প্রসাদলীলা: দইবড়া। ডান দিকে, স্বামী হরিদাসজি প্রতিষ্ঠিত বৃন্দাবনের বাঁকেবিহারী
মশলাদার টক দইয়ে বিউলির ডালের বড়ার আত্মসমর্পণ। তার উপরে ঝুরিভাজা, চাট মশলা ও তেঁতুলের চাটনি। দারুণ সুস্বাদু এই মিশেলটিকে আমরা চিনি দইবড়া নামে। বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘পাকপ্রণালী’ বইতে একে বলেছেন ‘ঘোলবড়া’। প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীও তাঁর বইতে দইবড়ার প্রস্তুত প্রণালী বর্ণনা করেছেন। মুখরোচক জলখাবার হিসেবে পরিচিত হলেও প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী দইবড়ার ভোজনবিধি সম্বন্ধে বলেছেন, “জলপানে লুচি, ছোকা প্রভৃতির সঙ্গে এবং ভাতের সহিতও দই বড়া খাইতে ভাল।” ভারতের হিন্দি বলয়ের জনপ্রিয় এই খাদ্যটি যে কবে, কী ভাবে বাংলার জলহাওয়ায় মিশে গিয়েছে তা আজ আর জানার উপায় নেই। দইবড়া যে উত্তর ভারত থেকে বাংলায় এসে নিজের আধিপত্য কায়েম করেছে, সেই তত্ত্ব অনেকে মানতে নারাজ। আবার বেশ কিছু বৈষ্ণব সাহিত্যে উল্লেখ আছে, শ্রীকৃষ্ণের পছন্দের খাবারের মধ্যে অন্যতম ছিল দইবড়া। যদিও বৃন্দাবনের আদরের কানাইয়ের জন্য ডালের বদলে ছোলার বেসন দিয়ে বড়া তৈরি করে পাতলা ঘোলে পাতিলেবুর রস, আদা ও হিং মিশিয়ে দইবড়া প্রস্তুত হত।
প্রাচীনকাল থেকেই দই স্বমহিমায় ভাস্বর। বেদে দধির উল্লেখ আছে। মহাভারতে দই প্রভূত প্রশংসা পেয়েছে। মোগলরাও মহামানবের সাগরতীরে এসে আপন করে নিয়েছিল তাকে। অন্য দিকে বড়ার কথা প্রথম পাওয়া গিয়েছে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অর্থাৎ পরবর্তী বৈদিক যুগে রচিত সূত্র-সাহিত্যে। সেখানে সে ‘মাষবটক’ অর্থাৎ মাষকলাইয়ের বড়া। বট ফলের মতো গোলাকার বলে বড়াকে সংস্কৃতে বলা হত ‘বটক’। প্রথমে মাষকলাই ডাল ভিজিয়ে বেটে নুন, হিং মিশিয়ে বড়া তৈরি করে তেলে ভেজে পরিবেশন করা হত। পরবর্তী কালে মাষকলাইয়ের পরিবর্তে মুগ, মুসুর, ছোলার ডালের বড়া তৈরির প্রচলন ঘটেছে। বড়ার প্রচলন ভারত জুড়ে। তবে বড়া ‘সুপারস্টার’ হয়ে উঠেছে দক্ষিণ ভারতে। সোনালি মুচমুচে, নরম দক্ষিণী বড়াকে শুধু কিংবা সম্বর, চাটনি সহযোগে— যে ভাবেই খাওয়া হোক না কেন, অতি উপাদেয়। খ্রিস্টজন্মের আগে লেখা ‘ধর্মসূত্র’ গ্রন্থে দক্ষিণ ভারতের বড়ার উল্লেখ পাওয়া যায়। বাঙালির পাতে বড়ার প্রথম উপস্থিতি দেখা গিয়েছে ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে। শ্রীচৈতন্যের পার্ষদ বাসুদেব সার্বভৌম নীলাচলে মহাপ্রভুর ভোজনের যে এলাহি বন্দোবস্ত করেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল মুদগবড়া, মাসবড়া ও কলাবড়া ।
ভারতের দক্ষিণের ওই বড়া ভারতের উত্তরে এসে পিছলে পড়েছে দইয়ের ঘোলে। বঙ্গবাসীর রসনায় আধিপত্য কায়েম করেছে উত্তর ভারতের ‘দহিবড়া’-ই। পশ্চিমবঙ্গের বহু মিষ্টির দোকানে কচুরি, শিঙাড়া, খাস্তা কচুরির পাশাপাশি আজকাল দেদার বিক্রি হয় দইবড়া।
শুধু আপামর ভারতবাসীকেই নয়, জগৎপতিকেও দইবড়া আনন্দ দান করে আসছে যুগ যুগ ধরে। বৃন্দাবনের বিখ্যাত বাঁকেবিহারী মন্দিরের সঙ্গে দইবড়া নিয়ে একটি আশ্চর্য কিংবদন্তি আছে। বাঁকেবিহারী বৃন্দাবনের সুপ্রাচীন বিগ্রহদের মধ্যে অন্যতম। জানা যায়, বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ও ভক্তিমার্গের সাধক স্বামী হরিদাস এই বিগ্রহের প্রতিষ্ঠাতা। বৃন্দাবনের প্রসিদ্ধ নিধুবনে হরিদাসজি সাধন-ভজন করতেন। কথিত আছে, ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দের অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথির সন্ধ্যায় হরিদাসজি তানপুরা নিয়ে নিধুবনে বসে গান গাইছিলেন। তাঁর সুললিত কণ্ঠ ও প্রেম-ভক্তির আকর্ষণে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধিকা সেখানে আবির্ভূত হন। হরিদাসজির প্রার্থনায় রাধা-কৃষ্ণ পরস্পর এক হয়ে বাঁকেবিহারীর বিগ্রহরূপ ধারণ করেন। যে স্থানে রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি প্রকট হয়, সেখানকার মাটি খুঁড়তেই পাওয়া যায় বাঁকেবিহারীর বিগ্রহ। শোনা যায়, হরিদাসজির সময়ে বাঁকেবিহারী নিধুবনে পূজিত হতেন। পরে বর্তমান মন্দিরটি স্থাপন করে বিগ্রহকে সেখানে স্থানান্তরিত করা হয়।
বাঁকেবিহারী মন্দিরে বহুকাল ধরে চলে আসছে ‘ঝাঁকি দর্শন’ প্রথা। ভক্তদের দর্শন চলাকালীন কিছু ক্ষণ অন্তর গর্ভগৃহের দরজার পর্দা টানা হয়, পরক্ষণেই সরিয়ে দেওয়া হয়। বাঁকেবিহারীর সেবাইতরা বলেন যে, ওই নয়নাভিরাম বিগ্রহ দেখে ব্যাকুল হয় ভক্তরা, আর ভক্তের প্রেমের আকর্ষণে ভগবানও গর্ভমন্দির ছেড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। তাই ভক্তের আকর্ষণে অবরোধ সৃষ্টি করার জন্যই ঝাঁকি দর্শন প্রথার প্রচলন। বাঁকেবিহারী মন্দির শ্রীরামকৃষ্ণ ও সারদা দেবীর পদধূলিধন্য। শ্রীরামকৃষ্ণ যখন মথুরানাথের সঙ্গে বৃন্দাবনে আসেন, তখন এই বাঁকেবিহারী মন্দিরে তাঁর অদ্ভুত ভাবাবেশ হয়। শোনা যায়, তিনি আত্মহারা হয়ে বিগ্রহকে আলিঙ্গন করতে ছুটে গিয়েছিলেন। শ্রীমা সারদা বাঁকেবিহারী দর্শনে এসে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন, “তোমার রূপটি বাঁকা, মনটি সোজা। আমার মনের বাঁকটি সোজা করে দাও।”
বাঁকেবিহারী সম্পর্কে বৃন্দাবনে যে অদ্ভুত কাহিনিটি প্রচলিত রয়েছে তা হল, বহু কাল আগে এক দিন সকালে মন্দিরের সেবাইতরা গর্ভগৃহের দরজা খুলে বিগ্রহকে সাজাতে গিয়ে দেখেন, বাঁকেবিহারীর হাতের একটি সোনার বালা উধাও! মন্দিরে তন্নতন্ন করে খুঁজেও বালার সন্ধান পাওয়া গেল না। মন্দির জুড়ে হইচই। চতুর্দিকে খবর ছড়িয়ে পড়ল। সেই সময় মন্দিরের কাছে অবস্থিত একটি খাবারের দোকানের মালিক মন্দিরের সেবাইতদের শোনালেন একটি আশ্চর্য ঘটনা। তিনি বলেন যে, গত রাতে যখন তিনি দোকান বন্ধ করছেন, তখন একটি ছোট ছেলে এসে তাঁর কাছে দইবড়া খেতে চায়। ছেলেটি দইবড়া খাবার পর দোকানদার তার কাছ থেকে দইবড়ার দাম চাইলেন। ছেলেটি নিজের হাতের বালা খুলে দোকানদারের কাছে বন্ধক রেখে চলে যায়। দোকানদার প্রমাণস্বরূপ ছেলেটির রেখে যাওয়া বালাটি বের করে দেখালেন। বাঁকেবিহারীর সেবাইতরা স্তম্ভিত। বিগ্রহের খোয়া যাওয়া সোনার বালাটি দোকানদারের হাতে! ভক্তদের বিশ্বাস, সে দিন শ্রীমান বিহারীলালই মন্দির থেকে বেরিয়ে হাতের বালা বন্ধক দিয়ে দইবড়া খেয়েছিলেন! সেই থেকে বাঁকেবিহারীর নিত্যভোগে নিবেদন করা হয় দইবড়া। দ্বাপর যুগের প্রিয় খাদ্যটিকে কলিতেও ভুলতে পারেননি বিহারীলাল। এই ভাবেই দইবড়ার মহাপ্রসাদ হয়ে ওঠা।
‘দধি’ এবং ‘বটক’-এর এই মণিকাঞ্চন যোগ সত্যিই অমৃততুল্য! সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যকর এই খাবারটি ভগবানকেও তৃপ্তি দেয়, ভক্তের মুখেও হাসি ফোটায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy