Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
গানে গানে তাঁরা মুগ্ধ করেছিলেন দর্শকদের। নানা অজ্ঞাত কারণে আজকের শ্রোতা ভুলে গিয়েছে তাঁদের নাম। তাই সমাজমাধ্যমের ফেক পোস্টে গুলিয়ে যায় সত্যি-মিথ্যে।
Bengali Story

স্মৃতির ছায়ালীন

সনৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কপালে কিন্তু  জুটেছে বিস্মৃতি। ‘রানার’ কবিতায় সুর করে গানটি ওঁকেই প্রথম তোলান সলিল চৌধুরী।

বিস্মৃত: কণ্ঠশিল্পী সনৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ডান দিকে, মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়

বিস্মৃত: কণ্ঠশিল্পী সনৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ডান দিকে, মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়

অলক রায়চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০২২ ০৫:১২
Share: Save:

একের পর এক গেয়ে যাচ্ছেন শিল্পী। গাইছেন মান্না দে-র স্মরণীয় সব গান। শ্রোতারাও ছাড়ছেন না। অগত্যা ‘স্লিপ’ পাঠালেন স্বয়ং মান্নাবাবু। লিখলেন, ‘কিছু রেখো আমার জন্য’। এক সাক্ষাৎকারে এ কথা জানিয়েছিলেন গ্রামোফোন কোম্পানির কর্তাব্যক্তি এবং সঙ্গীতপ্রেমী বিমান ঘোষ। শ্রোতার চোখের মণি সেই শিল্পী মলয় মুখোপাধ্যায়। মিল্টু ঘোষের কথায় আর শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের সুরে ওঁর রেকর্ডের গান মাত্র দু’খানি— ‘শ্রীমতী যে কাঁদে’ আর ‘কিছু নেই তবু দিতে চাই’। অবিস্মরণীয় সে গান। পথ-দুর্ঘটনায় অকালে চলে না গেলে বাংলা গানে শিরোনামে থাকতেন মলয়, মান্নাবাবু তাঁর জীবনকথায় তেমনই লিখেছেন।

সনৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কপালে কিন্তু জুটেছে বিস্মৃতি। ‘রানার’ কবিতায় সুর করে গানটি ওঁকেই প্রথম তোলান সলিল চৌধুরী। তাপস সেনের আলো, শম্ভু ভট্টাচার্যের নাচের সঙ্গে সনৎবাবুর ‘রানার’ দিগন্ত ছেয়ে ফেললেও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ডের পর সে গান জনপ্রিয় করার কণামাত্র কৃতিত্ব জোটেনি গণনাট্য সঙ্ঘের মাস্টারমশাই সনৎবাবুর কপালে। অথচ ওঁর দেশাত্মবোধক গানের বহু রেকর্ড এক কালে প্রকাশ করেছিল গ্রামোফোন কোম্পানি, সে সবের জনপ্রিয়তাও ছিল আকাশছোঁয়া। বিশেষ করে ‘নওজোয়ান’ তো ভোলাই যাবে না।

হেমন্ত ধাঁচের কণ্ঠ হয়েও যাত্রার সুরের রাজা ছিলেন প্রশান্ত ভট্টাচার্য, কিন্তু ‘কপি গায়ক’-এর তকমা পেতে চাননি। অনুরোধের আসরে এক সময় গমগম করে বাজত, ‘আমায় অন্ধ করে দাও, বন্ধ করে দুটি চোখ/ দেখিতে চাহি না আমি কাঁদে পৃথিবীর এত লোক’। কপি গানের রমরমা বাজারে, বেসিক গানের গায়ক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার সে চেষ্টা কম গৌরবের নয়। কিন্তু সমাদর পেলেও হালফিলের স্মৃতিতে নেই সেই গায়ন।

স্মৃতিতে কিন্তু রয়ে গেছে, ‘হলুদ বনে বনে/ আমার নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে/ সুখ নেই তো মনে’। কেউ কি মনে করতে পারেন, কে কণ্ঠ দিয়েছিলেন কিশোরীর সেই অপাপবিদ্ধ গানে? তিনি মঞ্জু বন্দোপাধ্যায়। কিংবা ছায়াছবির গানের সেই সুপারহিট ‘আমি বৌ তুমি বর/ সাতপাকে বাঁধা ওগো তুমি কি আমার পর’ কার গাওয়া? জয়ন্তী সেন নামটি স্মৃতি হাতড়ে বের করতে হয়। ‘অতল জলের আহ্বান’ ছবিতে নবাগতা তন্দ্রা বর্মণের লিপেও মানানসই কণ্ঠ দেওয়ালেন হেমন্তবাবু। ‘ভুল সবই ভুল’ গানটি গেয়ে চমকে দিয়েছিলেন সুজাতা চক্রবর্তী। তাঁর কণ্ঠবৈভবে ধোয়া কয়েক দশকের সুরস্মৃতির সম্পদ আজ স্মৃতির বাইরে। হয়তো রেকর্ডের সংখ্যা তাঁদের সুনামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তাই সময়ের সঙ্গে ম্লান হয়েছে মুখগুলি। কিন্তু ‘নামহারা ফোটা ফুল’ গানের শিল্পী বাণী ঘোষাল তো ছিলেন অনেক গানে যশস্বিনী। তাঁকে কেন ভুলে গেলেন সুররসিকেরা?

লতা মঙ্গেশকরের আগে শচীন গুপ্তকে দিয়ে সলিল চৌধুরী আলাদা গায়নশৈলীতে গাইয়েছিলেন ‘এবার আমি আমার থেকে আমাকে বাদ দিয়ে’। এই বিস্ময় ইউটিউবে লভ্য হলেও, জানা যায় না সলিল চৌধুরীর ‘প্রান্তরের গান আমার’ কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় আদৌ রেকর্ড করেছিলেন কি না। বাজারে এসেছিল উৎপলা সেনের ডিস্ক, কিন্তু এ গান গাইবেন বলে কথা দিয়েছিলেন কণিকা। বিশ্বভারতীর বাধাদানে তা সম্ভব হয়নি। এমন আত্মঘাতী ইতিহাস রচনার কি খুব প্রয়োজন ছিল?

শচীন গুপ্ত সে দিনের বড় শিল্পী হলেও সুধীরলাল চক্রবর্তী, জগন্ময় মিত্র, সায়গল সাহেব, জ্ঞান গোস্বামীর মতো এ কালে এসে পড়েনি তাঁর নাম। এমনকি সত্য চৌধুরীকেও চেনাতে কষ্ট হয়। কিন্তু তাঁর গান ‘পৃথিবী আমারে চায়’ বা ‘জেগে আছি একা’ সেই চল্লিশের দশক থেকেই জনপ্রিয়। পাশাপাশি পিন্টু ভট্টাচার্যের প্রায় সমসাময়িক সে দিনের শিল্পীদের অনেকেই বিস্মৃত আজ। ‘ওই লাল গোলাপটা’ বা ‘ছোট চিঠি লাগে ভারি মিষ্টি’-সহ অনেক হিট গানের শিল্পী ললিতা ধর চৌধুরী হারিয়েই গেলেন! মেলোডি-ভরা কণ্ঠে ‘জীবনে এই তো প্রথম তোমার হব’ বা ‘একটু আগে তোমাকে ভাবছিলাম’ শুনিয়ে জলসা মাত করতেন গোরাচাঁদ মুখোপাধ্যায়। তিনি নেই, কিন্তু আছেন সুপ্রকাশ চাকী, সুধীন সরকারেরা। স্মৃতি-জাগানিয়া অনেক গান তাঁদের কণ্ঠে ঝলমল করলেও সময়ের ব্লটিং পেপার সে পরিচয় শুষে নিয়েছে। কানে কিন্তু বাজতেই থাকে কার্তিক আর বসন্ত কুমারের প্রথম শীতের গুড়ের ঘ্রাণ মাখানো ‘সমবেত বন্ধুগণ আপনারাই বলুন’। শ্রোতাদের গুরুত্ব দিয়ে গান ওঁদের পরে আর কে-ই বা বাঁধলেন, গাইলেন!

অন্য ছবিও আছে। গণসঙ্গীত শিল্পী পূরবী মুখোপাধ্যায়কে সমকাল সম্মান জানালেও এ কালে তিনি অপরিচিত। কিন্তু ওঁর কিংবদন্তি গায়ন ‘ওল্ড ম্যান রিভার’ আর এক স্বনামখ্যাত গাইয়ে শাকিরা-র নামে চালিয়ে মিথ্যের ফায়দা লোটা চলছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। শেষে শিল্পীকেই এই ভুল ভাঙাতে মাঠে নামতে হল। মাত্র কিছু দিন হল গীতা আর গুরু দত্তর কন্যা বলে দেখিয়ে ভিডিয়ো এডিট করে সুমনা চক্রবর্তীর গান চালানো হচ্ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। এ ক্ষেত্রে অবশ্য সুমনার আগেই প্রতিবাদ জানিয়েছেন শ্রোতারা।

আসল ভূমিকা নেয় তো স্বকীয়তা। লতা মঙ্গেশকরের গানের প্রথম ‘কপি’ মীনা মুখোপাধ্যায় নিজের গানে কিন্তু কণ্ঠের আলাদা দ্যুতি আনতে পেরেছিলেন। ‘মাদার’ ছবির ‘আমার তুমি আছ’ কিংবা ‘এসো হে সুন্দর’ শুনতে এক সময় শহর আর গ্রামের জলসায় মানুষের ঢল নামত। তবু মীনা মুখোপাধ্যায় বা মীরা বিশ্বাসকে চিরকাল ‘মতো গায়িকা’ তকমা লাগিয়ে আলাদা ঘরে রাখা হয়েছে। মজার কথা হল, আজ সমস্ত ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কিন্তু হালফিলের শিল্পীরা গাইছেন সেই কপি গানই। শুরু যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কুমার শানু, অমৃক সিং অরোরা বা গৌতম ঘোষদের মতো দু’-এক জনই যা সম্মানিত হয়েছেন। বাকিরা অন্ধকারে।

দীর্ঘ সঙ্গীতজীবনে চণ্ডীদাস মাল ছিলেন থেকেও প্রচারে ধরা না দেওয়া ছাপোষা গায়ক। দু’টি রেকর্ডের গানের পরে প্রয়াত দীপক মৈত্র-র গানে ঝরে পড়েছিল শিল্পী-মনের অভিমান। সেই ‘এ তো নয় শুধু গান’-এর কলি ধরে বলা যায়, প্রকৃত শিল্পী আর শিল্পী-মন আসলে অন্তর্মুখী। নিজেকে জাহির না করে অন্তরালে থাকতে চায় সে। হৃদয় খুঁড়ে না পাওয়ার যে বেদনা, তা সে ব্যক্ত করে সুরেই। সাংবাদিক সম্মেলন করে নয়। কারও প্রতি অভিযোগ করেও নয়। তাই কোনও কোনও সুরের মুখ ক্রমশ স্মৃতির ছায়ায় লীন হয়ে যায়, যাচ্ছেও...

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Story music
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy