ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ
পূর্বানুবৃত্তি: ক্যাঙারুর প্রসব দেখার কৌতূহল মেটাতে গিয়ে বিবেক বোসের সঙ্গে কথা শেষ হয় না অনিকেতের। কিষণলালের ভাবনা মিথ্যে করে দিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে আসে সলিলসখা। এবার তাকে খেতে দিতে বারণ করেন অনিকেত। সে বন্যপ্রাণ দপ্তরের উদ্ধার করা একটি পুরুষ ভোঁদড়। আগেও সে কয়েকবার ফেরার হয়েছিল। শান্তশিষ্ট গন্ডার বিপুলের মান ভাঙিয়ে সলিলসখার কাছে ফিরে যান অনিকেত। সেখানে কিষণলালের তখন নেহাতই নাজেহাল অবস্থা...
সত্যিই ভোঁদড়টা ওকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে। একবার কুঁইকুঁই করে কিষণের হাতে ধরা বালতিতে উঁকি মারার চেষ্টা করছে, তারপর কিষণের গায়ের উপর ঝাঁপাচ্ছে, শেষে চৌবাচ্চায় ঝাঁপ দিয়ে সারা গা ভিজিয়ে আবার কিষণের গায়ে পড়ছে। অনিকেত ভিতরে ঢুকতে সলিল একটু যেন থতিয়ে যায়, দু’পা পিছিয়ে গিয়ে একটু শান্ত হয়ে অনিকেতকে নিরীক্ষণ করে। অনিকেত লক্ষ করে ওর ঘনকালো মাঝারি সাইজ়ের পুঁতির মতো চোখদু’টো, তাতে মোটেই নির্বোধের লক্ষণ নেই বরং সামনের লোকটাকে যাচাই করার চেষ্টা আছে। ও কিষণকে একটু পিছিয়ে যেতে বলে বালতি থেকে বড় সাইজ়ের একটা ল্যাটামাছ হাতে নেয়, তারপর সলিলের দিকে একপা এগোয়। সলিল আবার মুখে শব্দ করতে-করতে ওর সামনে এসে পিছনের দু’পায়ে দাঁড়িয়ে অনিকেতের হাঁটুর উপরে প্যান্টটা খামচে ধরে হালকা করে, মুখের দিকে তাকিয়ে কুঁইকুঁই করে নিজস্ব ভাষায় কত কী বলে যায়। না খেতে পেয়ে ও কত কষ্টে আছে কিংবা আর ও খাঁচা ভেঙে পালাবে না, ভালমানুষের মতো হয়ে থাকবে, এই ধরনের কিছু হবে হয়তো।
কিন্তু অনিকেত কড়াভাব দেখায়, এককোণে ছায়ায় বড় কিউবের আকারের একটা সিমেন্টের স্ল্যাব আছে, তাতে বসে। কিষণ বালতিটা পাশে রেখে সরে যায়। সলিল ওর মুখভাব লক্ষ করতে-করতে ক্রল করে এগোয়, ওর পায়ের কাছে এসে গুটিসুটি মেরে বসে, যেন কত বাধ্য ছেলে। অনিকেত ওর মাথায় হাত রাখে, তেলতেলে মসৃণ ফারে হাত রেখেই বুঝতে পারে এতে কেন জল আটকায় না। ওদের কনট্যাক্ট কমিউনিকেশন চলে মিনিটদুয়েক, তারপর অনিকেত ওর হাতে ধরা মাছটা সলিলের সামনে আনে। সলিল ওর দিকে তাকায় সরাসরি, ওর মুখের পাশের গোঁফগুলো কাঁপতে থাকে থরথর করে। তারপর আলতো করে মাছটাকে কামড়ে ধরে সড়াত করে জলে নেমে যায়, ডুবসাঁতার দিয়ে চৌবাচ্চাটা একবার লম্বালম্বি পারাপার করে পাড়ে ওঠে। খুব যত্ন করে মাছের মাথাটা ও চৌবাচ্চার বাঁধানো পাড়ে রাখে, তারপর ভিজে শরীর নিয়ে অনিকেতের সামনে এসে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে। অনিকেত ওর মাথায় আবার হাত বুলিয়ে বালতি থেকে আর-একটা মাছ দেয়। সলিলের খেলা চলতে থাকে, একটা করে মাছ, একটু করে জলকেলি। দশ মিনিটের মধ্যে একডজন মাছের মাথা পাড়ের দু’দিকে শোভা পেতে থাকে। অনিকেতের প্রশ্নের উত্তরে কিষণ জানায়, ‘‘ওটাই ওর খাওনের ইস্টাইল, ছ্যার! পেথমে ন্যাজের দিকের ছলিডটুকু খাবে, তারপর খানিকটা করে ছাঁতার দিয়ে খিদে বানিয়ে-বানিয়ে মুড়োগুলো ছাবাড় করবে।’’
খাওয়া শেষ করে পরিতৃপ্ত ভোঁদড়বাবাজি কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ ওর দর্শকদের সাঁতারের অ্যাক্রোব্যাটিক্স দেখানো শুরু করে। ওর কসরতগুলো দেখতে-দেখতে অনিকেতের মনে হয়, অলিম্পিক সাঁতারু হলে কতগুলো প্রাইজ জিততে পারত সলিল! একসময় কিষণই মনে করায়, ‘‘ছকাল থেকে আপনিও তো খায়েন নাই, ছ্যার! ক্যাবল ছলিলের খ্যালা দ্যাখলেই কি প্যাট ভরবে? অ্যাকন চলেন ছ্যার, বিকেলে আবার এসে বছবেন না হয় য্যাতক্ষণ মন চায়।’’
অনিকেত বোঝে, কিষণও বেশ সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। ডিরেক্টর থাকাতে ও-ও ছুটি পাচ্ছে না জলখাবার খেতে যাওয়ার। শেষবারের মতো সলিলের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে ও যখন এনক্লোজ়ার থেকে বেরিয়ে আসে, তখন দেখতে পায়, সলিলও পাড়ে উঠে ওর দিকেই তাকিয়ে বসে আছে। অনিকেত টের পায়, ওর হিসেবের খাতায় পরামানব বন্ধুর সংখ্যা আর-একজন বাড়ল। কিষণ গেটে তালা লাগিয়ে বেরনোর পর অনিকেত ওকে বলে, ‘‘ওয়াইল্ড লাইফ দফতরে তোমার অনেক জানাশোনা বন্ধু আছে শুনেছি, ওদের বলে রেখো তো, মেল-ফিমেল যা-ই হোক, যদি কোনও ভোঁদড় রেসকিউ হয় তো পত্রপাঠ সেটাকে এখানে নিয়ে আসতে। একটা সঙ্গিনী বা নিদেনপক্ষে একটা সঙ্গী পেলেও সলিলের বারমুখো নেচারটা অনেকটা বদলাবে, আর তুমিও রিলিফ পাবে।’’
কিষণ ঘাড় নেড়ে সায় দেয় ওর কথায় ৷
গেটের কাছে খগেনের সঙ্গে দেখা হয়, নমস্কার করে সে জানায়, ‘‘ভাল খবর আছে, স্যার! সোমবার আপনাকে রিপোর্ট করেছিলাম একটা কালনাগিনীকে সাপের ঘরে খুঁজে পাচ্ছি না বলে, সেটাকে আজ একটু আগে পেয়েছি পাশের বাগানে। গাছের ডালে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে ছিল, ধরে এনে ওর ঘরে ঢুকিয়ে দিলাম।’’
তিনদিন আগে একটা কালনাগিনীর মিসিং রিপোর্ট ছিল, এধরনের ঘটনা আকছারই হয়। ছোটখাটো জীবজন্তু এনক্লোজ়ার থেকে এসকেপ করে, আবার কিছুটা খোঁজাখুঁজি করলে পাওয়াও যায় কয়েকদিনের মধ্যে। মনসামঙ্গল কাব্যে বেহুলা-লখীন্দরের কাহিনিতে ভিলেন হলেও, এই সাপ বাস্তবে একনম্বরের ভীরু আর নির্বিষ। সরু, হিলহিলে চেহারা, ফণা নেই, মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত পিঠের উপর দিয়ে লাল দাগ, একটানা না হয়ে কালো দাগের সঙ্গে অল্টারনেট। অনেকে বলে বেহুলার সিঁদুর আর কাজল লেগে গিয়েছিল কালনাগিনীর গায়ে। তবে দু’টো কথা এই সাপ সম্বন্ধে সত্যি— এক, গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে যাওয়ার সময় শরীরটাকে এরা হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে, মনে হয় যেন উড়ে যাচ্ছে আর দুই, শরীরকে অসম্ভব রকম চ্যাপ্টা করে ফেলতে পারে কোনও সরু আর চ্যাপ্টা ফাঁক দিয়ে বেরনোর প্রয়োজনে। এর থেকেই হয়তো লোহার বাসরঘরে ঢোকা-বেরনোর কাহিনি। ওই বিশেষ ক্ষমতার জন্যই খুব যত্ন আর সাবধানতার সঙ্গে রেপটাইল হাউসের এনক্লোজ়ারগুলো নতুন করে তৈরি করা সত্ত্বেও একমাত্র কালনাগিনীই ওখান থেকে বেরতে পেরেছে। খগেনের পিঠ চাপড়ে প্রশংসা করে অনিকেত ওর অফিসরুমে ঢোকে, দেখে চাঁদু ওর ব্রেকফাস্ট চাপা দিয়ে রেখে গিয়েছে দেরি হচ্ছে বলে। খেতে-খেতে ক্লোজ় সার্কিট টিভির ব্যাক-আপ অন করে আজ সকালের স্টোররুম আর রান্নাঘরের রানিং ছবিগুলো দেখতে থাকে।
সিসি টিভি ক্যামেরাও কালীপুর চিড়িয়াখানায় অনিকেতের আমদানি। এগজ়িকিউটিভ ডিরেক্টরের দায়িত্ব নেওয়ার তৃতীয় দিন এক উলোঝুলো চেহারার দাড়িওয়ালা লোক ওর সঙ্গে দেখা করতে আসে। একথা-সেকথা বলার পর সে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলে, ওর কাছে চিড়িয়াখানার অন্দরের বহু গুহ্য খবর আছে, তাই তাকে রসেবশে রাখাটা ডিরেক্টরের অবশ্যকর্তব্য। আগে যারা ওকে গুড হিউমারে রেখে চলেনি তাদের সবাইকার নাকি হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছে সে। অনিকেত অনেকক্ষণ ধৈর্য ধরে ওর কথা শোনে, তারপর বলে, ‘‘দেখুন মিঃ পরিচয় গুপ্ত, বুঝতেই পারছি, এই অফিসেরই কারও সাহায্য নিয়ে প্রশাসনের কিছু দুর্বলতা খুঁজেপেতে বার করে সেগুলো নিয়ে ব্ল্যাকমেল করা আপনার একমাত্র কাজ। তবে একটা ব্যাপারে আপনাকে একটু ধন্যবাদ জানাচ্ছি, অনেক বাজে কথার মধ্যে আপনি জ়ু-প্রশাসনের কিছু ইচ্ছাকৃত এবং অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটির কথা তুলে ধরেছেন। আমি এখানে একেবারেই নতুন, এই দুর্বলতাগুলো খুঁজে বার করে ব্যবস্থা নিতে কিছুটা বাড়তি সময় লাগত, আপনার দৌলতে আজকেই এগুলোর আভাস পেলাম, সত্যিমিথ্যে মিলিয়ে নিয়ে সঠিক ব্যবস্থা অনেক কম সময়ে নিতে পারব।’’
নিরাশ পরিচয় গুপ্ত বিড়বিড় করে অনিকেতকে অভিসম্পাত দিয়ে এবং ভয় দেখিয়ে বিদেয় হয়েছিল। তারপর অনিকেত লোকটির আভাস দেওয়া দুর্বলতাগুলো দ্রুত সংশোধনের কথা ভাবে। গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয় ক্লোজ় সার্কিট ক্যামেরা বসানোর একটা পাইলট প্রজেক্ট চালু করার চিন্তা সেইসময়েই তার মাথায় এসেছিল। পরিচয় গুপ্তর বলা কথার মধ্যে একটা জরুরি বিষয় ছিল জীবজন্তুদের যে খাবারদাবার দেওয়া হয় সেগুলোর মান ও পরিমাণ সম্পর্কে। অবোলা প্রাণীগুলোর জন্যে আনা খাবারের বেশিরভাগটাই নাকি ডিরেক্টর এবং কর্মচারীরা মিলে হাতসাফাই করে খেয়ে ফেলে। অনিকেত হলফ করে বলতে পারে, জ়ু-তে জয়েন না করলে ও নিজেও জানতে পারত না ঠিক কী কোয়ালিটি ও কোয়ান্টিটির খাদ্য ওখানকার পশুপাখিদের দেওয়া হয়। দু’দিন দেখেই ও বুঝতে পেরেছে, যে বড় দু’টো স্টোররুম আর রান্নাঘরে একসঙ্গে পনের-কুড়িজন জ়ু’কিপার যেভাবে খাবারদাবার রেডি করে, তাতে হাতসাফাই করা বা খেয়ে ফেলার কথা ভাবা একরকম বাতুলতা।
তবু যারা এই সিস্টেমের সঙ্গে পরিচিত নয়, তাদের যা খুশি ভাবতে তো ট্যাক্স লাগে না। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বেশ কয়েকজন শিক্ষিত মিডিয়াপার্সনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে অনিকেত নিশ্চিত হয় যে, এ ব্যাপারে জনসাধারণেরও প্রায় একই ধারণা। তখন থেকেই অনিকেত ওর ডিজিটাল ক্যামেরায় চিড়িয়াখানার ভাঁড়ার আর হেঁসেলের ছবি তুলে কম্পিউটারে স্টোর করে, আর সময়-সুযোগ মতো ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মানুষজনকে দেখানো শুরু করে। তারপর একে-একে স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টগুলোয় সিসি টিভি ক্যামেরা ইনস্টল করতে থাকে। ফলে আজ দিনের যে-কোনও সময় অনিকেত ব্যাক-আপ থেকে সব ঘটনা মনিটর করতে পারে, যেমনটা এখন করছে।
৫
পুরুলিয়া গিয়ে বেন্দার মনে হল না আসতে হলেই ভাল ছিল। একে তো অমন হাসিখুশি মানুষটার কাটাছেঁড়া শরীরটা শুধু দেখতেই নয়, নাড়াচাড়াও করতে হল অন্য সবাই পোস্টমর্টেমের পর কেমন দূরে-দূরে সরে থাকছিল বলে, তার উপরে স্বপনবাবুর পরিবারকে অসহায়ের মতো ভেঙে পড়তে দেখে ওরও মনে হচ্ছিল, দূর ছাই, কেন যে মরতে রেঞ্জারবাবু আজকে আমাকে ডেকে আনল এই জায়গায়!
স্বপনবাবু বান্দোয়ানে থাকার সময় ওঁর স্ত্রী বেন্দার কাছ থেকে যেমন টুকটাক কাজ নিতেন, তেমনি আবার ছোট বোনের মতো ভালও বাসতেন। পালাপার্বণে নিজে হাতে রান্না করে বসিয়ে খাওয়াতেন ওকে। এভাবে সংসারটা ভাসিয়ে স্বপনবাবুর চলে যাওয়াটা ও মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। তাই বাকি কোলিগরা আর আত্মীয়স্বজন যখন ওঁর দেহটা নিয়ে দাহ করার তোড়জোড় শুরু করল, তখন ও রেঞ্জারবাবুকে চুপিচুপি বলল, “বড়বাবু, ইয়ারা তো ইখানকার লোক বট্যে, মনে হয় বাকিটা সামাল দিতে পারবেক। হামরা তো সেই দশটার সময় আলি, ইখন না ফিরলে মাঝরাত হইয়েঁ যাবেন আঁজ্ঞা!”
বড়বাবু নিজেও ভিতরে-ভিতরে ছটফট করছিলেন, সকাল থেকে অনেক দৌড়ঝাঁপ হয়েছে। এত ঘনিষ্ঠ ছিল স্বপন যে, মনে আত্মীয়-বিয়োগের মতোই তীব্র কষ্ট। তা সত্ত্বেও হসপিটাল-মর্গ-শ্মশানঘাট করে যেতে হয়েছে সারাদিন ধরে, শরীর আর বইছে না। প্রস্তাবটা বেন্দার কাছ থেকে আসায় যেন হাতে চাঁদ পেলেন, অনুনয়ের সুরে বলে উঠলেন, “দ্যাখ না বেন্দা, একটু ওদের সঙ্গে কথা বলে, যদি তেমন দরকার না থাকে তা হলে আমরা রওনা দিতে পারি কি না?”
শ্মশানযাত্রীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইকে বান্দোয়ান ফিরতে-ফিরতে সেই রাত দশটা৷ বড়বাবুকে নামিয়ে অফিসের গ্যারাজে বাইক রেখে বাড়ি ফিরে দেখে, বাড়ির সামনে পাড়া-পড়শিদের একটা জটলা। প্রথমেই বুকটা ধক করে উঠল, বুড়ো বাপটা পটল তুলল নাকি? তারপর খেয়াল করল, কান্নাকাটির আওয়াজ তো আসছে না! সেরকম হলে যে দু’জন সবচেয়ে খুশি হবে, তাদের কান্নার শব্দ সবাইকে ছাপিয়ে শোনা যেতই— সনাতনের বৌ সৈরভীর আর আর তার মায়ের।
বেন্দাকে দেখে ভিড়টা দু’-ভাগ হয়ে ওকে ভিতরে যাওয়ার রাস্তা করে দেয়। হাজার হোক, বাড়ির চালু কর্তা। সনাতন এখনও ততটা লায়েক হয়ে ওঠেনি। হঠাৎ ঘরের ভিতরে সাপুড়ের বিন বেজে উঠতে ও আবার চমকে ওঠে, ঘরে নির্ঘাত সাপ ঢুকেছে! বাড়ির পাশেই মাঠ আর ঝিলের পরই জঙ্গল শুরু হয়েছে, চলে গিয়েছে ডুংরির পর ডুংরি পার হয়ে সেই ঝাড়খণ্ড বর্ডার পর্যন্ত। সাপ ঢোকা আশ্চর্য কিছু নয় এখানে।
কথায়-কথায় জানা গেল সৈরভীই প্রথম সাপটাকে আলো-আঁধারে বেন্দার ঘরে ঢুকতে দেখে রাত আটটা নাগাদ। ও চেঁচামেচি শুরু করতে বাকি সকলে জড়ো হয়। সনাতন আর ওর দাদুর বক্তব্য ছিল, ওটা দাঁড়াশ সাপ, বিষটিষ নেই। মাঝে-মাঝে ইঁদুর ধরতে এ-ঘরে ও-ঘরে ঢুকে পড়ে। সৈরভী জোর দিয়ে বলতে থাকে, সাপটা কালো নয়, মেটে-হলুদ রংয়ের, তাতে চাকা-চাকা দাগ, মোটা আর বেঁটে। তাতে সনাতন ঠাট্টা করতে থাকে বৌকে, “পাশের ডোবা থেকে জলঢোঁড়া সাপ ঢুকেছে হয়তো, তাতেই এত আদিখ্যেতা!” আজকালকার জেদি মেয়ে সৈরভী, কোনও কথা শোনেনি, পাশের গ্রাম থেকে বেশি মজুরির টোপ দিয়ে সাপুড়ে আনিয়েছে। রেঞ্জ অফিস থেকে সাপ রাখার বাক্স আর সার্চলাইটও জোগাড় করিয়েছে।
সাপটার বর্ণনা শুনতেই বেন্দার মাথার ভিতরে যেন টিংলিং বাজনা শুরু হয়ে যায় আপনা থেকেই। অনেক কথা মনে পড়তে চায় এই মেটে-হলুদ রং আর কালো চাকা চাকা দাগের ভিতর থেকে। আর-এক দফা হইচই শুরু হতে ওর ভাবনা বাধা পায়, সাপুড়ে দু’জন বর্ণনামতো একটা মোটা সাপকে ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। একজন মাথার নীচে গলার কাছটা আর অন্যজন লেজের দিকটা ধরেছে, সার্চলাইটের আলো পড়ায় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে মোটা, বেঁটে শরীরটা। ওদিকে চোখ পড়তেই একটা ঝাঁকুনি দিয়ে স্থির হয়ে যায় বেন্দার শরীর আর সময় পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়ে ওর মন।
তখন সবে একসপ্তাহ হয়েছে বোসস্যারের বান্দোয়ান রেঞ্জে জয়েন করার, সেদিন বেলা ন’টা নাগাদ জলখাবার খেয়ে স্যার বললেন, “বৃন্দাবন, বান্দোয়ান বাজার থেকে তো চারদিকে চারটে রাস্তা, আজ আমাকে কোনও একটা দিক ধরে বিহার বর্ডারের দিকে নিয়ে চলো।”
ও ইতঃস্তত করছে দেখে অফিসের দেওয়ালে ঝোলানো ম্যাপটায় ছড়ি ঠেকিয়ে বললেন, “এই যে দুয়ারসিনি বলে জায়গাটা, এটা তো প্রায় বাংলার শেষপ্রান্তে। চলো, আজ ওইদিক থেকেই ঘুরে আসি।”
দুয়ারসিনি যাওয়ার রাস্তাটা স্যারের প্রথমদিনেই ভাল লেগে গেল, বিশেষ করে পারগোড়ার পর থেকে পিচরাস্তার ঢেউখেলানো অংশটা। ওখানে বাইক চালাতে ওরও মজা লাগে, দুইপাশে ঘন জঙ্গলের জন্যে এলাকাটায় বেশ ঠান্ডা-ঠান্ডা ভাব। স্যার তো উচ্ছ্বসিত দু’পাশের টিলা-ডুংরি আর ঝোপ-জঙ্গলের সৌন্দর্য দেখে। সাতগুড়ং নদীর নামেই নদী, আসলে সরু ঝোরা। তার জলে জুতো-মোজা খুলে পা ডুবিয়ে অনেকক্ষণ বসে রইলেন জলে ডোবা একটা পাথরের চাটানের উপর। নদীতে ঝিরঝিরে জল, তলায় বালি আর নুড়িপাথর।
সময়টা নভেম্বর মাস। কালীপুজো হয়ে গেছে। শীত সেভাবে পড়েনি। তবে রোদের তাত অনেক কম। হঠাৎ বোসস্যারের নজর পড়ল নদীর গা ঘেঁষে টিলার যে অংশটা ক্রমশ খাড়া উঠে গিয়েছে বিহারের পাহাড়ি এলাকার দিকে, তার জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় দু’-একটা কুঁড়েঘর মতো। জিজ্ঞেস করলেন, “জঙ্গলের এতটা ভিতরে কী বলো তো এগুলো? গ্রামের শেষ বাড়িও তো আমরা আধ কিলোমিটার আগে ফেলে এসেছি। গ্রামের লোক ওইখানে কুঁড়ে তৈরি করে বাস করতে যাবে কেন?”
(ক্রমশ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy