ছবি: কুনাল বর্মণ
একটা তালা আর একটা চাবি!” লিলুয়ার পঞ্চাশ তলা বাড়ির দোতলার ফ্ল্যাটে বসে বলল পঁয়ত্রিশ বছরের সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী জানকী শর্মা, “কলকাতার দুটো আলাদা জায়গায় জিনিস দুটো রাখা আছে। মিখাইল, আপনার কাজ হল আজ রাত বারোটার আগে চাবি দিয়ে তালাটা খোলা।”
“আরও ডেটা চাই,” জানকীর দিকে তাকিয়ে বললেন আমেরিকার অন্যতম কৃত্রিম মেধা বিজ্ঞানী, সত্তর বছরের মিখাইল অল্টম্যান।
“চাবি হল রঞ্জন নামের একটি ছেলের আইরিস বা কনীনিকা। সে রয়েছে কলকাতার বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজের একটি কেবিনে। আর তালা হল ‘ওম’ নামের একটি সুপারকম্পিউটার যার মধ্যে ‘মাইন্ডমাস্টার’ নামের একটি প্রোগ্রাম রান করছে। ‘ওম’ রাখা আছে পূর্ব কলকাতার জলাভূমির ‘মড়াচর’ দ্বীপে।”
“সমস্যাটা কোথায়?”
“প্রথম সমস্যা, রঞ্জনকে ২০২৫ সালে ঘুম পাড়ানো হয়েছিল। ফাঁসির বদলে ঘুম পাড়িয়ে রাখার নিদান সেই বছর থেকেই চালু হয়। এটা ২০৩৩ সাল। লম্বা ঘুমের পরে ওর স্মৃতির কী অবস্থা— জানা নেই। তা ছাড়া গত আট বছরে তুমুল বদলে-যাওয়া কলকাতা শহরে ও প্রতি পদে হোঁচট খাবে। দ্বিতীয় সমস্যা, মড়াচরকে ঘিরে যে খাল আছে তাতে অঢেল কুমির আর সাপের বাস। মড়াচরে একটা মানুষখেকো বাঘিনিও রাখা আছে।”
“কোনও পেশাদার শিকারি কি রঞ্জনকে উদ্ধার করে মড়াচরে নিয়ে যেতে পারে না?”
“রাত আটটা থেকে পরের দিন সকাল আটটা পর্যন্ত কলকাতা শহরে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ। কলকাতায় থাকে আমার বাবা দশানন শর্মার মতো ধনী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। কাজেকর্মে তাদের সাহায্য করে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স পাওয়ার্ড ‘হিউম্যানয়েড রোবট।’ রঞ্জন যেগুলোর নামকরণ করেছিল ‘হি-রো।’ বাকি সব মানুষ কলকাতার বাইরে থাকে। অল্প কয়েক জন সকালে বায়োমেট্রিক অ্যাটেনডেন্স দিয়ে কলকাতায় ঢোকে। রাতে সেই ভাবেই বেরিয়ে আসে।”
“আমার আরও ডেটা লাগবে।”
“বলছি স্যর,” পানীয় জল এগিয়ে দিল জানকী।
মিখাইলের জলপানের মধ্যে টুক করে জেনে নেওয়া যাক তাঁর সঙ্গে জানকীর কী ভাবে আলাপ হয়। ‘সিটেশান ট্রান্সলেশন ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘সেটি’ নামে একটি প্রজেক্টের প্রধান ছিলেন মিখাইল। ২০২৫ সালে জানকী সেই প্রজেক্টে যোগ দেয়। ২০৩০ সালে প্রজেক্ট ছেড়ে দিলেও মিখাইলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। জানকীর অনুরোধে আজই তিনি আমেরিকা থেকে উড়ে এসেছেন বর্ধমান বিমানবন্দরে। সেখান থেকে লিলুয়ার এই ফ্ল্যাটে।
জানকী বলল, “২০২৪ সালে মেরিন বায়োলজিতে এআই-এর প্রয়োগ নিয়ে গবেষণা করতে আমি মিশিগান যাই। রঞ্জন ওখানে গিয়েছিল বায়ো ইঞ্জিনিয়ারিং-এ এআই-এর প্রয়োগ নিয়ে গবেষণা করতে। প্রথম আলাপেই প্রেম। সেটা বাবা জানতে পেরে রঞ্জন সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়। এবং এতটাই ইমপ্রেসড হয় যে রঞ্জনকে নিজের কোম্পানি ‘মুক্তি কর্পোরেশন’-এর প্রধান বিজ্ঞানীর চাকরি দেয়। রঞ্জন সেখানে ‘মাইন্ডমাস্টার’ ল্যাব তৈরি করে।”
“তোমার বাবা কী করেন? আর এই ‘মাইন্ডমাস্টার’ ব্যাপারটাই বা কী?”
“আমার বাবা দশানন শর্মা বাংলার ধনীতম ব্যবসায়ী। বাবার কোম্পানি ‘মুক্তি কর্প’ আগে কৃত্রিম মেধা চালিত সফ্টওয়্যার আর অ্যাপ বিক্রি করত। ‘মাইন্ডমাস্টার’ এমন একটা প্রোগ্রাম যা ডেটা মাইনিং, মেশিন লার্নিং, এআই, চ্যাটবট আর রোবটিক্স মিলিয়ে তৈরি। এটা রঞ্জনের আবিষ্কার। প্রোগ্রামটা ব্যবহার করলে হিউম্যানয়েড রোবটরা শ্রমনির্ভর এবং স্বল্প-মেধানির্ভর সমস্ত কাজ করে দেবে। কর্মচারীরা অসুস্থ হলে, তাদের পিরিয়ড বা প্রেগন্যান্সি হলেও কাজ চালু থাকবে। বাংলার সমস্ত কোম্পানি প্রোগ্রামটা কেনার ফলে বিরাট সামাজিক বদল আসে। শ্রমিক, কৃষক, কুলি, দারোয়ান, কেরানি বা টেলিকলারের দরকার ফুরিয়ে যায়। শিক্ষকতা, ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারির মতো পেশাও অবলুপ্তির পথে। শিল্পীরা বেকার। আর সব কিছুর মূলে যে মানুষটা, গত আট বছর ধরে আমার ভালবাসার সেই রঞ্জন ঘুমিয়ে আছে হাসপাতালের কেবিনে। আমার বাবা ওকে
ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে।”
“তোমার প্রেমিকের এ কী অবস্থা হয়েছে জানকী!”
মিখাইল গম্ভীর।
“প্রেম না দেশপ্রেম জানি না মিখাইল,” চোখের জল মোছে জানকী, “বাংলার ঘরে ঘরে মানুষ নেশা করে পড়ে আছে। শ্রমিক আর কৃষকরা খেতে না পেয়ে বৌ-বাচ্চাকে খুন করার পরে আত্মহত্যা করেছে। মেধাবীরা অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। এ জিনিস দেখা যায় না। আপনি প্লিজ় মাইন্ডমাস্টার প্রোগ্রামটা শাটডাউন করুন। সেই জন্যেই আপনাকে ডাকা।”
“হুম!” আর এক ঢোক জল খেলেন মিখাইল, “রঞ্জনের অনুপস্থিতিতে ওই মাইন্ডমাস্টার কী ভাবে রান করছে?”
“ওমের পাসওয়ার্ড হল রঞ্জন অথবা আমার বাবার কনীনিকার স্ক্যান। মড়াচরের বাড়ির প্রধান ফটক খোলার জন্যে লাগে রঞ্জন বা বাবার আঙুলের ছাপের স্ক্যান। বাবা সপ্তাহে এক দিন স্পিডবোট চালিয়ে মড়াচরে যায়। তখন বাঘিনিকে গুলি করে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। সারা সপ্তাহ স্পিডবোটটা জলের তলায় থাকে।”
“শেষ প্রশ্ন। আজ রাতে মাইন্ডমাস্টার শাটডাউন না করলে কী হবে?”
“আজ রাত ঠিক বারোটার সময় মাইন্ডমাস্টারের বাজার খুলে দেওয়া হচ্ছে সারা পৃথিবীর জন্য। বাংলায় যা ঘটে গেছে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সারা পৃথিবী জুড়ে সেটাই ঘটবে। পৃথিবীটা মানুষের না কৃত্রিম মেধার— সেটা রাত বারোটার আগেই ঠিক করতে হবে।”
চিবুক চুলকে মিখাইল বললেন, “এখন বাজে সন্ধে সাতটা। আগামি পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে রঞ্জনকে ঘুম থেকে তুলে ওর অতীত মনে করাতে হবে। হাসপাতাল থেকে মড়াচর নিয়ে যেতে হবে। তার পর কুমির আর সাপে ভরা খাল পেরিয়ে ও এমন একটা দ্বীপে যাবে, যেখানে মানুষখেকো বাঘিনি আছে। সেখানে গিয়ে ওমের অ্যাকসেস নিয়ে মাইন্ডমাস্টার শাটডাউন করবে। এবং এই কাজে রঞ্জনকে কোনও মানুষ সাহায্য করতে পারবে না। দ্যাট’স গ্রেট!”
তার পর ল্যাপটপ খুলে বসলেন...
*****
ঘুম থেকে উঠে রঞ্জন দেখল, সে হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে আছে। পুষ্টি আসছে আই-ভি চ্যানেল দিয়ে। নানা ইলেকট্রোড আর প্রোব শরীরের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে। সে এখানে কী করছে? কিছু মনে পড়ছে না কেন?
কারা যেন কেবিনে ঢুকছে। চোখ বুজল রঞ্জন। ওরা কী বলে শোনা যাক।
ধাতব পুরুষকণ্ঠ বলল, “বুঝলেন সিস্টার, পেশেন্টের কেবিনে শ্বন এসেছে। এর মানে হল পেশেন্ট কিছু ক্ষণের মধ্যে মারা যাবে।”
মরে যাওয়ার খবর শুনে চোখ খুলে রঞ্জন দেখল, তার সামনে দু’টি হিরো দাঁড়িয়ে। ছেলে হিরোটি ডাক্তার এবং মেয়ে হিরোটি নার্স।
রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, “আমার কী হয়েছে?”
ডাক্তার বলল, “আপনাকে হাসপাতালে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। আর হয়তো জাগানো হত না। কিন্তু আজ রাত সাড়ে সাতটার সময় শ্বন আপনার কেবিনে এসে টানা দু’ঘণ্টা বসে আছে। তাই জাগানো হল। এই নিন ছুটির টিকিট। এক্ষুনি হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান। রোগী এখানে মারা গেলে স্বাস্থ্য-বিনিয়োগকারীরা রাগ করেন।”
ছুটিকিট নিয়ে রঞ্জন বলল, “শ্বন কে?”
নার্স বলল, “শ্বন এই হাসপাতালের অনেকগুলো কেয়ার-গিভার কুকুরের মধ্যে একটা। কেউ মারা যাওয়ার ঘণ্টা তিনেক আগে ও তার কাছে গিয়ে বসে থাকে। গবেষণা করে জানা গেছে, মরণাপন্ন রোগীর শরীর
থেকে যে সব নিউরো-কেমিক্যাল বেরোয় সেটা শুঁকে ও নেশা করে।”
হিরো দু’টি বেরিয়ে গেল। বিছানা থেকে ঝুঁকে রঞ্জন দেখল, বাদামি রঙের একটি কুকুর মায়াভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হাত নেড়ে রঞ্জন বলল, “হাই শ্বন!”
রঞ্জনকে বেজায় ঘাবড়ে দিয়ে তার মুখ থেকে এক ফুট দূরে মায়াবী নীল রঙের ভার্চুয়াল পর্দা ফুটে উঠল। কমিকসের চরিত্ররা যেমন স্পিচ বাব্ল বা কথা-বুদবুদের মধ্যে সংলাপ বলে, অবিকল সেই কায়দায় পর্দায় বাংলা হরফ টকাটক ফুটে উঠছে, “হ্যালো! আমি শ্বন। আমাকে জানকী পাঠিয়েছে।”
জানকী! একটিমাত্র শব্দ! জলপ্রপাতের মতো, পাহাড়ি ধসের মতো, বুকে তির-লাগা গেম বার্ডের মতো আছড়ে পড়ছে রঞ্জনের স্মৃতি-সমগ্র। অবিশ্রান্ত, একটানা, বিরামবিহীন...
“চলো, যাই...” পর্দায় ফুটেছে নতুন দু’টি অক্ষর।
স্মৃতির পাহাড় জোর করে সরিয়ে রঞ্জন বলল, “শ্বন, তুমি যা বলছ সেটাই কি ভার্চুয়াল মনিটরে ফুটে উঠছে?”
“ঠিক ধরেছ। এই পর্দার নাম ‘চ্যাট অন ডিমান্ড’ বা ‘সি-ও-ডি’ বা ‘কোড।’ আমার বলা কথা যে তুমি দেখতে পাচ্ছ, একে ‘কোড’ করা বলে। আমি না চাইলে তুমি দেখতে পাবে না। এ বার চলো!” বিছানায় সামনের দু’পা তুলে রঞ্জনের জামা ধরে টানছে শ্বন।
“কিন্তু ওরা যে বলল, আমি আর একটু পরেই মরে যাব!”
“এটা ঠিক যে, আমি যার কাছে যাই সে মারা যায়,” কেবিন থেকে বেরোনোর সময় শ্বন কোড করল, “কারণ আমি মৃত্যুর গন্ধ পাই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy