Advertisement
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
Rabindranath Tagore

বিরহের দুঃখই তাঁর কবিতার অলঙ্কার

কবিতায় যে অনুভব প্রকাশ করতে পারেননি প্রিয়ম্বদা, তাঁকে স্থান দিয়েছেন তাঁর ভাবনামূলক অজস্র গদ্যে।

সৃজনশিল্পী: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রিয়ম্বদা দেবী এবং ওকাকুরা কাকুজো

সৃজনশিল্পী: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রিয়ম্বদা দেবী এবং ওকাকুরা কাকুজো

কৃষ্ণা রায়
শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২২ ০৫:৫০
Share: Save:

তাঁর কবিতার সহজ প্রসাদগুণ পছন্দ করতেন রবীন্দ্রনাথও। দেশ-বিদেশের নানা বিচিত্র বিষয় জায়গা পেয়েছিল তাঁর অনুবাদে। তাঁর গদ্যভাষা ছিল আধুনিক। বিভিন্ন সমিতির সঙ্গে সমাজসেবামূলক কাজেও ছিলেন সক্রিয়। জাপানি শিল্পী ও ইতিহাসবিদ ওকাকুরা প্রেমে পড়েছিলেন তাঁর। তিনি প্রিয়ম্বদা দেবী। সম্প্রতি নিঃশব্দে পেরিয়ে গেল তাঁর ১৫০ বছর।

কবি কবিতা সিংহ তাঁর ‘আমি সেই মেয়েটি’ কবিতায় সখেদে বলেছিলেন, আমি বুঝতে পারিনি আমি যদি কবি হতে চাই, আমার বন্ধুরা বলবে ‘ওটা কবিতা হয়নি, পদ্য হয়েছে।’ ইদানীং কালে অবশ্য বাঙালি কবি-সাম্রাজ্যে সফল নারী কবির সংখ্যা ব্যাপক। কাজেই এমন অপবাদ তাঁদের কেউ দিতে সাহস করবে না। তবু খেদ থেকে যায়। এই ২০২২ সালে, তেমন কোনও স্মৃতিচারণ চোখে পড়েনি সেই অগ্রজ নারী কবি প্রিয়ম্বদা দেবীর সম্বন্ধে, যাঁর সার্ধশতবর্ষ গত নভেম্বরেই আমরা নিঃশব্দে পেরিয়ে এলাম। মাত্র তেষট্টি বছরের জীবনে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন কবি, শিশুসাহিত্যিক, অনুবাদক এবং অক্লান্ত সমাজকর্মী হিসেবে। তাঁর সমকালের বিখ্যাত কবি প্রসন্নময়ী দেবীর কন্যা, প্রমথ চৌধুরীর ভাগনি, বেথুন কলেজের কৃতী স্নাতক প্রিয়ম্বদা অকালবৈধব্য ও সন্তানবিয়োগের কষ্ট সঙ্গী করে বাংলার সাহিত্যজগতে পা রেখেছিলেন। তখন উনিশ এবং বিশ শতকের সন্ধিক্ষণ। গত শতকের শুরুতে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রেণু’ প্রকাশিত এবং বিখ্যাত হয়েছিল সনেটধর্মী কবিতার জন্য। একাধিক কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা প্রিয়ম্বদার শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘চম্পা ও পাটল’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ সালে, তাঁর মৃত্যুর (১৯৩৫) চার বছর পর। এই কাব্যগ্রন্থের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবি হিসেবে সেকালে তিনি প্রসন্নময়ী দেবী, গিরিন্দ্রমোহিনী দাসী, মানকুমারী বসু এবং কামিনী রায়ের সার্থক উত্তরসূরি।

প্রিয়ম্বদার জন্ম অধুনা বাংলাদেশের যশোরে, ১৮৭১ সালে। জন্মতারিখ নির্দিষ্ট করে পাওয়া যায় না। তবে ১৯১২ সালের ১৬ নভেম্বর তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত নোটবইয়ে ইংরেজিতে কিছু মনের কথা লেখার পর শেষে লিখেছেন ‘মাই বার্থডে’। পাবনার গুনাইগাছার সম্পন্ন জমিদার কৃষ্ণকুমার বাগচী এবং কবি প্রসন্নময়ী দেবীর কন্যা প্রিয়ম্বদার ছেলেবেলায় নাম ছিল গিরিবালা। সে কথা প্রসন্নময়ী জানিয়েছেন তাঁর ‘পূর্বকথা’ গ্রন্থে।

কী ছিল প্রিয়ম্বদার কবিতায়? সেকালের প্রথামাফিক মানবিক অনুভূতি, প্রকৃতিপ্রেম অথবা ঈশ্বরের প্রতি আত্মনিবেদন— সব কিছুকেই তিনি স্থান দিয়েছিলেন তাঁর কবিতায়। স্থান দেননি দারিদ্র, সংসারের ছোটখাটো অভাব-অভিযোগ কিংবা সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে সমালোচনা, রাজনীতির কূট-কৌশলের কথা। সমকালীন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়েও কোনও বক্তব্য তাঁর কবিতায় রাখেননি। বিরহ, বিচ্ছেদ এবং বিয়োগ-বেদনার করুণ রসই তাঁর কবিতার প্রাণপ্রবাহ। প্রিয়ম্বদার কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় মনোনীত করেছেন, প্রশস্তি সহযোগে তাঁর কবিতার আলোচনাও করেছেন। প্রিয়ম্বদাও কবিকে নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। অনেকে বলেন কবির কাব্যশৈলীর এক আশ্চর্য প্রভাব ছিল প্রিয়ম্বদা দেবীর কবিতায়। জানা যায়, এক সময়ে ভুলক্রমে প্রিয়ম্বদার কবিতা রবীন্দ্রনাথের নামে প্রকাশিত হয়ে যায় ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। রবীন্দ্রনাথের কাব্য-সঙ্কলন ‘লেখন’-এ প্রিয়ম্বদার পাঁচটি কবিতাও স্থান পেয়ে যায় সঙ্কলনকারীদের ভুলেই। বয়সে দশ বছরের বড় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একাধারে তাঁর সুহৃদ, পত্রবন্ধু এবং অশেষ শ্রদ্ধার পাত্র।

প্রিয়ম্বদা দেবীর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ‘ভারতী’ এবং ‘বালক’ পত্রিকায় ১২৯৩ বঙ্গাব্দে। ‘রেণু’, ‘তারা’, ‘পত্রলেখা’, ‘অংশু’ এবং ‘চম্পা ও পাটল’— এই পাঁচটি শিরোনামে তাঁর পাঁচটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়। ‘পত্রলেখার’ ছোট ছোট চার পঙ্‌ক্তির কবিতাগুলো মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের ‘স্ফুলিঙ্গ’-র কবিতাগুলি। রবীন্দ্রনাথের মতে ‘প্রিয়ম্বদা’-র কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য রচনার সহজ ধারায়, অলঙ্কারশাস্ত্রে যাকে বলে প্রসাদগুণ। শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘চম্পা এবং পাটল’ (পারুল ফুল)-এ সঙ্কলিত আটত্রিশটি কবিতা রচিত হয়েছে ১৯১৬ থেকে ১৯২৯ সাল অবধি সময়কাল জুড়ে। অধিকাংশ কবিতা প্রেম এবং রোম্যান্টিক চেতনায় ভরপুর। প্রিয়ম্বদার কবি-পরিচয় এক সময় ছাপিয়ে যায়, তাঁর গদ্য রচনায় এবং শিশু-সাহিত্যে।

কবিতায় যে অনুভব প্রকাশ করতে পারেননি প্রিয়ম্বদা, তাঁকে স্থান দিয়েছেন তাঁর ভাবনামূলক অজস্র গদ্যে। দেশ-বিদেশের সাহিত্য পাঠে অভিজ্ঞ প্রিয়ম্বদার পক্ষে সহজ হয়েছিল সেই সব অন্য রকম কিছু অনুভূতি তাঁর রচিত শিশুসাহিত্যে ছড়িয়ে দিতে। ছোটদের জন্য নিয়মিত লিখেছেন অজস্র মৌলিক শিশু উপন্যাস, অনুবাদ করেছেন বিদেশি শিকার কাহিনি, নির্মাণ করেছেন দেশি ও বিদেশি লোককথাভিত্তিক গল্প সঙ্কলন, পরিবেশ এবং পশু-পাখি-মানুষ নিয়ে চমৎকার উপভোগ্য সব গল্প। একই সঙ্গে লিখেছেন ধর্ম সম্বন্ধীয় প্রবন্ধ, অনুবাদ করেছেন বাইবেল এবং গীতা। অনুবাদ সাহিত্যে সে যুগে তিনি ছিলেন এক বিরল প্রতিভা। শিশু থেকে বয়স্ক, সব ধরনের পাঠকের কথা মাথায় রেখেই বিচিত্র বিষয়ে অনুবাদ করে গিয়েছেন। বিষয় নির্বাচনে অসাধারণ ব্যাপ্তি ছিল তাঁর। সেখানে যেমন স্থান দিয়েছেন নিকোলা টেসলার মতো বিজ্ঞানীর আবিষ্কারের কথা, তেমনই এগিয়ে এসেছেন শিশুদের জন্য আমেরিকা এবং সার্বিয়ার জাতীয় সঙ্গীতের অনুবাদে। অনুবাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখ দাবি করে ওকাকুরা লিখিত ‘দ্য বুক অব টি’ গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ।

সাহিত্য রচনা ছাড়াও প্রিয়ম্বদা যুক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী প্রতিষ্ঠিত ‘সখীসমিতি’, বিধবা শিল্পাশ্রম বা মহিলা শিল্পাশ্রম এবং সরলা দেবী প্রতিষ্ঠিত ‘ভারত-স্ত্রী-মহামণ্ডল’ ইত্যাদি একাধিক সমাজ-কল্যাণমূলক সংস্থায়। অবৈতনিক শিক্ষকতা করেছেন ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে। আন্তরিক যোগাযোগ রেখেছিলেন চারণকবি মুকুন্দদাসের সঙ্গে। প্রিয়ম্বদার লেখা একটি কবিতা ‘ঝড়ের মুখে পাখীর বাসা যেমন টলমল’ সুর দিয়েছিলেন মুকুন্দদাস।

রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও তাঁর জীবনে আর এক জন মানুষ এসেছিলেন প্রবল সমারোহে। বয়সে আট বছরের বড়, বিশিষ্ট পণ্ডিত, ইতিহাসবিদ, জাপানি চিত্রশিল্পী ওকাকুরা কাকুজো। ভাবুক, অনর্গল প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহী ওকাকুরা, মিতভাষী বিষণ্ণ, নিঃসঙ্গ এই অভিজাত বিধবা নারীকে দেখামাত্র হৃদয়ে স্থান দিয়ে ফেললেন। ১৯০২ সালে প্রথম বার ভারত ভ্রমণকালে এই ওকাকুরাই তীব্র ভাবে অনুরক্ত হয়েছিলেন ভগিনী নিবেদিতার প্রতি। ওকাকুরার প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়েও ভগিনী নিবেদিতা সেই প্রেম নিবেদনকে উপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু প্রিয়ম্বদা দেবী তাঁকে উপেক্ষা করতে পারেননি।

১৯১২ সালে প্রথম দেখার এক দশক পর যখন আবার কলকাতায় এলেন ওকাকুরা, মামা আশুতোষ চৌধুরীর বাড়ি প্রিয়ম্বদার সঙ্গে দেখা হল ভাবুক শিল্পীর। তারিখটি ছিল ১৬ সেপ্টেম্বর। চল্লিশ-উত্তীর্ণ, শুভ্র পোশাকের প্রিয়ম্বদাকে দেখে মুগ্ধ হলেন ওকাকুরা। শোনা যায়, ওকাকুরা তাঁকে নিয়ে একটি ছবি এঁকে, নাম দিয়েছিলেন ‘শ্বেত-কমল’। তাঁর দৃষ্টিতে প্রিয়ম্বদা যেন সূক্ষ্ম রেখায় আঁকা এক বিরল জাপানি চিত্রশিল্প। ওকাকুরার সঙ্গে গড়ে উঠেছিল তাঁর পত্রবন্ধুতা, এবং কালক্রমে অন্তরঙ্গ সখ্য। প্রিয়ম্বদাকে লেখা ওকাকুরার চিঠি প্রকাশিত হয় প্রিয়ম্বদার মৃত্যুর পর, ‘বিশ্বভারতী কোয়ার্টার্লি’ পত্রিকায়, ‘লেটার্স টু আ ফ্রেন্ড’ শিরোনামে। অক্টোবর ১৯১২ থেকে অগস্ট ১৯১৩ সাল অবধি দশ মাস এই পত্র-সংযোগ অব্যাহত ছিল। ওকাকুরা তাঁকে নিঃসঙ্কোচে প্রেম নিবেদন করেছিলেন। সেই প্রেমের প্রকাশকে প্রিয়ম্বদা স্নিগ্ধ সৌজন্যে বরণ ও লালন করেছেন। সাড়া দিয়েছেন শালীন পরিমিতিতে।

মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, সুশিক্ষিত, দানশীল তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রিয়ম্বদা দেবীর দাম্পত্যজীবন ছিল মাত্র তিন বছরের। একমাত্র পুত্র তারাকুমারকেও হারিয়েছেন অল্প বয়সে। যৌবনের সীমান্তে দাঁড়িয়ে আকস্মিক প্রেমের অভিঘাতে বিহ্বল হয়েছেন। ওকাকুরার মাধ্যমে প্রিয়ম্বদা পরিচিত হয়েছিলেন জাপানের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও লোকজীবন সম্বন্ধে, আর সেই জানাটিকে কাজে লাগিয়েছেন তাঁর সাহিত্যকর্মে। ওকাকুরার তিনটি জাপানি কবিতা তিনি অনুবাদ করেছেন— ‘কল্পতরু’, ‘কামনা’ এবং ‘অন্তিম ইচ্ছা’ শিরোনামের এই কবিতাগুলি প্রকাশ করেছেন ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়। তাঁকে লেখা চিঠিতে ওকাকুরার সম্বোধন ছিল বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর। প্রথম আলাপের শালীন, পোশাকি, সম্বোধন পেরিয়ে ওকাকুরার সম্বোধনের ভাষা হয়ে উঠল নিবিড় অনুরাগ-সংরক্ত। কখনও তিনি লেখেন ‘মুন সোল’, কখনও ‘মাই ডিয়ার লেডি’। প্রিয়ম্বদার সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় মাত্র ক’দিনের হলেও ওকাকুরা ভুলতে পারেন না তাঁর অমৃত কণ্ঠস্বর, তাই তাঁকে লিখতেই হয় ‘ডিয়ার জুয়েল ভয়েসড’ বা ‘ডিয়ার জুয়েল অব দ্য লোটাস’। ওকাকুরার কাছে প্রিয়ম্বদা অনন্যা, ‘ওয়ান অব দ্য নেমলেস নেম’ বা ‘ডিয়ার ওয়ান অব দ্য মিরিয়াড নেমস’, আবার কখনও ‘মাই ডিয়ার মুনস অব দ্য ওয়াটার্স’।

ওকাকুরা বিবাহিত, সন্তানের পিতা। কিন্তু প্রিয়ম্বদা তাঁর সন্ধ্যা-রাতের তারা, যাঁকে স্বল্প সময়ের জন্য দেখেও প্রতিনিয়ত বিহ্বল হয়েছেন, তাঁর হৃদয়ের শব্দ শোনার জন্য জীবনের শেষ প্রহরে বাংলা শিখতে চেয়েছেন, প্রিয়ম্বদাও সেই চাওয়াকে প্রশ্রয় দিয়ে ওকাকুরার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছেন বাংলা ব্যাকরণের বই। ওকাকুরার কাছে প্রিয়ম্বদা গোধূলির সুগন্ধ, তাঁর নিজের কথায় ‘মাই ডিয়ার ফ্রেগ্র্যান্স দ্যাট কামস ইন দ্য টোয়াইলাইট’। এ ভাষা নিঃশর্ত প্রেমের। প্রিয়ম্বদা মোট ১৫টি চিঠি ওকাকুরাকে লিখেছেন, ওকাকুরা ১৯টি। ১৯১৩ সালের ২১ অগস্ট ওকাকুরার শেষ চিঠিটি পান প্রিয়ম্বদা। সে বছর জুন মাসের পর থেকেই ওকাকুরা, ‘ব্রাইটস ডিজ়িজ়’ বা কিডনির অসুখে দারুণ অসুস্থ। ২৫ অগস্ট হার্ট অ্যাটাকের পর অসহ্য যন্ত্রণায় জীবনের শেষ ক’টি দিন স্বজনসান্নিধ্যে কাটিয়ে ২ সেপ্টেম্বর ১৯১৩ সালে ওকাকুরা মারা যান।

প্রিয়ম্বদা তাঁর সজল ভাষ্যে এই প্রেমকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিলেন, সে অনুভবের সাক্ষ্য দেয় তার একান্তে লেখা ডায়েরি বা নোটবইয়ের পাতা। বিশ্বভারতী থেকে সংগৃহীত, এই নোটবইয়ের পাতায় পাতায় তিনি ইংরেজিতে লিখে রেখেছেন তাঁর মনের কথা, ১৯১২ থেকে ১৯১৫ সালের মধ্যে। ওকাকুরার সঙ্গে প্রথম আলাপের পর নোটবই লেখা শুরু ১৯১২ সালের ৬ নভেম্বর। চিঠিপত্রে যেমন তাঁর বিকল স্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তেমনই নোটবইয়ের পাতায় ছড়িয়ে রেখেছেন এক প্রিয় মানুষের জন্য তীব্র হাহাকার। ১৯১৩-র ৯ জুনের পর নোটবইয়ের পাতা শূন্য। পত্রবিনিময় কিন্তু অব্যাহত ছিল। মনের কথায় সেই নোটবই ভরে উঠল ওকাকুরার মৃত্যুর পর, ১৯১৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯১৩, উদ্দিষ্ট মানুষটির জন্য অসঙ্কোচে লিখলেন, ‘তুমি তীক্ষ্ম তরবারি দিয়ে আমার আমার সিঁথিতে সিঁদুর দিয়েছ, আলতায় রাঙিয়েছ পা, আর লৌহবলয় পরিয়ে চিরকালীন স্বামীর দাবি নিয়ে আমার জীবনে এসেছিলে।’ তিন দিন পর ১৫ সেপ্টেম্বর, সরাসরি লিখলেন, ‘তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার এক বছর পূর্ণ হবে আগামী কাল। আমাদের চূড়ান্ত পরিণতি, চিরস্থায়ী মিলন যদি হত!’

ওকাকুরার কাছে প্রিয়ম্বদা ছিলেন তাঁর সারা জীবনের অভীষ্ট ছায়াতরু, যাঁর ফুলের পাপড়ি না তুলেও সৌরভে স্নাত হতে চেয়েছিলেন আজীবন। সার্ধশতবর্ষে পৌঁছে যাওয়া শিশুসাহিত্যিক, অনুবাদকর্মী, কবি প্রিয়ম্বদা দেবী ছিলেন আক্ষরিক ভাবেই আধুনিকমনস্কা, নিজের হৃদয়ের শব্দ শোনার জন্য অবেলার প্রেমকেও তিনি ফিরিয়ে দেননি।

গত শতকের সমাজ, এই বিধবা নারীর অকুণ্ঠ সাহিত্যচর্চা এবং সামাজিক মেলামেশায় ভ্রুকুঞ্চন করে সমালোচনা করতে ছাড়েনি। প্রিয়ম্বদা যে সে সব অনায়াসে উপেক্ষা করতে পেরেছিলেন, প্রমাণ তাঁর নোটবই।

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore Priyamvada Devi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy