রুটি
পিনাকী ভট্টাচার্য
মশলা-মদিরা-মাংসের পদ ছেড়ে আমাদের রোজকার থালার প্রাথমিক সদস্য রুটির তল্লাশি করতে গিয়ে দেখি, এ তো কাতলা মাছের চেয়েও ঘোড়েল— ইতিহাসের গভীর দিঘির মধ্যে কখন কোথায় আর কবে যে ঘাই মারছে তার হিসেব পাওয়া দুষ্কর।
পারস্যের থাপ্পড় এমন মোলায়েম ছিল যে তার রেশ ভারত আজও বয়ে চলেছে। ময়দার চাপাটি প্রথম তৈরি হয়েছিল নাকি পারস্যে। চাপাটি শব্দটা আদতে ফারসি— সেই ভাষায় ‘চাপাট’ মানে থাপ্পড় বা চড়। ময়দার লেচি নিয়ে হাতের তালুতে মেরে যেহেতু বানানো হয়, তাই এই নাম। এই রুটি ভারতের নাগরিকত্ব পেয়েছিল অওধ পৌঁছে, কারণ সেখানেই ময়দার বদলে আটা দিয়ে রুটি তৈরি শুরু হয়। রুটির জনপ্রিয়তার মূলে ছিল পর্যটক আর বণিকরা— রুটিকে চোঙা করে পাকিয়ে তাতেই তরকারি নিয়ে খেলে, রুটিই থালা-বাটির কাজ করত। ফলে বাসনপত্র ছাড়া দিব্যি বেড়ানো যেত। পাখতুন প্রদেশ আর ওয়াজিরিস্তানের কিছু অঞ্চলে এখনও পুরনো জমানার গড়নের চাপাটি পাওয়া যায়।
রুটির উৎসের এই তথ্য নস্যাৎ করে দেয় আফ্রিকা। সেখানে ইউরোপের দেশগুলোর মতো আটা গেঁজিয়ে রুটি বানানোর দস্তুর ছিল না— গোল রুটি বানানোর কৌশলের মালিকানা নাকি আদতে পূর্ব আফ্রিকা থেকেই এশিয়া পৌঁছেছিল, কারণ সোয়াহিলি উপজাতির কাছে এই রুটি বহু যুগ ধরেই প্রধান খাবার। আরব বণিকরা সেই আদ্যিকাল থেকে বাগদাদ বা পশ্চিম এশিয়ার কোনও শহর থেকে রওনা দিয়ে পূর্ব আফ্রিকা ছুঁয়ে ইউরোপে সওদা নিয়ে যেত— ফেরার সময় রুটি বানানোর কায়দা শিখে নিজেদের দেশে চালু করে দিয়েছিল এই নয়া খাবার।
আফ্রিকার দাবি সবাই মেনেই নিয়েছিল প্রায়। তখন আবিষ্কার হল, সিন্ধু সভ্যতার আমলেও রুটি ছিল। কৃষিপ্রধান সেই সভ্যতায় জোয়ার-বাজরা চাষের সঙ্গে রুটি বানানোর নিদর্শনও পাওয়া গিয়েছে বিভিন্ন মুদ্রায়। বৈদিক যুগে হোম-যজ্ঞে যে ডাল বা সবজির পুর দেওয়া পুরডাস ব্যবহার করা হত (যা থেকে এখনকার পরোটা এসেছে), তার সঙ্গেও রুটি বা চাপাটির মিল অবাক করে দেওয়ার মতো।
রুটির উৎপত্তি নিয়ে যতই বিবাদ থাকুক, মানতেই হবে, এর জনপ্রিয়তা হয়েছে পর্যটক আর সাধারণ মানুষের হাত ধরে। তবে, ঘিয়ের স্বাদ থাকা সত্ত্বেও খাবারটি সহজপাচ্য বলে, রাজদরবারেও জায়গা পেতে সময় লাগেনি। মুঘল বাদশাদের রুটি-প্রীতি ছিল খুব। ষোড়শ শতাব্দীতে আবুল ফজলের লেখা ‘আইন-ই-আকবরি’তে রুটির কথা লেখা আছে, আকবর নাকি রুটি খেতে খুব ভালবাসতেন। উনি ছিলেন স্বল্পাহারী, একা বসে খেতে পছন্দ করতেন। পাতলা রুটি ঘিয়ে ডুবিয়ে চিনি মাখিয়ে খাওয়া তাঁর প্রিয় শখ ছিল। এমনকী ঔরঙ্গজেব (যিনি স্বাস্থ্য-সচেতনতার কারণে নিরামিষাশী ছিলেন), ছিলেন রুটির গুণগ্রাহী। তাঁর আমলে হাতের তালুর সমান রুটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল— কারণ স্বয়ং বাদশা এমন চাপাটি খুবই পছন্দ করতেন, যা এক গ্রাসে খাওয়া যায়।
রুটির জনপ্রিয়তার পিছনে শুধুই মুঘল পৃষ্ঠপোষকতা আছে, তা নয়। একই সময়ে, ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে লেখা তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’-এ রুটির উল্লেখ আছে। আবার ভারত মিশ্রের চিকিৎসাশাস্ত্রের পুঁথি ‘ভাবপ্রকাশ’ রোটিকা’র কথা বলেছে। এমনকী একই সময়ের কন্নড় সাহিত্যে অনেক জায়গায় আটার রুটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
দুটো বাবাবল্লভি খেয়ে যান
স্বপ্নময় চক্রবর্তী
আমাদের কুলগুরুর শুভাগমে বাড়ির হালুয়া হয়ে যেত মোহনভোগ। সুজিতে দুধ-ঘি-বাদাম-কিশমিশ পড়লে হালুয়া তো মোহনভোগই হয়। গোয়ালাকেও বলা-কওয়া থাকত, গুরুদেব আসছেন, তেরাত্র থাকবেন। ধর্ম বলে সত্যিই কিছু আছে, ফলে সেই তিন দিন দুধ ততটা পাতলা হত না। সেই মোহময়, মোহনভোগময় তেরাত্রে গুরুর সন্ধ্যাহারের জন্য বাবাবল্লভি ভাজা হত, কেনা হত বসমালাই।
বসমালাই ব্যাপারটা চাকুরিজীবীরা কিছুটা জানেন। বস’কে সুকৌশলে দিতে হয়। তেল দেওয়াটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারলে সেটাকে মালাই দেওয়া বলা যায়। কিন্তু কুলগুরুর বসমালাই মানে রসমালাই ছাড়া কিছু না। উনি ওটা সেবা করতে ভালবাসতেন। উনি ‘র’ ধ্বনিটা জাগতিক শব্দ ব্যবহারে উচ্চারণ করতেন না। কারণ তাঁর ইষ্টমন্ত্রে ওই ধ্বনিটা আছে। এ কারণেই রাবড়িকে বলতেন বাব্বি। ঠাকুরমাও রাধাবল্লভির নামটা পরিবর্তন করেছিলেন। পেতলের রেকাবিতে ধূমায়িত, সুগন্ধায়িত সোনালি আভার সুখাদ্যটি রান্নাঘর থেকে এনে ঠাকুরমা বলতেন, আর দুটি বাবাবল্লভি সেবা করুন গুরুদেব...
কুলগুরুর জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন, তাঁর কথায়— বেলওয়ে বথ চালক। মানে রেলের ড্রাইভার। সেই সুবাদে জলশুদ্ধির মন্ত্রটাকে প্রায় বাস্তবায়িত করে ফেলেছিলেন। মন্ত্রটা সবাই জানেন—
গঙ্গে চ যমুনেশ্চৈব গোদাবরী সরস্বতী।
নর্মদে সিন্ধু কাবেরী জলেস্মিন সন্নিধিং কুরু।।
মানে— এই নদীগুলির সমুদয় জল এখানেই একত্রিত করা হোক।
গঙ্গা যমুনা কাবেরী ইত্যাদি নিয়ে ততটা সমস্যা ছিল না। সরস্বতী নিয়ে কিছুটা ছিল, কারণ নদীটার ট্রেস নেই। তবে কিনা প্রয়াগে গুপ্ত সরস্বতী আছে, এই বিশ্বাসে প্রয়াগের জল নিলেই গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী এক সঙ্গেই হয়ে গেল। রেলের ‘পাস’ ব্যবহার করে গুরুদেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র নর্মদা-কাবেরীও ম্যানেজ করে ফেলেছিলেন, কিন্তু সিন্ধুটাই ঝামেলায় ফেলে দিয়েছিল। পাকিস্তানে গিয়ে সিন্ধুর জল সংগ্রহ করা অসম্ভব। মুশকিল আসান করেছিল কুলগুরুর ছ’নম্বর পুত্র। ও তখন হোমিয়োপ্যাথির ছাত্র। ও জেনেছে সূক্ষ্ম মাত্রায় হোমিয়ো ওষুধের শক্তি বেশি। এক আউন্স জলে এক ফোঁটা নাক্স ভোমিকা আরকের যা শক্তি, এক গ্যালন জলে মেশালে আরও বেশি শক্তি। আরব সাগরের জলে সিন্ধু নদ পতিত হয়েছে। গোয়া বেড়াতে গিয়ে এক শিশি আরব সাগরের জল নিয়ে এল। ওই জলে তত্ত্বানুযায়ী শক্তিশালী সিন্ধুর জলও রয়েছে। সেই জলের কিছুটা গঙ্গা-গোদাবরী-নর্মদা-কাবেরীর জলে মিশিয়ে ঝাঁকিয়ে দিলেই বৈদিক মন্ত্রটি বোতল-শরীর পেয়ে যায়। আমাদের কুলগুরু সেই বোতল-জলের দু’ফোঁটা আহ্নিকের সময় তাম্রকুণ্ডে টালার জলে মিশিয়ে নিলেই ওটা ‘গঙ্গেচ যমুনেশ্চৈব’ হয়ে যেত। ওই বোতলটার গল্প ওঁর মুখে শুনে বোতলটাকে অবাক হয়ে দেখতাম— যেন ‘ভারত ও ভূমণ্ডল’ বইটার নদী-নালা চ্যাপ্টারটা ঢুকে বসে আছে।
কুলগুরু আরও একটা ব্যাপার করতেন। সকালের আহ্নিকের পর লুচি-মোহনভোগ সেবনের প্রাক্কালে একটা রুপোর ডিবে থেকে গুরুর প্রসাদ গ্রহণ করতেন। গুরুরও গুরু হয়। আমাদের কুলগুরুরও গুরু ছিল। সেই গুরুর মুমূর্ষু দশায় তাঁর মুখের ভিতরে এক খণ্ড গুড়ের চাক ঘুরিয়ে এনে গুড়টাকে প্রসাদে পরিণত করা হয়েছিল। সেই এক তোলা পরিমাণ পাটালি গুড়ে পোয়াখানেক ভেলিগুড় মিশিয়ে প্রসাদের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছিল। প্রসাদগ্রহণটা নিত্যকর্ম হয়ে যাবার ফলে প্রসাদের ক্ষয়কার্য হতে লাগল। ক্ষয়পূরণের জন্য নব নব গুড় মিশছিল, ফলে গুরুপ্রসাদের হোমিয়োপ্যাথিকরণ প্রক্রিয়া চলছিল এবং প্রসাদ ক্রমশ সূক্ষ্ম মাত্রায় চলে যাচ্ছিল ও শক্তিশালী হচ্ছিল। এবং গুড়-মহিমায় আমাদের কুলগুরু শতায়ু হয়েছিলেন। তিনি আমার পিতামহর চেয়ে বয়সে কিছুটা ছোটই ছিলেন, তবু পিতামহ তাঁকে প্রণাম করতেন। এবং বাড়ির সবাই।
জাতীয় কংগ্রেসের মতোই গুরুদেবরাও বংশানুক্রমিক হন। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র আমাদের কুলগুরু হয়ে গেলেন। আমার দাদু সেই কুলগুরুর স্বর্গারোহণের আগেই মারা গিয়েছিলেন, আর আমার বাবার মধ্যে গুরুভাব প্রবল ছিল না। ঠাকুরমার কারণেই রেল-চাকুরে গুরুপুত্রকে বছরে দুই-এক বার নিমন্ত্রণ করতে হত। উনিও বাবাবল্লভি খেতেন, হোমিয়োকৃত জল ও গুড়পাত্র সঙ্গে রাখতেন। বহু বার টালার জল ও বাজারের ভেলি ঢুকে গেলেও ক্রমশক্তিশালী প্রাচীনতা ওরই মধ্যে বেঁচে ছিল। প্রাচীনতা এ ভাবেই বহমান থাকে।
ঠাকুরমার মৃত্যুর পর গুরুবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়।
সম্প্রতি আবার যোগাযোগ হল।
একটি ছেলে, গোলগাল, দানাদার গলা, বছর চল্লিশ বয়স হবে, গলায় রুদ্রাক্ষ মালা, লাল পাঞ্জাবি, সবুজ উড়নি— আমাদের বাড়ি এল। বলল,আমার দাদুর খাতায় আপনার দাদুর নাম-ঠিকানা ছিল। অনেক খুঁজে আপনার সন্ধান পেলাম। আমি আপনার গুরুবংশ। আমার নাম তান্ত্রিকার্য প্রভাত কুমার সর্ববিদ্যা। টিভিতে প্রোগ্রাম করি।
— তো?
— এক দিন আমার চেম্বারে যেতে হবে। শুটিং হবে। খেলোয়াড়, এম এল এ, এম পি, সিনেমা আর্টিস্ট— সবাই এসেছেন। আপনি আমার নিজের লোক, বলতে গেলে গুরুই হই। কবে যেতে পারবেন?
বুঝলাম এটা গুরু-আজ্ঞা। বুঝলাম এক পিস সাহিত্যিকও ওর দরকার। কে বলে সাহিত্যিকদের কদর নেই?
বলি— দুটো বাবাবল্লভি খাবেন?
ছবি; ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy