স্মৃতিচিহ্ন: সবচেয়ে বাঁ দিকে, পেলিতি নিজে, মাঝে, ফেদেরিকো পেলিতির নামাঙ্কিত সেই পাথরের ফলক, ডান দিকে, ‘পেলিতি’জ়’-এর দোতলার সেই বিখ্যাত বারান্দা। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
মধ্য কলকাতার বাতাসে তখন ভাসছে গরম কেকের সুঘ্রাণ। যে রেস্তরাঁ থেকে তার উৎপত্তি, তার খাওয়ার জায়গায় কাঁটাচামচ ও প্লেটের মৃদু টুংটাং। খেতে খেতে মৃদু জল্পনায় মগ্ন অভিজাত নরনারী। ভিড়ে ঠাসা এসপ্লানেড ইস্ট রো-তে দাঁড়ালে এখন অবিশ্বাস্য লাগে যে, ব্রিটিশ জমানায় এক ইটালীয় সাহেবের সুবিশাল রেস্তরাঁ ছিল এই মহল্লায়! তাঁর নাম ফেদেরিকো পেলিতি। কলকাতার ১১ গভর্নমেন্ট প্লেস ইস্ট ঠিকানায় একটি বিবর্ণ পাথরের ফলকে এখনও রয়ে গিয়েছে যাঁর নাম।
সালটা ১৮৬৯। ব্রিটিশ ভারতের চতুর্থ ভাইসরয় হিসেবে নিযুক্ত হলেন আয়ারল্যান্ডের মেয়ো প্রদেশের ষষ্ঠ আর্ল রিচার্ড সাউথওয়েল বার্ক। এ নাম সম্ভবত অনেকেরই মনে নেই। কারণ তিনি পরিচিত ছিলেন লর্ড মেয়ো নামে। তাঁর প্রয়োজন হল এক জন রাঁধুনির। সিদ্ধান্ত হল, প্যারিসে করা হবে এক অভিনব রান্নার প্রতিযোগিতা, বিজয়ীর পুরস্কার লর্ড মেয়োর রাঁধুনির পদ। ফরাসি রান্নার স্বাদ-গন্ধ-বর্ণের কথা মাথায় রেখেই হয়তো প্রতিযোগিতা প্যারিসে আয়োজন করার কথা ভাবা হয়েছিল। জিতলেন কিন্তু এক জন ইটালীয় যুবক— ফেদেরিকো পেলিতি। পরে কলকাতার মজ্জায় মজ্জায় খাঁটি ইটালীয় খাবারের স্বাদ মিশিয়ে দিয়ে যাবেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত কার্যত রমরম করে চলবে তাঁর রেস্তরাঁ— কলকাতা ও শিমলায়।
সেই শুরু। প্রতিযোগিতায় জিতে লর্ড মেয়োর সঙ্গে কলকাতায় পা রাখলেন যুবক পেলিতি। তখন থেকেই অবশ্য নিজস্ব ব্যবসার সুপ্ত ইচ্ছে ডানা মেলছিল। ১৮৭২ সালে আন্দামানে আফগান আততায়ীর হাতে প্রাণ যায় লর্ড মেয়োর। চাকরি ছেড়ে পেলিতি ৪১ নম্বর বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে শুরু করেন তাঁর প্রথম কেকের দোকান— ‘ও’নিল অ্যান্ড পেলিতি’। মূলধনের বেশির ভাগ অংশই ছিল টমাস ও’নিলের, তাই এই অংশীদারি।
সময়টা তখন ১৮৭২ সাল। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের মতো রাস্তায় যে শৌখিন খাবারের দোকান চলতে পারে, তখন তা ভাবা দুষ্কর। যদিও ১৮৩০ সালে ডেভিড উইলসন বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটেই সূচনা করেছিলেন তাঁর ‘উইলসন বেকারি’। পরে যা নাম পাল্টে ‘অকল্যান্ড হোটেল’ থেকে ‘গ্রেট ইস্টার্ন’ নামে পরিচিত হয়। তবু সে ঘটনা বিরলের মধ্যেই পড়ে। দেড়শো বছর আগের সেই বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট আর আজকের বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের তফাত আকাশ-পাতাল। হ্যারি হবস-এর ক্রনিকল থেকে জানা যায়, তখনকার বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে কায়ক্লেশে দু’টি ট্রাম পাশাপাশি যেতে পারত। রাস্তার পশ্চিম দিকে ছিল ১৮ ইঞ্চি চওড়া একটি অপরিচ্ছন্ন ফুটপাত। পেলিতির নতুন দোকানের ঠিক পাশেই ছিল ম্যাকিনটশ বার্ন সংস্থার বিল্ডিং ইয়ার্ড। সেখানে ইট ভাঙা হত। গরমের দুপুরে হাওয়ার সঙ্গে পাক দিয়ে উঠত সেই ধুলো এবং অপরিচ্ছন্নতার গন্ধ। ক্রমশ পেলিতির দোকানের কেক-পাউরুটি তৈরির ঘ্রাণ মিশে যেতে থাকল তাতে।
হয়তো এই বৈপরীত্যই প্রাথমিক ভাবে আকর্ষণ করেছিল মানুষকে। তার পরে পরিচিতি ঘটে স্বাদের সঙ্গে। ক্রমে বেশ পরিচিত হয়ে ওঠে ‘ও’নিল অ্যান্ড পেলিতি’।
ও’নিলের সঙ্গে পেলিতির এই বন্ধুত্ব অবশ্য বেশি দিন টিকল না। ১৮৭৫ সালে রাস্তা আলাদা হয়ে গেল দু’জনের। পেলিতি তখন অবশ্য বেশ বুঝেছেন কলকাতার স্বাদ-পছন্দ। ওই বছরই ১৮/১ চৌরঙ্গির ঠিকানায় বাড়ি ভাড়া নিলেন তিনি। কথিত, সে বাড়ির মালিক ছিলেন এক ইহুদি। যিনি পেলিতিকে মোটেই পছন্দ করতেন না। কেন, সে কথা জানা নেই। ধারণা করা যায়, ইহুদিদের সম্পর্কে অজস্র গুজবই এর কারণ। যা-ই হোক, গল্পে ফেরা যাক। বাড়ির মালিকের সঙ্গে ক্রমাগত অশান্তিতে বিরক্ত পেলিতির যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা, তখন তাঁর এক সুহৃদ ডবলিউ নিউসন (এঁর ছোট্ট একটি মশলার দোকান ছিল চৌরঙ্গিতে) বুদ্ধি দিলেন বাড়ির সদরে শূকরের একটি মূর্তি তৈরি করে ঝুলিয়ে রাখতে। অজুহাত, খাবারের ব্যবসার বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। নিষ্ঠাবান ইহুদিদের কাছে শূকর পরিত্যাজ্য। ব্যস, বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন বাড়ির মালিক! এ কেমন ইহুদি! সে যাত্রা পেলিতি তাঁর বাড়ির মালিককে বেশ আতান্তরেই ফেলেছিলেন। তবে তা ১৮৮০ পর্যন্তই। তার পরে ফের বাড়ি বদল করেন তিনি।
কিছু দিন ৫ নম্বর ক্রুকেড লেনে বাস করলেও তাঁর চোখ ছিল ১০ ও ১১ নম্বর এসপ্লানেড ইস্টের (বর্তমানে গভর্নমেন্ট প্লেস ইস্ট) বাড়িটার দিকে। ১৮৮১ সালে সেখানেই তিনি শুরু করেন তাঁর প্রথম রেস্তরাঁ ও কেকের দোকান — ‘ফেদেরিকো পেলিতি, ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড কনফেকশনার্স’। ক্রমে যা হয়ে ওঠে ‘পেলিতি’জ়’। অ্যালিস্টার ম্যাকমিলান তাঁর ‘সি পোর্টস অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড সিলোন’-এ বলেছিলেন, পেলিতির রেস্তরাঁর টেবিল ঢাকা থাকত দুধসাদা লিনেনে। কাঁটা-চামচ-কাপ-ডিশ ছিল আয়নার মতো ঝকঝকে। সিলিং থেকে ঝুলত বাহারের বিজলি বাতি।
অর্কেস্ট্রা, নাচ, সুখাদ্য ও পানীয়ে জমজমাট ‘পেলিতি’জ়’-এ মুখের আগল খুলে যেত বহু সাহেবের। লর্ড লিটন বিশেষ ভাবে পছন্দ করতেন পেলিতিকে। তাঁর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে পেলিতি তাঁর রেস্তরাঁয় এমন এক পরিসর তৈরি করেছিলেন, যেখানে সহজেই নারী-পুরুষের মেলামেশা ঘটে। কত রোমাঞ্চকর প্রেম, কত পরিণয়, কত বিচ্ছেদ এবং কত ব্যবসায়িক কথা পাকা হয়েছে এই রেস্তরাঁয়। ম্যাকমিলানের মতে, দোতলার বড় পরিসর পেলিতির রেস্তরাঁকে আরও জনপ্রিয় করেছিল। ১৯১৯ সালে কলকাতার রোটারি ক্লাবের জন্ম হয় এখানে বসেই।
ভাগ্যদেবী অবশ্য তত দিনে পেলিতির উপরে বেশ প্রসন্ন। ওই বছরই ব্রিটিশদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শিমলাতেও প্রথমে ‘পেলিতি’জ় কাফে’ ও পরে ‘পেলিতি’জ় গ্র্যান্ড হোটেল’ খুলে যায়। সেই হোটেল তথা রেস্তরাঁর দোতলার বারান্দায় বসলে দেখা যেত সুউচ্চ পাহাড় ও সবুজ উপত্যকা। সেই বারান্দায় বসে সময় কাটানোর জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যেত সাহেব-মেমদের মধ্যে। রুডিয়ার্ড কিপলিং-এর ‘দ্য ফ্যান্টম রিকশ’ নামের ছোটগল্পে রয়েছে শিমলার ‘পেলিতি’জ়’-এর উল্লেখ। ১৯২২ সালে বিধ্বংসী আগুনে ধ্বংস হয়ে যায় ‘পেলিতি’জ় গ্র্যান্ড হোটেল’। এ ছাড়াও, শিমলার কাছে মাশোবরা নামের ছোট্ট শহরে নিজের ভিলা তৈরি করেছিলেন তিনি। জন্মশহর কারিনিয়ানোর নামেই নাম রেখেছিলেন তার।
অথচ উত্তর ইটালির পিয়েডমন্ট অঞ্চলের মানুষ ফেদেরিকো কিন্তু প্রথম জীবনে এক জন ভাস্কর হতে চেয়েছিলেন। ছিল সেই প্রশিক্ষণও। ছবি তুলতেও অসম্ভব ভালবাসতেন। ১৮৯৮ সালে ইটালির টুরিনের জাতীয় প্রদর্শনীতে যে তিনটি স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন, তার একটি ছবি তোলার জন্যই। হয়তো সেই কারণেই তাঁর তৈরি খাবারে রয়ে গিয়েছিল এক জন নিপুণ শিল্পীর হাতের স্পর্শ। চিনি দিয়ে ১২ ইঞ্চি লম্বা আইফেল টাওয়ারের প্রতিকৃতি তৈরি করেছিলেন তিনি, দোকানে সাজানো থাকত সেটি। রেস্তরাঁর খাদ্যতালিকায় ছিল ‘রিসোত্তো আলা মিলানিজ়’, ‘আন্নুলত্তি পাস্তা’-র মতো বিভিন্ন উপাদেয় ইটালীয় খাবার। ছিল ‘ব্রিটিশ মিন্স পাই’ অর্থাৎ মাংসের পুর ভরা পাই এবং ফরাসি ‘ফিলে দ্য ব্যফ’। এবং অবশ্যই ছিল বিভিন্ন কিসিমের কেক ও আইসক্রিম। তিন কোর্স লাঞ্চের মূল্য ছিল তখনকার দিনে টাকা দেড়েকের মতো। ব্রিটিশ ভারত থেকে বর্মা (অধুনা মায়ানমার) পর্যন্ত কেটারিং পরিষেবা দিতেন পেলিতি। মুম্বইতেও প্রসার হয়েছিল তাঁর ব্যবসার, শেষ পর্যন্ত সেখানকার দায়িত্ব দিয়ে ফেলিস কর্নেলিয়া নামের এক আত্মীয়কে।
ফেদেরিকো পেলিতির বিখ্যাত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল তাঁর স্বহস্তে তৈরি ‘ভারমুথ’, যা এক বিশেষ ধরনের ওয়াইন। জানা যায়, ১৮৭৫ সালে প্রিন্স অব ওয়েলস আলবার্ট এডওয়ার্ড যখন কলকাতায় এসেছিলেন, পেলিতি তাঁকে ভারতীয় মশলা দিয়ে তৈরি বিশেষ ‘হোয়াইট ভারমুথ’ খাইয়েছিলেন। প্রিন্স অব ওয়েলস-এর সেই পানীয় পছন্দ হয়। ১৮৭৭ সাল থেকে স্রেফ ব্রিটেনে পাঠানোর জন্য বাণিজ্যিক ভাবে তৈরি হতে থাকে ‘পেলিতি’জ় ভারমুথ’। ‘নিয়ো-গথিক মনুমেন্টাল কেক’ তৈরিতেও হাতযশ ছিল তাঁর।
১৮৪৪ সালের ২৯ জুন জন্ম ফেদেরিকো পেলিতির। সারা জীবন ধরে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন সুপুরুষ, শৌখিন মানুষটি। তাঁর স্ত্রীর নাম জুডিথ। দুই ছেলে এদোয়ার্দো ও ফেদেরিকোই তাঁর পরে ব্যবসার হাল ধরেন। পেলিতির সুযোগ্য শিষ্য ছিলেন অ্যাঞ্জেলো ফিরপো, যিনি ১৯১৭ সালে চৌরঙ্গিতেই খোলেন তাঁর বিখ্যাত রেস্তরাঁ— ‘ফিরপো’জ়’। কার অনুপ্রেরণায়, সহজেই অনুমেয়।
কালের গর্ভে পেলিতির সেই বিখ্যাত রেস্তরাঁ হারিয়ে গিয়েছে বহু দিনই। বাড়িটা এখন এক পরিত্যক্ত অফিসবাড়ি, যার নীচতলায় বহু দোকান। প্রবেশপথের সামনে ইটের স্তূপ, আবর্জনা। সংস্কারের নানা পরিকল্পনা শোনা গিয়েছিল এক কালে। উৎসাহ প্রকাশ করেছিলেন ভারতে ইটালির রাষ্ট্রদূত ভিনচেনসো দে লুকা-ও। কিন্তু এখনও তা ভবিষ্যতের গর্ভে। রয়ে গিয়েছে শুধু ফেদেরিকো পেলিতি-র নামাঙ্কিত এক শ্বেতপাথরের ফলক, দোতলায় ওঠার অন্ধকার ধুলোমাখা সিঁড়ি আর ইতিহাসের কানাকানি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy