সুরশিল্পী: নিকোলো পাগানিনি। ছবি: গেটি ইমেজেস।
তিনি নিকোলো পাগানিনি। সেকেন্ডে বারোটি নোট এবং ছড়ের এক টানে তিন সপ্তক ছুঁয়ে আসার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। এক দিকে জুয়া-নেশা-লাম্পট্য, অন্য দিকে কালো পোশাক, বিবর্ণ লম্বাটে মুখ আর সুরের মায়াজাল তৈরি করেছিল নানা অলৌকিক মিথ। চলছে তাঁর ২৪০তম জন্মবর্ষ।
বলা হয়, মসৃণ জীবনযাপন শিল্পের জন্ম দেয় না। সংশয়, সঙ্কট, অপমান, ঘৃণায় যে আহত হয়নি, শিল্পের পূর্ণ রূপ তার কাছে অধরাই থেকে যায়। মানসিক ক্ষত থেকে নিঃসৃত রক্তই স্রষ্টার কাছে আনন্দস্বরূপ। এই ক্ষরণ তাঁকে প্ররোচিত করে শিল্পের রহস্যময়তার আরও কাছে যেতে। মৃত্যুর মুখেও সূক্ষ্ম কারুকাজ দেখতে পান শিল্পী। সঙ্গীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য— দৃশ্য এবং শ্রাব্য মাধ্যমের ভিতর দিয়ে জীবনকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্ঘাটিত করেন শিল্পী। এক অস্থিরতার ভেতর দিয়ে শিল্পীর অবিরাম যাত্রা। সরু সুতোর এক পাশে গড় মানুষদের নিয়মে বাঁধা পৃথিবী, অন্য পাশে বিস্মৃতির শহর, উন্মাদের পাঠশালা। এই দুই জগতের মাঝে সরু সুতোর ওপর ভারসাম্য রেখে টালমাটাল পায়ে হেঁটে যান শিল্পী। এই সব বাঁধনছেঁড়া, পাগলপারা মানুষদের আমরা সাধারণরা বলি উচ্ছৃঙ্খল, বোহেমিয়ান। আমরা তাঁর সৃষ্টি নয়, ব্যক্তিজীবন তছনছ করে তুলে আনি বিশৃঙ্খল জীবনযাপনের কড়চা। অথচ এই পাগলামি মানবসভ্যতাকে দিয়ে যায় কত দৈব সম্ভার।
১৭৮২ সালের ২৭ অক্টোবর ইটালির জেনোয়া শহরে জন্ম হয়েছিল এক বিস্ময়কর বেহালাবাদকের। বেহালাবাদনে তাঁর অতিলৌকিক ক্ষমতার জন্য তিনি শ্রদ্ধা, ভালবাসা যেমন পেয়েছেন, মানুষ তাঁকে ভয়ও পেয়েছে। তাঁকে নিয়ে জনশ্রুতি প্রবল আকার ধারণ করেছে যে, কনসার্ট বাজানোর সময় স্বয়ং শয়তান তাঁর ওপর ভর করে। তাঁর নাম নিকোলো পাগানিনি। আন্তোনিয়ো এবং তেরেসার তৃতীয় সন্তান। আন্তোনিয়ো বাণিজ্যে ব্যর্থ হয়ে ম্যান্ডোলিন বাজিয়ে সংসার চালাতেন কায়ক্লেশে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই বাবার কাছে ম্যান্ডোলিনে হাতেখড়ি নিকোলোর। পুত্রের সাঙ্গীতিক প্রতিভা চিনতে আন্তোনিয়োর দেরি হয়নি। বছর সাতেক বয়সেই নিকোলো ম্যান্ডোলিন ছেড়ে হাতে নিলেন বেহালা। হাতেখড়ির পর ‘হাতেছড়ি’।
আন্তোনিয়োর শিক্ষার ঝুলি দ্রুতই শেষ হয়ে গেল। এ ছেলে যেন বুভুক্ষুর মতো সব আত্মসাৎ করে নেয়। রক্তে তার সঙ্গীতের তীব্র নেশা। আর, এ নেশা যার রক্তে এক বার মিশে যায়, তার আর মুক্তি নেই। চাই লয়ের অনুভব, সুরের প্রমা, কঠোর সাধনা, শর্তহীন সমর্পণ। ছেলেকে শেখানোর মতো আর কোনও পাঠ বাকি নেই আন্তোনিয়োর কাছে। জেনোয়ার স্থানীয় শিক্ষকদের কাছে নিকোলোকে নিয়ে গেলেন বাবা। সেখানেও খুব দ্রুত সব ‘লেসন’ শেখা হয়ে যাচ্ছিল। সুরের প্রতি বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা যেন এই বালকের। এক বার শুনেই যে কোনও পাঠ তার বেহালায় তুলে নিতে সময় লাগে না। তার পর সেটিকে ক্রমাগত অনুশীলনে, সুরের নিখুঁত প্রয়োগে সেই কাঠামোকে আরও শ্রুতিনন্দন করে তোলে। এ বার বাবার সঙ্গে পুত্র চলল পারমা শহরের সেই সময়ের বিখ্যাত বেহালাবাদক আলসান্দ্রো রোলা-র কাছে শিক্ষা নিতে। তার মাঝে বাবার কড়া নজরদারিতে চলছে রেওয়াজ। শোনা যায়, প্রত্যহ ১৫-১৬ ঘণ্টাও তাকে রেওয়াজ করতে হত। সেখানে এক চুলও ফাঁকি আন্তোনিয়ো বরদাস্ত করতেন না। শুধু তো নোটেশন ফলো করা নয়, ফিঙ্গারিং-এর কৌশল, বোইং-এর কায়দা, কম্পোজ়িশনের ভিতরে ঢুকে পড়ার কত অন্ধিসন্ধি। সব তো আর কনসার্ট শুনে বা স্বরলিপি দেখে শেখা যায় না। সঙ্গীত গুরুমুখী বিদ্যা। বালক সব জানতে চায়, সব শিখতে চায়।
পাগানিনির বাজনা শুনে চোখ কপালে উঠল আলসান্দ্রোর। এ তো একেবারে তৈরি ছেলে! আগুনের খাপরা। একে শেখানো তাঁর কম্মো নয়। তাঁর নিজের গুরু ফার্দিনান্দোর কাছে পাঠিয়ে দিলেন এই নবীন শিক্ষার্থীকে। কিছু দিন তালিম দেওয়ার পর ফার্দিনান্দো দেখলেন, এই ছেলেকে শেখানোর মতো বিদ্যে তাঁর কাছে আর কিছু নেই। এই বিস্ময়বালকের সবই যথাযথ ভাবে আত্মস্থ। ফার্দিনান্দোও আবার তাঁর গুরু গাসপারো-র কাছে পাঠালেন।
এরই মাঝে পাগানিনির ঝোঁক হল গিটার শেখার। প্রতিভার স্ফুরণ সেখানেও। সুরের ধারা যাঁর রক্তে বহমান, তাঁর হাতে যে কোনও যন্ত্রই সুরে বাজে। কারণ শিল্পীর আত্মার সঙ্গে সেগুলির সুর মিলে যায়। গিটার ছিল পাগানিনির নিভৃত সময়ের সঙ্গী।
কৈশোর কেটে যাচ্ছে। আসছে যৌবন। জীবনযাপন অনিয়মিত হয়ে উঠছে। কোথায় যেন অস্থিরতা কাজ করতে শুরু করেছে। বেহালার জাদুকর হিসেবে যেমন তাঁর নাম দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, তেমনই বাড়ছে জুয়ার নেশা, মদ্যপানে আসক্তি, নারীসঙ্গলিপ্সা। জুয়াড়ি, মদ্যপ এবং লম্পট হিসেবে ছড়াচ্ছে দুর্নাম। এর মাঝেই ইটালির বিভিন্ন শহরে অনুষ্ঠান করে তাঁর জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গস্পর্শী। কিন্তু ইউরোপের অন্যান্য শহরে তখনও তাঁর বিস্ময়কর সঙ্গীতপ্রতিভার খবর পৌঁছয়নি। এর মধ্যে ইটালির এক বিখ্যাত কনসার্টে তাঁর বেহালাবাদন ঝড় তুলল সঙ্গীতবোদ্ধাদের কাছে। আরও উঁচুতে উঠল তাঁর খ্যাতি। যোগাযোগ হল বিখ্যাত কম্পোজ়ারদের সঙ্গে। পাগানিনি বুঝলেন, বাইরে বেরোতে হবে।
১৮২৭-এ পোপ দ্বাদশ লিয়ো তাঁকে সম্মানিত করলেন ‘অর্ডার অব দ্য গোল্ডেন স্পার’ দিয়ে। নিকোলো পাগানিনির সফর শুরু হল। জয় করার জন্য পড়ে আছে পৃথিবী। অবলম্বন এক তারযন্ত্র আর তার ছড়। যা দিয়ে তিনি মন্ত্রমুগ্ধ, সম্মোহিত করতে পারেন আসরের পর আসর। শুরু হল এক দীর্ঘ সঙ্গীতসফর।
১৮২৮-এর অগস্টে ভিয়েনা থেকে তাঁর যাত্রা শুরু হল। জার্মানি, পোল্যান্ড, বোহেমিয়া, স্ট্রসবার্গ, প্যারিস, ব্রিটেন— সর্বত্র তুমুল অভিনন্দন। নিকোলো পাগানিনি সমসময়ের সেরা বেহালাবাদকের স্বীকৃতি পেলেন সংশয়াতীত ভাবে।
কিন্তু মাঝে মাঝেই শরীর কেমন অবসন্ন হয়ে পড়ে। প্রায় সমস্ত জীবন জুড়েই নানা অসুস্থতায় ভুগেছেন তিনি। অসুস্থতার কারণে শেষ মুহূর্তে বাতিল করতে হয়েছে বহু কনসার্ট। ১৮২২-এ আক্রান্ত হয়েছিলেন সিফিলিসে। তখন পারদঘটিত ওষুধ আর আফিম দিয়ে এই যৌন রোগের চিকিৎসা করা হত। সেই চিকিৎসার ফলে পরবর্তী কালে তাঁর শরীর ও মনে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শুরু হয়। অবসাদ তার অন্যতম লক্ষণ। ১৮৩৪-এ যখন প্যারিসে, ধরা পড়ল যক্ষ্মা। পাবলিক কনসার্টে আর না বাজানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। ফিরে এলেন জেনোয়ায়।
আর পাবলিক কনসার্ট নয়, বহু কাজ বাকি। বেহালাবাদনের খুঁটিনাটি বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে লেখাগুলো মাথায় জমে আছে, কত কম্পোজ়িশন শিট হারিয়ে গেছে, কত কর্ড মাথার ভেতরে গুঞ্জন তোলে। সব এখন ধীরে ধীরে প্রকাশ করার ব্যাপারে উদ্যোগ করতে হবে।
১৮৩৬-এ প্যারিসে এলেন। এ বার ভাবনা অন্য রকম। ব্যবসা করবেন। একটা ক্যাসিনো খুললেন। জুয়াড়িদের নয়, তাঁর ভাগ্যেই ঘটল বিপর্যয়। চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে দেনা শোধ করার জন্য ঘরবাড়ির আসবাব, এমনকি তাঁর প্রাণের চেয়ে প্রিয় বাদ্যযন্ত্রগুলো নিলামে তুলে দিতে বাধ্য হলেন।
একটু সুস্থ হতেই ১৮৩৮-এ চললেন মার্সেই। সেখান থেকে নিস। নিসেই তাঁর অবস্থা সঙ্কটজনক হয়ে পড়ল। ১৮৪০-এর মে মাসে শেষ প্রার্থনার জন্য তাঁর কাছে এক জন যাজক পাঠানো হলে পাগানিনি তাঁকে পত্রপাঠ বিদায় করলেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, সাময়িক অসুস্থতা। দু’দিন বাদেই আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন। তাঁর মৃত্যুর এখনও অনেক বাকি। কিন্তু মৃত্যু তাঁর দুয়ারে অপেক্ষা করছিল। ১৮৪০-এর ২৭ মে সুরলোকে চলে গেলেন বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বেহালাবাদক। যে হেতু মৃত্যুর আগে কোনও যাজক উপস্থিত ছিলেন না, এবং পাগানিনি সম্পর্কে সেই বিখ্যাত মিথ— তাঁর আত্মা স্বয়ং শয়তান অধিকার করেছে— ফলে জেনোয়ার ক্যাথলিক চার্চের মত অনুযায়ী, স্থানীয় চার্চ তাঁর দেহ সমাধিস্থ করতে অস্বীকার করে বসল। দীর্ঘ দিন ধরে অনেক টানাপড়েনের পর শেষ পর্যন্ত ১৮৭৬-এ পারমার এক সমাধিক্ষেত্রে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
পৃথিবীর সমস্ত প্রবাদপ্রতিম প্রতিভাধরদের নিয়েই কত প্রবাদ, কত গল্পকথা ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ কখনও তাঁদের উপর দেবত্ব আরোপ করে, কখনও বা বলা হয় এই প্রতিভা দেবদত্ত নয়, শয়তান ভর করেছে এই মানুষের উপর। নইলে পৃথিবীর এক জন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় এই বেহালাবাদন, লোকসম্ভব নয় এই শিল্পসৃষ্টি। শোনা যায় পাগানিনি ছড়ের এক টানে বিদ্যুৎগতিতে তিন সপ্তক বিহার করে আসতেন। প্রতি সেকেন্ডে বারোটি নোট স্পর্শ করার ক্ষমতা ছিল তাঁর। সাধারণ মানুষের ক্ষমতার অগম্য এই সব জনশ্রুতি পাগানিনিকে রহস্যময় করে তুলেছিল। এক দিকে তাঁর নেশা ও লাম্পট্য, অন্য দিকে সুরসৃষ্টির অতিলৌকিক ক্ষমতা সেই সময়ে জনমানসে তাঁর সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল। পাগানিনি নন, কনসার্টে যে লোকটা অবিশ্বাস্য কৌশলে বেহালায় সুরের মায়াজাল রচনা করে, সে স্বয়ং শয়তান। লোকসম্ভব নয় এই সৃষ্টি।
কান পাতলে শোনা যেত, ‘ওই যে দেখছ নিকোলোর হাতে বেহালা, ওর তারগুলো কী দিয়ে তৈরি জানো?’
‘কী দিয়ে?’
‘সে কী হে! তুমি কোন শহরে থাকো? সবাই জানে ওর এক প্রেমিকাকে খুন করে তার অন্ত্র দিয়ে তৈরি করেছে বেহালার তার। পেট চিরে সব নাড়িভুঁড়ি বার করে নিয়েছিল। খেয়াল করে শোনো, ওর বেহালা থেকে তারসপ্তকে নারীকণ্ঠের আর্তনাদ শুনতে পাবে। তুমি কোথাকার সুরকানা হে, জেনোয়া-মিলান-মার্সেই-রোম-পারমা— সবাই জানে নিকোলো পাগানিনির আত্মা অধিকার করেছে স্বয়ং শয়তান!’
এ রকম বহু গল্প ভেসে বেড়ায় ইটালির সঙ্গীতমহলে। পাগানিনির চেহারা এবং পোশাকের বৈশিষ্ট্য এই সব গল্পকথায় কুলোর বাতাস দিয়েছিল। তাঁর লম্বা চিবুক, বিবর্ণ ত্বক, অস্বাভাবিক লম্বা আঙুল এবং সব সময় কালো পোশাক পরে স্টেজে বাজানো, কখনও মৃদু লয়ে, কখনও ঝড়ের গতিতে তাঁর ছড় এবং অব্যর্থ আঙুলের টিপে প্রার্থিত সুরের অবয়ব গড়ে তোলা— শ্রোতার দরবারে শুধু এক জন বিস্ময়কর বেহালাবাদকই নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি এক রহস্যময় মানুষের মূর্তি তৈরি হত। পরবর্তী কালে তাঁর এই অস্বাভাবিক দ্রুত বাদনকৌশলের পেছনে এক রকম জেনেটিক সিনড্রোমের কথা বলেছেন বিজ্ঞানীরা। এই সিনড্রোমে পেশির নমনীয়তা অসম্ভব বৃদ্ধি পায়।
নিকোলো পাগানিনির বায়োপিক ‘দ্য ডেভিল’স ভায়োলিনিস্ট’ মুক্তি পেয়েছিল ২০১৩ সালে। পাগানিনির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জার্মান বেহালাবাদক ডেভিড গ্যারেট। পাগানিনির তৈরি বহু কম্পোজ়িশন ছিল এই ফিল্মে। এ-মাইনরে তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টি ‘ক্যাপ্রিস নাম্বার টোয়েন্টিফোর’ ছাড়াও ‘কার্নিভাল অব ভেনিস’ শীর্ষক কম্পোজ়িশনও এই ছবিতে বাজিয়েছিলেন ডেভিড। ছবিটির পরিচালক ইংরেজ পরিচালক বার্নার্ড রোজ়। সঙ্গীত পরিচালক ডেভিড গ্যারেট। প্রসঙ্গত, এই ডেভিড গ্যারেটই ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড’-এ বিশ্বের দ্রুততম বেহালাবাদকের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।
জীবনব্যাপী অসংখ্য নারীসঙ্গ করেছেন পাগানিনি। কত নর্তকী, কত অপেরা গায়িকা এসেছে তাঁর জীবনে। দীর্ঘ সম্পর্ক হয়েছিল গায়িকা (অনেকের মতে, নর্তকী) আন্তোনিয়া বিয়াঙ্কির সঙ্গে। ১৮১৩ সালে মিলানে তাঁদের প্রথম দেখা। দু’জনে মিলে সমস্ত ইটালি জুড়ে অনুষ্ঠান করেছেন। বিয়াঙ্কির মেধা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। তাঁদের সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু সে সম্পর্কও শেষ হল ১৮২৮ সালে ভিয়েনায় এসে। এরই মধ্যে তাঁদের পুত্রসন্তান আলেসান্দ্রোর জন্ম হয়ে গেছে ১৮২৫-এর ২৩ জুলাই। পাগানিনি ও বিয়াঙ্কির সম্পর্কের আইনি বৈধতা ছিল না। পরে পুত্রের সঙ্গে পাগানিনির খুব আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হয়। অনেক সফরে তিনি পুত্রকে সঙ্গী করেছিলেন।
বেহালাবাদনের রীতিতে পাগানিনি একটা নতুন ধরন তৈরি করেছিলেন। ‘ক্যাপ্রিস’ শব্দের অর্থ, অকারণে হঠাৎ কোনও মানসিক অবস্থা বা আচার-ব্যবহারের পরিবর্তন। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে, কোনও ছোট কম্পোজ়িশন যার চলনশৈলী সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং অনন্য। গতিময়তা ও স্বরক্ষেপণের তীব্রতাও এর বৈশিষ্ট্য। পাগানিনির ক্যাপ্রিসগুলোর মধ্যে সব বৈশিষ্ট্য থাকলেও এ-মাইনরে ২৪ নম্বর ক্যাপ্রিস সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে অসম্ভব প্রিয়। পাগানিনির বাদনরীতি প্রভাবিত করেছিল পরবর্তী কালের বিশ্ববিখ্যাত সুরস্রষ্টাদের। প্রেরণা পেয়েছিলেন ব্রাহ্মস, শপাঁ, শ্যুমান।
কোনও এক অভ্যন্তরীণ সংশয় এই দিব্যোন্মাদদের অহরহ তাড়িত করে। সংসার ভাল লাগে না। বুকের ভিতরে সুরের কোলাহল ঝড় তোলে। প্রতিভার দীপ্ত আগুনে পুড়ে যায় শরীর ও মন। পুড়ে যেতে যেতে তৈরি হতে থাকে অসাধারণ এক একটি কম্পোজ়িশন। শ্রোতারা তাঁর আঙুলের অলৌকিক সঞ্চালনা, ঝড়ের মতো ছড়ির ওঠানামা আর মোহময় সুর শুনে বলেন— শয়তানের সঙ্গে আত্মা বিনিময় করেছেন নিকোলো পাগানিনি।
যদিও কষ্টকল্পনা এবং সমাপতন, তবু ভাবতে ভাল লাগে, প্রাচ্য সুরসপ্তকের পঞ্চম, গান্ধার এবং দু’টি নিষাদের ইশারা নামে বহন করেই পৃথিবী জুড়ে তাঁর পরিচয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy