এ বছর সতেরোই মার্চ ঘুম থেকে উঠে জানতে পারলাম, আমি মারা গেছি। তাও আজ নয়, পাক্কা ঊনত্রিশ বছর আগে। অর্থাৎ, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভাঙা কিংবা মেসির ফুটবল— কিচ্ছুটি জেনে যাওয়ার কথা নয় আমার। অথচ এ সব ভুবন বদলে দেওয়া ঘটনা আমি স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করেছি। চোখ রগড়ে ঘুম তাড়িয়ে ভাল করে মোবাইল নিয়ে নিজের মালা দেওয়া ডিজিটাল ছবি দেখতে বসলাম। ও হরি! আমার ছবির নীচে অনিল চট্টোপাধ্যায়ের নাম। তিনি ঊনত্রিশ বছর আগে সতেরোই মার্চ মারা যান। দেখুন আমার হয়তো অনিলবাবুর সঙ্গে মুখের, অভিনয়ের মিল আছে। আমি ‘মেঘে ঢাকা তারা’, যা কিনা কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত, তাতে অনিলবাবুর ভূমিকায় অভিনয় করার পর সেই ধারণার জন্ম হয়, যা দিনে দিনে আরও পোক্ত হয়েছে। তাই বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টানোর তাড়ায় ছবিতে মালা পরিয়ে দিবি বাপধন? আমার প্রৌঢ়া মা সকালে উঠে ফুলের ছবি-সহ আমাকে পাশের ঘরে গুড মর্নিং পাঠাতে গিয়ে এই পোস্ট দেখে ঘেমে নেয়ে একশা। থেকে থেকে খাবারের অ্যাপ খুলে বিপি-র ওষুধ খুঁজছে। পিসি বিলাপ করছে, “ছেলেটা বালি গেল, কিন্তু দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিল না, তখনই মনটাকু ডেকেছিল...”
পিসিকে কী করে বোঝাই, এই বালি ইন্দোনেশিয়াতে! এ দিকে নিজের ভূগোল বদলে গেছে, পিসিকে ভুগোল বোঝাব কী! যে বন্ধুর থেকে কোভিডে ধার নিয়েছি, সে শুধু আমার ছবিতে মালা দেখেই আর্তনাদ করতে করতে দৌড়ে এসেছে। কেলেঙ্কারি কাণ্ড। কাকে কী বলি?
শেষে ঘরে ঢুকে অনিলজেঠুকেই অভিযোগ জানালাম, “এটা কেমনধারা ব্যাভার জেঠু? তোমার ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘মহানগর’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘নির্জন সৈকতে’ কিচ্ছুটি পেলাম না, গলায় মালা জুটে গেল?”
সোজা কথা সোজা ভাবে বলে ফেলা ভাল। অনিলবাবুর সঙ্গে আমার নাম যত বার জোড়ে, আমার স্টারডম বাড়ে বই কমে না। উপরের ফিল্মোগ্রাফিটা তো হালকা করে বললামই, তপন সিংহ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘সাগিনা মাহাতো’ ছবি চলাকালীন দিলীপকুমার উর্দুতে লেখা সিন চান তপনবাবুর কাছে। সেই মুহূর্তে বাংলার গ্রামে চল্লিশ ডিগ্রিতে শুট হচ্ছে, ওখানে কে লিখবে উর্দু হরফে? কিন্তু-কিন্তু করে এগিয়ে এলেন অনিলবাবু… তার পর মুক্তোর হরফে সেই যে লিখলেন, দিলীপকুমার ফ্যান হয়ে গেলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়ের। তার পর তপন সিংহ বলছেন, যত শুটিং এগোল, দিলীপকুমারের বিস্ময় বাড়তে থাকল অনিলবাবুর টাইমিং দেখে, অভিনয় দেখে। পরবর্তী কালে, দিলীপকুমারের অনুরোধে যখন হিন্দিতে আবার ‘সাগিনা’ করতে রাজি হন, ‘সিন্হাসাহেব’ এর কাজে নাক গলানোর ক্ষমতা ‘দিলীপসাব’-এরও ছিল না। শুধু আমতা আমতা করে বলেছিলেন, হিন্দিতেও অনিলদা থাকতে পারেন না? আমি জানি প্রসঙ্গান্তর, তাও এই ক্ষোভটুকু বাংলা ছবির এক জন ছাত্রের থাকতেই পারে, তাই বলছি অনিলবাবুর বেশি ফ্যান না থাকলেও এক জন ফ্যানের নাম দিলীপকুমার। কে দিলীপকুমার? যিনি সেই সময় কিচ্ছু না জেনে বম্বেতে নিজের মেধায় মেথড অ্যাক্টিং আবিষ্কার করছেন। শুধু তা-ই নয়, ভারতের সমস্ত ভাষা মিলিয়ে পাঁচ জন অভিনেতা-নায়কের নাম লিখতে হলে দিলীপকুমারের নাম লিখতে হবে বলেই আমার বিশ্বাস (যদিও তা অবশ্যই তর্কযোগ্য, দিনের শেষে শিল্পে কোনও কিছুই সুপারলেটিভ হয় না)। তো অনিলবাবুর মৃত্যুদিনে অবশ্যই শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাও বাপুরা। আমার সঙ্গে গুলিয়ো না, সবটাই তোমার রিচ হয়ে গেলে সেই রিচের মাথায় বাড়ি (এটা মা বলেছে লিখতেই হবে, মা এখনও রেগে)।
কিন্তু যাকগে, আশকথা-পাশকথা তো হল, এই বার আসল কথায় আসি— ‘যারা আয়নায় মিলেছিল’ অর্থাৎ, সেই সব মানুষ, যারা এক রকম দেখতে। দেখুন বন্ধুগণ, আমার নদিয়ার দশেরে গ্রামের এক ফরসা পিসেমশাইকে, আমাদের ছোটবেলায় বুলেট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক সদাহাস্যময় কাবুলিওয়ালার মতো দেখতে, কিন্তু এ সব গল্প বলে তো লাভ নেই। আপনারা এদের চিনবেন না। পিসেমশাই এক সিটিংয়ে খুর আর শিং বাদ দিয়ে গোটা পাঁঠা সাবড়ে দিতেন, কিন্তু গুগলে এর উল্লেখ নেই, তাই এদের গুগল করলেও পাবেন না। তাই আলোচনা চেনা পরিসরেই হওয়া ভাল।
আমাদের ছোটবেলার টিভি ভারী অবাধ্য ছিল, অর্ধেক সময় তাকে চাবকে, মানে থাবড়ে সিধে করতে হত। তাই সেখানে দারা সিং আর চাঙ্কি পাণ্ডে গুলিয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু ছিল না। টিভির মন ছিল তখন, তা ভাল থাকলে মাধুরী দীক্ষিত, খারাপ থাকলে ললিতা পওয়ার। বাজ পড়লে তো টিভি-মেকানিকরা বৃষ্টিতে বেরিয়ে স্ক্রুড্রাইভার দিয়ে ডান্ডিয়া খেলত। কিন্তু তার মধ্যে টিভির ‘গুড হেয়ার ডে’ থাকলেও আমি ‘চিত্রহার’-এ রাজেন্দ্রকুমার আর দিলীপকুমারকে দেখলে গুলিয়ে ফেলতাম। আর যে হেতু বাড়িতে নাটকের আবহ ছিলই, মনের মধ্যে একটা আবছা কিছু তৈরি হচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না, এক-এক দিন লোকটাকে এত ভাল লাগে, আর অন্য দিন রাজপুত্র সেজে এই একই লোক অকারণে হাউমাউ করে কেঁদে রফির গানগুলোকে খুন করছেন কেন? পরে জেনেছি, রাজেন্দ্রকুমার নিজেই বলেছেন, তিনি ‘দিলীপ সাব’ দ্বারা প্রভাবিত।
এ রকম ঘটনা কম নেই। আপনি ইটালির উমবের্তো আই-এর কথা ধরুন। তিনি এক নিরীহ রেস্তরাঁয় খেতে বসে আবিষ্কার করেন নিজের মতো দেখতে আর এক জনকে। তার পর জানতে পারেন সেই ভদ্রলোক তার সঙ্গে একই দিনে জন্মেছেন, এমনকি স্ত্রীর নামও এক। উনি একই দিনে রেস্তরাঁ খুলেছেন যে দিন উমবের্তোর রাজ্যাভিষেক হয়েছে। এমনকি পরবর্তী কালে জানা যায় উমবের্তো যে দিন খুন হন, সে দিনই নিজের রেস্তরাঁয় খুন হনওই ভদ্রলোক।
আমার বড়পিসির নজরও বড়। দাদার পৈতেতে উনি ভাগলপুরের মেজমেসোকে প্রথম দেখেন। পিসি মেজোমেসোকে সমানে বলে চলেছেন, “তোমাকে বাংলা ছবিতে দেখেছি না?”
মেজোমেসো অকূল পাথারে। তিনি শুধু ঘুষ খান, ফুটেজ নয়। তাও প্রচুর ভেবে উত্তম,অসিতবরণ ঘুরে বিশ্বজিৎ হয়ে নিজের ভাবনা থামিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত বড়পিসির মুখ উজ্জ্বল হল, “চিনতে পেরেছি, অবিকল নবদ্বীপ হালদার!”
বুইতে পারছেন ব্যাপারটা? সে বার আমার দাদার পৈতের দণ্ডীর সঙ্গে যে মেজমাসির বিয়ের দণ্ডী ভেসে যায়নি, তা এক প্রকার ভাগ্যই বলতে হবে। এই সব দুর্ঘটনা আপনার আমার সবার বাড়িতেই ঘটেছে, নতুন কিছু নয়।
পরভিন বাবি মুম্বইয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যখন নিজের বাড়িতে নিজেকে বন্দি করে রেখে, দীর্ঘ দিন কিছু না খেয়ে মারা গেলেন, তখন তাঁর এক সময়ের প্রেমিক মহেশ ভট্ট একটি কলাম লেখেন। তাতে তিনি দুঃখ করেছিলেন, “হয়ে উঠতে চাওয়া জ়িনত আমন-এর তকমা পরভিনকে সারা যৌবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।” ভেবে দেখতে গেলে পরভিন বাবির হিট-এর সংখ্যা জ়িনত আমন-এর চেয়ে খুব কম হবে না। বিগ বি-র সঙ্গেই তো গুচ্ছখানেক হিট। কিন্তু সেই সময় না থেকেও বুঝতে পারি, দেব আনন্দের স্পর্শে ও রাজ কপূরের দৃষ্টি বেয়ে জ়িনতের যে চোখ-ধাঁধানো উপস্থিতি আসমুদ্রহিমাচল নাড়িয়ে দিয়েছে, তার সঙ্গে তুলনা পরভিন বাবিকে ব্যথিত করেছে চিরকাল। আর ভাবতে বসে অবাক লাগে, যখন চার-পাঁচ বছর বয়সে ‘চিত্রহার’ দেখে আমরা নায়ক-নায়িকা চিনছি, তখন তো আমরা স্টাইল আইকন কী, সেক্স অ্যাপিল খায় না মাথায় দেয় বুঝতাম না, আমরাও কিন্তু জ়িনত আর পরভিনকে কাছাকাছিই ভাবতাম। যেমন অনেক দিন অবধি বুঝতে পারিনি নবীন নিশ্চল কে আর অনিল ধওয়ন কে। আমার ধারণা, সুখেন দাস আর শক্তি ঠাকুরকে গোলায়নি, ছোটবেলায় এমন বাঙালিও বিরল।
এই যে আপনাদের প্রিয় অভিনেতা বিশ্বনাথ বসু, যার নিত্যনতুন অভিনয় আপনাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে, সে তো আমাকে নিজের ভাইয়ের মতো স্নেহ করে। বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে আমাদের ফোন নিজেদের মধ্যে অবারিত। কিন্তু কোনও দিন আমার কথার গুরুত্ব দিল না। কবে থেকে বলছি, ফিটনেস আর ফিল্ডিংয়ে মন দাও, তা না, গরমে হিমসাগর আর শীতকালে নলেন গুড় সাঁটিয়েই চলেছে। না হলে সুরেশ রায়নার সঙ্গে আমার বিশ্বনাথদার ফারাকটা কী বলুন তো! একদম অবিকল একই তো। কোথায় চেন্নাইতে থালার সঙ্গে খেলবে তা নয়, বিশ্বনাথদা আড়বেলিয়ায় নিজের দেশের বাড়িতে থালাভর্তি মাখা সন্দেশ খাচ্ছে। কিন্তু ভেবে দেখতে গেলে ভালই তো হয়েছে! সুরেশ রায়না কি পারত পেটকাটা-ষ’এরঅভিনয়টা করতে?
এই যে আরবাজ় খান জীবনে টেনিস না খেলে মুন্নি কেন বদনাম তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করে গেল, এ তো ভারতবাসীর সার্বিক ক্ষতি। আমরা একটুর জন্য রজার ফেডেরারকে পেলাম না। দু’জনের কী আশ্চর্য মিল। যেন টেনিস কোর্টে আলাদা হওয়া দুই ভাই।
এই বছর আইপিএল যেমন সরগরম ক্যাভিট সেটিন গানার-কে নিয়ে। না, উনি কোনও দলের হয়ে খেলছেন না, এবং উনি যে দেশের লোক, সম্ভবত ক্রিকেট কেমন খেলা তা-ই জানেন না। তা হলে? এই ক্যাভিট সেটিন গানার ভদ্রলোক তুরস্কের অভিনেতা এবং অবিকল বিরাট কোহলির মতো দেখতে। এবং সে যে কী মিল, না দেখলে পেত্যয় যাবেন না বাবুমশাইরা! অনুষ্কা পর্যন্ত ভিরমি খেয়ে এক পাক তুর্কি নাচ নেচে দেবে এমন মিল!
আচ্ছা, আপনারা অনিল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার মিল পান। অনিলবাবু আর গুরু দত্তের মিল আপনাদের চোখ পড়েনি? আমি তো প্রচণ্ড মিল পাই। গুরু মনেপ্রাণে বাঙালি ছিলেন, সাজতেন বাঙালি মতে। তাই অনিলবাবুর সঙ্গে মিল আরও বেশি করে চোখে পড়ত।
১৯৬৬-তে ব্রিটেন এবং বিশ্ব জুড়ে রটে যায় যে, বিটল্স-এর পল ম্যাকার্টনি মোটর দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, এবং কাউকে জানতে না দিয়ে বিটলস তার মতো দেখতে আর এক জনকে নিয়ে এসেছে। এখন ২০২৫-এ আপনার এটা শুনে হাসি পেতে পারে, কিন্তু সেই সময় এই তত্ত্ব জল-হাওয়া পেয়ে রীতিমতো ফুলে-ফেঁপে ওঠে। জন লেনন যে বলেছিলেন, সেই মুহূর্তে বিটলস জিশুর চেয়ে বেশি জনপ্রিয়, তা নিছক অতিশয়োক্তি ছিল না। তাই ম্যাকার্টনির মৃত্যুর তত্ত্ব নিয়ে রীতিমতো সাড়া পড়ে যায়। তা নিয়ে অনুসন্ধান, আলোচনা শুরু হয়ে যায়। আপনাকে সময়টা বুঝতে হবে, মাত্র দু’দশক আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। সেই বিশ্বযুদ্ধে কী হয়েছে? ধরুন আপনি স্ট্যালিনকে গুলি করতে চান, কিন্তু গুলি করলেন ইউক্রেনের চাষিকে, স্ট্যালিনের লোক বেচারাকে এক রকম সাজিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। আপনি হিটলার ভেবে পোল্যান্ডের রাজমিস্তিরির গোঁফ উপড়ে নিলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। বুঝতে হবে, গেস্টাপো তেমনটাই চেয়েছিল। তাই বড় মানুষদের দু’-চারটে যমজ যে থাকতে পারে, এই তত্ত্ব তখনকার পৃথিবী একেবারে উড়িয়ে দিতে পারত না। কাজেই পল ম্যাকার্টনির মৃত্যুর তত্ত্ব দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ‘পল ইজ় ডেড’, এই ইংরেজি বাক্যবন্ধটি ব্রিটিশ পপ কালচারের অংশ হয়ে ওঠে। ম্যাকার্টনি নিজে পরবর্তী কালে ব্যঙ্গ করে ‘পল ইজ় লাইভ’ কভার করেন। ‘টাইম্স ম্যাগাজ়িন’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সমস্ত তত্ত্ব উড়িয়ে দেন। কিন্তু আজও ব্রিটেনের কোনও টিউবে আপনার কানের কাছে কেউ যদি ফিসফিস করে বলে ‘পল ইজ় ডেড’, চমকে যাবেন না কিন্তু!
এটা বহুচর্চিত একটি ঘটনা। চার্লি চ্যাপলিন এক বার একটি নির্জন জনপদে ঘুরতে গেছেন। সেখানে দেখলেন, একটি মেলায় চ্যাপলিন সাজার প্রতিযোগিতা হচ্ছে। চ্যাপলিনের খুব আমোদ লাগল। তিনি নাম ভাঁড়িয়ে নাম দিলেন প্রতিযোগিতায়। তো সেই প্রতিযোগিতায় দেখা গেল, আসল চ্যাপলিন প্রথম তিন জনেও জায়গা পাননি। কিন্তু যাদের চ্যাপলিন নিয়ে উন্মাদনা চরমে, যেমন আমি, তারা মনে করিয়ে দেবে— এই ঘটনার ঐতিহাসিক কোনও ভিত্তি নেই। এ রকম কোনও ঘটনার কোনও প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায় না। কিন্তু এ কথা সত্যি যে, চ্যাপলিনের ইমেজ সেই সময় এমনই ছিল যে, সবাই চ্যাপলিন হতে চাইত। এই মুহূর্তেও পৃথিবীর কোণে কোণে বহু বিপন্ন শিল্পীর সহায় ওই ছেঁড়া কালো কোট, কালো টুপি, হাতে-লাঠি। কাজেই ঘটনাটি মিথ হয়েও, মিথ্যেরমতো নয়।
এ বার আসি বড়চর্চায়। সেই সময়ের সাহিত্যিক মহলে বিশেষ পাড়ায় কেউ কেউ যাতায়াত করতেন। আর বিশেষ পাড়া শুনে চমকে পাতা গুটিয়ে চলে যাবেন না আবার, সেই পাড়ায় শরীরের শুধু নয়, সুরেরও লেনদেন হত। এক আকাশ মন নিয়ে হারমোনিয়াম টেনে বসে পড়তেন কাজীসাহেব নতুন গজল শোনাতে। যাকগে, তা এক বার সাহিত্যিকদের মধ্যে হুজুগ উঠল, আজ সন্ধের চা এক বিশেষ ঘরে খাওয়া হবে। সেই ভিড়ে শিবরাম, প্রেমেন্দ্র, হেমেন্দ্রকুমার রায় অনেকেই আছেন। নির্ভেজাল, নির্বিষ আড্ডা, সঙ্গে চা। যত যা-ই হোক, যাদের লাল আলোর দুনিয়ায় যাওয়ার অভ্যাস নেই, তাদের বুক তো একটু আনচান করবেই। তাই ভয়ে ভয়েই পৌঁছনো গেল, তার পর সুন্দর আড্ডা জমে গেল। গানে, গল্পে সময় বয়ে গেল কোথা দিয়ে। খালি বেসুর বাজছিলেন শিবরাম। তিনি থেকে থেকে ভদ্রমহিলাকে বলতে লাগলেন, “আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?”
প্রথমে বন্ধুরা ভেবেছিল অকৃতদার শিবরাম বুঝি ফ্লার্ট করছেন, কারণ তিনি নিজেই বলেছেন তাঁর বোন দুই রকম, পিসতুতো ও কিসতুতো। কিন্তু দেখা গেল শিবরাম রীতিমতো গম্ভীর। চায়ে চুমুক দিতে দিতে নিজের মনেই বলে চলেছেন, “আপনাকে কোথাও একটা দেখেছি...” যা-ই হোক, সব বন্ধু মিলে বাসস্ট্যান্ডে আসা হয়েছে, যার যার মেসে ফিরে যাওয়া হবে। শিবরাম হাহাকার করে উঠলেন, “এ আমরা কী করলাম প্রেমেন? হেমেন, তোমরা কেউ চিনতে পারলে না?”
সবাই অবাক। শিবরাম মাথায় হাত দিয়ে বিলাপ করতে করতে বললেন, “তোমরা কেউ চিনতে পারলে না? ভদ্রমহিলা অবিকল বুদ্ধদেব বসুর মতো দেখতে। এত আয়োজন করে, পয়সা খরচ করে শেষ পর্যন্ত বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে চা?”
গোস্তাকি মাফ জনাব! এই ফাজলামির সাহস এই অধমের নেই। এই ঘটনা লিখেছেন শিবরাম স্বয়ং, তাঁর ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা’ বইতে।
যাত্রার কিংবদন্তি শিল্পী শান্তিগোপাল। তিনি বিশেষ সুনাম অর্জন করেছিলেন মহাপুরুষ এবং রাষ্ট্রনায়কদের ভূমিকায় অভিনয় করে। পেলে কসমসের হয়ে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে খেলতে আসেন। পেলে তখন বাঙালির চোখে ফ্যান্টম গোছের ছিলেন। মানে কী রকম ছিলেন আমি বলছি, আমার শৈশবে আমি ছাপার অক্ষরে পড়েছি— “ব্রাজিলের ছোট্ট গ্রামে সন্ধের অন্ধকার নামছে। নিজের ঘরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে পেলে। আজও তার মা তাকে সন্ধের মুড়িটুকু দিতে পারেনি।” এহেন পেলে আসছেন। ফুটবল-পাগল বাঙালি নাওয়াখাওয়া ভুলে গেল। কিন্তু বাস্তবে পেলে খুব একটা গা ঘামিয়ে প্রদর্শনী ম্যাচটি খেললেন না। দর্শক হতাশ হলেন। আমরা, অর্থাৎ ইস্টবেঙ্গল ফ্যানরা বলতে শুরু করলাম, “মোটেই পেলে আসেনি মোহনবাগানে, ও শান্তিগোপাল।” এ রকম মতামত কিন্তু সেই সময়ের এক যাত্রাশিল্পীর শ্রেষ্ঠত্বই প্রমাণ করে। দেশি, বিদেশি এমন কেউ নেই যাদের শান্তিগোপালবাবু মঞ্চে জীবন্ত করে তুলতে পারতেন না।
মেসুট ওজ়িলকে চেনেন না এমন ফুটবলপ্রেমী বিরল, আর এনজ়ো ফেরারিকে না চিনলেও, তাঁর গাড়িটির যে ভুবনজোড়া খ্যাতি, তা তো সচিন, শুমাখারের দৌলতে আমরা সবাই জানি। তো সেই ওজ়িল এবং ফেরারি। এক জন ইটালির প্রবাদপুরুষ, এক জন দুনিয়া কাঁপানো জার্মান ফুটবলার। তাঁদের মুখের মিল চমকে দেওয়ার মতো। শুধু তাই নয়, এনজ়ো ফেরারি মারা যান ১৯৮৮-তে, সেই সালেই জন্মান মেসুট ওজ়িল। কখনও সখনও বিস্ময় এমন ড্রিবল করে যে, যুক্তির গাড়ি ফেরারি হয়ে যায়।
আমি আর আমার ভাই বোধিসত্ত্ব যখন এই মিলের খেলায় মেতে উঠেছি, তখন আশ্চর্য কিছু নাম উঠে এসেছে। সৌন্দর্যের সেতুতে মাধুরী দীক্ষিত, সুচিত্রা সেন, মধুবালার যে দেখা হয়েছে, তা আর আমরা কে না জানি? কিন্তু বিষণ্ণতা ও যন্ত্রণার সেতুতে দাঁড়িয়ে থাকা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও সাদাত হাসান মান্টোকে যে এক রকম দেখায়, সেটা কি আমরা লক্ষ করেছি?
আমি বারো ক্লাসে থাকতে ‘বিশ্বাসঘাতক’ নাট্যরূপ দিই। সেই সূত্রে বুক ঠুকে চলে যাই নারায়ণ সান্যালের বাড়ি। জেঠু নিজেই দরজা খোলেন, খালি গা, গায়ের রঙের সঙ্গে মিশে গেছে উপবীতের রং। ছ’ফুটের কাছে উচ্চতা, আমি ও রকম সুপুরুষ আর এক কৃষ্ণনগরিয়ান (জেঠু নিজেকে এটা বলতে ভালবাসতেন) সৌমিত্রজেঠু ছাড়া সামনে থেকে বিশেষ দেখিনি। কিন্তু জেঠুর মুখ যদি লক্ষ করা যায়, আশ্চর্য রকম ভাবে জগমোহন ডালমিয়ার মতো। কোথায় সাহিত্যিক, প্রযুক্তিবিদ নারায়ণ সান্যাল আর কোথায় ক্রিকেট-প্রশাসক, শিল্পপতি জগমোহন ডালমিয়া। মজার বিষয় হচ্ছে, নারায়ণজেঠু সদাসর্বদা দুটো জিনিসের গড্ডলিকায় কখনও ভাসেননি— ক্রিকেট এবং হিন্দি ছবি। তাঁর গল্প ‘সত্যকাম’ ফিল্মফেয়ার পাওয়া সত্ত্বেও না। ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দিনের পর দিন ইডেনে কাজ করেছেন, ভুলেও একটা টেস্ট ম্যাচ দেখতে যাননি। সে কিনা জগমোহন ডালমিয়ার মতো দেখতে!
আমার ভাই পাশ থেকে বলছে, ইমরান খান আর গদ্দাফি। শৈশবের মন মাথা নেড়ে বলছে, কদাপি নয়। মাঠের মধ্যে বাঘের মতো বিচরণ ভুলে যাই কী করে এত সহজে? কিন্তু নির্মোহ ভাবে ভাবলে ভাইয়ের কথা ফেলে দিতেও পারছি না। একটু মিল আছে বইকি। বিকাশ রায় দীর্ঘ দিন আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টর ছিলেন, আর সেই সময় যদি নিষেধাজ্ঞা না নেমে আসে, তা হলে কি তিনি দেবব্রত বিশ্বাসের মুখোমুখি হয়ে কখনও ভেবেছেন যে, তাঁদের মুখের কী আশ্চর্য মিল! বা মৃণাল সেন যখন রমাপদ চৌধুরীর গল্পে ‘খারিজ’ বানাচ্ছেন, তখন কি তিনি দু’জনের মিল খেয়াল করেছেন?
জন্মসূত্রে ভারতীয়, এক সময়ের ডাকসাইটে ইংলিশ ক্রিকেট ক্যাপ্টেন নাসের হুসেন রাতের দিকে রাশিয়ায় গিয়ে পুতিন হয়ে যান না তো? না হলে এ রকম মিল হয় কী করে? নাসিরুদ্দিন শাহ একটু ভোঁতাটে দেখতে হয়ে গেলেই অবিকল প্রিন্স চার্লস। জিতু কমলকে ‘অপরাজিত’-তে সত্যজিৎ রায় এবং চঞ্চল চৌধুরীকে ‘পদাতিক’-এ মৃণাল সেন হিসেবে নির্বাচন যে মাস্টারস্ট্রোক, এ তো কেউ অস্বীকার করবে না। আহা! জয় গোস্বামী যদিএক বার প্রোফেসর শঙ্কু করতে রাজি হতেন? কী মজাই না হত!
আরও প্রচুর মিল! ফতেমা সানা শেখ ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, জেরার্ড বাটলার এবং ক্লাইভ ওয়েন, মানেকা গান্ধী এবং নাজ়িয়া হাসান— এমন আরও কত মিলের কথা ভাবতে ভাবতে হাঁপিয়ে উঠি।
মনে পড়ে যায়, শুধু এক মানুষের সঙ্গে আরও এক মানুষেরই নয়, দুনিয়ার এক প্রান্তের ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন অনুষঙ্গ ও অভিঘাত নিয়েও কী ভাবে মিশে যায় অন্য প্রান্তের ঘটনার সঙ্গে। এক চ্যানেলে আইপিএল চলছে, অপর চ্যানেলে গাজ়ার বোমা বিস্ফোরণে উড়ন্ত মানুষ— আমরা ভাবছি ফ্রি-হিট!
২০১৬ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশনে পরীক্ষা দিয়েছিল আমার অন্য এক ভাই। এখন তার চাকরি নেই, কিন্তু ওকে নিদান দেওয়া হয়েছে: কর্ম করে যাও, হিমসাগর অন্যেরা খাবে। তুমি শিক্ষক, মহান হতে তুমি বাধ্য। অতএব সে এখন ভলান্টিয়ার শিক্ষক, যাকে আগে স্বেচ্ছাসেবক বলেই জানতাম।
এই বিশ্বজোড়া আইপিএল-এ আমার সেই ভাই, এমন এক জন ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার, যে জানেও না তাকে এই খেলায় দরকার হবে কি না— শুধু ছাইমাখা চোখে ডাগ-আউটে বসে থাকা আপাতত। তার অজানতেই, কবে যে আমাদের খাটের তলাগুলোও টাকার সিন্দুকের মতো দেখতে হয়ে গেল! আমাদের সমস্ত স্বপ্নকে দেখতে হয়ে গেল নৈরাশ্যের মতো!
বুদ্ধিজীবীরা আর আয়নার সামনে দাঁড়ানোর সময় পান না বোধহয়। তা হলে তাঁরাও হয়তো টের পেতেন, আদতে ঠিক কাদের মুখের সঙ্গে তাঁদের মিল পাওয়া যাচ্ছে আজকাল!
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)