Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

মায়ের কীর্তি মুছে দিলেন ছেলে

মা তৈরি করেছিলেন মন্দিরের প্রবেশদ্বার। নকল দাড়িতে, পুরুষের পোশাকে সিংহাসনে বসতেন। পরের প্রজন্ম বদলে দিল সব।

স্মৃতিচিহ্ন: হাটসেপসুটের মন্দিরের ভাস্কর্য

স্মৃতিচিহ্ন: হাটসেপসুটের মন্দিরের ভাস্কর্য

তিলক পুরকায়স্থ
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ২৩:৩২
Share: Save:

প্রাচীন মিশরের সুন্দরী নারী ও রানি বলতে সবাই বোঝেন ক্লিয়োপেট্রা। কিন্তু টলেমি রাজবংশের এই রানির বহু আগেই প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে কয়েক জন রানির খোঁজ পাওয়া যায়, যারা ‘ফারাও’ বা ঈশ্বরের প্রতিভূ হিসেবে রাজত্ব করেছেন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী, বিজ্ঞ, রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন বলে কথিত যিনি, তিনি হলেন রানি হাটসেপসুট।

তাঁর কথা বলতে গেলে, শুরু করতে হয় তাঁর পিতা প্রথম থুটমোস-এর কথা দিয়ে। তিনি সব দিক থেকেই, সে যুগের গড়পড়তা ফারাওদের থেকে আলাদা ছিলেন। তাঁর নির্দেশেই প্রাচীন থিবস নগরী, বর্তমানের কার্নাকের বিশাল আমুন রা-র মন্দিরের প্রবেশদ্বারের সামনে দু’টি তোরণদ্বার এবং সেখানকার হলঘর নির্মাণের সূচনা। দায়িত্বে ছিলেন সে যুগের বিখ্যাত স্থপতি ইনেনি।

এ-হেন প্রথম থুটমোস তাঁর পুত্র এবং ভাবী উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় থুটমোস-এর চেয়ে তাঁর কন্যা হাটসেপসুটকে সিংহাসনের জন্য বেশি উপযুক্ত বলে মনে করতেন। মেয়েকে তাই নিজের মনের মতো করে শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে উপযুক্ত করে গড়ে তোলেন।

প্রথম থুটমোস তাঁরই ছেলে, হাটসেপসুটের সৎভাই দ্বিতীয় থুটমোস-এর সঙ্গে মেয়ে হাটসেপসুটের বিয়ে দিয়েছিলেন। প্রাচীন মিশরে এ রকমটাই ছিল প্রথা। ক্লিওপেট্রা ও তাঁর স্বামী ত্রয়োদশ টলেমিও সম্পর্কে তুতো ভাইবোন।

দ্বিতীয় থুটমোস-এর অকালমৃত্যুর সময়, তাঁর এক রক্ষিতার শিশুপুত্র, ভবিষ্যতের রাজা তৃতীয় থুটমোস ছিল নেহাতই নাবালক। প্রথম থুটমোস, হাটসেপসুটকে সূর্যদেব আমুন রা-র কন্যা বলে ঘোষণা করেন এবং তাঁকে সিংহাসন দেন। মহাভারতের কর্ণ আধিদৈবিক কারণে সূর্যের পুত্র। কুন্তীর আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন আলোর দেবতা। আর, মিশরের বাটসেপশুটকে তাঁর বাবা রাজনৈতিক কারণেই সূর্যতনয়া ঘোষণা করলেন। বিশ্ব জুড়ে উপকথাগুলি অনেকটা এক রকম, মিলতে মিলতেও পুরোদস্তুর মেলে না।

রাজপাট চালানোর পাশাপাশি মিশরের সঙ্গে নানা দেশের বাণিজ্যেও উৎসাহ দেন এই মেয়ে—হাটসেপসুট।

মিশরের এক প্রাচীন দেওয়ালচিত্রে আঁকা আছে, নীল নদের উপর বাণিজ্যপোত নিয়ে, রানি হাটসেপসুট চলেছেন ‘পুন্ট’ নামক দেশে। ফিরে এসে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে তিনি একটি বৃক্ষ রোপণ করেন, তাঁর ভবিষ্যতের সমাধিসৌধের সামনে। সে যুগে ফারাওরা জীবদ্দশাতেই নিজেদের সমাধিসৌধ তৈরি করিয়ে রাখতেন। প্রাচীন পুন্ট ঠিক কোথায় ছিল, ইতিহাসবিদরা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নন। অনেকের মতে এটি হয়তো বর্তমানের সোমালিয়া।

শোনা যায়, হাটসেপসুট ছিলেন অসামান্য সুন্দরী। কিন্তু পুরুষের পোশাকেই, সে যুগের ফারাওদের মতো থুতনিতে নকল দাড়ি লাগিয়ে, খ্রিস্টপূর্ব ১৪৭৯-১৪৫৮ অব্দ অবধি শাসন করেছেন মিশর।

অসাধারণ স্থাপত্যকলার নিদর্শন হিসেবে তিনি লুক্সরে, নীল নদের পশ্চিম তীরে, দাল-আল-বাহারিতে, নিজের সমাধিসৌধ তৈরি করিয়েছিলেন। অনেকে গ্রিক স্থাপত্য পার্থেনন-এর সঙ্গে এর তুলনা টানেন। মনে রাখা দরকার, রানি এটি তৈরি করান পার্থেনন-এরও অন্তত হাজার বছর আগে।

কার্নাক মন্দিরে সূর্যদেব আমুন রা-র মন্দিরটির ব্যাপক সংস্কার করিয়েছিলেন রানি। আবার কার্নাক মন্দিরেই সর্পদেবতা ওয়াজেট-এর একটি মন্দির নির্মাণ করান তিনি। এ ছাড়া কার্নাক মন্দিরে সম্ভবত দু’জোড়া ওবেলিক্স-ও (স্মৃতিস্তম্ভ) নির্মাণ করেছিলেন। শুধু দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের স্মৃতিস্তম্ভটি এখনও অক্ষত।

দুঃখের বিষয়, রানির এমন খ্যাতি প্রথমে তাঁর অকালমৃত স্বামী দ্বিতীয় থুটমোস এবং পরে সৎপুত্র তৃতীয় থুটমোস কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। খ্রিস্টপূর্ব ১৪৫৮ অব্দে রানি হাটসেপসুটের মৃত্যুর সময় তৃতীয় থুটমোস প্রায় পঁচিশ বছরের যুবক। সৎমায়ের জন্য এত দিন তার রাজসিংহাসন না পাওয়ার আফসোস এবং পুরুষতান্ত্রিক অহমিকা, দুই মিলিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন প্রচণ্ড মাতৃবিদ্বেষী।

তৃতীয় থুটমোসও যে এক জন উল্লেখযোগ্য ফারাও ছিলেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহ করে তিনি মিশরের সীমানা বহুদূর বিস্তৃত করেছিলেন। এই কারণে অনেক ইতিহাসগ্রন্থে তাঁকে ‘থুটমোস দ্য গ্রেট’ বলেও বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর মায়ের সমাধি ও মমি বিলুপ্ত হওয়ার পিছনে আসলে তাঁরই ‘অবদান’। ইতিহাসের চোখে এই অপরাধ ক্ষমাহীন।

আসলে, রানির কীর্তিগুলিকে তাঁর পুত্র তৃতীয় থুটমোস বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজের নামে নামাঙ্কিত করে দিয়েছেন। মায়ের পুরুষালি পোশাক এবং ছদ্ম-দাড়ি ছিল তাঁর না-পসন্দ!

অসাধারণ একটি সমাধিসৌধ এবং কার্নাক মন্দিরের চমৎকার স্মৃতিস্তম্ভ বা ওবেলিক্স ছাড়া রানি হাটসেপসুটের আর কোনও স্মৃতিচিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে কার্বন ডেটিং এবং ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত রানির শরীরের কিছু অংশ, যেমন খুলি এবং একটি দাঁত বর্তমানে কায়রো মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। সেটুকুই ইতিহাসের পাওনা।

অন্য বিষয়গুলি:

Hatshepsut Egypt
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy