ভারতপথিক: ধর্মকে জীবন যাপনের সহজ অঙ্গ করে তুলতে চেয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়
রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭২-১৮৩৩) নাম শুনলেই প্রথমত আমাদের যে দু’টি ঐতিহাসিক ঘটনার কথা মনের পর্দায় ভেসে ওঠে, সেগুলি হল ব্রাহ্ম ধর্মের প্রবর্তন এবং সতীদাহ প্রথা রদ। একটি ধর্ম সংস্কার, অন্যটি সমাজ সংস্কার। সাধারণ জনমানসে সতীদাহ প্রথা রদ করার ব্যাপারটাই বেশি গুরুত্ব পায়, আর ধর্ম সংস্কার গুরুত্ব পায় নির্দিষ্ট ধার্মিক মহলে, প্রধানত ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীদের কাছে। একটা গাছ যখন লতায়-পাতায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়, তখন তার নীচে দাঁড়ালে আর স্পষ্ট সূর্যালোক পাওয়া যায় না। এ দেশের হিন্দু সমাজের অবস্থাও হয়েছিল তেমনই। অসংখ্য দেবদেবী, অগণিত সংস্কার, অজস্র বিশ্বাস, প্রথা ও প্রকরণ ছেয়ে ফেলেছিল আমাদের জীবনের আকাশ। দরকার ছিল সেই সব লতাপাতা ছেঁটে গাছটাকে স্বরূপে বার করে আনার, যাতে মুক্ত আলো, নীল আকাশের দেখা পাওয়া যায়, নির্মল বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যায়। রাজা রামমোহন রায় বহু দেববাদের ডালপালা ছেঁটে এক দেববাদকে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর ধর্ম সংস্কার মানে ধর্মের অজস্র জটিলতায় আর একটি জটিল সূত্রের সংযোজন নয়, আমাদের ধর্মীয় জীবনকে জটিলতা মুক্তির দিকে এগিয়ে দেওয়া।
রামমোহন বললেন, ঈশ্বর এক। বিশ্বের পরম নিয়ন্তা। তিনি ব্রহ্ম। নিরাকার। তাঁকে দেখা যায় না, তাঁকে অনুভব করতে হয়। তাঁর কথা প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রে আছে। বেদান্ত, উপনিষদ অনুবাদ করে দেখালেন যে, তিনি নতুন কিছু বলছেন না। শুধু তাই নয়, সেই একের কথা ইসলাম ধর্মেও আছে, একত্ববাদী (ইউনিটারিয়ান) খ্রিস্টধর্মেও আছে। পৃথিবীর মান্য তিনটি বড় বড় ধর্মেই রয়েছে সেই পরম ঈশ্বরের কথা। তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম্।
সংস্কৃত ভাষায় রামমোহনের প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য ছিল। কৈশোরে বাড়ি থেকে চলে গিয়ে বারাণসীতে সংস্কৃত শেখেন, পটনায় গিয়ে শেখেন আরবি, ফার্সি। ইংরেজি শেখেন বেশি বয়সে। গ্রিক ও হিব্রু ভাষা শিখেছিলেন ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ ভাল করে পড়ার জন্য। প্রতিটি ধর্মের কথা সেই ধর্মের আদি শাস্ত্রে কী ভাবে লিখিত আছে— এই জিজ্ঞাসা থেকেই তাঁর শাস্ত্র পাঠ। সেই বিপুল অধ্যয়ন থেকেই তিনি অর্জন করেছিলেন তাঁর ধর্ম সংস্কারের রসদ। নির্দিষ্ট ধর্মের ধর্ম ব্যবসায়ীরা কী করছেন বা করতে বলছেন, তাতে আস্থা না রেখে তিনি নিজস্ব অধ্যয়ন ও অনুসন্ধানের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। একটি নির্দিষ্ট ধর্ম নয়, মুক্ত মনে একাধিক ধর্মের আদি শাস্ত্র পর্যালোচনা করে ধরার চেষ্টা করেছিলেন বিশ্বমানবের ধর্মবিশ্বাসের মূল সূত্রটি।
রামমোহনের লেখা ‘তুহফত-উল-মুওয়াহিদ্দিন’ নামক পুস্তিকায় আছে (যার ভূমিকা আরবিতে ও গ্রন্থাংশ ফার্সিতে লেখা) তাঁর এই বিচারশীল অনুসন্ধিৎসু মনের পরিচয়। তাতে লিখেছেন— “সমতল দেশ বা পার্বত্য অঞ্চল যেখানেই সফর করেছি সেখানকার অধিবাসী সবাই সাধারণত একটি পরম সত্তায় বিশ্বাসী... চিরন্তন এক পরম সত্তায় বিশ্বাস মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি যা সবার মধ্যে সমভাবে বিদ্যমান।” এই পুস্তিকাতেই তিনি লেখেন, মননশক্তিও মানুষের সহজাত মৌলিক প্রকৃতি। স্থির বুদ্ধিযুক্ত মননশক্তি মানুষকে চিনিয়ে দিতে পারে ধর্মতত্ত্বের কোনটি ভ্রান্ত আর কোনটি যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং শুধু বিশ্বাস নয়, মননশক্তিও তাঁর ধর্মচর্চার অন্যতম উপাদান। বলেছেন, “সত্য তাই যা কার্যকারণের দ্বারা যুক্ত, বিশ্বাস চালিত নয়। মিষ্টান্নজ্ঞানে বিষ সেবন করিলে মৃত্যু অবধারিত।” পুস্তিকার উপসংহারে লিখেছেন, জগতে চার শ্রেণির মানুষ আছে— ক. প্রতারক, খ. প্রতারিত, গ. প্রতারক ও প্রতারিত এবং ঘ. প্রতারক নয়, প্রতারিতও নয়। প্রথম দল নিজেদের ইচ্ছেমতো ধর্মীয় তত্ত্ব ও মত উদ্ভাবন করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা ও বিরোধ সৃষ্টি করে। দ্বিতীয় দল কোনও রকম বিচার বিবেচনা না করে অন্ধ ভাবে প্রথম দলের অনুগামী হয়। তৃতীয় দল অপরের কথায় বিশ্বাস করে অন্যদেরও সেই বিশ্বাসে প্ররোচিত করে। চতুর্থ দল মহামহিম ঈশ্বরের করুণায় প্রতারকও নয়, কারও কাছে প্রতারিতও হয় না। এঁরাই মুক্তবুদ্ধির মানুষ। এঁদের সংখ্যা বৃদ্ধি করাই রামমোহনের ধর্ম সংস্কারের প্রধান অভিমুখ। মনে করা হয়, এই পুস্তিকা লেখা হয়েছিল প্রধানত একেশ্বরবাদী ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য।
পরে তিনি হিন্দু ধর্মের দিকে মনোযাগী হন। বেদান্ত-উপনিষদাদির বঙ্গানুবাদ করেন ও ভাষ্য সহকারে দেখানোর চেষ্টা করেন, প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রে একেশ্বরের কথা বলা হয়েছে। তিনিই একমাত্র উপাস্য। বলেছেন, ‘সংস্কৃত ভাষারূপ যবনিকার অন্তরালে ইহা লুক্কায়িত থাকায়’, সাধারণ মানুষ সংস্কৃত না-জানা এবং এ সব পবিত্র ধর্মগ্রন্থ স্পর্শের অধিকারী না হওয়ায়, তারা জানে না শাস্ত্রে কী আছে না আছে। সে জন্য লিখেছেন, “বেদান্ত গ্রন্থের তথা ইহার সারভাগের অনুবাদ আমার সাধ্যানুসারে করিয়া বিনামূল্যে আমার স্বদেশ বাসীদিগের মধ্যে যতদূর ব্যাপকভাবে বিতরণ করা সম্ভব, ততদূর বিতরণ করিয়াছি।”
‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় এক জন লিখেছিলেন, “বহু দিবসাবধি বঙ্গদেশে বেদের চর্চা উঠিয়া গিয়াছিল, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা রামমোহন রায়ের নিকট হইতে বেদ বেদান্তের মন্ত্র, ব্রাহ্মণ, শ্লোক, সূত্র ও ভাষ্য শুনিয়া একেবারে চমকিত হইয়া উঠিলেন।” ভট্টাচার্য ও গোস্বামীরা যে শুধু অভিভূত হয়ে পড়লেন তা নয়, যাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁদের গ্রাসাচ্ছাদন চলত, সেই সমাজপতি রাজা-জমিদারদের উস্কানিতে তাঁরা রণং দেহি মূর্তি ধারণ করলেন। এ ছাড়া নিজেদের জায়গা রক্ষা করার তাগিদও ধর্ম ব্যবসায়ীদের ছিল। তাঁরা একের পর এক প্রস্তাবপুস্তিকা লিখে রামমোহনকে পর্যুদস্ত করতে নামলেন। রামমোহন তাঁর বিপুল শাস্ত্রজ্ঞান নিয়ে প্রস্তুত হলেন, সুভদ্র ভাষায় অকাট্য যুক্তিতে তার উত্তর দিতে। সেই কারণে ধর্মসংস্কার কর্মে নেমে রামমোহনকে দু’-তিন রকম লেখা লিখতে হয়েছিল—
ক) প্রাচীন শাস্ত্রের মূল-সহ অনুবাদ। এই ধরনের অন্তত দশটি লেখা তিনি লেখেন। যার মধ্যে পাঁচটি উপনিষদের সভাষ্য সুনির্বাচিত অনুবাদ ছিল। যেমন, ঈশোপনিষদ, কঠোপনিষদ, তলবকার উপনিষদ ইত্যাদি।
খ) আর লিখতে হয়েছিল বিচার বা বিতর্কমূলক পুস্তিকা। অন্তত ছ’টি এই ধরনের জবাবি পুস্তিকা লেখেন তিনি, যেমন, ‘উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশের সহিত বিচার’, ‘ভট্টাচার্য্যের সহিত বিচার’, ‘গোস্বামীর সহিত বিচার’, ‘কবিতাকারের সহিত বিচার’ ইত্যাদি।
সাকার সাধনা ও নিরাকার ব্রহ্মসাধনার পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে রামমোহন ঈশোপনিষদে মহানির্বাণ শ্লোক প্রমাণে লিখেছেন, “পরব্রহ্মজ্ঞান হইলে কোনো নিয়মের প্রয়োজন থাকে না। যেমন মলয়ের বাতাস পাইলে তালের পাখা কোনো কার্য্যে আইসে না।”
বিরুদ্ধবাদীদের উদ্দেশে মহাভারত প্রমাণে লিখেছেন, “পরের ছিদ্র সর্ষপমাত্র লোকে দেখেন, আপনার ছিদ্র বিল্বমাত্র হইলে দেখিয়াও দেখেন না।”
যে সব পণ্ডিত প্রশ্ন তুলেছেন, শাস্ত্রীয় বিধি নিয়ম মানা না-মানা নিয়ে, তাঁদের প্রসঙ্গে বলেছেন, “ওই পণ্ডিতদিগ্যে জিজ্ঞাসা কর্ত্তব্য যে তাঁহারা ব্রাহ্মণের যে যে ধর্ম্ম প্রাতঃকাল অবধি রাত্রি পর্য্যন্ত
শাস্ত্রে লিখিয়াছেন তাহার লক্ষাংশের একাংশ করেন কিনা...”
রামমোহনের উপর দোষারোপ করার জন্য কবিতাকার লিখেছিলেন, ধর্মবিষয়ে তাঁর লেখা প্রকাশিত হওয়ায় ‘অমঙ্গল ও মারীভয় ও মন্বন্তর হইতেছে’। তদুত্তরে রামমোহন মজা করে লিখেছিলেন, কিছু দিন আগে কবিতাকারের রোগ, ধনহানি, মানহানি হয়েছিল, “তাহাতেও বুঝি কবিতাকার কহিতে পারেন যে স্বকর্ম্মের ফল নহে অন্য কোনো ব্যক্তির গ্রন্থ করিবার দোষে ঐ সকল ব্যামোহ কবিতাকারের হইয়াছিল।” ‘পাষণ্ডপীড়ন’-এ জনৈক কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন রামমোহনকে বিস্তর কটুকাটব্য করে লেখেন, “রামমোহন অর্থসহিত বেদমাতা গায়ত্রী ম্লেচ্ছহস্তে সমর্পণ করিয়ছেন।” তদুত্তরে রামমোহন ‘পথ্যপ্রদান’-এ লেখেন, “৪০ বৎসর পূর্ব্বেই দেশাধিপতিরা জানিয়াছেন।” শ্রীরামপুরে ওয়ার্ড সাহেব গায়ত্রীর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন। ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের প্রবল আপত্তি ছিল দেশভাষাতে বেদ প্রকাশ করায়। ম্লেচ্ছ ও শূদ্র হস্তে এটা দেওয়া অত্যন্ত গর্হিত কাজ। ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’-য় ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, ‘সালঙ্কারা শাস্ত্রার্থবতী’ ‘নগ্না উচ্ছৃঙ্খলা লৌকিক ভাষা’; ‘শাস্ত্রসিদ্ধান্ত’ নিতান্ত লৌকিক ভাষায় থাকে না। দীর্ঘকালের ভাষান্তরাল সরিয়ে রামমোহন শাস্ত্রজ্ঞানকে সকলের জন্য সহজবোধ্য দেশি ভাষায় উন্মুক্ত করে দিলেন। ইটালীয় রেনেসাঁসের মানবতাবাদীরা এই কাজই করেছিলেন। রামমোহনের জীবনীকার লিখেছেন, “রামমোহন সেই ভাষার বাধা ভেঙে দিয়ে হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠ ঐশ্বর্যকে সকলের মধ্যে বিতরণ করে দিলেন— এই ঘটনাকে বিপ্লবই বলব।”
জ্ঞান ও শাস্ত্রের ঠিক-ভুল নির্ণয়ে রামমোহন তাঁর মনন বা বিচারশক্তিকে প্রখর ভাবে ব্যবহার করেছেন। শাস্ত্রে যা আছে, তাকে নির্বিচারে অন্ধ ভাবে গ্রহণ করা ঠিক নয়। এই ভুলটাই রক্ষণশীল শাস্ত্রবাদীরা করে। এখনও দেখা যাচ্ছে, তথাকথিত প্রাচীনপন্থীরা বা ‘দেশপ্রেমী’রা ধুয়ো তুলেছে, যা কিছু আমাদের দেশে প্রাচীন কালে ছিল, তা-ই সর্বশ্রেষ্ঠ। নির্বিচারে আমাদের স্বাদেশিক জীবনে তা হুবহু ফিরিয়ে আনতে হবে। রামমোহন প্রাচীন বিদ্যা ও প্রাচীন শাস্ত্রকে পরিগ্রহণ বা পুনরুদ্ধার করার একটি মাপকাঠি ঠিক করে দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, “শাস্ত্রসকল সমানভাবে গ্রাহ্য করা যায় না। কারণ তাহার মধ্যে পৌর্ব্বাপর্য্য আছে, অসামঞ্জস্য আছে। শাস্ত্রসকলের মধ্যে বচনে বচনে বিরোধ দৃষ্ট হয়।”
বুঝতে হবে কোনটি মূল ও প্রামাণ্য, “...যেরূপ ব্যাখ্যা দ্বারা বচন সকলের সামঞ্জস্য রক্ষা হয় তাহাই প্রকৃত ব্যখ্যা বলিয়া গণ্য করিতে হইবে।” সতীদাহের পক্ষেও মুনিবচন ছিল, শাস্ত্রীয় শ্লোক ছিল— রামমোহন দেখালেন সেগুলি অর্বাচীন, প্রক্ষিপ্ত, প্রতারকদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভুল ভাষ্যে ফেনায়িত। তিনি মূল ও প্রামাণ্য শাস্ত্র উদ্ধার করে দেখালেন কোনটি গ্রহণযোগ্য, কেন গ্রহণযোগ্য, কোনটি বর্জনীয় এবং কেন বর্জনীয়। সত্যদর্শী মননশক্তি প্রয়োগ করে তিনি সমাজ সংস্কার করেছেন, ধর্ম সংস্কারও করেছেন। বাতিল করেছেন অর্বাচীন অন্যায্য শাস্ত্রবিধি, কুৎসিত দেশাচার ও অনুচিতের জঞ্জাল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর প্রদর্শিত পথেই বিধবা বিবাহ প্রচলনের লড়াইয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন। বিধবা বিবাহের সপক্ষে শাস্ত্রীয় বক্তব্য ও যুক্তিসূত্রগুলি তুলে এনেছিলেন শাস্ত্রের সাগর ছেঁচে। শুকিয়ে যাওয়া পাতা না ঝরালে জীবনের গাছে নতুন কিশলয় গজায় না। বর্জনের এই অনিবার্যতা রামমোহন তাঁর ধর্ম সংস্কারেও দেখিয়েছিলেন, সমাজ সংস্কারেও।
রামমোহন কেন ধর্ম সংস্কারের পথে নেমেছিলেন, তার ব্যাখ্যা নানা স্থানে নানা ভাবে দিয়েছেন। সবই যে তিনি অধ্যয়নের জগৎ থেকে পেয়েছিলেন তা নয়, অভিজ্ঞতাও তাঁকে আলোকসন্ধানী করেছিল। নিজস্ব অভিজ্ঞতায় তিনি প্রচলিত ধর্মসংস্কৃতির যে আবিলতা দেখেছিলেন, সে প্রসঙ্গে ঈশোপনিষদের ভূমিকায় লিখেছেন, “প্রত্যেক দেবতার উপাসকরা আপনাদের উপাস্য দেবতার প্রাধান্য রক্ষার জন্য এতদূর অধ্যবসায়শীল হন যে, যখন তাঁহারা হরিদ্বার, প্রয়াগ, শিবকাঞ্চি, বিষ্ণুকাঞ্চি প্রভৃতি তীর্থস্থানে একত্র হন, তখন তাঁহাদের সাম্প্রদায়িক শ্রেষ্ঠতা লইয়া ঘোরতর বাক্যুদ্ধ উপস্থিত হয়, এবং কখন কখন পরস্পর প্রহার ও অত্যাচার পর্য্যন্ত হইয়া থাকে।”
রামমোহন-রচিত ‘ব্রহ্মসভার ন্যাসপত্র’ পড়লে দেখা যাবে, তিনি সর্বপ্রকার গোঁড়ামিমুক্ত সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিচয় দিয়েছেন। সকলের উদার আমন্ত্রণ ছিল তাঁর পত্তন করা ধর্মভুবনে। বলা হয়েছিল, এই সমাজের উপাসনা-গৃহ জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
ইংরেজি এক চিঠিতে লিখেছিলেন— আমি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, হিন্দুদের বর্তমান ধর্মীয় ব্যবস্থা তার কোনওরকম রাষ্ট্রনৈতিক উন্নতির পথে সহায়ক নয়। নানা ভাগে, উপবিভাগে ছিন্নভিন্ন জাতিভেদ প্রথা দেশাত্মবোধের পরিপন্থী। নানা ধরনের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং অস্পৃশ্যতা তাদের কোনও অগ্রগতির কর্মসূচি নেওয়ার পক্ষে বাধাস্বরূপ। আমি মনে করি, তাদের ধর্মীয় ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা জরুরি। অন্তত রাজনৈতিক সুবিধা বা সামাজিক স্বস্তির জন্য সেটা অত্যাবশ্যক।
রামমোহনের ধর্ম সংস্কার শুধুমাত্র ব্যক্তিমানুষের পারমার্থিক উন্নতির জন্য নয়, মালিন্যমুক্ত একটি সুস্থ সমাজ গঠন এবং দেশের সামগ্রিক উন্নতির জন্যও অতি আবশ্যক হয়ে উঠেছিল।
বিশ্বপ্রকৃতির বিশালতার সঙ্গে ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্বকে একটি অভিন্ন ও নিবিড় অনুভব সূত্রে বেঁধে দেওয়ার প্রয়াস নিয়েছিলেন রামমোহন, সে কথা তাঁর ‘প্রার্থনা পত্র’ বা ‘গায়ত্র্যা ব্রহ্মোপাসনা বিধানম্’ পাঠ করলে টের পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, “সর্ব্বাধিক তেজস্বী ও প্রকাশক এবং মহান্ সূর্য্য তাঁহার অন্তর্যামি আত্মা আর অতি সাধারণ জীব যে আমরা আমাদের অন্তর্যামি আত্মা একই হয়েন।”
রামমোহনের ধর্ম সংস্কার প্রসঙ্গে আরও দু’-একটি সূত্রের কথা উল্লেখযোগ্য। ‘ব্রহ্মোপাসনা’য় স্পষ্ট করে লিখেছেন, শুধু পরমেশ্বরের চিন্তা করলেই হবে না, প্রতিবেশীর কথাও মনে রাখতে হবে— “মানুষের যাবৎ ধর্ম দুই মূলকে আশ্রয় করিয়া থাকেন। এক এই যে সকলের নিয়ন্তা পরমেশ্বরেতে নিষ্ঠা রাখা; দ্বিতীয় এই যে পরস্পর সৌজন্যতে ও সাধু ব্যবহারেতে কাল হরণ করা।”
তাঁর মতে ধার্মিক মানুষ মানে ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ নয়, সৌজন্যসম্মত সামাজিক মানুষও—“অপরে আমাদের সহিত যেরূপ ব্যহার করিলে আমাদের তুষ্টির কারণ হয় সেইরূপ ব্যবহার আমরা অপরের সহিত করিব। আর অন্যে যেরূপ ব্যবহার করিলে আমাদের অতুষ্টি হয় সেরূপ ব্যবহার আমরা অন্যের সহিত করিব না।”
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববোধের গোড়া পত্তন হয়েছিল রামমোহন ধর্মসংস্কারের মধ্যে দিয়েই। রামমোহন না এলে রবীন্দ্রনাথ কি মেলাতে পারতেন বিজ্ঞানের নবাবিষ্কৃত সম্বন্ধতত্ত্ব ও কবির সর্বগ্রাহী বিশ্বপিপাসা— ‘যেথা যাব সেথা অসীম বাঁধনে অন্তবিহীন আপনা।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy