বিশ্বসন্ধানী: অমলকুমার রায়চৌধুরী ও ডান দিকে, রজার পেনরোজ়
২০২০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেলেন বিজ্ঞানী রজার পেনরোজ়। ব্ল্যাক হোলের উৎপত্তির রহস্য সন্ধানে যুগান্তকারী কাজের স্বীকৃতি হিসাবে। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা সূত্রের এক অমোঘ ভবিষ্যৎ ব্ল্যাক হোলের জন্ম, এমনটাই পেনরোজ়-এর প্রতিপাদ্য। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ইংরেজ অধ্যাপক ১৯৮৮ সালে স্টিফেন হকিংয়ের সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানে উলফ পুরস্কারও পেয়েছিলেন।
আজ থেকে কোটি কোটি বছর পরে, তারাদের জ্বালানি শেষ হয়ে যাবে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হয়ে উঠবে মৃত তারকাদের সমাধিভূমি। সূর্যও নিবে যাবে। পৃথিবীও বিলুপ্ত হবে। প্রাণের চিহ্নহীন মহাবিশ্বে নামবে ভয়াবহ শীতলতা। সেই প্রেক্ষাপটেই রজার পেনরোজ়-এর ‘কনফর্মাল সাইক্লিক কসমোলজি’ মডেল। লক্ষ কোটি কৃষ্ণগহ্বরের সেই শীতলতার মধ্যেই হঠাৎ সেখানে শুরু হবে ভুট্টার খই ফোটার মতো ছোট্ট ছোট্ট বিস্ফোরণ। রজার পেনরোজ় বিস্ফোরণের (এক্সপ্লোড)-এর বদলে খই ফোটা (পপ) বলা বেশি পছন্দ করেছেন। এই সব ব্ল্যাক হোলগুলির ফুটে ওঠা আগামী মহাবিশ্বের জন্য প্রয়োজনীয় মহাবিস্ফোরণের (বিগ ব্যাং) শক্তি একত্রিত করবে। এই ভাবে এক কল্পের শেষে সূচিত হবে আর এক কল্প (eon বা ইওন)। ‘কনফর্মাল সাইক্লিক কসমোলজি’ নিউটন আর আইনস্টাইনের পরে মহাবিশ্বকে বোঝার জন্য এক নতুন ভিত্তি।
এই কনফর্মাল সাইক্লিক কসমোলজিতে এক কল্পের শেষে সময় থেমে যায়, তাই স্থানেরও কোনও মানে থাকে না। কল্পান্তে কোনও বস্তু বা ভরও থাকে না। এই কল্পান্তের একমাত্র ব্যতিক্রম ‘হকিং পয়েন্ট’। যেখানে বিগত কল্পের কোনও অতিবিশাল কৃষ্ণগহ্বর থেকে হকিং বিকিরণ পরিলক্ষিত হয়। এগুলি গত কল্পের কোনও গ্যালাক্সি ক্লাস্টার, যা ক্ষয় হতে হতে একটি মাত্র হকিং বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এই বিন্দুগুলি সরাসরি দেখা না গেলেও শক্তিপুঞ্জের অনুভব হয়। ৩,৮০,০০০ বছর আগের এমনই এই বিন্দু উষ্ণতার উৎস হিসেবে অধুনা প্রকাশিত, যা পূর্ণিমার চাঁদের চেয়ে আট গুণ বড়। বাস্তব হল, হকিং পয়েন্ট বিগত কল্পেরই স্মৃতিচিহ্ন। এর নাম ‘পেনরোজ়-হকিং সিঙ্গুলারিটি থিয়োরেম’। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ থেকে এই উপপাদ্যের মাধ্যমে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মহাকর্ষ বল থেকে সিঙ্গুলারিটি তৈরি হওয়ার ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। ‘সিঙ্গুলারিটি’ হল মহাকর্ষ বলের সেই ঘনীভূত অবস্থা, যেখানে স্থান আর কাল মিলেমিশে একাকার। এই আবিষ্কারের মূলে আছে কলকাতার এক বিজ্ঞানীর গাণিতিক সূত্র। বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে সেটি রায়চৌধুরী’জ় ইকুয়েশনবলে সমাদৃত।
১৯৭৩ সালে স্টিফেন হকিং এবং জি এফ আর অ্যালিস একটি বই লেখেন, ‘দ্য লার্জ স্কেল স্ট্রাকচার অব স্পেস-টাইম’। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত এই বই পদার্থবিদ্যার প্রাচীন বনিয়াদ অনেকটাই নড়িয়ে দিয়েছিল। এই পুস্তকের চতুর্থ অধ্যায়, ‘দ্য ফিজ়িক্যাল সিগনিফিক্যান্স অব কারভেচার’-এর একেবারে প্রথম প্যারাগ্রাফেই আছে রায়চৌধুরী সূত্রের উল্লেখ। ফিলাডেলফিয়ার ‘সোসাইটি ফর ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড ম্যাথামেটিক্স’ থেকে ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় রজার পেনরোজ়-এর গ্রন্থ ‘টেকনিকস অব ডিফারেনশিয়াল টোপোলজি ইন রিলেটিভিটি’। সেই রচনাতে পেনরোজ় উল্লেখ করেছেন রায়চৌধুরীর কাজের কথা।
কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের সেই মাস্টারমশাইয়ের নাম অমলকুমার রায়চৌধুরী। ছাত্রদের একান্ত প্রিয় অধ্যাপক ‘একেআর’ তাঁর জীবনে সেই সম্মান পাননি। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের নির্ভুল সম্পূর্ণ সমাধানের উদ্দেশ্যে রায়চৌধুরী এনেছিলেন তাঁর ইকুয়েশন। এই সমীকরণ সিঙ্গুলারিটি-কে অঙ্কের সূত্রে বেঁধেছিল, যেখানে প্রকৃতির সাধারণ সব হিসাব-নিকাশ আর কাজ করে না। মহাকর্ষ বলের আওতায় যে মহাবিশ্বের যে কোনও দু’টি ভরশক্তি পতিত হবে, এই সাধারণ প্রত্যাশাকে গাণিতিক প্রমাণ দিয়েছিল রায়চৌধুরীর সূত্র। ধীরে ধীরে দেখা গেল, ‘জেনারেল রিলেটিভিটি’ সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে এই সূত্র কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি, স্ট্রিং থিয়োরি এবং সেই সঙ্গে হাইড্রোডায়নামিক্স এর বহু দিগন্ত উন্মোচন করছে।
অমলবাবু তখন কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কালটিভেশন অব সায়েন্স’-এর সায়েন্টিফিক অফিসার। দেশভাগের পর পূর্ববাংলার বরিশাল জেলার উদ্বাস্তু ছেলে তখন ভাগ্যসন্ধানী। ১৯৫৩ সালের ২১ এপ্রিল ‘ফিজ়িক্যাল রিভিউ’ পত্রিকায় গবেষণাপত্রটি জমা দিয়েছিলেন তিনি। প্রথম দিকে সূত্রগুলির প্রমাণ না থাকায় নির্ণায়কদের বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল। কয়েক বার প্রশ্ন-উত্তর চলার পরে মনোনীত হল গবেষণাপত্রটি। প্রকাশ পেল ১৯৫৫ সালের ১৫ মে সংখ্যায়।
পেনরোজ় বা অন্য বিজ্ঞানীরা যাকে ‘ইওন’ বা কল্প বলছেন, তা এক নতুন ভাবনার সূচনা করেছে। সেই ভাবনা বিজ্ঞানের সীমানা ছাড়িয়ে দর্শনের প্রাঙ্গণে এসে গেছে। কল্পের শেষে যে শূন্যতা, তা কি নাস্তিকতাকে নিশ্চিত করে, না কি ‘অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’— জন্মরহিত শাশ্বত, নিত্য এবং পুরাতন হলেও চিরনবীন অস্তিত্বের তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠিত করে? ভারতবর্ষ এই প্রশ্নের উত্তর বহু প্রাচীন কাল থেকে খুঁজছে। উপনিষদের উপলব্ধি আজকের যুগের উপযোগী করে উপস্থাপন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
মহাজাগতিক কণা খোঁজার পর্যায়ে অ্যাক্সিলারেটরের ভূমিকা একান্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহাবিশ্বের রহস্য সমাধানে নিউক্লিয়ার অ্যাস্ট্রোফিজ়িক্স, অবআণবিক কণার গবেষণা এই যন্ত্রের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে।
স্যর পেনরোজ ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি ভারতে এসেছিলেন। জানিয়েছিলেন তাঁর গবেষণা-সংক্রান্ত বক্তব্য। কলকাতার সাহা ইনস্টিটিউটে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি উল্লেখ করেছিলেন অমলকুমার রায়চৌধুরীর অসামান্য কাজের কথা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy