১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি, কলকাতার কলামন্দিরের বেসমেন্টে একটি দেড় ঘণ্টার নাটক করেছিল ‘চেতনা’। নতুন দলের নতুন নাটক। সেই ‘চেতনা’র অর্ধশতবর্ষপূর্তির আর দেরি নেই। কলকাতার গ্রুপ থিয়েটারের শিয়রে শমন এসে গেলেও আধুনিক রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে ‘চেতনা’-র দহরম মহরম প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে চলেছে। ‘চেতনা’র হিসাবের খাতা বলছে, আটশোর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে তাঁদের প্রথম প্রযোজনার অভিনয় সংখ্যা। তা বলে স্রেফ ‘চেতনা’ই এত দিন ধরে এ নাটক করেছে, তা কিন্তু নয়। সে দিনের সেই নাটক শুধু বাংলায় নয়, হিন্দি-ইংরিজি কন্নড়-সহ কত ভাষায় যে তরজমা হয়ে তামাম ভারত জুড়ে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার প্রতীক হয়ে উঠেছে, তার ইয়ত্তা নেই।
অনেকেই বুঝতে পারছেন হয়তো, আমরা ‘মারীচ সংবাদ’-এর কথা বলছি। অরুণ মুখোপাধ্যায়ের রচনা ও প্রয়োগে এ নাটক উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতনাট্যের কিংবদন্তি এত দিনে। ব্যক্তি আর রাষ্ট্রের আড়াআড়ির কত রং বদলেছে এই পাঁচ দশকে। কত ঢং বদলেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। তবু ‘মারীচ সংবাদ’ তামাদি হয়নি। সে আজও সবিশেষ।
‘রামায়ণ’ বা ‘মহাভারত’-এর খেই ধরে বাংলা নাটক লেখার চল মাইকেল মধুসূদন দত্তের আমল থেকেই আছে। ‘শর্ম্মিষ্ঠা’ এর আদি উদাহরণ। কলকাতার পাবলিক থিয়েটার হামেশাই মহাকাব্য থেকে মাধুকরী নিয়েছে। খোদ গিরিশচন্দ্র ঘোষ মহাকাব্যের কাছে হাত পেতেছেন বার বার। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ‘মহাভারত’ না পড়া থাকলে তাঁর হাত দিয়ে ‘জনা’ বেরোত না। দর্শকরুচির কথা মাথায় রেখে শিশির ভাদুড়ীও মহাকাব্যের দ্বারস্থ হতে দ্বিধা করেননি। হাতেনাতে ফলও পেয়েছেন। যোগেশ চৌধুরীর ‘সীতা’ এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।
১৯৪৭-এর পর কলকাতার থিয়েটারের কোনও পাড়াতেই মহাকাব্যিক বিভূতির খোঁজ পড়েনি। বাংলার বাইরে যাঁদের হাতে নয়া ভারতের নয়া নাটকের কাঠামো খাড়া হচ্ছিল, তাঁদের অনেকেই মহাকাব্যের দোরে ধর্না দিচ্ছিলেন। ধরমবীর ভারতীর ‘অন্ধাযুগ’, গিরীশ কারনাডের ‘যযাতি’, আদ্য রঙ্গাচার্যের ‘কেলু জন্মেজয়’ নিয়ে দিল্লি-বম্বে মেতে উঠেছিল। এ সব নিয়ে কলকাতার প্রসেনিয়াম থিয়েটারের হেলদোল ছিল না বললেই চলে। আধুনিকতার সঙ্গে পৌরাণিকতার এক ধরনের আড়াআড়ি চলছিল সেখানে। ভক্তিমূলক পালার তৃষ্ণা নিবারণের জন্য বুঝি যাত্রাই যথেষ্ট ছিল।
‘মারীচ সংবাদ’ সে দিক থেকে ব্যতিক্রমী।
এখানে মনে রাখতে হবে, পাবলিক থিয়েটার বা গ্রুপ থিয়েটার— কোনও তল্লাটের মুখ চেয়ে ‘মারীচ সংবাদ’-এর জন্ম নয়। রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের সংগঠন কো-অর্ডিনেশন কমিটির রাজ্য সম্মেলনে এক সন্ধের খোরাক হিসেবে এ নাটকের আবির্ভাব।
রাজ্যে তখন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার। নকশাল দমনের নামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে এসেছে পথেঘাটে। অন্য দিকে বাম রাজনীতির পালে হাওয়া তুলছে সাংস্কৃতিক আন্দোলন। আইপিটিএ-র নানা শাখা সংগঠন টগবগ করে ফুটছে। কো-অর্ডিনেশন কমিটির নানা আয়োজন ঘিরে প্রগতিশীল নাটকের বান ডাকছে। রাইটার্স বিল্ডিংকে সদর দফতর করে প্রতিষ্ঠানবিরোধী রাজনীতির মানচিত্র ছকা হচ্ছে। তাতে অঙ্গাঙ্গি হয়ে থাকছে শেকলছেঁড়া হাতের ইন্ধন জোগানো সব গান। এবং নাটক। মূলত প্রচারধর্মী সেই সব নাটকের কোনওটা হয়তো দেশি-বিদেশি কথাসাহিত্যের কাছে ঋণী, কোনওটা নয়। তার সবেতে কমিউনিস্ট পার্টির সবুজ সঙ্কেত মিলছে এমনও নয়। ‘স্পার্টাকাস’ তো লিবার্যাল বুর্জোয়া, তাঁকে নিয়ে নাটক কেন? এ সব খিটিমিটি লেগেছে থেকে থেকেই, তারই মধ্যে চলছে দিনবদলের সলতে পাকানো। এই নাট্য-উদ্যোগের অন্যতম হোতা জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়। আর মাঝে মাঝেই নজর কাড়ছেন জ্ঞানেশের চেয়ে বছর দশেকের ছোট আর এক জন। তিনি অরুণ মুখোপাধ্যায়।
হাওড়ার শিবপুরে বাড়ি অরুণের। বর্ধিষ্ণু পরিবারের সন্তান। রোগা পাতলা দোহারা গড়ন। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে যে ইন্দো-পাক পাসপোর্ট অফিস, সেখানে তাঁর চাকরি। এক দিকে আইপিটিএ, অন্য দিকে অফিস ক্লাব— দু’জায়গাতেই চুটিয়ে নাটক করেন। অভিনয়ের দিকে অত নজর নেই। মনোনিবেশ করেছেন নাটক লেখায়, নির্দেশনায়। আর গানে। কবির লড়াই, তরজা গানের সঙ্গে তখন রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিরোধ তৈরি হয়নি। যুক্তফ্রন্টের আমলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে কথায়-সুরে পলিটিক্যাল স্যাটায়ার চলে। প্যারডি গানের জোয়ারে ভাসে ভোটের ময়দান, মাতে কলেজ ক্যাম্পাস। তাতে সদলবল আসর জমান অরুণ।
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের অগস্ট মাসে ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট কো-অর্ডিনেশন কমিটির কনফারেন্স হবে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে। অরুণের মনে আছে, “আমাদের কনফারেন্সে নাটক হওয়ার রীতি ছিল। কমিটি জানাল যে, এ বারের নাটক মহিলা শিল্পী ছাড়া করতে হবে, কারণ লোকরঞ্জন শাখা থেকে যে সব মহিলা শিল্পী আমাদের নাটকে এসে যোগ দেন, তাঁরা এ বারে পারবেন না। তাঁদের লং টুর।” কাজেই মহিলা ভূমিকা-বিবর্জিত কিছু ভাবতে হবে।
শুরু হল ভাবা। প্রথমেই মনে এল ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা। ঠান্ডা যুদ্ধের আবহে কলকাতায় তখন এক দিকে রুশ, অন্য দিকে মার্কিন দূতাবাসের সক্রিয়তা দেখার মতো। মস্কো বা পিকিং, সব পন্থার কমিউনিস্টদের কাছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দুনিয়ার পয়লা নম্বর দুশমন। বছরের পর বছর ধরে ভিয়েতনামিরা যে ভাবে আমেরিকার চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের মোকাবিলা করছিল সেটা অরুণদের কাছে অনুপ্রেরণার জায়গা হয়ে ওঠে। নানা সূত্র থেকে খবর আসছিল যে, আমেরিকার অনেকে এই যুদ্ধটা পছন্দ করছে না। তারা প্রশ্ন তুলছে কেন যুদ্ধ করব? “এক জন ওয়ারের এগেনস্টে, আর এক জন ফ্যানাটিক। দুটো পক্ষ— পাওয়ার যে এগজ়ার্ট করছে, আর পাওয়ার যে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে বা মেনে নিচ্ছে না। এই সংঘাতটা আমার প্রথম মাথায় আসে।” কিন্তু এটুকু দিয়ে তো বাংলা নাটক জমবে না। দরকার ছিল “আমার দেশের প্যারালাল কোনও স্টোরি বা প্যারালাল কোনও ঘটনা।”
সেটা জোগান দিল রামযাত্রা। হ্যাঁ, লোকনাট্য আঙ্গিক রামযাত্রা। কী ভাবে? সেটা এক বার হাত খুলে লিখেছিলেন অরুণের জ্যেষ্ঠপুত্র সুমন। “তখন বয়স হবে পাঁচ কি ছয়। বাড়ির সামনে উন্মুক্ত ধোপার মাঠে বসত রামযাত্রা। চলত মাসখানেক ধরে। নিয়ম করে সন্ধেবেলায় কনসার্ট বাজতেই দৌড়ে গিয়ে একদম সামনের দিকে। মাঠের একদিকে চাঁদোয়া টাঙানো। পাশের একটা টিনের চালের ঘরকে সাজঘর বানিয়ে বসত রামযাত্রা।”
কলকাতায় কিংবা শিবপুরে গণনাট্য সঙ্ঘের দফতরে মহলা সেরে অরুণ যত ক্ষণে বাড়ি ফিরতেন, তত ক্ষণে রামযাত্রার পালা অনেকটাই গড়িয়ে যেত। ধোপার মাঠের ভিড় থেকে সুমনকে খুঁজে বের করে বাড়ি ফেরানো ছিল অরুণের নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম। এক দিন গিয়ে দেখেন ভরাট মাঠ। হঠাৎ কানে এল মারীচ বলছে, “আমি কি রাবণের বেতনভুক কর্মচারী না কি?” অরুণ তো অবাক! খানিক বাদে মালাডাক-টাক হয়ে গেলে রামযাত্রার দলের এক জনকে ধরে অরুণ যাচাই করেছিলেন যে মারীচের এই বিদ্রোহের বীজ বাল্মীকির রামায়ণেই আছে। তবু খটকা ছিল। দেব সাহিত্য কুটির থেকে বেরোনো বাংলায় বাল্মীকি রামায়ণ তখন কলেজ স্ট্রিট কাঁপাচ্ছে। ও দিকে ভারতীয় বিদ্যা ভবন থেকে বেরোনো চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীর ‘রামায়ণ’ বেস্টসেলার, দশম সংস্করণ বাজারে এসে গেছে। একটু উল্টেপাল্টে নিলেই অরুণ দেখতেন যে, রাবণকে বোঝানোর শত চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ভীত ও সন্ত্রস্ত মারীচ নেহাত প্রাণের দায়ে সোনার হরিণ সাজতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সে সময় অত কিছুর ধার ধারেননি অরুণ। এক জন সংস্কৃত-জানা মানুষকে দিয়ে ব্যাপারটা যাচাই করে নিয়েছিলেন শুধু।
এর পরের গল্পটা সাদাসিধে। মার্কিন মুলুক থেকে সাংবাদিক গ্রেগরির ওপর সেনেটর ম্যাকির জোরজুলুমের ব্যাপারটা আগে থেকেই মাথায় ছিল। এ বারে বাল্মীকি ‘রামায়ণ’ থেকে এল রাবণের জবরদস্তিতে কাহিল মারীচের ইস্তেহার। বাকিটা এল বাংলার মাটি থেকে। জমিদারের খাস লেঠেল ঈশ্বর আর অন্যায় ভাবে সাধারণ গ্রামবাসীদের উপর চড়াও হতে অস্বীকার করলে নায়েবের সঙ্গে তাঁর এক চোট তর্ক হয়ে গেল। তিনটে গল্পকে পাশাপাশি রেখে রঙিন সুইফোঁড়ে জুড়ে দেওয়ার জন্য এক জনকে চাই। দুই শাগরেদকে নিয়ে এসে পড়লেন মাদারি কা খেলের ওস্তাদ। গড়গড়িয়ে চলতে শুরু করে দিল ‘মারীচ সংবাদ’।
মাদারির খেলের অবশ্য একটা অন্য রহস্যও আছে। পঞ্চাশ বছর বাদে সেটা খোলসা করছেন অরুণ। পূর্ব পাকিস্তান যখন আয়ুব খান-ইয়াহিয়া খানের দাপটে কম্পমান, তখন রাইটার্স বিল্ডিংয়ের খুব প্রভাবশালী এক জন অফিসার অরুণকে পশ্চিম পাকিস্তানের এই জবরদখলের বিরুদ্ধে একটা নাটক লেখার জন্য বলেছিলেন। কথাটা অরুণের মনে ধরেছিল। একটা খসড়াও তৈরি করেছিলেন। ওস্তাদের হাতে জাদুদণ্ড, সে চাইলে যে কোনও ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসতে পারে। এর মধ্যে আয়ুব খানের ছায়া ছিল। নাটকটা শেষতক হয়ে ওঠেনি। ‘মারীচ সংবাদ’ ভাবনা যখন দানা বাঁধল তখন আয়ুবশাহি মুছে গেছে, বাংলাদেশ এসে গেছে। ‘মারীচ সংবাদ’-এর তিনটে জোরজুলুমের গল্পকে কতক ব্রেশটীয় এলিয়েনেশনের কায়দায় এক সুতোয় গাঁথার জন্য ওস্তাদের কেরামতি কাজে লেগে গেল।
১৯৭২ সালের অগস্ট মাস। রাইটার্স বিল্ডিং ক্যান্টিন হলে ‘মারীচ সংবাদ’-এর প্রথম শো। ঠাসা ভিড়। রাইটার্স ছাড়াও ডালহৌসি অঞ্চলের সব ব্যাঙ্ক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ হাজির। উত্তরপাড়ার অনেক দিনের বিধায়ক শান্তশ্রী চট্টোপাধ্যায়ের ভাই শম্ভু সেজেছিলেন ওস্তাদ। শিবশঙ্কর ঘোষ— যিনি পরের দিকে দশকের পর দশক ধরে ওস্তাদ করেছিলেন— তিনি হয়েছিলেন ঈশ্বর। ছ’বছরের সুমন ওরফে ‘মাঃ লাল’ সেজেছিলেন সোনার হরিণ। এক ঘণ্টা পাঁচ মিনিটের নাটক দেখতে দেখতে শেষ!
সাড়া পড়ে গেল? না। অরুণের মনে আছে, “রাইটার্সের ইন্টেলেকচুয়ালদের বড় অংশেরই ‘মারীচ সংবাদ’ পছন্দ হয়নি। অভিযোগ উঠেছিল: নট ফর দ্য পিপল, বাট ফর দ্য ইন্টেলেকচুয়ালস। জনগণের নাটক নয়, অতএব জনবিরোধী নাটক।” শুধুমাত্র অনুনয় চট্টোপাধ্যায় সাপোর্টে ছিলেন। উনি বলেছিলেন, “এটা আমাদের, জনগণের নাটক।”
অতএব ‘মারীচ সংবাদ’ চলছে চলবে। কিন্তু কী ভাবে? পঁচাশি ছুই-ছুঁই অরুণের মনে পড়ে, “রাইটার্স বিল্ডিংয়ের কালচারাল উইংটা তখন খুব স্ট্রং ছিল। একটা শো হলেও আমরা পাঁচ ছ’মাস রিহার্সাল করতাম। চোস্ত প্রোডাকশন হত। বড় বড় প্রোডাকশন করেছি। ‘হারানের নাতজামাই’, ‘মা’, ‘স্পার্টাকাস’। যাত্রার ফর্মে করেছি। সবেতেই ৪০-৫০ জন লোক। সাড়ে পাঁচটা বাজল তো দশ মিনিটের মধ্যে সবাই রিহার্সাল রুমে চলে এল। বেশির ভাগই রাইটার্সের। বাইরের অফিসের থাকত। ফ্রি স্কুল স্ট্রিট থেকে ফুড। লোকরঞ্জন। বাছাই করা অ্যাক্টররা আসত। কিন্তু তখন যা পরিস্থিতি তাতে রেগুলার শো করা সম্ভব নয়। সব মিলিয়ে টালমাটাল অবস্থা।”
জট ছাড়ানোর উদ্যোগ নিলেন কল্যাণ চক্রবর্তী। রাইটার্সের পিছনে মিত্র বিল্ডিং নামে যে বাড়িটা আছে, তার বড় হলঘরে একটা সভা ডাকা হল। তাতে জনা চল্লিশেক হাজির ছিলেন। সবাই কো-অর্ডিনেশন কমিটির সদস্য ছিলেন এমন নয়। অরুণের মনে পড়ে, “কো-অর্ডিনেশনের একটা অংশ মনে করল আমি নিজের কেরামতি দেখানোর জন্য এটা করছি। ব্যক্তি অরুণ মুখোপাধ্যায়ের অ্যাম্বিশন ইত্যাদি। আমার এ নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। সুবিমলবাবু (রায়) রাইটার্সের লাইব্রেরিতে কাজ করতেন। উনি আমার সঙ্গে থাকলেন। বিরোধের কোনও জায়গাই নেই। যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা নাটক করি সেটা সবাই জানেন। এ নাটকে আমাদের আদর্শবাদের কোনও খামতি হচ্ছে না, কোনও বিরুদ্ধ মতও নেই।”
বাইশে নভেম্বরের সেই সভায় সিদ্ধান্ত হল, নাটক চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটা দল গড়তে হবে। হাতের কাছে ‘মারীচ সংবাদ’ আছে। ওটা নিয়ে লেগে পড়া যাক। কল্যাণ, সুবিমল ছাড়াও শিবশঙ্কর ঘোষ, মিহির বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মল চক্রবর্তী, ফণী রায়, মনোরঞ্জন সরকার এমন বেশ কয়েকজন পাশে থাকলেন। অরুণ দলের নাম দিলেন ‘চেতনা’। রাতারাতি রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেল। তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরে কাজ করতেন পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ভাল করে এঁকে ব্লক করে দিলেন।
অরুণের ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের অফিসে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে ‘চেতনা’র মহলা হত। খুব দরকার পড়লে দুপুরবেলায় টিফিনের সময় ছোটখাটো কোনও ঘরে ঢুকে গিয়ে রিডিং রিহার্সাল সেরে নেওয়া হত। বিকেল পাঁচটায় ছুটি হলেই তো সবাই বেরিয়ে যান না। কেউ কেউ থাকেন। গোড়ার দিকে একটু সমীহের চোখে দেখা হত কুশীলবদের। দু’দিনে গা-সওয়া হয়ে গেল। এমনও হয়েছে যে ল্যান্ডিংয়ের এ দিকে ম্যাকি পার্ট বলছেন, ও দিকে গ্রেগরি পার্ট বলছেন, মাঝখান দিয়ে খাদ্য দফতরের এক জন কর্মচারী নেমে চলে গেলেন অম্লানবদনে! এতেই সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। প্রোডাকশন কস্ট বলতে ৭৫ টাকা! কয়েকটা কাঠি আর পিসবোর্ড কিনে পঙ্কজবাবুকে এনে দিতেই উনি রংটং করে দিলেন। পোশাক ভাড়া করা হল। একটা ঢোল আর সিঙ্গল রিডের ভাঙা হারমোনিয়াম জোগাড় হল।
এমনিতে আলোকসম্পাতের হাঙ্গামা বড় একটা রাখেননি দীপক মুখোপাধ্যায়। একটা স্পট দিয়েই ল্যাঠা চুকিয়ে দিয়েছিলেন। নতুন করে মহলা শুরু হতে এক দিন অরুণকে তিনি বললেন, “ভেবে দেখুন— ঈশ্বর তো বিদ্রোহ করছে, গ্রেগরি সুইসাইড করছে। মারীচের ব্যাপারটা কী হবে? তার তো ঠিক জাস্টিস হল না। বাল্মীকিকে নিয়ে আসুন।” অরুণ বাল্মীকিকে আনলেন। ‘অজ্ঞানজন মাগে শরণ/ এসো হে জ্ঞানী পরম’ বলে তাঁর আবাহন করল এক বেঁড়ে পাকা ছেলে। দেখতে দেখতে সাদা গোঁফদাড়ি লাগিয়ে মঞ্চে এসে পড়লেন বাল্মীকি-বেশী মনোরঞ্জন সরকার। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে হন্তদন্ত হয়ে স্টেজে ঢুকে পড়ে এক ঘর অডিয়েন্সকে দেখে এক হাত লম্বা জিভ কেটে হাতে ধরা কমণ্ডলুকে অ্যাশট্রে বানিয়ে দেড় টোকায় সিগারেটের ছাই ঝাড়লেন। লোকে হইহই করে উঠল। হেসে গড়াগড়ি দিল। দেখতে দেখতে প্রায় দেড় ঘণ্টায় পৌঁছে গেল ‘মারীচ সংবাদ’।
‘চেতনা’ গড়ে ওঠার দু’মাসের মাথায় ‘মারীচ সংবাদ’ ফের মঞ্চস্থ হল কলামন্দিরের বেসমেন্টে, কলাকুঞ্জ নামের ছোট প্রেক্ষাগৃহে। কাউন্টার থেকে একটা টিকিটই বিক্রি হয়েছিল। সাত টাকার। বাদবাকি সব পুশ সেল। আর তাতেই হাউসফুল! ভিনি ভিডি ভিসি!
“মারীচ যে এ ভাবে ক্লিক করবে আমরা ভাবতেই পারিনি,” অরুণের মুখে আজও লাজুক হাসি। মনোরঞ্জন বয়সে অরুণের চেয়ে কিঞ্চিৎ বড় ছিলেন। নব্বইয়ের কাছাকাছি বয়সেও বাল্মীকি সাজতেন। ১৯৭২ আর ২০২২-এর শুরুর দিক পর্যন্ত ‘মারীচ সংবাদ’-এর মিসিং লিঙ্ক ছিলেন তিনিই। তাঁকে ছাড়া ‘মারীচ সংবাদ’ ভাবা যেত না। শেষ বিশ-বাইশ মিনিটের হুল্লোড় বাদ দিলে ‘মারীচ সংবাদ’কে যে কিঞ্চিৎ পানসে লাগবে এ কথা হলফ করে বলা যায়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি প্রয়াত হয়েছেন মনোরঞ্জনবাবু।
তবে ক্লিক করার মূলে ‘মারীচ সংবাদ’-এর গানের যে বিরাট ভূমিকা আছে সেটা সবাই মানেন। আশৈশব অপেরা পার্টির পরিমণ্ডলে থাকার ফলে অরুণের ভিতরে সুর একেবারে টইটম্বুর ছিল। তাতে জুড়ে গিয়েছিল খোলা চোখ-কান। এই প্রতিবেদকেরও মনে পড়ে, ১৯৭০-এর দশকের শেষাশেষি নবদ্বীপের রাধাবাজার পার্কে ‘মারীচ সংবাদ’ দেখেছিল সে। মনে তুফান তুলেছিল ‘মেরিবাবা’র গান। অহোরাত্র বালকের মুখে ‘মেরিবাবা মেরিবাবা’ শুনে তাকে গানের ইস্কুলে ভর্তি করেছিলেন অভিভাবকরা। মাঝবয়সে পৌঁছে সে বুঝতে পারে, এ গানের মধ্যে বুনে দেওয়া ‘ওরে মেরেছিস কলসির কানা’র পদকীর্তনের চাল নবদ্বীপের নগরসঙ্কীর্তনের সুরের মাতনের সঙ্গে মিশে গেছিল এক আশ্চর্য বন্ধনে। যখন বেয়োনেট চার্জের গতে ‘বল প্রেম দিবি কি না’ বলে সুরের বিরোধাভাস তৈরি হয়েছিল, তখন এ রাজ্যের তপ্ত রাজনৈতিক আবহে একটুও বেমানান ঠেকেনি। বিপ্লবকেতন চক্রবর্তীর গায়ন ও অভিনয়ে সুখ্যাত ‘মেরিবাবা’ই শুধু নয়, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিয়া’র ফন্দিফিকির ফাঁস করা ‘সিয়ার গান’ও সহজিয়া চালে দুলিয়েছিল বাংলাকে। আজও দোলায়। রাজস্থানের মাটিতে যখন ‘মারীচ সংবাদ’ হয়, তখন কীর্তনের জায়গায় শুধু মীরার ভজনের সুর ভেঁজে নিলেই চলে। বাদবাকি সব এক। হাবিব তনভিরের ‘চরণদাস চোর’ ছাড়া আর ক’টা নাটকের শরীরে এত সর্বভারতীয় হয়ে ওঠার সূত্র আছে, তা খতিয়ে দেখতে বসলে হাতে পেনসিল বই কিছু থাকবে না!
তাই এ দেশের বহুভাষিক সংস্কৃতিতে অনায়াসে ঘরবসত করতে পারে ‘মারীচ সংবাদ’। বছর দশেক আগে নান্দীকার-এর জাতীয় নাট্যমেলায় ‘ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা’র রেপার্টরি কোম্পানির নাটক হওয়ার পর কার্টেন কল চলছে। প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত অরুণকে ডাকা হল মঞ্চে, রেপার্টরি-চিফ সুরেশ শর্মার হাতে ফুল তুলে দেওয়ার জন্য। অরুণ মঞ্চে উঠতেই গড় হয়ে তাঁকে প্রণাম করলেন সুরেশ। কী ব্যাপার? পরে জানা গেল, ১৯৭৬-এ লখনউয়ে ‘ভারতেন্দু নাট্য অ্যাকাডেমি’র আয়োজনে ‘মারীচ সংবাদ’-এর হিন্দি প্রযোজনা করিয়েছিলেন অরুণ। তাতে গ্রেগরি সেজেছিলেন সুরেশ। এর কিছু কাল বাদে প্রসন্ন ‘মারীচ সংবাদ’ করেছিলেন কন্নড়ে। বেঙ্গালুরুতে ইংরেজিতে এ নাটক করেছিলেন রঞ্জন ঘোষাল। আর কোনও বাংলা নাটক জাতিগর্বে স্ফীত কন্নড় প্রদেশে কলকে পেয়েছে? পায়নি।
সিগাল বুকস থেকে ‘মারীচ সংবাদ’-এর ইংরেজি তরজমা বেরিয়েছিল ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে, উৎকল মোহান্তির হাতযশে, ‘মারীচ, দ্য লেজেন্ড’ নামে। দু’মলাটের ভিতর অরুণের আর একটা নাটকও ছিল, ‘মারীচ সংবাদ’-এর সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে যেটির নাম করেন অনেকে— ‘জগন্নাথ’। ‘জগন্নাথ’-এর তরজমা করেছিলেন হিমানী বন্দ্যোপাধ্যায়। বইয়ের ভূমিকা লিখতে বসে হিমানীর মনে হয়েছিল, মানবসমাজের সব স্তরে শ্রেণি ও শ্রেণিসংগ্রামের যে কাঠামো বোনা আছে, “তার বহুমাত্রিক বয়ান তৈরির মধ্যেই ‘মারীচ সংবাদ’-এর নাটকীয় উৎকর্ষ।” হিমানীর ভাষ্য আরও বলছে, “কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-তে সম্পত্তির মালিকানা হাসিলের লাগাতার পর্যায়বিন্যাসকে বিশ্লেষণ করে শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাসের মধ্যে ইতিহাসের যে সংজ্ঞা নিরূপণ করেছিলেন মার্ক্স, এই নাটক তারই নাট্যরূপ। এ নাটকের সময়সীমা রামায়ণের মহাকাব্যিক কাল থেকে সমকাল অবধি, পুরাণ থেকে এ আমলের কলকাতার রাস্তা অবধি প্রসারিত। এই দুয়ের মধ্যিখানে, একটু ঘুরপথে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার মধ্যে দিয়ে একটি সমান্তরাল রচনা করেছেন অরুণ। এর প্রত্যেক স্তরে, রাষ্ট্রব্যবস্থার চাপ, তার মতাদর্শগত কলকব্জা আর শাসক শ্রেণির অর্থনৈতিক খবরদারির সামনে পড়ে একজন শোষিত মানুষ কীভাবে নড়েচড়ে বসে, তা দেখাতে দেখাতে চলেছেন তিনি।”
এ বিশ্লেষণ অরুণের পছন্দসই। তবু সহজ কথা সহজে বলার যে শিক্ষা ‘মারীচ সংবাদ’ দিয়েছিল, তা কেন আমাদের চেতনার গভীরে গেল না— এই হতাশা তাঁকে কুরে কুরে খায়। এক বার তো তেড়েফুঁড়ে উঠে ঘোষণাই করেছিলেন, “মারীচ যে আজও চলছে, আজও সাকসেসফুল, তাতে নাট্যকার হিসেবে, পরিচালক হিসেবে আমার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু আমি খুশি নই। আমি চাই মারীচের আর কোনও দাম থাকবে না। মারীচের কোনও মূল্যই থাকবে না। তবেই আমি খুশি হব।”
তাঁর খুশি হওয়ার রাস্তা ক্রমশ দুরাশায় ম্রিয়মাণ। তবু চেতনার পঞ্চাশে পদার্পণের উৎসবে আবার জমকালো করে ‘মারীচ সংবাদ’-এর পালা পড়বে। ফের বেজে উঠবে ওস্তাদের ডুগডুগি, শুরু হবে জাদুকাঠির খেলা। সেই আনন্দে বুঁদ হয়ে আছেন অরুণ মুখোপাধ্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy