জগৎ শেঠদের মৃত্যু নেই। সারা পৃথিবী জুড়ে এখনও তাঁরা আছেন এবং টাকার গদির উপর রাজত্ব করে চলেছেন। স্বনামে অথবা বেনামে। কারণ আজও মুর্শিদাবাদি নবাবদের ব্যাঙ্কার হিসেবে তাঁর নাম মীরজাফরের সঙ্গেই একই রকম ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। যদিও মুর্শিদাবাদের নবাবি ধূলিসাৎ হওয়ার পর স্বভাবতই জগৎ শেঠদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কমে আসে। পাশাপাশি তখন বাংলার রাজনীতি-অর্থনীতির কেন্দ্রগুলি ক্রমশ কলকাতায় চলে আসার ফলে জগৎ শেঠদের উত্তরপুরুষেরা অনেকটাই সরকারি দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। কিন্তু রক্তে যাঁদের ব্যবসা, তাঁরা চাঁদে গেলেও দোকান খুলে বসবেন। জগৎ শেঠ তো আসলে মারোয়াড়ি সম্প্রদায়েরই এক জন প্রতিভূ ছিলেন, যাঁরা রাজস্থানের একটি বিশেষ অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষ তো বটেই, পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, এঁরা নিজেদের প্রখর ব্যবসাবুদ্ধি দিয়ে দেশের অন্যতম ধনী সম্প্রদায় হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এই জাতিটি ব্যবসার কারণে দেশ-বিদেশের নানা কোণে বসতি গেড়েছেন।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলে এই সম্প্রদায় বসতি স্থাপন করেন। অনেকেই জানেন এই অঞ্চলটি কী রকম ঘিঞ্জি। পানের পিক, গুটখার গন্ধে ঝিমঝিমে অথচ ব্যবসাবাণিজ্যের নিরিখে অতি সচল একটি জায়গা। রাজস্থান থেকে আসা মারোয়াড়ি সম্প্রদায় কলকাতার এই পরিবেশেই তাঁদের জীবন-জীবিকার লক্ষ্মীর আসন পাতেন। যদিও ব্রিটিশদের আসার আগে এখানেই ছিল সুতানুটি হাট। ১৭০৭ সালে এই জায়গাটি সুতো ও কার্পাস ব্যবসার কেন্দ্র হিসাবে গড়ে ওঠে। সেই সময় এখানে একটি বিশাল অঞ্চল জুড়ে সার সার দোকান, গুদাম, বাড়ির পর বাড়ি ছিল। সেই কারণে অনেকে এই অঞ্চলটিকে বড়বাজার বলতেন। আবার কেউ কেউ বলেন, বুড়ো শিবের থান থেকে জায়গাটির নাম ‘বুড়াবাজার’ এবং তা থেকে পরবর্তী কালে বড়বাজার হয়েছে।
১৮৪০ সাল থেকে মারোয়াড়ি সম্প্রদায় এখানে আসতে শুরু করেন। তখন বঙ্গপ্রদেশে নানা ধরনের ব্যবসার চল ছিল। সেই কারণে অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় এ বঙ্গেই মারোয়াড়িরা দলে দলে আসতে শুরু করেন। এই ‘মাইগ্রেশন’-এর বিশেষ কারণ ছিল রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। ১৯১১ সালের জনগণনায় দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গে রাজস্থান থেকে আগত প্রায় কুড়ি হাজারের উপর মারোয়াড়ি বাস করতেন। যদিও বেসরকারি মতে আসল সংখ্যাটি অনেক বেশি।
চিরকালই বলা হয় বাঙালি জাতিগত ভাবে ভিতু এবং অলস। তখনকার দিনে এই বঙ্গে বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত বাঙালি কোম্পানির কেরানিগিরি করতেন এবং রাতদিন সাহেব প্রভুদের হেনস্থা সহ্য করতেন। আর এর উল্টো দিকে মারোয়াড়ি যুবকরা বেনিয়া ইংরেজদের ব্যবসাবুদ্ধিকে কী করে টেক্কা দেওয়া যায় তার ফন্দি আঁটতেন। মারোয়াড়িদের সাফল্যের আরও একটি বড় কারণ, তাঁদের ঝুঁকি নেওয়ার সাহস। এই অদম্য সাহস থেকেই তাঁরা নানা ধরনের ফাটকা কারবার শুরু করলেন। তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাটকার পণ্য ছিল আফিম। অনেকেই এই আফিমে বাজি লাগিয়ে সেই সময় লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করেছেন। এই বেনিয়া সম্প্রদায়ের একটি দল ছিল আরও তীক্ষ্ণ, আরও ক্ষুরধার। কোনও রকম পণ্য ছাড়াই তাঁরা আশ্চর্য সব জুয়ার জন্ম দিয়েছিলেন। এমনই এক বড়বাজারি জুয়ার বিষয় ছিল বৃষ্টিপাত। কলকাতার মারোয়াড়িদের মতে, বৃষ্টি নিয়ে জুয়া বা ফাটকার প্রচলন ১৮২০ নাগাদ। কারণ তাঁরা মূলত রাজস্থানের শেখায়তী অঞ্চলে থাকতেন। সেই সব শুখা অঞ্চলে বর্ষার পরিমাণ এতটাই কম ছিল যে, বৃষ্টিকে তাঁরা খুবই সৌভাগ্যসূচক বলে মনে করতেন। আকাশের মেঘ দেখে বৃষ্টি হবে কি হবে না, সে নিয়ে ছেলে-বুড়ো সকলেরই ছিল অদম্য প্রত্যাশা। বর্ষার তীব্র প্রতীক্ষা থেকেই এই জুয়ার শুরু। সেই ঐতিহ্য তাঁরা কলকাতাতেও নিয়ে এলেন।
ব্রিটিশদের মতে, ১৮৭০ সালে কলকাতায় রমরমিয়ে বর্ষাজুয়া চলত। দিনের বিভিন্ন সময়ে কী পরিমাণ বৃষ্টি হতে পারে, তারই পূর্বাভাস ধরে বাজি লড়া হত। যেমন ধরা যাক দুপুর দুটো থেকে চারটে পর্যন্ত কতটা বৃষ্টিপাত হবে। থাকত বৃষ্টি মাপার নানা যন্ত্রপাতি। এই খেলা বা জুয়া এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, শুধুমাত্র বড়বাজার অঞ্চলের মারোয়াড়ি নয়, দূরের গ্রাম, মফস্সল থেকেও ধনী-গরিব নির্বিশেষে আসতেন ভাগ্য ফেরাতে। লোকসমক্ষে এই জুয়া যারা পরিচালনা করত, তারা ছিল দালাল। আসলে এই চক্রের নেপথ্যে ছিলেন ধনী মহাজনেরা। কাজেই অর্থের জোগানটাও তাদের থেকেই আসত।
জুয়া মানুষের এক ধরনের আদিম আসক্তি। সেই মহাভারতের কাল থেকে চলে আসছে। যে কোনও জুয়ার প্রবৃত্তিই হল, শেষ পর্যন্ত জিতে যাওয়ার অবাস্তব আকাঙ্ক্ষা। এই আশা নিয়েই বাজি ধরতে আসা মানুষজন ক্রমশ নিঃস্ব হয়ে যেত। এবং প্রত্যেক জুয়ার মতো এখানেও দেখা যেত, সংগঠকরাই লাভের গুড় খেয়ে নিলেন। এই বৃষ্টি নিয়ে ফাটকাবাজি মারোয়াড়িরা শুরু করলেও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এই খেলায় অংশ নিত। ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের সামাজিক মেলামেশাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে কোনও জুয়ায় সাধারণত গরিব মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথমে নগদ অর্থ, স্ত্রীর গয়না, তার পর সামান্য জমিজায়গা, স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তিও তাঁরা বাজি ধরতেন লাভের আশায়। লাভ তো হতই না, শেষ পর্যন্ত সব খুইয়ে পারিবারিক বিপর্যয়ে ঘটনাটি শেষ হত। কেউ কেউ এই বিপর্যয়ের আঘাত সামলাতে না পেরে আত্মহত্যাও করতেন। বিষয়টি ক্রমশ আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিলে ব্রিটিশ সরকার আইন করে বৃষ্টিজুয়া নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দিলেন। এর ফলে সর্বপ্রথম বাধাটি এল মারোয়াড়ি সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে। তাঁদের যুক্তি ছিল, এই জুয়া তাদের বহু পুরনো সংস্কারের সঙ্গে জড়িত। এই বৃষ্টিজুয়ার সঙ্গে তাঁদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্যও মিশে আছে। কাজেই এর মধ্যে বিদেশির হস্তক্ষেপ তাঁরা কিছুতেই মেনে নেবেন না। তাঁরা পাল্টা যুক্তি দিলেন, বৃষ্টিজুয়া বন্ধ করলে ঘোড়দৌড় নিয়ে ইংরেজদের ফাটকাবাজিও বন্ধ করতে হবে। কারণ সেই সময় ইংরেজরা ঘোড়দৌড়কে শুধু প্রশ্রয়ই দিচ্ছিল না, রীতিমতো বাজিতে অংশ নিচ্ছিল। তবু সাহেবদের কথা শোনানো যায়নি। কাজেই বৃষ্টিজুয়া বেআইনি হয়ে গেলেও গোপনে চলতে লাগল। কে না জানে কোনও কিছু নিষিদ্ধ হয়ে গেলে তার আকর্ষণ বাড়ে!
বর্তমান কটন স্ট্রিটের ৬৭ নম্বর বাড়িটি ছিল বৃষ্টিজুয়ার প্রধান আখড়া। আইন করে এই জুয়া বন্ধ করা হলেও শোনা যায়, গোপনে এই জুয়ার আসর নাকি এখনও বসে।
তথ্যসূত্র: দ্য মারোয়াড়িজ়, ফ্রম জগৎ শেঠ টু বিড়লাজ়— টমাস এ টিমবার্গ, পেঙ্গুইন বুকস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy