাটিতে প্রবিষ্ট হয়ে স্তম্ভের মতো ধরে রেখেছে এর বিশাল বিস্তারকে, যার পরিধি ব্যাপ্ত প্রায় সাড়ে চার বিঘা জমিতে।
কিডের বাগানের নাম পরিবর্তিত হয়েছে বার বার। ১৭৮৭ সালে জন্মকালে নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ইন্ডিয়ান বোটানিক গার্ডেন’। মহাবিদ্রোহের পর, ব্রিটিশ রাজের আমলে নাম হয় ‘রয়্যাল বোটানিক গার্ডেন’। স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ছিল আটপৌরে ‘কোম্পানির বাগান’ নামে। স্বাধীনতা লাভের ছয় দশক পরে, ২০০৯ সালে বাগানের নতুন নামকরণ হয় ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ইন্ডিয়ান বোটানিক গার্ডেন’। এটা সত্যি যে কিড সাহেব কোম্পানির বস্তুগত লাভের কথা বিবেচনা করেই এই বাগানের পরিকল্পনা করেছিলেন। প্রকৃত অর্থে বোটানিক্যাল গার্ডেন বলতে যা বোঝায়, তা স্থাপনের ভাবনা তাঁর ছিল না। সন্দেহ নেই, ঔপনিবেশিক শাসনের হিতার্থে এবং স্বার্থেই এই বাগানের পরিকল্পনা করেছিলেন কিড। দারচিনি ও অন্যান্য মশলা চাষের সীমিত লক্ষ্য নিয়ে তিনি এই বাগানের সূচনা করলেও, জীবিত থাকতে তাঁর এই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। কিন্তু হেরেও জিতে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর ব্যর্থতাই আক্ষরিক অর্থে বোটানিক্যাল গার্ডেনের আজকের রূপ পরিগ্রহ করার পথ পরিষ্কার করে দেয়। পরবর্তী কালে সঙ্কীর্ণ বস্তুগত লাভের উদ্দেশ্যকে অতিক্রম করে প্রকৃত বোটানিক্যাল গার্ডেনের সমস্ত বৈশিষ্ট্য অর্জন করে গড়ে ওঠে এই বাগান, যা নিয়ে এক
সময় এ দেশের ইংরেজরা যথেষ্ট শ্লাঘা প্রকাশ করতেন প্রকাশ্যে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy