আদিপর্ব থেকে মধ্যযুগ— ভূস্বর্গের শাসনভার বার বার সামলেছেন বীরাঙ্গনারা। প্রথম যে রানির নাম শোনা যায়, তিনি যশোবতী। তাঁকে মুকুট পরিয়েছিলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। তর্কযোগ্য ভাবে, তিনি পৃথিবীরই প্রথম মহিলা যাঁর হাতে এসেছিল কোনও সাম্রাজ্যের সার্বভৌম সৌভাগ্য। এর পর কাশ্মীরের শাসনদণ্ডে কালে কালে লেখা হয়েছে সুগন্ধাদেবী, কোটা রানি বা কবি হাব্বা খাতুনের নাম। কিন্তু এঁদের মধ্যে সবচেয়ে নামজাদা ও একই সঙ্গে সর্বাধিক কুখ্যাত ছিলেন দশম শতাব্দীর মহারানি দিদ্দা। চল্লিশ বছরের কাছাকাছি কাশ্মীর তাঁর বশে ছিল। আজ হাজার বছর পরেও তাঁর নাম করলেই উপত্যকার অধিবাসীদের চোখের কোণে উঁকি মেরে যায় আতঙ্ক। মানুষ বলে, “দিদ্দা রানি? তিনি তো প্রেতসিদ্ধ ছিলেন।”
কাশ্মীরের ইতিহাসকার কল্হণ তাঁর ‘রাজতরঙ্গিণী’-তে দিদ্দার চরিত্রটা এমনই ভয়াল করে এঁকেছেন। তাঁর লেখনীতে দিদ্দারই বছর কয়েক আগেকার রানি সুগন্ধা সাক্ষাৎ দেবী। তিনি বড় ভাল মানুষ ছিলেন। তাই সভাসদরা তাঁকে কোতল করেছিল।
দিদ্দা রানির মাতৃকুল অতি পরাক্রমী। সে সময়ে পিরপঞ্জাল পর্বতশ্রেণির এ-ধার ও-ধারে মণিমুক্তোর মতো গেঁথে ছিল ছোট অথচ শক্তিশালী সব শৈবরাজ্য। এর মধ্যে কপিসা (কাবুল) থেকে গান্ধার (পেশোয়ার) পর্যন্ত শাসন করতেন হিন্দু শাহি বংশ। মামুদ এসে রাজ্য তছনছ করার আগে পর্যন্ত এঁদের দাপটে কেউ আঁচড়ও কাটতে পারেনি। সেই রাজ্যের ভীমরাজা তাঁর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিলেন লোহার (পুঞ্চ) দেশের সিংহরাজার। অমনই সঙ্কীর্ণ গিরিপথের মধ্য দিয়ে রত্ন আনা-নেওয়ার দামি বাণিজ্যপথের সবটাই এসে গেল দুই রাজ্যের বাহুবলে। আর জাটপুরুষ সিংহরাজার ঘরে এল পরমাসুন্দরী কন্যা। কল্হণের ভাষায়, এই রাজকন্যা ‘চরণহীনা’। সম্ভবত পোলিয়োতে পঙ্গু। রাজকুমারী দিদ্দার জন্য রাজা-রানির দুঃখের সীমা রইল না।
কাছাকাছি সময়ে ঝিলমের পাড়ের ছোট্ট কাশ্মীর রাজ্যটিতে চলছে ঘোর অনাচার। বালকরাজা সংগ্রামদেবের বাঘচোখ তাজখানি কেড়ে, তাঁর শিরে পাথরের চাঁই চাপিয়ে হ্রদে ফেলে এসেছেন খল মহামন্ত্রী প্রভাগুপ্ত। তার পর নড়বড়ে মুকুটটি নিজের নিষ্কেশ মস্তকে চাপিয়েছেন। ছোট্ট রাজার ঠান্ডা দেহ যখন উপত্যকার কাচের মতো বরফের নীচের হিমেল নীল স্রোতে ভেসে ভেসে চলেছে, তখন স্থলে-জঙ্গলে তাণ্ডব করছেন প্রভাগুপ্তর ছেলে ক্ষেমাগুপ্ত। সুরা, নারী আর শিকার ছাড়া তাঁর মোটা মাথায় কিছুই ঢোকে না। তাঁর রাজা হওয়ার না ছিল ক্ষমতা, না ছিল কুলগৌরব। প্রজারা ক্ষিপ্ত, কিন্তু মৌন। পার্ষদরা বিরক্ত এবং ষড়যন্ত্রে মত্ত।
এই সময়ই ক্ষেমাগুপ্ত বিয়ে করে শ্রীনগরে আনলেন দিদ্দাকে। রানির তখন ২৬ বছর বয়স। সে কালেও এত দিন অনূঢ়া থাকার কারণ সহজেই অনুমেয়। রাজার মেয়ে দিদ্দাকে বিয়ে করে বংশগরিমা পেতে চাইলেন অপদার্থ ক্ষেমাগুপ্ত। আর কয়েক দিনেই সুরম্য প্রাসাদের অলিন্দে দাঁড়িয়ে হ্রদের কাকচক্ষু জলে সর্বনাশের ছায়া দেখতে পেলেন বুদ্ধিমতী দিদ্দা। অল্প দিনেই যে রাজা তাঁতে লুব্ধ। সপত্নীরা দ্বেষে পুড়ছেন। ক্ষেমাগুপ্তকে স্ত্রৈণ বলছে সকলে। রাজাও আলোচনা বাড়িয়ে ‘দিদ্দাক্ষেমা’ নামে মুদ্রা চালু করে দিলেন। সব চাইতে রুষ্ট মহামন্ত্রী ফাল্গুন। তাঁর মেয়ে চন্দ্রলেখাও তো এক রাজরানি। সতীনের বাড়বাড়ন্ত সহ্য করতে না পেরে সে রোজ কাঁদছে বাবার কাছে। জামাইয়ের নামে আগে রাজ্য চালাতেন ফাল্গুনই। আজ সে অধিকারও যেতে বসেছে।
তার পর জন্মাল দিদ্দা-ক্ষেমার পুত্র অভিমন্যু। বিশাল বাহিনী নিয়ে নাতির মুখ দেখতে এলেন লোহারের সিংহরাজা। পৌত্রের শুভকামনায় মন্দির গড়লেন, রাজ্যে নামল ভোজ-খয়রাতির অকালবর্ষণ। পরবর্তী রাজা কে, সংশয়ই রইল না।
এর কিছু দিন পরে, বারামুল্লায় শেয়াল শিকারে গিয়ে, অজানা জ্বরের শরে বিদ্ধ হলেন ক্ষেমাগুপ্ত। অচিরেই পৃথিবীর মায়া কাটালেন তিনি। চোখের জলের প্রথম ফোঁটাটি মাটি ছোঁয়ারও আগে, মহারানি লুকিয়ে ফেললেন অভিমন্যুকে। রাজাকে চিতায় তোলার প্রস্তুতি চলছে। দিদ্দার কাছে সোনার রেকাবিতে এল বিবাহবাসরের পোশাক। জানানো হল, “অমাত্য রাজপুরুষরা আপনার জন্যই অপেক্ষা করছেন। আসুন মা, অন্য রানিদের মতো আপনিও রাজার সঙ্গেই স্বর্গপথের আগুনরথে উঠুন। সতী মায়ের চরণ ছুঁয়ে পুণ্য অর্জন করে পাত্রমিত্ররা নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাক।”
কিন্তু দিদ্দা সহমরণে কিছুতে রাজি হলেন না। জানিয়ে দিলেন, ছেলে অভিমন্যুর রক্ষাকবচ তিনি। তার জন্যই বেঁচে থাকবেন। শিশুরাজপুত্রের মাথায় মুকুট পরিয়ে নিজেই এলেন দরবারে। দমিয়ে দিলেন সব বিদ্রোহ। মাথা থেকে পাগড়ি নামিয়ে মন্ত্রী ফাল্গুন দেশ ছাড়লেন।
এক দিন পুত্র-সহ দিদ্দারানি পদ্মস্বামীর মন্দিরে গিয়েছেন। শুনেই তাঁকে ও অভিমন্যুকে মারতে ছুটলেন ক্ষেমাগুপ্তের জ্ঞাতি, দিদ্দার শত্রু মহিমান ও পাটালা। তাঁরা দুই ভাই। তাঁরা গিয়ে অবাক হয়ে দেখলেন কোথায় অভিমন্যু? দাসীর পিঠে বসে তরোয়াল-ঢাল উঁচিয়ে চোখ পাকিয়ে স্বয়ং দিদ্দা। রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়তে যেতেই, হঠাৎ তাঁদের সঙ্গী সৈন্যরাই উল্টোবাগে মারমুখী হয়ে ছুটে এল দুই ভাইয়ের দিকে। মন্দিরের চাতালে পর পর গড়িয়ে পড়ল দুই ভাইয়ের মাথা। দিদ্দার শব দেখার জন্য যে বীরপুরুষরা বাইরে দাঁড়িয়েছিল, তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাল। দিকে দিকে রটে গেল, মহারানি পিশাচিনী। তাঁর চোখের ইশারায় ধড় থেকে মাথা খসে পড়েছে মহিমান-পাটালার। তিনি চাইলেই সেনারা মোহাবিষ্টের মতো হুকুম তামিল করে। দিদ্দা কাউকে গুমখুন করিয়ে, কাউকে রত্নে-সম্পদে ভরিয়ে নিজের দল ভারী করতে লাগলেন।
ত্রাস হয়ে উঠলেন তিনি। দেখতে স্বাভাবিক নন। অসম্পূর্ণ দেহেই অসাধারণ সৌন্দর্যের অধিকারিণী। চলতে পারেন না। ভলগা নামের এক দাসী বয়ে বেড়ায় তাঁকে। গোটা দৃশ্যটাই ভীষণ ভীতি উদ্রেক করে। শোনা যায়, একের পর এক পুরুষকে রূপের গোলাম বানিয়ে চলেছেন। কত শত্রুই রাতারাতি তাঁর শিবিরে চলে এসেছে। নতুন মন্ত্রী নরবাহন আর রাক্কা তাঁর একটি কথায় পাশের রাজ্যের বিক্ষুব্ধদের চাবুক মারতে মারতে সভায় এনে মাথা কাটছে। সবাই বলতে লাগল, দিদ্দা মানুষ নন। মন্ত্র ফুঁকে বশ করতে জানেন। এতটুকু বাড়বাড়ন্ত দেখালেই দক্ষ সেনাধ্যক্ষেরও গর্দান নেন মুহূর্তে। কাউকে বিশ্বাস করেন না। প্রতিদ্বন্দ্বিতা মাথাচাড়া দিলেই চতুরতম সান্ত্রিদের লাগিয়ে শত্রুদের শয়নকক্ষ জ্বালিয়ে দেন গভীর রাতে। তাদের বংশনাশ করেন ধারালো কুঠারে। সকলে তটস্থ। দিদ্দা-বিদ্বেষী কল্হণ পর্যন্ত লিখছেন, “বিদ্রোহীরা সমূলে উৎপাটিত। মনে করা হয়েছিল এই পঙ্গু নারীর গোষ্পদসম ধরণী চলারও ক্ষমতা নেই। হনুমান যে হেলায় এক লাফে সমুদ্র ডিঙিয়েছিলেন, আজ এই নারী ঠিক যেন তেমনই অবলীলায় শত্রু জয় করলেন।”
কী ভাবে? চাউর হয়ে গিয়েছিল, রূপের জালে। সেই গুঞ্জনকে আর একটু উস্কে মন্ত্রী নরবাহন আত্মহনন করলেন। তাঁর উপর থেকে দিদ্দা মনোযোগ সরিয়ে নেওয়ায় নাকি হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল তাঁর। লোহার বংশীয়দের চিরকালই দু’চক্ষে দেখতে পারে না শূদ্রবর্ণীয় দামারা গোষ্ঠী। এ বার নরবাহনের মৃত্যু হতেই রানির বিরুদ্ধে যুদ্ধের দামামা বাজাল দামারা-রাজা। কথিত, এক তন্ত্রপ্রাচীরে তাঁদের আগ্রাসন দেখতে পান ক্ষত্রাণী দিদ্দা। পুঞ্চের কোনও আশ্রম থেকে খুঁজে বার করেন ভগ্নমনোরথ মন্ত্রী ফাল্গুনকে। দামারাদের শায়েস্তা করে রানির নেকনজরে আসেন ফাল্গুন। এ বার তাঁর সঙ্গে রানির বিশেষ সম্পর্কের ধোঁয়া ঘনায় রাজপ্রাসাদের আকাশে। কিন্তু তিলে তিলে সাজানো সিংহাসনকে শূন্য করে ৯৭২ খ্রিস্টাব্দে কোনও অজানা কারণে অভিমন্যুর মৃত্যু হয়। ঘা খাওয়া বাঘিনি হয়ে ওঠেন দিদ্দারানি। যদিও নিন্দুকে বলছে, নিজের ছেলেকে খেয়েছেন এই প্রেতিনীই। সৎমায়ের বাবা ফাল্গুনের সঙ্গে নিজের মাকে দেখামাত্র বিষাদে ডুবে গিয়েছিলেন যুবরাজ। তার পরেই বিষফল খান। কিংবা এক নাগিনী এসে হলাহল ঢেলে যায় তাঁর পেয়ালায়। যে ভাবেই অকালমৃত্যু এসে থাক, সকলে নিশ্চিত, দিদ্দাই পুত্রঘাতিনী। রটে গেল, পাহারাদারেরা রাতে নাকি এক অজানা বাতাসের ভরে তন্দ্রায় ঢলে পড়ে। সে সময় রানি সরীসৃপের মতো বুকে হেঁটে প্রাসাদ পাহারা দেন। তিনি বিকলাঙ্গ, মাটিতে হাঁটতে পারেন না। তবে দেওয়াল বাইতে পারেন অনায়াসে। এ দৃশ্য যে দেখে, সে সঙ্গে সঙ্গে মরে যায়।
পর পর যমের বাড়ি গেল অভিমন্যুর শিশুপুত্ররাও। নন্দীগুপ্ত, ত্রিভুবনগুপ্ত। রাজার বেদি নাকি মায়াপাশে বাঁধা। রাজকুমার যতই ছোট্ট হোক, হোক বা আপন পৌত্র, অনুজ্ঞার এতটুকু অবজ্ঞা করলেই পিছন থেকে গলায় এসে সুতীক্ষ্ণ শ্বদন্ত ফোটায় পিতামহীর পোষা অপদেবতা। ৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা হলেন তৃতীয় পৌত্র ভীমগুপ্ত। বয়স ভারে ন্যুব্জ ফাল্গুনও শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন। রানিকে সঙ্গ দেওয়ার যোগ্যতা তাঁর অনেক দিনই গিয়েছিল। তত দিনে রানির জীবনে এসেছেন তুঙ্গ নামের এক সুদর্শন মেষপালক। বয়সে অভিমন্যুর ছেলেদেরই বয়সি। অঙ্গে আপেল বাগিচার টুকটুকে যৌবন, দেহে চিনার বৃক্ষের সুঠাম পল্লবিত ছাঁদ। রানি এই তুঙ্গের সেবায় তুষ্ট হয়ে কয়েক দিনেই সেই অজ্ঞাতকুলশীলকে রাজ্যের সর্বেসর্বা করে দিলেন। বয়ঃসন্ধিতে উপনীত ভীমগুপ্ত গর্জে উঠলেন। রাজ্যের ভার চাইলেন নিজের হাতে। তাঁর স্থান হল কালকুঠুরিতে। সেখানেই রাজমহামাতার অনুচরদের অত্যাচারে ৯৮১ খ্রিস্টাব্দে জীবন খোয়ালেন তিনি। তখনও সাবালকত্বেই পৌঁছাননি সেই রাজপুত্র।
বংশহীনা রানি এ বার রাজ্যের লাগাম তুলে নিলেন পুরোপুরি নিজের হাতে। ২২ বছর ধরে তুঙ্গের সহায়তায় দাপিয়ে রাজ্যশাসন করলেন একাকিনী, আর কোনও নাবালকের অভিভাবক হয়ে নয়। এ বার স্বয়ং তিনিই রানি। কাশ্মীরের একমাত্র একচ্ছত্র নায়িকা।
তাঁর এই প্রায় অর্ধশতকব্যাপী রাজ্যশাসন কাল সম্পর্কে কল্হণ যে বর্ণনা করেছেন, তার সারকথা— রানি ব্যভিচারিণী, কটুভাষিণী, পাষাণহৃদয়া, নিষ্ঠুরমতি এবং জাদুবিদ্যায় পারদর্শিনী। তিনি কাশ্মীরের খলনায়িকা। কিন্তু এ কথা কি এক বাক্যে মেনে নেওয়া চলে? কল্হণ তো রানির শাসনকাল নিজ চোখে দেখেননি। ১০০৩ খ্রিস্টাব্দে রানি মারা যান। তার প্রায় দেড়শো বছর পর তিনি ইতিহাস রচনা করেন। তাঁর এই লিখনের মূল ভিত্তি তো লোককথন, শ্রবণ। এ কথাও তো কল্হণই লিখেছেন, রানি প্রায় সত্তরের কাছাকাছি মঠ ও মন্দির গড়েছিলেন। কালের ছলে ও লুঠতরাজের ফলে তার কোনওটাই আজ আর দাঁড়িয়ে নেই। তাই সাক্ষ্যও নেই। তা হলে কি এই কঠোর মহিলার নেতৃত্বে নত হতে বাধ্য হয়েই পিতৃতন্ত্র তাঁকে ডাকিনী অপবাদ দিয়ে শোধ তুলল? শত্রুর অভাব ছিল না তাঁর। তাঁদের ষড়যন্ত্রেই হয়তো যুবক হওয়ার অনেক আগে নাবালক রাজকুমাররা একে একে ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে— আর আসল মাথাটা ফেলতে না পারায়, শিশুঘাতিনীর কলঙ্ক চাপানো হল দিদ্দার স্কন্ধে। এমন কাহিনির ছেঁড়া ছেঁড়া টুকরোও কিন্তু বাতাসে ওড়ে। সে সময় নগরীতে যে শিশুরই অকালে প্রাণ যেত, মৃদু স্বরে অনুমান চলত, যখ বানাতে কচি আত্মাকে নিয়ে গিয়েছেন রানি।
হতেই পারে, মোহিনী-কাহিনির সুতোও হয়তো তখনকার মোড়ল-গ্রামবুড়োরা নিজেরাই পাকিয়েছিল! নইলে এক খোঁড়া মেয়ের পায়ের তলে পর পর আছড়ে পড়ছে দুর্দান্ত সব কূটনীতিজ্ঞ আর যোদ্ধাকুলপতি— এ বিষয়টা মেনে নিতে বড় মানে লাগছিল তাঁদের। মনে রাখতে হবে, হিংসার চোটেই রাজিয়া সুলতানার নামও এক আফ্রোবংশজাত প্রহরীর সঙ্গে জড়িয়ে দিয়েছিল ওমরাহরা। তা যে মিথ্যা, প্রমাণিত। দিদ্দার সঙ্গেও সেই অন্যায় না হওয়ার কোনও কারণ নেই।
কারণ আছে বরং দিদ্দার। যে সময়ে তিনি পুত্রক্রোড়ে স্বামীহারা, সে সময়ে যে দিকে তাকান শুধু রাজত্বলোলুপ শত্রু। তাদের কখনও শেষ রাখতে হয়? তাই, বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্, যেনতেনপ্রকারেণ মারমার কাটকাট নীতি নিয়েই বা কী দোষ করেছিলেন তিনি? দিদ্দার রাজনীতি যে নিশ্ছিদ্র ছিল, তার কিন্তু প্রমাণ বহু। জানা যায়, যখন তাঁর বয়স প্রায় আশি, পৌত্রদের হারিয়ে, নিজ রক্তজ কোনও উত্তরাধিকারী নির্বাচনে বদ্ধপরিকর হলেন। তাঁর ভ্রাতৃবংশ লোহার-কুলের অনেকেই রাজ্যের দাবি করল। তাদের একত্র করে দিদ্দা এক বিরাট ঝুড়ি ছেলেদের দিলেন। বললেন, যার হাতে সবচেয়ে বেশি ফল, রাজ্য তার। ছেলেরা মারপিট শুরু করল। উত্তরীয়ে থোকা থোকা লাল জামুন আর বাবাসেতি নিয়ে রানির সামনে রাখল সংগ্রামরাজ। তার পোশাক এতটুকু ধ্বস্ত নয়। কারণ সে তো নিজে লড়েনি। অন্যদের উদ্দীপিত করছিল মাত্র। তার পর ভাইরা যখন দাঙ্গায় ব্যস্ত, সন্তর্পণে ফলগুলো কুড়িয়েই জিতে বেরিয়ে এসেছে। দিদ্দা সংগ্রামরাজাকে দত্তক নিয়ে তাকে পরবর্তী রাজা ঘোষণা করেন। মন্ত্রী তুঙ্গকে দিয়ে শপথ করান যে তিনি আজীবন এই নতুন রাজাকে রক্ষা করবেন। তার পর চোখ বোজেন।
এর পর দুই দশক ধরে দিদ্দার মুকুট সামলে রেখেছিলেন সংগ্রামরাজ। সে সময় গজনির সুলতান মামুদ বার বার ধাক্কা দিচ্ছেন উত্তর ভারতের রাজ্যসমূহের বিরাটকায় ফটকে। তাঁকে দু’-দু’বার রুখে দিয়েছিলেন যে মহাবীর, তিনিই এই সংগ্রামরাজ। হয়তো সারা ভারতে আর কোনও শাসকের এই কৃতিত্ব নেই। যদিও এই কৃতির মূল দাবিদার দিদ্দার হাতে লালিত ও পুষ্ট পোক্ত প্রশাসন এবং দুর্দম সেনাবাহিনী। যাদের সঙ্গে তুলনা করা হত হিমালয়ের তুষারঝড়ের।
তা হলে? দিদ্দার ক্ষমতা কি আগাগোড়াই অন্ধকারময়? তা-ই যদি হবে, আজও কাশ্মীরিরা শ্রদ্ধাস্পদ মানবীকে ‘দেদ’ বা ‘দিদ্দি’ অভিধায় অভিহিত করেন কেন? এই সম্মাননাম তো দিদ্দারই অপভ্রংশ! তবে কি কল্হণের কলমে পৌরুষের অভিমান? পক্ষপাতের কালি?
নাহ্। তা কী করে হয়? ‘রাজতরঙ্গিণী’ই তো কাশ্মীর রাজবংশের আদিতম লিপিবদ্ধ ইতিহাস। তাই বুকে পাথর বেঁধে সত্যটাই বুঝি ঝাঁপ মেরেছে বিয়াস নদীর জলে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy